চামড়ার দরপতন: সংকটে মাদরাসা এতিমখানা
এবার
কোরবানির পশুর চামড়ার দামে ধস নামায় বড় ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছে মাদরাসা ও
এতিমখানাগুলো। বিশেষ করে দেশের কওমি মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষা
কার্যক্রমে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, চামড়ার দাম কমার
কারণে অনেক কওমি মাদরাসার আয় কমে যাবে। এর ফলে এসব মাদরাসায় বার্ষিক বাজেটে
ঘাটতি দেখা দিতে পারে । যা শিক্ষা কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলবে। সাধারণ
মানুষের দানের পাশাপাশি যাকাত, ফিতরা ও কোরবানির সময় দান করা চামড়া বিক্রির
আয়ের ওপরই নির্ভরশীল অধিকাংশ মাদরাসার পরিচালনা ব্যয়। এতে অনুদান হিসেবে
পাওয়া চামড়ার দাম না পেলে আর্থিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এসব
প্রতিষ্ঠানের। এদিকে কোরবানি পশুর চামড়ার বাজারে আকস্মিক ধসের নেপথ্যে একে
অপরকেই দোষারোপ করছেন মৌসুমি, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা। একাধিক
মৌসুমি, খুচরা, পাইকারি ব্যবসায়ী, কওমি মাদরাসার নীতিনির্ধারক, ট্যানারি
ব্যবসায়ী ও চামড়া ব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা
গেছে, কতিপয় পাইকারি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে
নিয়ন্ত্রণ করছেন চামড়া বাজার। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ ব্যবসায়ী,
কওমি মাদরাসা ও এতিমখানাগুলো। এ ছাড়া বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া
বিক্রি না হলেও কোনো তদারকি লক্ষ্য করা যায়নি।
রাজধানীর উত্তরা এলাকার সব চেয়ে বড় কওমি মাদরাসা আজমপুর দারুল উলুম মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালনা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সাঈদুল ইসলাম সরকার বলেন, চামড়ার বাজার ধসের কারণে তাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের মাদরাসা এলাকাবাসীর অনুদানে চলে থাকে। আর অনুদানের বড় অংশ পেয়ে থাকি চামড়ার দান থেকে। কিন্তু চামড়ার দামের যে অবস্থা, তাতে করে প্রতিষ্ঠান চালানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, গত বছর ৪৩০ পিসের বেশি চামড়া কিনে আয় হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা (প্রতি পিস ১২০০ টাকা ধরে)। আর এবার ৫১৫ পিস চামড়ায় হতে পারে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। তিনি বলেন, কোরবানির সময় কিনে বা দানের চামড়া দিয়ে বড় একটা অঙ্ক আয় আসে মাদরাসায়। আর এটা সম্পূর্ণ ব্যয় হয় এতিম ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে। এখন সেই চামড়ার দামই বছর বছর কমানো হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি জানান, এই মাদরাসায় প্রায় ৫০০ ছাত্র পড়াশুনা করে। তাদের পেছনে মাসে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। চামড়ার দাম বেশি পাওয়া গেলে এই এতিম ছাত্ররাই উপকৃত হতো। এখন দাম কমায় এরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ চমড়া-চামড়াজাত পণ্যের দাম খুবই চড়া। তিনি বলেন, দাম কমার ফলে আর্থিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের।
কাওরান বাজার আম্বর শাহ জামে মসজিদ ও মাদরাসার সহসভাপতি আমীর হোসেন পাটোয়ারি বলেন, গত বছর এই মাদরাসার পক্ষ থেকে ৩০০ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রতি পিস দাম পড়েছিল গড়ে ১১০০ টাকা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। কিন্তু এবার ৩৩০টির বেশি সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব চামড়া গড়ে প্রতি পিস দাম পড়ছে প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। তিনি বলেন, এবার বেশি চামড়া সংগ্রহ করেও গত বারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দাম পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, এই মাদরাসায় ৩০০ জন ছাত্র পড়াশুনা করে। তাদের খাওয়ার পিছনে দিনে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বছর কোরবানির পশুর চামড়া থেকে একটা আয় আসে। এবার এ আয় হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হবে।
এদিকে গত বছরের চেয়ে এ বছর চামড়ার দাম কমানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ঈদের আগেই সংবাদ সম্মেলন করেছিল কওমি মাদরাসাগুলোর সংগঠন কওমি ফোরাম। সংগঠনটির দাবি, সরকার চামড়ার দাম কমানোর পরও প্রতিটা গরুর চামড়ার দাম ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা করে আসার কথা। কিন্তু সেখানে চামড়াগুলো বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা করে। ফলে ক্ষতির পরিমাণটা বেড়ে গেছে কওমি মাদরাসাগুলোতে। চামড়ার দাম কম হওয়াতে আয়ের কিছু অংশ কমে যাবে।
চামড়ার দাম নিয়ে ট্যানারি মালিকরা কোনো সিন্ডিকেট করেননি দাবি করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, কোরবানি পশুর চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় কম হওয়ার জন্য দায়ী স্থানীয় সিন্ডিকেট। রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী, সামাজিক ক্লাবভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন এলাকাভিত্তিক চামড়ার দাম তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যদি ২০০-৩০০ টাকা করে চামড়া ক্রয় করে, ট্যানারি মালিকদের এখানে কী করার আছে?
