শোডাউন, হুঁশিয়ারি
সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানে জনসভার মাধ্যমে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করেছে জাতীয়
ঐক্যফ্রন্ট। বিরোধী নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের বিপুল সমাগম ঘটেছিল এ
জনসভায়। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ফ্রন্টের নেতারা সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি
উচ্চারণ করেছেন। ঘোষণা দিয়েছেন বুধবারের সংলাপ ব্যর্থ হলে পরের দিন ৮ই
নভেম্বর রাজশাহী অভিমুখে রোডমার্চ যাত্রা করবেন। পরদিন রাজশাহীতে সমাবেশ
হবে। ধারাবাহিকভাবে সারা দেশে সভা-সমাবেশ, রোডমার্চ-পদযাত্রা করবেন। তফসিল
না পেছালে পদযাত্রা করবেন নির্বাচন কমিশন অভিমুখে। বিএনপি মহাসচিব ও
ফ্রন্টের মুখপাত্র এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, পদত্যাগ করুন এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তারা বলছেন, এই সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্যই নিজেদের অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু জোর করে নির্বাচন করা যাবে না। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে ও সেনাবাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্যফ্রন্টের এই জনসভা ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বড় সমাগম। জনসভা থেকে আন্দোলনমুখী অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতারা। দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেক বক্তাই মুক্তি চেয়েছেন কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার।
সমাবেশে অংশ নিয়েছেন ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি শরিক দলের শীর্ষ নেতারা। প্রথমবারের মতো ঐক্যফ্রন্টের মঞ্চে বক্তব্য দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। বেলা ২টায় শুরু হয়ে এই সমাবেশ শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়। বেলা তিনটার মধ্যে মঞ্চের সামনে ও ডানে-বামে নেতা-কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে জনসভা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। হাজার হাজার মানুষের ঢল উদ্যান ছাড়িয়ে মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে গড়ায়। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে দেখা গেছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সমাবেশে বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে নেতাকর্মীরা নানা স্লোগান দেয়। জনসভাকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছগাছালিতে টানানো হয় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ দলের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ছবি সংবলিত ব্যানার। উল্লেখ্য, ১৩ই অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর ঢাকায় এটি তাদের প্রথম জনসভা। এদিকে জনসভায় আসার পথে পুলিশি বাধার অভিযোগ করেছেন নেতারা। আর জনসভায় আসার পথে ও ফেরার সময় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছে বিএনপি।
সংলাপ নিয়ে নাটক করলে চলবে না: মির্জা আলমগীর
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব ও ফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে এই পিজি হাসপাতালে ছোট একটি কক্ষে আমাদের দেশনেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। আমি জানি না, জনগণের এই উচ্চারণ পৌঁছাচ্ছে কি না। আমি বিশ্বাস করি, তিনি সেখান থেকে শুনছেন এবং বলছেন- এগিয়ে যাও, গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য এগিয়ে যাও, বিজয় নিশ্চিত করো। তিনি বলেন, কারাগারে যাওয়ার আগে আমাদের নেত্রী বলে গেছেন, আমি কারাগারে যেতে ভয় পাই না। গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, জাতীয় নেতৃবৃন্দকে আহবান জানাবে। আজকে আল্লাহর কাছে এই শুকরিয়া আদায় করছি এই মঞ্চে জাতীয় নেতৃবৃন্দ দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি চাচ্ছেন, জনগণের মুক্তি চাচ্ছেন।
সংলাপ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এখনো আমাদের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। সংলাপে তথাকথিত প্রহসনের মতো বলা হলো, আর গ্রেপ্তার করা হবে না, মামলা তুলে নেয়া হবে। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। উল্টো প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছে। এই জনসভা থেকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার কাছে লম্বা তালিকা আছে যা পড়ে শেষ করা যাবে না। কেবল ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৪ হাজার ৩৭১টি মামলা হয়েছে। যেখানে আসামির সংখ্যা ২৫ লাখ। মির্জা আলমগীর বলেন, আগামীকাল একটা ছোট সংলাপের ডাক দিয়েছে। আমরা রাজি আছি। সংলাপে বিশ্বাস করি। আমরা চাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণের সমস্যার সমাধান হোক, জনগণ মুক্তি পাক। কিন্তু এটা নিয়ে নাটক করলে চলবে না। আপনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে হবে, সংসদ বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, জনগনের স্বার্থে ৭ দফা দাবি মেনে নেবেন।
আপসহীনভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবো: ড. কামাল
প্রধান অতিথির বক্তব্যে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের মালিক কোনো মহারানি-মহারাজা নন। এই দেশের মালিক জনগণ। জনগণের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপসহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, ঐক্যবদ্ধ থাকবো। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। ঐক্যভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা দেশের সব অন্যায় দূর করব। জনগণের উদ্দেশ্যে কামাল হোসেন বলেন, আপনারা পায়ে হেঁটে কষ্ট করে এখানে দাঁড়াবেন, জেলায় জেলায় দাঁড়াবেন। দেশের মালিক জনগণকে দাঁড়াতে হবে, শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে ড. কামাল হোসেন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে।
আপনাদেরকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সবাইকে মিলে পাহারাদার হতে হবে ভোটও দিতে হবে। ভোট পাহারা দেয়া মানেই হলো স্বাধীনতা পাহারা দেয়া। ভোট সুষ্ঠু না হলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য, ভোটের অধিকার রক্ষা করার জন্য আজকে আমরা এখান থেকে শপথ নিয়ে যাই, আপসহীনভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যাবো। নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনগণ রাষ্ট্র-ক্ষমতার অধিকার ফিরে পাবে। এই রাষ্ট্র আপনাদের আমাদের কাছে ফিরে আসবে। ভয়াবহ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এটা থেকে আমরা মুক্ত হবো। ড. কামাল বলেন, সরকারের কথার এক পয়সাও দাম নেই।
সেটা গত ৫ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। দেশে যা হচ্ছে তা মেনে নেয়া যায় না। আইনের শাসনের লঙ্ঘন করা হচ্ছে, যাকে-তাকে যেন-তেনভাবে জেলে নিয়ে অন্তরীণ করা হচ্ছে। এগুলো করে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, সংবিধানের কথা বলা হয়। ষোল আনা উপেক্ষা করা হয়েছে সংবিধান। সমাবেশে আগত ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের পুলিশি বাধার সমালোচনা করে ড. কামাল বলেন, যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়রানি করছে, তা অপরাধ, মহা-অপরাধ। হয়রানি বন্ধ করতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এটা চলতে দেয়া যায় না। আমি বলতে চাই, রাস্তা বন্ধ করে, বাস বন্ধ করে, লঞ্চ বন্ধ করে জনগনকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না।
আমরা আমাদের অধিকার উদ্ধার করে ছাড়বো। জনগণ জেগেছে, দেশের মালিকরা জেগেছে; এই জাগরণের মধ্যদিয়ে আমরা দেশের মালিকানা ফিরে পাবো, জনগণের জয় হবেই। তিনি বলেন, এটা কোনো ব্যক্তি শাসনের রাষ্ট্র নয়। সরকারি দলের জন্য একরকম, বিরোধী দলের জন্য অন্যরকম। সরকারি দল সব আইনের ঊর্ধ্বে। আর বিরোধী দলকে যেনতেনভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রত্যেক দিন বিরোধী দলের কর্মীদের পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে। এটা বন্ধ হতে হবে। স্বাধীন দেশে এটা চলতে পারে না। এমনভাবে হয়রানির অধিকার সরকারের নেই। আর অনির্বাচিত সরকার তো এটা করতেই পারে না। আমি বলতে চাই, আজ হোক কাল হোক এসব অপরাধের অবশ্যই জবাব দিতে হবে। বক্তব্যের শুরুতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানিয়ে ড. কামাল বলেন, আমি শুরুতে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করছি। আর যারা রাজবন্দি আছেন তাদের সবার মুক্তি দাবি করি।
দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরবো না: রব
জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, এই লড়াই মুক্তির লড়াই, এই লড়াই গণতন্ত্রের লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমরা দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরবো না। ৭ দফা দাবি মেনে নিন। তা না হলে আপনার উপায় নেই। আর গায়েবি মামলা দেবেন না, কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না। খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিন। অন্যথায় খবর আছে। তিনি বক্তব্যের শুরুতে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে স্লোগান ধরেন এবং উপস্থিত নেতাকর্মীদের সে স্লোগান দিতে বলেন। এ সময় পুরো জনসভা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
রাজাকারের গাড়িতে প্রথম পতাকা তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ: কাদের সিদ্দিকী
রাজাকারের গাড়িতে প্রথম পতাকা বিএনপি তুলে দেয়নি বলে মন্তব্য করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা রাজাকারের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছে। এই অভিযোগ সত্য নয়। আওয়ামী লীগই প্রথম রাজাকার নুরুর গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছে। রাজাকার মহিউদ্দিন ও আশিকুর রহমানের গাড়িতেও পতাকা তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উদ্দেশে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি বিএনপিতে যোগ দেইনি। ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছি। জিততে হলে জয় আপনাদের হাতে। হারতে চাইলেও তা আপনাদের হাতে। শেখ হাসিনা কিছু করতে পারবেন না।
নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিকে ভুলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পতাকা তলে হিমাদ্রীর মতো সোজা হয়ে দাঁড়ান। পথে পথে পুলিশি বাধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাস্তায় গাড়ি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গাবতলী বন্ধ, টঙ্গী বন্ধ। সব বন্ধের পরও আমার বোনকে (শেখ হাসিনা) বলতে চাই, আপনি একটু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হেফাজতের দেয়া সংবর্ধনা ও ৫ই মে’র শাপলা চত্বরের ঘটনার প্রসঙ্গে টেনে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আল্লামা শফী ভুলে যেতে পারেন, আমি কাদের সিদ্দিকী ভুলে যেতে পারি না। শাপলা চত্বরে ইমানদারদের রক্ত ঝরানো হয়েছে।
