চট্টগ্রামে ইয়াবায় রাতারাতি শ’শ’ কোটিপতি by ইব্রাহিম খলিল
ইয়াবার
কল্যাণে চট্টগ্রামে শ’শ’ কোটিপতি গজে উঠছে রাতারাতি। যাদের নামের তালিকা
ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে পুলিশের খাতায়ও। চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের
তালিকায় দামি গাড়ি এবং একাধিক ফ্ল্যাটধারী এমন অনেকেরই খোঁজ মিলছে। ইয়াবা
যাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। আর তাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ হিসেবে
বেড়ে উঠা কিশোর-তরুণরা। কোটিপতি ব্যবসায়ীরাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পার্ট
টাইম জব হিসেবে অনেক ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম কর্মী,
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষদের আয়েশি জীবনের
টোপ দিয়ে কাছে টেনে নিচ্ছে। যাদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া,
লোহাগাড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া ও সাতকানিয়ার। এছাড়া রয়েছে কুমিল্লা ও
বরিশাল জেলার লোক। যারা সড়ক, সমুদ্র ও আকাশপথ দিয়ে নিয়মিত ইয়াবা পাচারে
জড়িত।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি বন্দর) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ইয়াবা পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে চট্টগ্রামে শ’শ’ কোটিপতির সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে সামপ্রতিক যে তথ্য আছে সেটা হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করছেন। পণ্য পরিবহন তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। পণ্যের আড়ালে ইয়াবা পাচারই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কারণে প্রথাগত পরিবহন ব্যবসায়ী যারা আছেন তারাও বিপাকে পড়ছেন।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, ইয়াবা ব্যবসা চলছে এখন মুঠোফোনে। টেকনাফের বিশেষ একজনকে জানাতে হয় কী পরিমাণ ইয়াবা লাগবে, পাঠাবেই বা কোথায়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ইয়াবা চলে যায় সেই ঠিকানায়। লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। টেকনাফ থেকে ইয়াবা তাই চট্টগ্রাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে।
তিনি বলেন, ২০০৬ সাল থেকেই মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে ইয়াবার চালান আসতে থাকে এ দেশে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কয়েক বছর আগেও টেকনাফে পেশা হিসেবে যারা জেলে, রিকশাচালক, বেকার যুবক, পিঠা বিক্রেতা, কৃষক বা ক্ষুদ্র লবণচাষি ছিলেন, তাদের প্রায় অধিকাংশই এখন সচ্ছল, কেউ কেউ কোটিপতি, গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন। গ্রামের রাস্তার দু’পাশে সব সুরম্য বাড়িঘর। এরমধ্যে অন্যতম টেকনাফের নাজিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এজাহার মিয়ার ছেলে নূরুল হক ওরফে ভুট্টো। একটি রিকশা কেনার সামর্থ্য ছিল না নূরুল হকের। বসতবাড়ি বলতে ছিল গোলপাতার একটি ঘর। সেই নূরুল হক এখন নাজিরপাড়ার দুটি বাড়ির মালিক। চট্টগ্রাম ও খুলনায় তার ফ্ল্যাট আছে। আছে তিনটি গাড়িও। জমিজমাও কিনেছেন অনেক। নাজিরপাড়ায় রাস্তার পাশে এখন একটি মার্কেটও নির্মাণ করছেন।
নূরুল হক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। নূরুল হক একাই শুধু নন, সঙ্গে আছেন তার পিতা এজাহার মিয়া, ভাই নুর মোহাম্মদ ওরফে মংগ্রী, ভগ্নিপতি নূরুল আলম, ভাগিনা জালাল উদ্দিন, বেলাল, আবছার উদ্দিন, হেলাল, হোছেন কামাল ও নুরুল আমিন ওরফে খোকন। তারা সবাই ইয়াবা মামলার আসামি। চলতি বছরের ৮ই এপ্রিল চকরিয়ার নূরুল হুদা নামে এক যুবক ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। সাত বছর আগে যে ছিল বাসের হেলপার। আর এখন চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত এলাকার যে ফ্ল্যাটে তার পরিবার থাকে, সেটির ভাড়া ৩৫ হাজার টাকা। আয়ের উৎস একটাই, ইয়াবা। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। গাড়ি আছে দুটি। বিউটি পার্লার খুলে দিয়েছেন স্ত্রীকে। রয়েছে মুঠোফোনের দোকান। জমি কিনেছেন কক্সবাজার শহরে, ফ্ল্যাট কিনেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম শহরের ২ নম্বর গেট এলাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়িসহ হুদাকে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেদিন হুদার গাড়িতে ১০ হাজার ইয়াবা ছিল। হুদা এখন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। এর আগে বিভিন্ন সময়ে দুবার তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে যান তিনি। তার অর্থবিত্তের বিষয়টি এতদিন অজানা ছিল।
আনোয়ারা গহিরাকেন্দ্রিক ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মোজাহের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর এলাকার চান মিয়ার ছেলে। মুখোশের আড়ালে তিনি ইয়াবা পাচারের কাজ করতেন। র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মো. মোজাহারের নগরীতে আছে ছয়তলা বাড়ি। এর দ্বিতীয় তলায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। ইয়াবা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান নয়-দশ বছর আগেও ছিলেন বেকার। টেকনাফ মৌলভীপাড়ার চোরাচালানের ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর ইয়াবা পাচার শুরু করেন। এখন দুটি মাইক্রোবাস ও চারটি ভারতীয় বিভিন্ন মডেলের দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের মালিক। একটি আলিশান বাড়িও বানিয়েছেন। তার ছোট ভাই আবদুর রহমান ও কামাল হোসেন ইয়াবা ব্যবসায় সক্রিয়। গ্রীনলাইন পরিবহনের এসি বাসে কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় নতুন ব্রিজ এলাকায় তল্লাশির সময় মহিলা ক্রিকেটার মুক্তা ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন ৩০শে এপ্রিল সকালে। তিনি প্রায়ই কক্সবাজার যাওয়া-আসা করতেন। মুক্তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের ছাত্রী ছিলেন। মাদকাসক্ত হওয়ার পর অনিয়মিত হয়ে পড়ায় তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়। তিনি ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ, মহিলা ক্রিকেট লীগে নিয়মিত অংশ নেন। মহিলা ক্রিকেট আনসার টিমের
তিনি একজন নিয়মিত ক্রিকেটার বলে জানান বাকরিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী। ওসি জানান, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, কক্সবাজারে গিয়ে প্রায়ই তিনি নাহিদ নামে এক লোকের কাছ থেকে ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় রিপন নামে আরেকজনকে সরবরাহ করতেন। ৪ঠা মে শুক্রবার চট্টগ্রামের হালিশহরের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির একটি ফ্লাটে ধরা পড়ে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে এই অভিযানে ১৩ লাখ ইয়াবাসহ মো. আশরাফ (৩৪) ও হাসান (২৪) নামে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরমধ্যে আশরাফ ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। তাদের বাড়ি বান্দরবান পার্বত্য জেলায়।
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, আশরাফ প্রবাস জীবনে তেমন উন্নতি করতে না পারলেও দেশে এসে মাত্র এক দুই বছরে ইয়াবা পাচার করে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির ওই ফ্লাট ছাড়াও নাসিরাবাদে একটি ফ্লাট ও বাকলিয়ায় একটি প্লটের মালিক তিনি। রয়েছে দুটি গাড়িও।
গত বছর ৩১শে আগস্ট সিদ্দিকুল ইসলাম নামে এক ইয়াবা ব্যসায়ীর খোঁজ মিলে। যার কৌশলের কাছে বারবার পরাস্ত হতে হয়েছিল পুলিশের কৌশল। তবে শেষরক্ষা হয়নি তার। ইয়াবা পাচারে সিদ্দিকুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন পারিবারিক সিন্ডিকেট।