খুচরা ব্যবসায়ী এবং চামড়ার আড়তদারদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, এখনো যারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি, তাদের লোকসানের আশঙ্কা নেই। আপনারা কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন। ট্যানারির প্রতিনিধিরা তিন থেকে চার দিনের মধ্যে আড়তদারদের কাছে থেকে নির্ধারিত মূল্যে লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে আসবে।
আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ কওমি মাদরাসাগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস। অর্জিত এই অর্থ দিয়ে চলে মাদরাসাগুলোর লিল্লাহ বোডিং। কিন্তু এবার চামড়া নিয়েই চরম বিপাকে পড়েছে মাদরাসাগুলো। আয় তো দূরের কথা এবার চামড়ার ক্রেতাই পাচ্ছে না মাদরাসার কর্তারা।
চামড়ার দাম কম হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও হাজিরপুল আযিযাবাদ এলাকায় অবস্থিত কওমি মাদরাসা জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়ার পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী। তিনি জানান, মাদরাসায় এক হাজার ৮০০’রও বেশি কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি চামড়া সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে কেনা হয়েছে। কিন্তু এসব চামড়া কিনতে কোনো ব্যবসায়ী আসেননি। শনিবার দুপুরে একজন ব্যবসায়ীকে ডেকে আনা হলেও সে গড়ে প্রতিটি চামড়া ৩০০ টাকার বেশি কিনতে রাজি নন। কিন্তু ক্রয়মূল্য ছাড়াও এসব চামড়া ক্রয়ে পরিবহন খরচ, লবণজাত করা ও শ্রমিকের বেতনসহ প্রতিটি চামড়ার পেছনে আরো ২০০ টাকা খরচ পড়েছে। এ অবস্থায় ৩০০ টাকা করে চামড়া বিক্রি করলে বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান যাবে।
একই কথা জানালেন, চট্টগ্রামের লালখান বাজারে অবস্থিত কওমি মাদরাসা জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়ার লিল্লাহ বোর্ডের সদস্য আল্লামা সামশুদ্দিন আল মাদানী। তিনি বলেন, ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে চামড়া কিনলেও ব্যবসায়ীরা একই মূল্যে চামড়া কিনতে চাচ্ছে। ফলে নিরুপায় হয়ে লোকসান দিয়ে এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে দিয়েছি। তিনি বলেন, এবার এক হাজার ৩৪৭ পিস কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছি আমরা। যা বিক্রি করে দুই লাখ টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়েছে। আর এসব টাকা মাদরাসার গরিব-এতিম শিক্ষার্থীদের হক। অথচ প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া থেকে আমরা ৫-৬ লাখ টাকা আয় করতাম। যা দিয়ে লিল্লাহ বোর্ডের কয়েক মাসের খোর-পোষের যোগান হতো।
চট্টগ্রামের রাউজানের মদুনাঘাট ইউনুসিয়া ফাতহুল ইসলাম মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডের পরিচালক আল্লামা খায়রুল আলা নদভী বলেন, মাদরাসায় এবার কোরবানির পশুর ৭০০ চামড়া সংগ্রহ করা হলেও লাভ হয়নি তেমন। এর মধ্যে বিনামূল্যের চামড়া থাকায় সামান্য টাকা লাভ হয়েছে। যা দিয়ে মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডের ৫ দিনের খরচও হবে না। অথচ প্রতিবছর ৩-৪ মাসের খরচের টাকা আসত এই কোরবানির পশুর চামড়া থেকে।
দেশের প্রাচীন কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী শিক্ষা পরিচালক আল্লামা শফীপুত্র মাওলানা আনাস মাদানী জানান, এবার কোরবানির পশুর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে মাদরাসায়। কিন্তু দাম কম হওয়ায় চামড়া এখনো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার উপরে চামড়ার দাম বলছেই না। এ দামে চামড়া বিক্রি করা হলে নিশ্চিত লোকসান হবে। তিনি বলেন, মাদরাসায় গরিব-এতিম ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড় ও পড়ালেখার খরচ যোগাতে প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এ কাজে মাদরাসার পরিপক্ব শিক্ষার্থীরা শ্রম দিলেও পরিবহণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ করতেই হয়। ফলে কোরবানিতে তিনভাবে পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে প্রথমত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