এই রক্তের বদলা না নিলে আমরা বেইমানে পরিণত হবো। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, চাঁড়ালের কথার মূল্য আছে কিন্তু কাদেরের কথার মূল্য নেই। কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই না। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার দরকার নেই। আমাদের চিন্তা করতে হবে, হাসিনা কবে মুক্তি পাবেন? খালেদা জিয়া জেলে গিয়ে গণতন্ত্রের প্রতীক হয়েছেন। দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আমি জানি, বাংলাদেশকে বন্দি রাখা যায় না। তাই খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখা যাবে না। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আমরা স্বাধীনতা এনেছিলাম। আজকে বলে যাচ্ছি, ড. কামালের নেতৃত্বে গণতন্ত্রকে মুক্ত করবো, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবো।
খালেদা জিয়ার জন্য জীবন দেবো: মান্না
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, জনগণ গণতন্ত্রের পক্ষে। গণতন্ত্রের পক্ষে আমরা বুধবার সংলাপে যাবো, কথা বলব। আপনাদের সমস্ত প্রাণের দাবি তার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে দেবো। যে সংলাপ হবে, সে সংলাপে শুধু মুখে নয়, লিখিত অঙ্গীকার করতে হবে। কারও নামে মিথ্যা মামলা দেয়া যাবে না, গ্রেপ্তার করা যাবে না; কোনো গায়েবি মামলা দেয়া যাবে না। মান্না বলেন, আমাদের একটাই দাবি আপনারা পদত্যাগ করেন।
সংবিধানের মধ্যে যদি থাকতে চান সংসদ বাতিল করে দেন। নতুন যে সরকার হবে তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না। তিনি বলেন, দেশে নির্বাচন হবে, জনগণের বিজয় হবে। যদি সরকার দাবি না মানে তাহলে কী করবে? এই সভা থেকে এই মঞ্চ থেকে জানাব এখান থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত যত রাজপথ আছে প্রকম্পিত করে আমাদের দাবি আদায় করবো। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর তালিকা চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সংলাপে মির্জা আলমগীরের কাছে তালিকা চেয়েছেন, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী একদিকে আশ্বাস দেন, অন্যদিকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার হয়। মান্না বলেন, খালেদা জিয়ার জন্য লড়াই করবো, তার জন্য জীবন দেবো, তাকে মুক্ত করে ছাড়বো। এ সময় সমাবেশজুড়ে স্লোগান ধরেন উপস্থিত নেতাকর্মীরা। মান্না বলেন, এই স্লোগানের ভিডিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ও ডিএমপি কমিশনারের কাছে পাঠানো হোক, তারা দেখুক, খালেদা জিয়া কত জনপ্রিয়। মান্না বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার ছিল না। কুকুর-বিড়ালের ছবি দেখেছে সবাই। আবার ভোট আসছে, মানুষ ভোট দিতে পারবে কি না- তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সংলাপে আমরা বলেছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশনের অধীনেও নির্বাচন হবে না। সরকারে থেকে কোনো নির্বাচন হবে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের পর থেকে পুলিশকে আর সরকারের নির্দেশ না মানার আহ্বান জানান তিনি।
আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে: মোশাররফ
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ৭ দফা দাবিতে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। প্রথম সংলাপ কোনো কাজের সংলাপ হয়নি। আমরা আগামীকাল যাচ্ছি। আমরা কোনো ঝগড়া করতে চাই না। আমরা বলতে চাই, আগামী দিনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
দাবি না মানলে আন্দোলনের বিকল্প নেই: মওদুদ
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ১০ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নতি করেছে, তবে সেটি দুর্নীতির উন্নয়ন। তিনি বলেন, সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান হবে ভেবেই আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম। সরকার সাড়া দিয়েছে, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সরকার একদিকে সংলাপের কথা বলছে, অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করছে। খালেদা জিয়াকে জেলে রাখবে, আবার তফসিল ঘোষণা করবে। একই সঙ্গে ভিন্ন আচরণ মেনে নেয়া যায় না। আজ সকালেও আমার বাসার সামনে থেকে নিরীহ কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একদিকে সংলাপ অন্যদিকে গ্রেপ্তার, এটা মেনে নেয়া যাবে না। মওদুদ বলেন, যদি সরকার সংলাপে আমাদের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প থাকবে না। সেভাবেই সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আজ আপনারা যারা জনসভায় আছেন, তারা যদি মাঠে নামেন, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। সরকার যদি মনে করে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসবে, তাহলে ভুল করবে। এবার আর তা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ১৪টি মামলা থাকা অবস্থায় প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তখন বলেছিলেন, ক্ষমতায় আসলে ওয়ান ইলেভেন সরকারের বৈধতা দেবেন। কিন্তু, আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া সেভাবে মুক্তি নেননি। এখনো তিনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
বিচার বিভাগের চিকিৎসা প্রয়োজন: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন জনসভায়। তিনি বলেছেন, আমি একজন চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু, প্রশ্ন উঠেছে আমি এই রাজনীতিতে কেন? উন্নয়নের জোয়ারে সরকারের চোখে ছানি পড়েছে, কানেও শুনতে পারে না। উন্নয়ন ও দুর্নীতির কারণে তাদের উচ্চ রক্ত চাপ বেড়ে গেছে। এর থেকে উত্তরণে সকলকে এক হতে হবে। আর চুপ করে বসে থাকা যাবে না। তিনি বলেন, এই সরকার মাদকের নাম করে সাড়ে ৪শ’ মানুষ হত্যা করেছে। এমন একটা অবস্থায় কিছুদিন আগে ১৬-১৮ বছরের কিশোর-কিশোরীরা রাস্তায় নেমে এসে বলেছে- রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন। এটার ছবি তোলার জন্য আলোকচিত্রী শহিদুল আলম কারাগারে।
