কারদাশিয়ানদের ভীড়ে শুনে নিন একজন নাঙ্গেলি’র গল্প by তাজবীর তন্ময়

এখন থেকে প্রায় ২০০ বছরেরও আগের কাহিনী।
সময়টা ১৮০৩ সালের দিকে, ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যের ত্রিভাঙ্কুরের (এখনকার কেরালা ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশ) খেয়ালী রাজা অদ্ভুত অদ্ভুত সব করের প্রচলন শুরু করেছেন। এই করগুলো মূলত নিম্নবর্ণের মানুষ এবং শ্রমজীবি মানুষদের উপর আরোপ করতো রাজা। এই মানুষগুলোর উপর জুলুম করে জোরপূর্বক কর আদায় করে নিজেরা গড়তেন সম্পদের পাহাড়। কেউ যদি অলঙ্কার পড়তো, তাকে কর দিতে হতো। পুরুষদের মধ্যে যদি কেউ গোঁফ রাখতে চাইতো, তাকে তার গোঁফের জন্য কর দিতে হতো।
তবে সবচেয়ে অদ্ভুত এবং বর্বর কর আরোপ করা হয়েছিলো তৎকালীন নিম্নবর্ণের নারীদের উপর। নিয়ম ছিলো, কেউই তাদের স্তন ঢেকে রাখতে পারবেন না। শুধু ব্রাহ্মণ নারীদের অনুমতি ছিলো, এক টুকরা সাদা কাপড়ে তারা স্তন ঢাকতে পারতো। অন্য বর্ণের নারীদের বলা হয়েছিল, তারা যদি সমাজের অন্যদের মতো সম্মানের সাথে চলাফেরা করতে চায়, তাহলে তাদেরকে স্তনের মাপে কর দিতে হবে। করের বিনিময়ে স্তন ঢাকতে পারবে তারা। এই বর্বর ও ঘৃণিত করটির নাম ছিলো “স্তনশুল্ক” (Breast Tax), স্থানীয় ভাষায় যা পরিচিত ছিলো ‘মুলাক্করম’ নামে।
“স্তনশুল্ক” বা মুলাক্করম থেকে প্রাপ্ত করের বড় অংশই চলে যেতো ত্রিভাঙ্কুরের রাজার পদ্মনাভ মন্দিরে। শুনে হয়তো হাসি পাবে, গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’র হিসেবে এই মন্দিরটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির। যে মন্দিরে মিশে আছে দলিত সম্প্রদায়, নিম্নবর্ণ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, শ্রমজীবি মানুষদের মেহনতের টাকা, তাদের উপর আরোপিত বর্বরোচিত করের দীর্ঘশ্বাস। চলতে থাকা এই সব প্রথা হয়তো অনেকেই মেনেই নেয় নিয়তির অংশ হিসেবে। শাসনকর্তার কথার উপরে কথাও বলা যায় না। তাই মনের বিরুদ্ধে তাদের নারীসুলভ সকল প্রকার মান সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো!
পদ্মনাভ মন্দির
কিন্তু, প্রতিটি বর্বরতার একসময় অবসান হয়। কিন্তু কেউ কেউ থাকে যারা স্রোতের বিপরীতে চলতে থাকে, ভাবে ‘হারানোর আর কি বাকি আছে!’, রুখে দাঁড়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ত্রিভাঙ্কুরে চলতে থাকা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন একজন।
আলাপুঝার এঝাওয়া সম্প্রদায়ের ৩৫ বছর বয়স্ক একজন নারী তিনি। বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরপ্রদত্ত সৌন্দর্য কখনো অভিশাপ হতে পারে না। কিন্তু, বাস্তবতা ও বর্বরতা যে তখন অন্য কথা বলছে, নিজের সৌন্দর্যই হয়ে দাঁড়ালো অভিশাপ। বিদ্রোহ করলেন সাহসী সেই নারী। নাম তার নাঙ্গেলি। রাজার করকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি তার মতো থাকলেন। স্তন উন্মুক্ত রাখার ব্যাপারটি তার কাছে অসুস্থ চর্চা মনে হয়। কিন্তু, যিনি একজন দরিদ্র নারী, জীবিকার তাগিদে তাকে ঘরের বাইরে যেতে হতো। বাইরে যখন যেতেন, তখন স্তন উন্মুক্ত না রাখার অপরাধ এবং আবৃত রাখার কর মিলিয়ে তার মুলাক্করম দিনে দিনে অনেক জমে গেলো। কিন্তু তাতে তিনি খুব একটা চিন্তিত না। এইদিকে রাজার লোকজন করের টাকা আদায়ের জন্য বের হয়। তারা খুব তাগাদা দিতে থাকে, হুমকি ধামকি দিতে থাকে। করের টাকা অমান্য করার ঘটনা খুব একটা যে ইতিহাসে নেই।
প্রতিবাদী নারী স্তনকর সংগ্রাহকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু তিনি কর দিবেন কেন? অবশেষে একদিন তিনি অত্যাচারে টিকতে না পেরে ঠিক করলেন কর দিবেন। রাজার কর্মচারীদের বাইরে অপেক্ষায় রেখে তিনি ঘরে গিয়ে মেঝেতে একটা কলাপাতা বিছিয়ে প্রদীপ জ্বালালেন। গৃহদেবতার সামনে আপনমনে প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা শেষ করে ধারালো এক অস্ত্র দিয়ে নিজের দুইটি স্তন কেটে ফেললেন। কাঁটা স্তন কলাপাতায় মুড়ে নিয়ে স্তনকর সংগ্রাহকের হাতে তুলে দিলেন! তারপর বললেন, যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখবো না…

