সৌদি ফেরত বাংলাদেশি নারীদের মুখে লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা by রোকনুজ্জামান পিয়াস
ভালো
নেই সৌদি আরবে কাজের সন্ধানে যাওয়া গৃহকর্মীরা। গৃহকর্তার নির্যাতনে তাদের
কারো হাত ভেঙেছে, কারো পা। কারো শরীরে ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে।
নির্মম নির্যাতনে কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আবার কেউ
নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এদের মধ্যে দু’একজন
মারাও গেছেন।
নির্যাতনে কারো কারো শরীরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তবে, শারীরিক এই নির্যাতনের বাইরে সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ, অধিকাংশ নারীই মারত্মক যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দেশটিতে। একই পরিবারের একাধিক পুরুষ সদস্যের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। এমনকি বাবা-ছেলে মিলেও ধর্ষণ করে গৃহকর্মীকে। নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ যে, এতে করে জড়ায়ুতে ক্ষত তৈরি হয়েছে। গৃহকর্তার এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসছেন। আর যারা এ সুযোগ পাচ্ছেন না তারা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন। আড়ালেই থেকে যাচ্ছে হতভাগ্য ওই নারীদের ঘটনা। এদিকে এসব ঘটনার শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা অনেক নারী কর্মীই পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে পড়েছেন। সামাজিকভাবেও নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন তারা। এমনকি স্বামী ও পিতা-মাতার সংসারেও ফিরতে পারছেন না কেউ কেউ। সূত্র বলছে, গত চার মাসে প্রায় আড়াই হাজার নারী কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরমধ্যে শতকরা ৮০ জনই ভয়াবহ রকমের যৌন নির্যাতনের শিকার। ফিরে আসা নারীরা দেশটিতে আর কোনো নারী কর্মী না পাঠাতেও অনুরোধ করছেন। এদিকে যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি নারী কর্মীদের পাঠাচ্ছে তারাও এসব ঘটনার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিতদের ফিরে আনা হচ্ছে সরকারি তহবিলের টাকা খরচ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এনজিওর সহযোগিতায় তারা দেশে ফিরছেন। অপরদিকে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের মধ্যেই দেশটিতে নারী কর্মী পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিলে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে ৮ হাজার ৪৯২ জন নারী কর্মী পাঠানো হয়েছে। আর চলতি বছরের গত চার মাসে গেছে ৩০ হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদিতে গৃহকর্মী পাঠানো উচিত কি না- সে ব্যাপারে এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়েছে।
জানা গেছে, নির্যাতনের কারণে অনেক আগেই সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। এরমধ্যে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা অন্যতম। এইসব দেশ তাদের নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার পর সৌদি আরবে চাহিদা বাড়ে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের। এজেন্সিগুলো নারী কর্মী পাঠানোর দিকেই ঝুঁকে পড়ে। কারণ একজন নারী কর্মীর বিনিময়ে তার সৌদির সংশ্লিষ্ট গৃহকর্তার কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ পেয়ে থাকে। যার ফলে বিনা পুঁজির ব্যবসার মতো তারা দেদারছে পাঠাচ্ছেন নারী কর্মী।