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, আজ আপনাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আজ এখানে যেমন উপস্থিত হয়েছেন, সেভাবে ভোট কেন্দ্রে সকল বাধা উপেক্ষা করে উপস্থিত হতে হবে। ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যদি ভোটকেন্দ্রে যান, পাহারা দেন তাহলে সরকার ভোটে কারচুপি করতে পারবে না। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সরকার ক্ষমতায় এলে প্রথম এক মাস বিচার বিভাগের চিকিৎসা করতে হবে। যে বিচারকরা যুক্তিতর্কে বিচার করেন না, মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে ১০ বছর সাজা দিয়েছেন; তাদেরও চিকিৎসা করা দরকার।
আঙুল বাঁকা করতে হতে পারে: সুলতান মনসুর
জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনসুর আহমেদ বলেন, আমরা সংলাপে আছি। আমরা জনগণকে বলতে চাই, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আঙুল বাঁকা করতে হতে পারে। সকলে প্রস্তুতি নিন। এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই মাঠেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। এই মাঠেই আমাদের প্রত্যয় ইনশাআল্লাহ জনগণের ?মুক্তির সংগ্রামে দেশের জনগণ বিনা ভোটের সরকারের পতন ঘটিয়ে আমরা বিজয় লাভ করবো। তিনি সরকারকে সতর্ক করে বলেন, যদি ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি মেনে না নেয়া হয় তাহলে কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে।
অন্য নেতারা যা বলেছেন
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ৬৪ বছর আগে মুসলিম লীগের আমলে সব রাজনৈতিক দল এক হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে মুসলিম লীগ ৮টার বেশি আসন পাবে না। সেটাই হয়েছিল। এতো বছর পরে আবার সকল রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছে। এবার আমাদের দাবি মানতে হবে। তাহলে এদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবো। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ আবারো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমাদের বিজয়ও হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আজকের এই সমাবেশে সব মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নিয়েছেন।
কোনো প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা এখানে নেই। এই সমাবেশ থেকে বলতে চাই- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বাংলাদেশে এমন কোনো বাপের বেটা নেই। আজকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দিতে হবে? সময় আসছে আপনাদের প্যারোলে কবরে যেতে হবে। প্রস্তুতি নিন। এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা জীবন দেবেন, কিন্তু কখনো আপস করবেন না। এখন আমাদের একটাই দাবি। সেটা হল- ৭ দফা দাবি মানতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা মেনে নেয়া ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ছাড়া দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও ফ্রন্টের দাবিগুলো মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ইভিএমের মাধ্যমে কম্পিউটারের বোতাম টেপাটিপি করে কারসাজির কোনো নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। সরকার যদি মনে করে, ডিসি এসপি দিয়ে আবার ১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করবেন, তাহলে তাদের জেনে রাখতে হবে এটা আর বাংলার মাটিতে হবে না। তিনি বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণ রুখে দাঁড়াবে। এদেশের মানুষের রক্তে গণতন্ত্র বহমান। তাই এটা মানুষ মেনে নিতে পারবে না।
সরকারকে যে সাত দফা দাবি দিয়েছি এগুলো মানতে হবে। জোর করে কোনো নির্বাচন করা যাবে না। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, স্বৈরাচার সরকার প্রতিপক্ষের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের বুঝতে হবে আমরা জয়ের মুখোমুখি অবস্থান করছি। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, সরকার আমাদের নামে গায়েবি মামলা দেয়। কিন্তু আমরা যদি কোনো সমাবেশ ডাকি, সেই সমাবেশে গায়েবি জনগণ এসে উপস্থিত হয়। আজকে সমাবেশে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
তার পরও জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে শেখ হাসিনার কোনো ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। এ সময় তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট যে ৭ দফা দাবি দিয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমি আশা করি এই দাবি পূরণ হবে। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বলেন, বাংলাদেশকে নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে এই জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে। জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির নূর হোসেন কাশেমী বলেন, এই সরকারের পতন না ঘটানো পর্যন্ত ঘরে ফেরা ঠিক হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে জনসভায় ঐক্যফ্রন্ট নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এলডিপি মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব, জাতীয় পার্টি (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, ইসলামী ঐক্যজোটের এমএ রকীব, খেলাফত মজলিশের আহমেদ আবদুল কাদের, এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, বিকল্পধারার (একাংশ) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বক্তব্য দেন। জনসভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, মোহাম্মদ শাজাহান, বরকতউল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান, জয়নুল আবদিন ফারুক, হাবিবুর রহমান হাবিব, ড. সুকোমল বড়ুয়া, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান ঢালী, পিপিবির রিটা রহমান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আবম মোস্তফা আমিন, কৃষকশ্রমিক জনতা লীগের হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক, যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসানসহ বিএনপি ও অঙ্গদল এবং ঐক্যফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।