কোরবানি দাতা তাতে রাজি না হলে অর্ধেক মূল্যে। তাতেও রাজি না হলে বাজার মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এ বছর চামড়ার মূল্য এত কম যে, যা সংগ্রহ করতেই ক্রয়মূল্যের চেয়েও খরচ বেশি পড়ে। অথচ চামড়া ব্যবসায়ীরা আমাদের ক্রয়মূল্যের চেয়েও কমমূল্যে চামড়া কিনছে। ফলে এবার চামড়া নিয়েই চরম বেকায়দায় পড়েছি।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে কওমি মাদরাসাসহ ৩ শতাধিক মাদরাসা রয়েছে। প্রতিটি মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং রয়েছে। ফলে প্রতিটি মাদরাসায় কিছু না কিছু কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছে প্রতিবছরের মতো। কিন্তু এবার লাভের মুখ দেখেছে এমন একটি মাদরাসাও নেই।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া ওবায়দিয়া মাদরাসার প্রধান আল্লামা শাহ ছালাহ উদ্দীন নানুপুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, চামড়ার দাম কমানো মাদরাসাগুলো ধ্বংসের একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র। কারন মাদরাসাগুলোর লিল্লাহ বডিং টিকে আছে কোরবানির পশুর চামড়ার আয়ের উপর। প্রতিবছর মাদরাসাগুলো যেখানে চামড়া থেকে আয় করে, সেখানে এবার লোকসান গুনছে। যা এতিমের হক। কেন? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সবক’টি ট্যানারি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ট্যানারিতে চামড়া নিতে পরিবহণ খরচও অনেক বেশি। যা ট্যানারির মালিক বা সরকার দেন না। এক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে চামড়ার দাম বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার বাইরে পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কম। এটাও চরম বৈষম্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্টাফ রিপোর্টার কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, এবারের কোরবানির ঈদে পশুর চামড়ার দাম আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। চামড়ার এই দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুস্থ, এতিম, হতদরিদ্র, এতিমখানা এবং কওমি মাদরাসা। বিশেষ করে কওমি মাদরাসায় যেসব এতিম ও গরিব মেধাবী প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র তহবিল থেকে সহায়তা পাচ্ছে, তারা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। কোরবানির চামড়া সংগ্রহের অর্থে পরিচালিত এসব কওমি মাদরাসার দরিদ্র তহবিল এবার সঙ্কুচিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কওমি মাদরাসাগুলোর বার্ষিক খরচ পরিচালনায় এটি বিশাল এক সংকট বলে মনে করছেন কিশোরগঞ্জে কওমি মাদরাসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। তাদের অনেকেই কোরবানির চামড়ার এই দরপতনকে কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে তিনশ’র মতো কওমি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসায় প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তাদের মধ্যে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন দান এবং ঈদুল ফিতরের যাকাত ও ঈদুল আজহার কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থে পরিচালিত হয় এসব মাদরাসার গোরাবা ফান্ড অর্থাৎ দরিদ্র তহবিল। এই তহবিল থেকে এতিম ও দরিদ্র মেধাবীদের থাকা-খাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কিন্তু এবার কোরবানির চামড়ার কাঙ্ক্ষিত দাম দূরে থাক, ন্যূনতম দামও মিলছে না। ফলে তহবিলে অর্থ সংকটের কারণে মাদরাসাগুলোর এতিম-অসহায় ছাত্ররা বিপাকে পড়বে। এ পরিস্থিতিকে কওমি মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে কিশোরগঞ্জের আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ বলেন, কওমি মাদরাসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় পরিকল্পিতভাবে চামড়া নিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারের কোথাও চামড়ার দাম কমেনি।
আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সমাজের গরিব, সুবিধাবঞ্চিত, বাবা-মা হারা প্রায় দেড় হাজার শিশু-কিশোর এই মাদরাসায় পড়াশোনা করে। এবার গত বছরের চেয়ে মাদরাসাটিতে চামড়ার সংগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় তারা স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু চামড়ার রেকর্ড দরপতনের কারণে তাদের সেই স্বস্তি এখন অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ শহরের বড় বাজারের আলহাজ শামসুদ্দিন ভুঁইয়া জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাদের মাদরাসার গোরাবা ফান্ড থেকে এতিম-গরিব মেধাবীদের ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহের অন্যতম প্রধান খাত কোরবানির চামড়া সংগ্রহের অর্থ। কিন্তু এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে অন্যান্য মাদরাসার মতো তাদেরও অর্থসংকটের মধ্যে পড়তে হবে।