সূত্রমতে, দেশটিতে নারী কর্মী পাঠানোর পর থেকেই একের পর এক নানা অভিযোগ আসতে থাকে। নারী কর্মীরা অভিযোগ করেন, তাদেরকে ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে দেয়া হয় না। টানা ২০ ঘণ্টাও কাজ করতে হয় কখনো কখনো। এ ছাড়া এক বাড়িতে কাজের কথা বলে নিয়ে গেলেও একাধিক বাড়িতে তাদের কাজ করানো হয়। অপরাগতা দেখালে নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিনের পর দিন অসুস্থ থাকলেও অনেকের ভাগ্যে জোটে না চিকিৎসা। এমনকি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেয়া হয় না। একই পরিবারের একাধিক সদস্য মিলে যৌন নির্যাতন চালায়। নির্যাতিত নারী কর্মীরা অনেকেই পালিয়ে গিয়ে দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে আশ্রয় নেন। অনেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। এরপর জেল জীবন শুরু হয় তাদের। পরে নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে কেউ দেশে ফেরার সুযোগ পান। আবার আইনি জটিলতায় অনেকেই মাসের পর মাস জেলে অথবা দূতাবাসের সেইফ হোমে কাটাচ্ছে। তবে, সম্প্রতি এই অভিযোগের মাত্রা বেড়েছে। ফিরে আসা নারীদের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ফিরে আসছেন নারী কর্মীরা।
সর্বশেষ গত রোববার রাতে সৌদি থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরেন ২১ নির্যাতিত নারী। এর আগের দিন ফেরেন আরো ৮১ নারী। রোববার ফিরে আসা হবিগঞ্জের একজন জানান, তিনি ১৫ দিন আগে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আবর গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যে বাসার কাজে তাকে দেয়া হয়েছিল সেই বাসার মালিক লুইচ্চা। বলেন, ম্যাডাম বাসায় না থাকলে মালিক তার ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর চেষ্টা করতো। তিনি রাজি না হওয়ায় মারধর করতো। ক্ষতের দাগ দেখিয়ে এই নারী বলেন, এটা ইস্ত্রির দাগ। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, মধ্যবয়সী গৃহকর্তা একদিন কফি বানাতে বলে। তার কথা মতো রান্না ঘরে গেলে সে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিৎ করে ফেলে দেয়। পরে হাতে কামড় দিয়ে ছাড়া পান। কিন্তু পরক্ষণে আবারো একই কাজ করে। তখন হাতে থাকা গ্যাস লাইট দিয়ে তার পাঞ্জাবিতে আগুন ধরিয়ে দিই। পরে নিজেই তা নিভিয়ে ঘরের দরজার বাইরে থেকে সিটকিনি দিয়ে পালিয়ে আসি। পরে এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় সেইফ হোমে যাই। সেখান থেকেই দেশে ফিরেছি। তিনি বলেন, আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই। তার বাড়ি থেকেও কেউ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। রোবাবর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে থাকা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের মিডিয়া কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন একাধিকবার ফোন করেও তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাননি। তার স্বামীও তাকে নিতে চাননি। এই অবস্থায় রাতভর তিনি বিমানবন্দরেই কাটান। পরে ব্র্যাকের সহযোগিতায় তাকে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের শেল্টার হোমে পাঠানো হয়। হবিগঞ্জের এই নারীসহ বিমানবন্দরে প্রত্যেকে তাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। এদিকে বিভিন্ন সময় ফিরে আসা নারীদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ তথ্য জানা গেছে। রেশমা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী বলেন, তিনি যে বাড়িতে কাজ করতেন সেই বাড়িন গৃহকর্তা ও তার ছেলে দু’জনেই যৌন নির্যাতন চালাতো। পরে পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। আকলিমা (ছদ্মনাম) জানান, তাকে সৌদি নিয়ে যাওয়ার পর জেদ্দার যে বাড়িতে রাখা হয়, সেখানে শুধু ১০-১২ জন পুরুষ ছিল। তারা তার ওপর অমানাবিক নির্যাতন চালাতো। আনোয়ারা নামের একজন জানান, শারীরিক নির্যাতন শেষে তাকে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়া হয়। ফলে পা ভেঙে যায়। সে জানায়, প্রথমে পালানোর সময় ধরা পড়ে। এরপর থেকেই তার ওপর চলতে থাকে নির্যাতন। বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার এক নারী জানান, গত বছর জুন মাসে সৌদি আরব যান তিনি। সেখানে ছয় মাস নিয়োগকর্তা ও তার ছেলের যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন দূতাবাসে। মুন্সীগঞ্জের এক নারী জড়ায়ুতে ইনফেকশন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ফরিদপুরের অপর এক নারীর হাতের হাড় ভেঙ্গে অন্য স্থান দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ১০ মাস অবস্থান কালে আট মাসের বেতন ছাড়াই ২৬ জন নারীর সঙ্গে তিনিও ফিরেছেন।