জনসভাটি যৌথভাবে সঞ্চালন করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, আমিরুল ইসলাম আলীম, জেএসডির শফিকউদ্দিন আহমেদ স্বপন ও গণফোরামের মোশতাক আহমেদ। জনসভাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে।
সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, পদত্যাগ করুন এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তারা বলছেন, এই সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্যই নিজেদের অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু জোর করে নির্বাচন করা যাবে না। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে ও সেনাবাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্যফ্রন্টের এই জনসভা ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বড় সমাগম। জনসভা থেকে আন্দোলনমুখী অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতারা। দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেক বক্তাই মুক্তি চেয়েছেন কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার।
সমাবেশে অংশ নিয়েছেন ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি শরিক দলের শীর্ষ নেতারা। প্রথমবারের মতো ঐক্যফ্রন্টের মঞ্চে বক্তব্য দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। বেলা ২টায় শুরু হয়ে এই সমাবেশ শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়। বেলা তিনটার মধ্যে মঞ্চের সামনে ও ডানে-বামে নেতা-কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে জনসভা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। হাজার হাজার মানুষের ঢল উদ্যান ছাড়িয়ে মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে গড়ায়। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে দেখা গেছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সমাবেশে বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে নেতাকর্মীরা নানা স্লোগান দেয়। জনসভাকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছগাছালিতে টানানো হয় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ দলের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ছবি সংবলিত ব্যানার। উল্লেখ্য, ১৩ই অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর ঢাকায় এটি তাদের প্রথম জনসভা। এদিকে জনসভায় আসার পথে পুলিশি বাধার অভিযোগ করেছেন নেতারা। আর জনসভায় আসার পথে ও ফেরার সময় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছে বিএনপি।
সংলাপ নিয়ে নাটক করলে চলবে না: মির্জা আলমগীর
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব ও ফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে এই পিজি হাসপাতালে ছোট একটি কক্ষে আমাদের দেশনেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। আমি জানি না, জনগণের এই উচ্চারণ পৌঁছাচ্ছে কি না। আমি বিশ্বাস করি, তিনি সেখান থেকে শুনছেন এবং বলছেন- এগিয়ে যাও, গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য এগিয়ে যাও, বিজয় নিশ্চিত করো। তিনি বলেন, কারাগারে যাওয়ার আগে আমাদের নেত্রী বলে গেছেন, আমি কারাগারে যেতে ভয় পাই না। গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, জাতীয় নেতৃবৃন্দকে আহবান জানাবে। আজকে আল্লাহর কাছে এই শুকরিয়া আদায় করছি এই মঞ্চে জাতীয় নেতৃবৃন্দ দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি চাচ্ছেন, জনগণের মুক্তি চাচ্ছেন।
সংলাপ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এখনো আমাদের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। সংলাপে তথাকথিত প্রহসনের মতো বলা হলো, আর গ্রেপ্তার করা হবে না, মামলা তুলে নেয়া হবে। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। উল্টো প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছে। এই জনসভা থেকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার কাছে লম্বা তালিকা আছে যা পড়ে শেষ করা যাবে না। কেবল ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৪ হাজার ৩৭১টি মামলা হয়েছে। যেখানে আসামির সংখ্যা ২৫ লাখ। মির্জা আলমগীর বলেন, আগামীকাল একটা ছোট সংলাপের ডাক দিয়েছে। আমরা রাজি আছি। সংলাপে বিশ্বাস করি। আমরা চাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণের সমস্যার সমাধান হোক, জনগণ মুক্তি পাক। কিন্তু এটা নিয়ে নাটক করলে চলবে না। আপনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে হবে, সংসদ বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, জনগনের স্বার্থে ৭ দফা দাবি মেনে নেবেন।
আপসহীনভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবো: ড. কামাল
প্রধান অতিথির বক্তব্যে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের মালিক কোনো মহারানি-মহারাজা নন। এই দেশের মালিক জনগণ। জনগণের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপসহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, ঐক্যবদ্ধ থাকবো। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। ঐক্যভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা দেশের সব অন্যায় দূর করব। জনগণের উদ্দেশ্যে কামাল হোসেন বলেন, আপনারা পায়ে হেঁটে কষ্ট করে এখানে দাঁড়াবেন, জেলায় জেলায় দাঁড়াবেন। দেশের মালিক জনগণকে দাঁড়াতে হবে, শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে ড. কামাল হোসেন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে।
আপনাদেরকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সবাইকে মিলে পাহারাদার হতে হবে ভোটও দিতে হবে। ভোট পাহারা দেয়া মানেই হলো স্বাধীনতা পাহারা দেয়া। ভোট সুষ্ঠু না হলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য, ভোটের অধিকার রক্ষা করার জন্য আজকে আমরা এখান থেকে শপথ নিয়ে যাই, আপসহীনভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যাবো। নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনগণ রাষ্ট্র-ক্ষমতার অধিকার ফিরে পাবে। এই রাষ্ট্র আপনাদের আমাদের কাছে ফিরে আসবে। ভয়াবহ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এটা থেকে আমরা মুক্ত হবো। ড. কামাল বলেন, সরকারের কথার এক পয়সাও দাম নেই।
সেটা গত ৫ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। দেশে যা হচ্ছে তা মেনে নেয়া যায় না। আইনের শাসনের লঙ্ঘন করা হচ্ছে, যাকে-তাকে যেন-তেনভাবে জেলে নিয়ে অন্তরীণ করা হচ্ছে। এগুলো করে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, সংবিধানের কথা বলা হয়। ষোল আনা উপেক্ষা করা হয়েছে সংবিধান। সমাবেশে আগত ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের পুলিশি বাধার সমালোচনা করে ড. কামাল বলেন, যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়রানি করছে, তা অপরাধ, মহা-অপরাধ। হয়রানি বন্ধ করতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এটা চলতে দেয়া যায় না। আমি বলতে চাই, রাস্তা বন্ধ করে, বাস বন্ধ করে, লঞ্চ বন্ধ করে জনগনকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না।
আমরা আমাদের অধিকার উদ্ধার করে ছাড়বো। জনগণ জেগেছে, দেশের মালিকরা জেগেছে; এই জাগরণের মধ্যদিয়ে আমরা দেশের মালিকানা ফিরে পাবো, জনগণের জয় হবেই। তিনি বলেন, এটা কোনো ব্যক্তি শাসনের রাষ্ট্র নয়। সরকারি দলের জন্য একরকম, বিরোধী দলের জন্য অন্যরকম। সরকারি দল সব আইনের ঊর্ধ্বে। আর বিরোধী দলকে যেনতেনভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রত্যেক দিন বিরোধী দলের কর্মীদের পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে। এটা বন্ধ হতে হবে। স্বাধীন দেশে এটা চলতে পারে না। এমনভাবে হয়রানির অধিকার সরকারের নেই। আর অনির্বাচিত সরকার তো এটা করতেই পারে না। আমি বলতে চাই, আজ হোক কাল হোক এসব অপরাধের অবশ্যই জবাব দিতে হবে। বক্তব্যের শুরুতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানিয়ে ড. কামাল বলেন, আমি শুরুতে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করছি। আর যারা রাজবন্দি আছেন তাদের সবার মুক্তি দাবি করি।
দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরবো না: রব
জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, এই লড়াই মুক্তির লড়াই, এই লড়াই গণতন্ত্রের লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমরা দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরবো না। ৭ দফা দাবি মেনে নিন। তা না হলে আপনার উপায় নেই। আর গায়েবি মামলা দেবেন না, কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না। খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিন। অন্যথায় খবর আছে। তিনি বক্তব্যের শুরুতে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে স্লোগান ধরেন এবং উপস্থিত নেতাকর্মীদের সে স্লোগান দিতে বলেন। এ সময় পুরো জনসভা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
রাজাকারের গাড়িতে প্রথম পতাকা তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ: কাদের সিদ্দিকী
রাজাকারের গাড়িতে প্রথম পতাকা বিএনপি তুলে দেয়নি বলে মন্তব্য করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা রাজাকারের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছে। এই অভিযোগ সত্য নয়। আওয়ামী লীগই প্রথম রাজাকার নুরুর গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছে। রাজাকার মহিউদ্দিন ও আশিকুর রহমানের গাড়িতেও পতাকা তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উদ্দেশে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি বিএনপিতে যোগ দেইনি। ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছি। জিততে হলে জয় আপনাদের হাতে। হারতে চাইলেও তা আপনাদের হাতে। শেখ হাসিনা কিছু করতে পারবেন না।
নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিকে ভুলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পতাকা তলে হিমাদ্রীর মতো সোজা হয়ে দাঁড়ান। পথে পথে পুলিশি বাধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাস্তায় গাড়ি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গাবতলী বন্ধ, টঙ্গী বন্ধ। সব বন্ধের পরও আমার বোনকে (শেখ হাসিনা) বলতে চাই, আপনি একটু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হেফাজতের দেয়া সংবর্ধনা ও ৫ই মে’র শাপলা চত্বরের ঘটনার প্রসঙ্গে টেনে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আল্লামা শফী ভুলে যেতে পারেন, আমি কাদের সিদ্দিকী ভুলে যেতে পারি না। শাপলা চত্বরে ইমানদারদের রক্ত ঝরানো হয়েছে।
এই রক্তের বদলা না নিলে আমরা বেইমানে পরিণত হবো। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, চাঁড়ালের কথার মূল্য আছে কিন্তু কাদেরের কথার মূল্য নেই। কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই না। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার দরকার নেই। আমাদের চিন্তা করতে হবে, হাসিনা কবে মুক্তি পাবেন? খালেদা জিয়া জেলে গিয়ে গণতন্ত্রের প্রতীক হয়েছেন। দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আমি জানি, বাংলাদেশকে বন্দি রাখা যায় না। তাই খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখা যাবে না। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আমরা স্বাধীনতা এনেছিলাম। আজকে বলে যাচ্ছি, ড. কামালের নেতৃত্বে গণতন্ত্রকে মুক্ত করবো, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবো।