সূত্র জানায়, ইয়াবার চালান টেকনাফ থেকে ঢাকায় আনা এবং ঘাটে ঘাটে পৌঁছে দিতে চারটি জিপ ব্যবহার করেন সিদ্দিকুল ইসলাম। একটি জিপে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চালান আনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনতে ব্যবহার করেন দুটি জিপ। আর ঢাকায় ঘাটে ঘাটে ইয়াবার চালান পৌঁছে দিতে বাকি জিপটি ব্যবহার করা হয়। ইয়াবাবাহী জিপ পুলিশ রাস্তায় আটকালে অনেক সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের গাড়ি বলে পরিচয় দিয়েও রক্ষা পান তারা। গাড়ি চালানোর জন্য রয়েছে বেতনভুক্ত চারজন দক্ষ চালক। প্রতি চালানেই তাদের আবার দেয়া হয় ঝুঁকি ভাতা।
সিদ্দিকের তিন ছেলের দু’জনই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। স্ত্রী রশিদা খাতুনও গ্রেপ্তার হয়েছেন দু’দফা। টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন সিদ্দিকের দুই ছেলে রবিউল ইসলাম ও ফরিদুল ইসলাম। একেক সপ্তাহে একেক ছেলে এই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার আগে নেয়া হয় অভিনব এক কৌশল। চালান আনতে যাওয়ার আগে রবিউল কিংবা ফরিদুল নিজের মোবাইল নম্বরটি কয়েকদিন আগেই বন্ধ করে দেন। তখন ব্যবহার করেন নতুন সিম ও ফোন সেট। পাশাপাশি ঢাকার কোনো একটি থানায় সিদ্দিক বা তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ জিডি করা হয়। যেন চালানসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও আদালতে দেখাতে পারেন, যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনি তিনদিন বা চারদিন আগেই নিখোঁজ হয়েছেন। এমন তথ্যই বের হয়ে এসেছে তাদের গ্রেপ্তারের পর। আর এ পদ্ধতিতে আদালত থেকে সহজেই জামিন পেয়ে যান তারা। এরমধ্যে ছেলে রবিউল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যদিও ঠিকমতো ক্লাস করেন না, বাবার ইয়াবা ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত তিনি। নিয়ন্ত্রণ করেন ইয়াবা সিন্ডিকেট।
টেকনাফের নাজিরপাড়ার নুরুল আলম ভালো ফুটবল খেলতেন। আর্জেন্টাইন ফুটবলারের নাম অনুসারে লোকে তাকে ডাকতেন ডি মারিয়া বলে। সাত-আট বছর আগেও নুরুল আলম রিকশা চালাতেন। এখন ইয়াবার কারবার করেন। তার ভাই ফরিদুল আলমের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে দেড় কোটি টাকা। তাকে নারায়ণগঞ্জের দুটি ইয়াবার মামলায় আটক করা হলে তিনি জামিনে ছাড়া পান। গত বছর ১৮ই সেপ্টেম্বর ১০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আতিকুল ইসলাম তারেক তার ভগ্নিপতির হাত ধরে মাদক কারবারে জড়িয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারেক (২০) চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির এলএলবি সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি টেকনাফে। তার বাবা টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম একজন ব্যবসায়ী। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, তারেকের এক বোনের স্বামী টেকনাফের মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা ফজর আলী। ফজর আলী ও তার ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা বিক্রেতা। মাস খানেক আগে চট্টগ্রামে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে ফজর।
কামরুজ্জামান বলেন, তারেক একাই একটি ফ্ল্যাট নিয়ে চট্টগ্রামের আতুরার ডিপো এলাকায় থাকেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় সচ্ছল পরিবারের ইয়াবা আসক্ত ছেলেদের সঙ্গে তার উঠাবসা সহজ ছিল। ইয়াবা কেনাবেচা করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীতে পরিণত হওয়া ব্যক্তিরা পরিবহন ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে বলে তথ্য দিয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান কিনে নিজেরা পরিবহন প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে সেই গাড়িতে কৌশলে বিশেষ চেম্বার বানিয়ে পাচার করছে ইয়াবা। নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (বর্তমানে কোতোয়ালি থানায় বদলিপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সংঘবদ্ধ ইয়াবা পাচারকারী চক্র তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। ২১টি ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যান