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় শুল্ক সংগ্রাহকসহ পাড়াপ্রতিবেশী সবাই! স্তন কাটার পর ভীষণ রক্তপাত হল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা, ফুঁসে ওঠে জনগণ। কয়েকদিন পর রাজা ত্রিভাঙ্গুর স্তনশুল্কসহ সকল প্রকার অবৈধ শুল্ক বাতিল করতে বাধ্য হন! নাঙ্গেলির মৃত্যুর পর তাঁর শোকাতুর স্বামী, চিরুকান্ডন তাঁরই জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন এবং নাঙ্গেলির আবাস যে অঞ্চলে ছিল তার নাম পরবর্তীতে হয়ে যায় ‘মুলাচিপারাম্বু’ (Land of the Breasted Woman)
কতটা দৃঢ়চেতা হলে একজন নারী প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এমন কাজ করে ফেলতে পারেন! তিনিও পারতেন বাকী সব নারীদের মতো স্তনশুল্ক মেনে নিতে! শুল্ক দেওয়ার মতো সক্ষমতাও তার ছিলো! কিন্তু পৃথিবীতে কেউ কেউ বুকে আগুন নিয়ে জন্মায়! নাঙ্গেলি নিজের নারীত্ব অভিশাপ হয়ে বেঁচে থাকুক সেটা চাননি। চাননি ভোগ্যপণ্যের মতো তার শরীরের উপর কর আরোপিত হোক। নাঙ্গেলির এই আত্মদানের ইতিহাস নিজের ক্যানভাসে তুলে এনেছেন কান্নরভিত্তিক চিত্রকর টি মুরালি ( চিত্রকরণ মুরালি)  তবে তার ছবিটি আঁকার জন্যে মুরালিকে সমালোচিতও হতে হয়। অনেক ব্রাহ্মণবাদী মুরালির সমালোচনা করেন।অনেক স্থানে মুরালির প্রতিকৃতি পোড়ানো হয়।
কিন্তু যে আগুন নাঙ্গেলি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ভারতীয় নারীদের মনে, সে আগুন আর নেভানো যায়নি। নিজের অজান্তেই নাঙ্গেলি ১৮৫৯ সালে ভারতে সংগঠিত কাপড় দাঙ্গা’র বীজ বপন করে গিয়েছিলেন! সে দাঙ্গার বিষয় ছিলো, নারীদের শরীর আবৃত রাখার অধিকার। যে অধিকারের জন্যে দাঙ্গার অনেক বছর আগেই প্রথমবারের মতো প্রাণ দিয়েছিলেন এক হতভাগ্য নারী নাঙ্গেলি!

No comments

Powered by Blogger.