খালেদা জিয়ার জন্য জীবন দেবো: মান্না
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, জনগণ গণতন্ত্রের পক্ষে। গণতন্ত্রের পক্ষে আমরা বুধবার সংলাপে যাবো, কথা বলব। আপনাদের সমস্ত প্রাণের দাবি তার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে দেবো। যে সংলাপ হবে, সে সংলাপে শুধু মুখে নয়, লিখিত অঙ্গীকার করতে হবে। কারও নামে মিথ্যা মামলা দেয়া যাবে না, গ্রেপ্তার করা যাবে না; কোনো গায়েবি মামলা দেয়া যাবে না। মান্না বলেন, আমাদের একটাই দাবি আপনারা পদত্যাগ করেন।
সংবিধানের মধ্যে যদি থাকতে চান সংসদ বাতিল করে দেন। নতুন যে সরকার হবে তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না। তিনি বলেন, দেশে নির্বাচন হবে, জনগণের বিজয় হবে। যদি সরকার দাবি না মানে তাহলে কী করবে? এই সভা থেকে এই মঞ্চ থেকে জানাব এখান থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত যত রাজপথ আছে প্রকম্পিত করে আমাদের দাবি আদায় করবো। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর তালিকা চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সংলাপে মির্জা আলমগীরের কাছে তালিকা চেয়েছেন, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী একদিকে আশ্বাস দেন, অন্যদিকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার হয়। মান্না বলেন, খালেদা জিয়ার জন্য লড়াই করবো, তার জন্য জীবন দেবো, তাকে মুক্ত করে ছাড়বো। এ সময় সমাবেশজুড়ে স্লোগান ধরেন উপস্থিত নেতাকর্মীরা। মান্না বলেন, এই স্লোগানের ভিডিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ও ডিএমপি কমিশনারের কাছে পাঠানো হোক, তারা দেখুক, খালেদা জিয়া কত জনপ্রিয়। মান্না বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার ছিল না। কুকুর-বিড়ালের ছবি দেখেছে সবাই। আবার ভোট আসছে, মানুষ ভোট দিতে পারবে কি না- তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সংলাপে আমরা বলেছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশনের অধীনেও নির্বাচন হবে না। সরকারে থেকে কোনো নির্বাচন হবে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের পর থেকে পুলিশকে আর সরকারের নির্দেশ না মানার আহ্বান জানান তিনি।
আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে: মোশাররফ
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ৭ দফা দাবিতে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। প্রথম সংলাপ কোনো কাজের সংলাপ হয়নি। আমরা আগামীকাল যাচ্ছি। আমরা কোনো ঝগড়া করতে চাই না। আমরা বলতে চাই, আগামী দিনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
দাবি না মানলে আন্দোলনের বিকল্প নেই: মওদুদ
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ১০ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নতি করেছে, তবে সেটি দুর্নীতির উন্নয়ন। তিনি বলেন, সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান হবে ভেবেই আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম। সরকার সাড়া দিয়েছে, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সরকার একদিকে সংলাপের কথা বলছে, অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করছে। খালেদা জিয়াকে জেলে রাখবে, আবার তফসিল ঘোষণা করবে। একই সঙ্গে ভিন্ন আচরণ মেনে নেয়া যায় না। আজ সকালেও আমার বাসার সামনে থেকে নিরীহ কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একদিকে সংলাপ অন্যদিকে গ্রেপ্তার, এটা মেনে নেয়া যাবে না। মওদুদ বলেন, যদি সরকার সংলাপে আমাদের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প থাকবে না। সেভাবেই সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আজ আপনারা যারা জনসভায় আছেন, তারা যদি মাঠে নামেন, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। সরকার যদি মনে করে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসবে, তাহলে ভুল করবে। এবার আর তা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ১৪টি মামলা থাকা অবস্থায় প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তখন বলেছিলেন, ক্ষমতায় আসলে ওয়ান ইলেভেন সরকারের বৈধতা দেবেন। কিন্তু, আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া সেভাবে মুক্তি নেননি। এখনো তিনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
বিচার বিভাগের চিকিৎসা প্রয়োজন: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন জনসভায়। তিনি বলেছেন, আমি একজন চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু, প্রশ্ন উঠেছে আমি এই রাজনীতিতে কেন? উন্নয়নের জোয়ারে সরকারের চোখে ছানি পড়েছে, কানেও শুনতে পারে না। উন্নয়ন ও দুর্নীতির কারণে তাদের উচ্চ রক্ত চাপ বেড়ে গেছে। এর থেকে উত্তরণে সকলকে এক হতে হবে। আর চুপ করে বসে থাকা যাবে না। তিনি বলেন, এই সরকার মাদকের নাম করে সাড়ে ৪শ’ মানুষ হত্যা করেছে। এমন একটা অবস্থায় কিছুদিন আগে ১৬-১৮ বছরের কিশোর-কিশোরীরা রাস্তায় নেমে এসে বলেছে- রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন। এটার ছবি তোলার জন্য আলোকচিত্রী শহিদুল আলম কারাগারে।
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, আজ আপনাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আজ এখানে যেমন উপস্থিত হয়েছেন, সেভাবে ভোট কেন্দ্রে সকল বাধা উপেক্ষা করে উপস্থিত হতে হবে। ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যদি ভোটকেন্দ্রে যান, পাহারা দেন তাহলে সরকার ভোটে কারচুপি করতে পারবে না। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সরকার ক্ষমতায় এলে প্রথম এক মাস বিচার বিভাগের চিকিৎসা করতে হবে। যে বিচারকরা যুক্তিতর্কে বিচার করেন না, মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে ১০ বছর সাজা দিয়েছেন; তাদেরও চিকিৎসা করা দরকার।