সৌদির গৃহকর্মীর বর্তমান অবস্থা ও এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গত ২-৩ মাসে তারা ১১৮ পরিবারের কাছ নির্যাতেনের অভিযোগ পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ব্র্যাকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ৭১ জনকে ফেরত আনা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে যখন বিভিন্ন দেশ সৌদি আরবে তাদের নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়, তখন বাংলাদেশের নারী কর্মীর চাহিদা তৈরি হয়। ওই সময় নির্যাতনের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছিল। তারা (সৌদি) সে সময় নির্যাতিত হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যারা ফেরত আসছে তারা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং দিনকে দিন এ সমস্যা বাড়ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমরা তাদেরকে (সৌদির নিয়োগকর্তা) কিছুই বলছি না। এতে করে তারা ভেবে নিয়েছে- বাংলাদেশের নারীদের যা ইচ্ছা তাই করা যায়। এমনকি সেইফ হোমে নির্যাতিত যেসব নারীরা আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই নিয়োগ কর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শরিফুল হাসান আরো বলেন, আমরা শুধু সংখ্যার বিচার করছি। কিন্তু কতজন নির্যাতিত হচ্ছে, কতজন ফেরত আসছে, সে হিসাব আমাদের কাছে নেই। শুধুমাত্র যারা ফেরত আসছে তাদের কাছ থেকেই ঘটনাগুলো জানতে পারছি। তিনি বলেন, সংখ্যা না দেখে, তাদের সেফটির বিষয়টি ভাবা উচিত। তিনি আরো বলেন, যেসব নারীরা ফেরত আসছে তারাও ভালো নেই। অনেকে ট্রমাটাইজড্ হয়ে যাচ্ছে। এই অভিবাসী অধিকার কর্মী বলেন, এখন সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার- সেখানে আমরা নারী কর্মী পাঠাবো, না কি পাঠাবো না। অন্য দেশে পাঠালেও সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে নতুন করে ভাবা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নির্যাতনে কারো কারো শরীরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তবে, শারীরিক এই নির্যাতনের বাইরে সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ, অধিকাংশ নারীই মারত্মক যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দেশটিতে। একই পরিবারের একাধিক পুরুষ সদস্যের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। এমনকি বাবা-ছেলে মিলেও ধর্ষণ করে গৃহকর্মীকে। নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ যে, এতে করে জড়ায়ুতে ক্ষত তৈরি হয়েছে। গৃহকর্তার এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসছেন। আর যারা এ সুযোগ পাচ্ছেন না তারা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন। আড়ালেই থেকে যাচ্ছে হতভাগ্য ওই নারীদের ঘটনা। এদিকে এসব ঘটনার শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা অনেক নারী কর্মীই পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে পড়েছেন। সামাজিকভাবেও নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন তারা। এমনকি স্বামী ও পিতা-মাতার সংসারেও ফিরতে পারছেন না কেউ কেউ। সূত্র বলছে, গত চার মাসে প্রায় আড়াই হাজার নারী কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরমধ্যে শতকরা ৮০ জনই ভয়াবহ রকমের যৌন নির্যাতনের শিকার। ফিরে আসা নারীরা দেশটিতে আর কোনো নারী কর্মী না পাঠাতেও অনুরোধ করছেন। এদিকে যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি নারী কর্মীদের পাঠাচ্ছে তারাও এসব ঘটনার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিতদের ফিরে আনা হচ্ছে সরকারি তহবিলের টাকা খরচ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এনজিওর সহযোগিতায় তারা দেশে ফিরছেন। অপরদিকে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের মধ্যেই দেশটিতে নারী কর্মী পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিলে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে ৮ হাজার ৪৯২ জন নারী কর্মী পাঠানো হয়েছে। আর চলতি বছরের গত চার মাসে গেছে ৩০ হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদিতে গৃহকর্মী পাঠানো উচিত কি না- সে ব্যাপারে এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়েছে।