কিশোরগঞ্জ শহরের তারাপাশা এলাকার জামিয়া নূরানিয়া মাদরাসার মুহাতামিম মাওলানা আবুল বাশার জানান, তাদের মাদরাসায় প্রায় এক হাজার ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এবার চামড়ার কম দামের কারণে মাদরাসার বার্ষিক খরচ পরিচালনায় তাদের ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, চামড়ার দাম কমার কারণে অনেক কওমি মাদরাসার আয় কমে যাবে। এর ফলে সেসব মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল নামাপাড়া এলাকার জামিয়া রাহমানিয়া, মারিয়া এলাকার আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ও জামিয়া আবুবকরসহ আরো বেশ কয়েকটি মাদরাসার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হলে তারা একই রকম আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য কম হওয়ার ফলে কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মাগুরায় এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে কেউবা চামড়া ফেলে দিয়েছেন বর্জ্য হিসেবে। এ কারণে বঞ্চিত হয়েছে মাগুরার শত শত এতিমখানা ও লিল্লাহ বডিং।
মাগুরা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ গত বছর ছিল ১০ শতাংশ এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশ। এবছর ১৩২৫০টি পশু কোরবানি হলেও ব্যবসায়ীরা ১৭০০টি মত চামড়া সংগ্রহ করেছে। শহরের একটি মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা অব্দুল মেমিন বলেন, প্রতিবছর চামড়া বিক্রির টাকা থেকে আমরা একটি ভালো অঙ্কের অনুদান পাই। এবার তা নেই বললেই চলে। আমার এতিমখানার বাচ্চাদের ভরণপোষণে এটি একটি বড় প্রভাব ফেলবে।
শহরের নতুন বাজার এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী শ্যামল কুমার বলেন, এবছর সরকার নির্ধারিত চামড়ার দর খুবই কম। ঐ দামে আমরা যত চামড়া কিনব তত লোকসান বাড়বে। একারণেই এবার বাজারে প্রচুর চামড়া থাকা সত্ত্বেও ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাছাড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রত্যেক ব্যবসায়ীই কয়েক লাখ করে পুরানো টাকা এখনো পাননি।
রাজধানীর উত্তরা এলাকার সব চেয়ে বড় কওমি মাদরাসা আজমপুর দারুল উলুম মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালনা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সাঈদুল ইসলাম সরকার বলেন, চামড়ার বাজার ধসের কারণে তাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের মাদরাসা এলাকাবাসীর অনুদানে চলে থাকে। আর অনুদানের বড় অংশ পেয়ে থাকি চামড়ার দান থেকে। কিন্তু চামড়ার দামের যে অবস্থা, তাতে করে প্রতিষ্ঠান চালানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, গত বছর ৪৩০ পিসের বেশি চামড়া কিনে আয় হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা (প্রতি পিস ১২০০ টাকা ধরে)। আর এবার ৫১৫ পিস চামড়ায় হতে পারে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। তিনি বলেন, কোরবানির সময় কিনে বা দানের চামড়া দিয়ে বড় একটা অঙ্ক আয় আসে মাদরাসায়। আর এটা সম্পূর্ণ ব্যয় হয় এতিম ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে। এখন সেই চামড়ার দামই বছর বছর কমানো হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি জানান, এই মাদরাসায় প্রায় ৫০০ ছাত্র পড়াশুনা করে। তাদের পেছনে মাসে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। চামড়ার দাম বেশি পাওয়া গেলে এই এতিম ছাত্ররাই উপকৃত হতো। এখন দাম কমায় এরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ চমড়া-চামড়াজাত পণ্যের দাম খুবই চড়া। তিনি বলেন, দাম কমার ফলে আর্থিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের।