আঙুল বাঁকা করতে হতে পারে: সুলতান মনসুর
জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনসুর আহমেদ বলেন, আমরা সংলাপে আছি। আমরা জনগণকে বলতে চাই, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আঙুল বাঁকা করতে হতে পারে। সকলে প্রস্তুতি নিন। এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই মাঠেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। এই মাঠেই আমাদের প্রত্যয় ইনশাআল্লাহ জনগণের ?মুক্তির সংগ্রামে দেশের জনগণ বিনা ভোটের সরকারের পতন ঘটিয়ে আমরা বিজয় লাভ করবো। তিনি সরকারকে সতর্ক করে বলেন, যদি ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি মেনে না নেয়া হয় তাহলে কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে।
অন্য নেতারা যা বলেছেন
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ৬৪ বছর আগে মুসলিম লীগের আমলে সব রাজনৈতিক দল এক হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে মুসলিম লীগ ৮টার বেশি আসন পাবে না। সেটাই হয়েছিল। এতো বছর পরে আবার সকল রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছে। এবার আমাদের দাবি মানতে হবে। তাহলে এদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবো। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ আবারো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমাদের বিজয়ও হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আজকের এই সমাবেশে সব মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নিয়েছেন।
কোনো প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা এখানে নেই। এই সমাবেশ থেকে বলতে চাই- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বাংলাদেশে এমন কোনো বাপের বেটা নেই। আজকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দিতে হবে? সময় আসছে আপনাদের প্যারোলে কবরে যেতে হবে। প্রস্তুতি নিন। এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা জীবন দেবেন, কিন্তু কখনো আপস করবেন না। এখন আমাদের একটাই দাবি। সেটা হল- ৭ দফা দাবি মানতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা মেনে নেয়া ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ছাড়া দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও ফ্রন্টের দাবিগুলো মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ইভিএমের মাধ্যমে কম্পিউটারের বোতাম টেপাটিপি করে কারসাজির কোনো নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। সরকার যদি মনে করে, ডিসি এসপি দিয়ে আবার ১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করবেন, তাহলে তাদের জেনে রাখতে হবে এটা আর বাংলার মাটিতে হবে না। তিনি বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণ রুখে দাঁড়াবে। এদেশের মানুষের রক্তে গণতন্ত্র বহমান। তাই এটা মানুষ মেনে নিতে পারবে না।
সরকারকে যে সাত দফা দাবি দিয়েছি এগুলো মানতে হবে। জোর করে কোনো নির্বাচন করা যাবে না। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, স্বৈরাচার সরকার প্রতিপক্ষের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের বুঝতে হবে আমরা জয়ের মুখোমুখি অবস্থান করছি। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, সরকার আমাদের নামে গায়েবি মামলা দেয়। কিন্তু আমরা যদি কোনো সমাবেশ ডাকি, সেই সমাবেশে গায়েবি জনগণ এসে উপস্থিত হয়। আজকে সমাবেশে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
তার পরও জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে শেখ হাসিনার কোনো ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। এ সময় তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্ট যে ৭ দফা দাবি দিয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমি আশা করি এই দাবি পূরণ হবে। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বলেন, বাংলাদেশকে নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে এই জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে। জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির নূর হোসেন কাশেমী বলেন, এই সরকারের পতন না ঘটানো পর্যন্ত ঘরে ফেরা ঠিক হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে জনসভায় ঐক্যফ্রন্ট নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এলডিপি মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব, জাতীয় পার্টি (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, ইসলামী ঐক্যজোটের এমএ রকীব, খেলাফত মজলিশের আহমেদ আবদুল কাদের, এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, বিকল্পধারার (একাংশ) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বক্তব্য দেন। জনসভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, মোহাম্মদ শাজাহান, বরকতউল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান, জয়নুল আবদিন ফারুক, হাবিবুর রহমান হাবিব, ড. সুকোমল বড়ুয়া, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান ঢালী, পিপিবির রিটা রহমান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আবম মোস্তফা আমিন, কৃষকশ্রমিক জনতা লীগের হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক, যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসানসহ বিএনপি ও অঙ্গদল এবং ঐক্যফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।
জনসভাটি যৌথভাবে সঞ্চালন করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, আমিরুল ইসলাম আলীম, জেএসডির শফিকউদ্দিন আহমেদ স্বপন ও গণফোরামের মোশতাক আহমেদ। জনসভাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে।
No comments