কিনে তারা নিজেদের পরিবহন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। সেই পরিবহনে তারা সাধারণত পচনশীল দ্রব্য যেমন মাছ পরিবহন করছে। মূলত পণ্য পরিবহনের মতো করে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতদের একটা তালিকা জমা দেয়া আছে। এক সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাসহ প্রায় সব পেশার লোকের নাম ওই তালিকায় উল্লেখ আছে; কিন্তু সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িত থাকায় প্রশাসন এখন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি বন্দর) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ইয়াবা পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে চট্টগ্রামে শ’শ’ কোটিপতির সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে সামপ্রতিক যে তথ্য আছে সেটা হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করছেন। পণ্য পরিবহন তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। পণ্যের আড়ালে ইয়াবা পাচারই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কারণে প্রথাগত পরিবহন ব্যবসায়ী যারা আছেন তারাও বিপাকে পড়ছেন।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, ইয়াবা ব্যবসা চলছে এখন মুঠোফোনে। টেকনাফের বিশেষ একজনকে জানাতে হয় কী পরিমাণ ইয়াবা লাগবে, পাঠাবেই বা কোথায়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ইয়াবা চলে যায় সেই ঠিকানায়। লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। টেকনাফ থেকে ইয়াবা তাই চট্টগ্রাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে।
তিনি বলেন, ২০০৬ সাল থেকেই মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে ইয়াবার চালান আসতে থাকে এ দেশে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কয়েক বছর আগেও টেকনাফে পেশা হিসেবে যারা জেলে, রিকশাচালক, বেকার যুবক, পিঠা বিক্রেতা, কৃষক বা ক্ষুদ্র লবণচাষি ছিলেন, তাদের প্রায় অধিকাংশই এখন সচ্ছল, কেউ কেউ কোটিপতি, গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন। গ্রামের রাস্তার দু’পাশে সব সুরম্য বাড়িঘর। এরমধ্যে অন্যতম টেকনাফের নাজিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এজাহার মিয়ার ছেলে নূরুল হক ওরফে ভুট্টো। একটি রিকশা কেনার সামর্থ্য ছিল না নূরুল হকের। বসতবাড়ি বলতে ছিল গোলপাতার একটি ঘর। সেই নূরুল হক এখন নাজিরপাড়ার দুটি বাড়ির মালিক। চট্টগ্রাম ও খুলনায় তার ফ্ল্যাট আছে। আছে তিনটি গাড়িও। জমিজমাও কিনেছেন অনেক। নাজিরপাড়ায় রাস্তার পাশে এখন একটি মার্কেটও নির্মাণ করছেন।
নূরুল হক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। নূরুল হক একাই শুধু নন, সঙ্গে আছেন তার পিতা এজাহার মিয়া, ভাই নুর মোহাম্মদ ওরফে মংগ্রী, ভগ্নিপতি নূরুল আলম, ভাগিনা জালাল উদ্দিন, বেলাল, আবছার উদ্দিন, হেলাল, হোছেন কামাল ও নুরুল আমিন ওরফে খোকন। তারা সবাই ইয়াবা মামলার আসামি। চলতি বছরের ৮ই এপ্রিল চকরিয়ার নূরুল হুদা নামে এক যুবক ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। সাত বছর আগে যে ছিল বাসের হেলপার। আর এখন চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত এলাকার যে ফ্ল্যাটে তার পরিবার থাকে, সেটির ভাড়া ৩৫ হাজার টাকা। আয়ের উৎস একটাই, ইয়াবা। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। গাড়ি আছে দুটি। বিউটি পার্লার খুলে দিয়েছেন স্ত্রীকে। রয়েছে মুঠোফোনের দোকান। জমি কিনেছেন কক্সবাজার শহরে, ফ্ল্যাট কিনেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম শহরের ২ নম্বর গেট এলাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়িসহ হুদাকে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেদিন হুদার গাড়িতে ১০ হাজার ইয়াবা ছিল। হুদা এখন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। এর আগে বিভিন্ন সময়ে দুবার তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে যান তিনি। তার অর্থবিত্তের বিষয়টি এতদিন অজানা ছিল।