কাওরান বাজার আম্বর শাহ জামে মসজিদ ও মাদরাসার সহসভাপতি আমীর হোসেন পাটোয়ারি বলেন, গত বছর এই মাদরাসার পক্ষ থেকে ৩০০ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রতি পিস দাম পড়েছিল গড়ে ১১০০ টাকা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। কিন্তু এবার ৩৩০টির বেশি সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব চামড়া গড়ে প্রতি পিস দাম পড়ছে প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। তিনি বলেন, এবার বেশি চামড়া সংগ্রহ করেও গত বারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দাম পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, এই মাদরাসায় ৩০০ জন ছাত্র পড়াশুনা করে। তাদের খাওয়ার পিছনে দিনে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বছর কোরবানির পশুর চামড়া থেকে একটা আয় আসে। এবার এ আয় হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হবে।
এদিকে গত বছরের চেয়ে এ বছর চামড়ার দাম কমানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ঈদের আগেই সংবাদ সম্মেলন করেছিল কওমি মাদরাসাগুলোর সংগঠন কওমি ফোরাম। সংগঠনটির দাবি, সরকার চামড়ার দাম কমানোর পরও প্রতিটা গরুর চামড়ার দাম ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা করে আসার কথা। কিন্তু সেখানে চামড়াগুলো বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা করে। ফলে ক্ষতির পরিমাণটা বেড়ে গেছে কওমি মাদরাসাগুলোতে। চামড়ার দাম কম হওয়াতে আয়ের কিছু অংশ কমে যাবে।
চামড়ার দাম নিয়ে ট্যানারি মালিকরা কোনো সিন্ডিকেট করেননি দাবি করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, কোরবানি পশুর চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় কম হওয়ার জন্য দায়ী স্থানীয় সিন্ডিকেট। রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী, সামাজিক ক্লাবভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন এলাকাভিত্তিক চামড়ার দাম তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যদি ২০০-৩০০ টাকা করে চামড়া ক্রয় করে, ট্যানারি মালিকদের এখানে কী করার আছে?
খুচরা ব্যবসায়ী এবং চামড়ার আড়তদারদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, এখনো যারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি, তাদের লোকসানের আশঙ্কা নেই। আপনারা কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন। ট্যানারির প্রতিনিধিরা তিন থেকে চার দিনের মধ্যে আড়তদারদের কাছে থেকে নির্ধারিত মূল্যে লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে আসবে।
আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ কওমি মাদরাসাগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস। অর্জিত এই অর্থ দিয়ে চলে মাদরাসাগুলোর লিল্লাহ বোডিং। কিন্তু এবার চামড়া নিয়েই চরম বিপাকে পড়েছে মাদরাসাগুলো। আয় তো দূরের কথা এবার চামড়ার ক্রেতাই পাচ্ছে না মাদরাসার কর্তারা।
চামড়ার দাম কম হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও হাজিরপুল আযিযাবাদ এলাকায় অবস্থিত কওমি মাদরাসা জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়ার পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী। তিনি জানান, মাদরাসায় এক হাজার ৮০০’রও বেশি কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি চামড়া সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে কেনা হয়েছে। কিন্তু এসব চামড়া কিনতে কোনো ব্যবসায়ী আসেননি। শনিবার দুপুরে একজন ব্যবসায়ীকে ডেকে আনা হলেও সে গড়ে প্রতিটি চামড়া ৩০০ টাকার বেশি কিনতে রাজি নন। কিন্তু ক্রয়মূল্য ছাড়াও এসব চামড়া ক্রয়ে পরিবহন খরচ, লবণজাত করা ও শ্রমিকের বেতনসহ প্রতিটি চামড়ার পেছনে আরো ২০০ টাকা খরচ পড়েছে। এ অবস্থায় ৩০০ টাকা করে চামড়া বিক্রি করলে বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান যাবে।
একই কথা জানালেন, চট্টগ্রামের লালখান বাজারে অবস্থিত কওমি মাদরাসা জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়ার লিল্লাহ বোর্ডের সদস্য আল্লামা সামশুদ্দিন আল মাদানী। তিনি বলেন, ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে চামড়া কিনলেও ব্যবসায়ীরা একই মূল্যে চামড়া কিনতে চাচ্ছে। ফলে নিরুপায় হয়ে লোকসান দিয়ে এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে দিয়েছি। তিনি বলেন, এবার এক হাজার ৩৪৭ পিস কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছি আমরা। যা বিক্রি করে দুই লাখ টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়েছে। আর এসব টাকা মাদরাসার গরিব-এতিম শিক্ষার্থীদের হক। অথচ প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া থেকে আমরা ৫-৬ লাখ টাকা আয় করতাম। যা দিয়ে লিল্লাহ বোর্ডের কয়েক মাসের খোর-পোষের যোগান হতো।