আনোয়ারা গহিরাকেন্দ্রিক ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মোজাহের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর এলাকার চান মিয়ার ছেলে। মুখোশের আড়ালে তিনি ইয়াবা পাচারের কাজ করতেন। র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মো. মোজাহারের নগরীতে আছে ছয়তলা বাড়ি। এর দ্বিতীয় তলায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। ইয়াবা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান নয়-দশ বছর আগেও ছিলেন বেকার। টেকনাফ মৌলভীপাড়ার চোরাচালানের ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর ইয়াবা পাচার শুরু করেন। এখন দুটি মাইক্রোবাস ও চারটি ভারতীয় বিভিন্ন মডেলের দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের মালিক। একটি আলিশান বাড়িও বানিয়েছেন। তার ছোট ভাই আবদুর রহমান ও কামাল হোসেন ইয়াবা ব্যবসায় সক্রিয়। গ্রীনলাইন পরিবহনের এসি বাসে কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় নতুন ব্রিজ এলাকায় তল্লাশির সময় মহিলা ক্রিকেটার মুক্তা ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন ৩০শে এপ্রিল সকালে। তিনি প্রায়ই কক্সবাজার যাওয়া-আসা করতেন। মুক্তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের ছাত্রী ছিলেন। মাদকাসক্ত হওয়ার পর অনিয়মিত হয়ে পড়ায় তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়। তিনি ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ, মহিলা ক্রিকেট লীগে নিয়মিত অংশ নেন। মহিলা ক্রিকেট আনসার টিমের
তিনি একজন নিয়মিত ক্রিকেটার বলে জানান বাকরিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী। ওসি জানান, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, কক্সবাজারে গিয়ে প্রায়ই তিনি নাহিদ নামে এক লোকের কাছ থেকে ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় রিপন নামে আরেকজনকে সরবরাহ করতেন। ৪ঠা মে শুক্রবার চট্টগ্রামের হালিশহরের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির একটি ফ্লাটে ধরা পড়ে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে এই অভিযানে ১৩ লাখ ইয়াবাসহ মো. আশরাফ (৩৪) ও হাসান (২৪) নামে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরমধ্যে আশরাফ ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। তাদের বাড়ি বান্দরবান পার্বত্য জেলায়।
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, আশরাফ প্রবাস জীবনে তেমন উন্নতি করতে না পারলেও দেশে এসে মাত্র এক দুই বছরে ইয়াবা পাচার করে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির ওই ফ্লাট ছাড়াও নাসিরাবাদে একটি ফ্লাট ও বাকলিয়ায় একটি প্লটের মালিক তিনি। রয়েছে দুটি গাড়িও।
গত বছর ৩১শে আগস্ট সিদ্দিকুল ইসলাম নামে এক ইয়াবা ব্যসায়ীর খোঁজ মিলে। যার কৌশলের কাছে বারবার পরাস্ত হতে হয়েছিল পুলিশের কৌশল। তবে শেষরক্ষা হয়নি তার। ইয়াবা পাচারে সিদ্দিকুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন পারিবারিক সিন্ডিকেট।
সূত্র জানায়, ইয়াবার চালান টেকনাফ থেকে ঢাকায় আনা এবং ঘাটে ঘাটে পৌঁছে দিতে চারটি জিপ ব্যবহার করেন সিদ্দিকুল ইসলাম। একটি জিপে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চালান আনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনতে ব্যবহার করেন দুটি জিপ। আর ঢাকায় ঘাটে ঘাটে ইয়াবার চালান পৌঁছে দিতে বাকি জিপটি ব্যবহার করা হয়। ইয়াবাবাহী জিপ পুলিশ রাস্তায় আটকালে অনেক সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের গাড়ি বলে পরিচয় দিয়েও রক্ষা পান তারা। গাড়ি চালানোর জন্য রয়েছে বেতনভুক্ত চারজন দক্ষ চালক। প্রতি চালানেই তাদের আবার দেয়া হয় ঝুঁকি ভাতা।
সিদ্দিকের তিন ছেলের দু’জনই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। স্ত্রী রশিদা খাতুনও গ্রেপ্তার হয়েছেন দু’দফা। টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন সিদ্দিকের দুই ছেলে রবিউল ইসলাম ও ফরিদুল ইসলাম। একেক সপ্তাহে একেক ছেলে এই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার আগে নেয়া হয় অভিনব এক কৌশল। চালান আনতে যাওয়ার আগে রবিউল কিংবা ফরিদুল নিজের মোবাইল নম্বরটি কয়েকদিন আগেই বন্ধ করে দেন। তখন ব্যবহার করেন নতুন সিম ও ফোন সেট। পাশাপাশি ঢাকার কোনো একটি থানায় সিদ্দিক বা তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ জিডি করা হয়। যেন চালানসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও আদালতে দেখাতে পারেন, যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনি তিনদিন বা চারদিন আগেই নিখোঁজ হয়েছেন। এমন তথ্যই বের হয়ে এসেছে তাদের গ্রেপ্তারের পর। আর এ পদ্ধতিতে আদালত থেকে সহজেই জামিন পেয়ে যান তারা। এরমধ্যে ছেলে রবিউল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যদিও ঠিকমতো ক্লাস করেন না, বাবার ইয়াবা ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত তিনি। নিয়ন্ত্রণ করেন ইয়াবা সিন্ডিকেট।
টেকনাফের নাজিরপাড়ার নুরুল আলম ভালো ফুটবল খেলতেন। আর্জেন্টাইন ফুটবলারের নাম অনুসারে লোকে তাকে ডাকতেন ডি মারিয়া বলে। সাত-আট বছর আগেও নুরুল আলম রিকশা চালাতেন। এখন ইয়াবার কারবার করেন। তার ভাই ফরিদুল আলমের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে দেড় কোটি টাকা। তাকে নারায়ণগঞ্জের দুটি ইয়াবার মামলায় আটক করা হলে তিনি জামিনে ছাড়া পান। গত বছর ১৮ই সেপ্টেম্বর ১০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আতিকুল ইসলাম তারেক তার ভগ্নিপতির হাত ধরে মাদক কারবারে জড়িয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারেক (২০) চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির এলএলবি সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি টেকনাফে। তার বাবা টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম একজন ব্যবসায়ী। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, তারেকের এক বোনের স্বামী টেকনাফের মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা ফজর আলী। ফজর আলী ও তার ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা বিক্রেতা। মাস খানেক আগে চট্টগ্রামে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে ফজর।
কামরুজ্জামান বলেন, তারেক একাই একটি ফ্ল্যাট নিয়ে চট্টগ্রামের আতুরার ডিপো এলাকায় থাকেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় সচ্ছল পরিবারের ইয়াবা আসক্ত ছেলেদের সঙ্গে তার উঠাবসা সহজ ছিল। ইয়াবা কেনাবেচা করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীতে পরিণত হওয়া ব্যক্তিরা পরিবহন ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে বলে তথ্য দিয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান কিনে নিজেরা পরিবহন প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে সেই গাড়িতে কৌশলে বিশেষ চেম্বার বানিয়ে পাচার করছে ইয়াবা। নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (বর্তমানে কোতোয়ালি থানায় বদলিপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সংঘবদ্ধ ইয়াবা পাচারকারী চক্র তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। ২১টি ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যান কিনে তারা নিজেদের পরিবহন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। সেই পরিবহনে তারা সাধারণত পচনশীল দ্রব্য যেমন মাছ পরিবহন করছে। মূলত পণ্য পরিবহনের মতো করে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতদের একটা তালিকা জমা দেয়া আছে। এক সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাসহ প্রায় সব পেশার লোকের নাম ওই তালিকায় উল্লেখ আছে; কিন্তু সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িত থাকায় প্রশাসন এখন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
No comments