চট্টগ্রামের রাউজানের মদুনাঘাট ইউনুসিয়া ফাতহুল ইসলাম মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডের পরিচালক আল্লামা খায়রুল আলা নদভী বলেন, মাদরাসায় এবার কোরবানির পশুর ৭০০ চামড়া সংগ্রহ করা হলেও লাভ হয়নি তেমন। এর মধ্যে বিনামূল্যের চামড়া থাকায় সামান্য টাকা লাভ হয়েছে। যা দিয়ে মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডের ৫ দিনের খরচও হবে না। অথচ প্রতিবছর ৩-৪ মাসের খরচের টাকা আসত এই কোরবানির পশুর চামড়া থেকে।
দেশের প্রাচীন কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী শিক্ষা পরিচালক আল্লামা শফীপুত্র মাওলানা আনাস মাদানী জানান, এবার কোরবানির পশুর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে মাদরাসায়। কিন্তু দাম কম হওয়ায় চামড়া এখনো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার উপরে চামড়ার দাম বলছেই না। এ দামে চামড়া বিক্রি করা হলে নিশ্চিত লোকসান হবে। তিনি বলেন, মাদরাসায় গরিব-এতিম ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড় ও পড়ালেখার খরচ যোগাতে প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এ কাজে মাদরাসার পরিপক্ব শিক্ষার্থীরা শ্রম দিলেও পরিবহণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ করতেই হয়। ফলে কোরবানিতে তিনভাবে পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে প্রথমত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
কোরবানি দাতা তাতে রাজি না হলে অর্ধেক মূল্যে। তাতেও রাজি না হলে বাজার মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এ বছর চামড়ার মূল্য এত কম যে, যা সংগ্রহ করতেই ক্রয়মূল্যের চেয়েও খরচ বেশি পড়ে। অথচ চামড়া ব্যবসায়ীরা আমাদের ক্রয়মূল্যের চেয়েও কমমূল্যে চামড়া কিনছে। ফলে এবার চামড়া নিয়েই চরম বেকায়দায় পড়েছি।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে কওমি মাদরাসাসহ ৩ শতাধিক মাদরাসা রয়েছে। প্রতিটি মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং রয়েছে। ফলে প্রতিটি মাদরাসায় কিছু না কিছু কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছে প্রতিবছরের মতো। কিন্তু এবার লাভের মুখ দেখেছে এমন একটি মাদরাসাও নেই।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া ওবায়দিয়া মাদরাসার প্রধান আল্লামা শাহ ছালাহ উদ্দীন নানুপুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, চামড়ার দাম কমানো মাদরাসাগুলো ধ্বংসের একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র। কারন মাদরাসাগুলোর লিল্লাহ বডিং টিকে আছে কোরবানির পশুর চামড়ার আয়ের উপর। প্রতিবছর মাদরাসাগুলো যেখানে চামড়া থেকে আয় করে, সেখানে এবার লোকসান গুনছে। যা এতিমের হক। কেন? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সবক’টি ট্যানারি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ট্যানারিতে চামড়া নিতে পরিবহণ খরচও অনেক বেশি। যা ট্যানারির মালিক বা সরকার দেন না। এক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে চামড়ার দাম বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার বাইরে পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কম। এটাও চরম বৈষম্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্টাফ রিপোর্টার কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, এবারের কোরবানির ঈদে পশুর চামড়ার দাম আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। চামড়ার এই দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুস্থ, এতিম, হতদরিদ্র, এতিমখানা এবং কওমি মাদরাসা। বিশেষ করে কওমি মাদরাসায় যেসব এতিম ও গরিব মেধাবী প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র তহবিল থেকে সহায়তা পাচ্ছে, তারা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। কোরবানির চামড়া সংগ্রহের অর্থে পরিচালিত এসব কওমি মাদরাসার দরিদ্র তহবিল এবার সঙ্কুচিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কওমি মাদরাসাগুলোর বার্ষিক খরচ পরিচালনায় এটি বিশাল এক সংকট বলে মনে করছেন কিশোরগঞ্জে কওমি মাদরাসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। তাদের অনেকেই কোরবানির চামড়ার এই দরপতনকে কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে তিনশ’র মতো কওমি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসায় প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তাদের মধ্যে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন দান এবং ঈদুল ফিতরের যাকাত ও ঈদুল আজহার কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থে পরিচালিত হয় এসব মাদরাসার গোরাবা ফান্ড অর্থাৎ দরিদ্র তহবিল। এই তহবিল থেকে এতিম ও দরিদ্র মেধাবীদের থাকা-খাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কিন্তু এবার কোরবানির চামড়ার কাঙ্ক্ষিত দাম দূরে থাক, ন্যূনতম দামও মিলছে না। ফলে তহবিলে অর্থ সংকটের কারণে মাদরাসাগুলোর এতিম-অসহায় ছাত্ররা বিপাকে পড়বে। এ পরিস্থিতিকে কওমি মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে কিশোরগঞ্জের আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ বলেন, কওমি মাদরাসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় পরিকল্পিতভাবে চামড়া নিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারের কোথাও চামড়ার দাম কমেনি।
আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সমাজের গরিব, সুবিধাবঞ্চিত, বাবা-মা হারা প্রায় দেড় হাজার শিশু-কিশোর এই মাদরাসায় পড়াশোনা করে। এবার গত বছরের চেয়ে মাদরাসাটিতে চামড়ার সংগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় তারা স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু চামড়ার রেকর্ড দরপতনের কারণে তাদের সেই স্বস্তি এখন অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ শহরের বড় বাজারের আলহাজ শামসুদ্দিন ভুঁইয়া জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাদের মাদরাসার গোরাবা ফান্ড থেকে এতিম-গরিব মেধাবীদের ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহের অন্যতম প্রধান খাত কোরবানির চামড়া সংগ্রহের অর্থ। কিন্তু এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে অন্যান্য মাদরাসার মতো তাদেরও অর্থসংকটের মধ্যে পড়তে হবে।
কিশোরগঞ্জ শহরের তারাপাশা এলাকার জামিয়া নূরানিয়া মাদরাসার মুহাতামিম মাওলানা আবুল বাশার জানান, তাদের মাদরাসায় প্রায় এক হাজার ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এবার চামড়ার কম দামের কারণে মাদরাসার বার্ষিক খরচ পরিচালনায় তাদের ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, চামড়ার দাম কমার কারণে অনেক কওমি মাদরাসার আয় কমে যাবে। এর ফলে সেসব মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল নামাপাড়া এলাকার জামিয়া রাহমানিয়া, মারিয়া এলাকার আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ও জামিয়া আবুবকরসহ আরো বেশ কয়েকটি মাদরাসার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হলে তারা একই রকম আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য কম হওয়ার ফলে কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মাগুরায় এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে কেউবা চামড়া ফেলে দিয়েছেন বর্জ্য হিসেবে। এ কারণে বঞ্চিত হয়েছে মাগুরার শত শত এতিমখানা ও লিল্লাহ বডিং।
মাগুরা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ গত বছর ছিল ১০ শতাংশ এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশ। এবছর ১৩২৫০টি পশু কোরবানি হলেও ব্যবসায়ীরা ১৭০০টি মত চামড়া সংগ্রহ করেছে। শহরের একটি মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা অব্দুল মেমিন বলেন, প্রতিবছর চামড়া বিক্রির টাকা থেকে আমরা একটি ভালো অঙ্কের অনুদান পাই। এবার তা নেই বললেই চলে। আমার এতিমখানার বাচ্চাদের ভরণপোষণে এটি একটি বড় প্রভাব ফেলবে।
শহরের নতুন বাজার এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী শ্যামল কুমার বলেন, এবছর সরকার নির্ধারিত চামড়ার দর খুবই কম। ঐ দামে আমরা যত চামড়া কিনব তত লোকসান বাড়বে। একারণেই এবার বাজারে প্রচুর চামড়া থাকা সত্ত্বেও ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাছাড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রত্যেক ব্যবসায়ীই কয়েক লাখ করে পুরানো টাকা এখনো পাননি।
No comments