জানা গেছে, নির্যাতনের কারণে অনেক আগেই সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। এরমধ্যে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা অন্যতম। এইসব দেশ তাদের নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার পর সৌদি আরবে চাহিদা বাড়ে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের। এজেন্সিগুলো নারী কর্মী পাঠানোর দিকেই ঝুঁকে পড়ে। কারণ একজন নারী কর্মীর বিনিময়ে তার সৌদির সংশ্লিষ্ট গৃহকর্তার কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ পেয়ে থাকে। যার ফলে বিনা পুঁজির ব্যবসার মতো তারা দেদারছে পাঠাচ্ছেন নারী কর্মী।
সূত্রমতে, দেশটিতে নারী কর্মী পাঠানোর পর থেকেই একের পর এক নানা অভিযোগ আসতে থাকে। নারী কর্মীরা অভিযোগ করেন, তাদেরকে ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে দেয়া হয় না। টানা ২০ ঘণ্টাও কাজ করতে হয় কখনো কখনো। এ ছাড়া এক বাড়িতে কাজের কথা বলে নিয়ে গেলেও একাধিক বাড়িতে তাদের কাজ করানো হয়। অপরাগতা দেখালে নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিনের পর দিন অসুস্থ থাকলেও অনেকের ভাগ্যে জোটে না চিকিৎসা। এমনকি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেয়া হয় না। একই পরিবারের একাধিক সদস্য মিলে যৌন নির্যাতন চালায়। নির্যাতিত নারী কর্মীরা অনেকেই পালিয়ে গিয়ে দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে আশ্রয় নেন। অনেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। এরপর জেল জীবন শুরু হয় তাদের। পরে নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে কেউ দেশে ফেরার সুযোগ পান। আবার আইনি জটিলতায় অনেকেই মাসের পর মাস জেলে অথবা দূতাবাসের সেইফ হোমে কাটাচ্ছে। তবে, সম্প্রতি এই অভিযোগের মাত্রা বেড়েছে। ফিরে আসা নারীদের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ফিরে আসছেন নারী কর্মীরা।
সর্বশেষ গত রোববার রাতে সৌদি থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরেন ২১ নির্যাতিত নারী। এর আগের দিন ফেরেন আরো ৮১ নারী। রোববার ফিরে আসা হবিগঞ্জের একজন জানান, তিনি ১৫ দিন আগে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আবর গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যে বাসার কাজে তাকে দেয়া হয়েছিল সেই বাসার মালিক লুইচ্চা। বলেন, ম্যাডাম বাসায় না থাকলে মালিক তার ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর চেষ্টা করতো। তিনি রাজি না হওয়ায় মারধর করতো। ক্ষতের দাগ দেখিয়ে এই নারী বলেন, এটা ইস্ত্রির দাগ। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, মধ্যবয়সী গৃহকর্তা একদিন কফি বানাতে বলে। তার কথা মতো রান্না ঘরে গেলে সে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিৎ করে ফেলে দেয়। পরে হাতে কামড় দিয়ে ছাড়া পান। কিন্তু পরক্ষণে আবারো একই কাজ করে। তখন হাতে থাকা গ্যাস লাইট দিয়ে তার পাঞ্জাবিতে আগুন ধরিয়ে দিই। পরে নিজেই তা নিভিয়ে ঘরের দরজার বাইরে থেকে সিটকিনি দিয়ে পালিয়ে আসি। পরে এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় সেইফ হোমে যাই। সেখান থেকেই দেশে ফিরেছি। তিনি বলেন, আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই। তার বাড়ি থেকেও কেউ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। রোবাবর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে থাকা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের মিডিয়া কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন একাধিকবার ফোন করেও তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাননি। তার স্বামীও তাকে নিতে চাননি। এই অবস্থায় রাতভর তিনি বিমানবন্দরেই কাটান। পরে ব্র্যাকের সহযোগিতায় তাকে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের শেল্টার হোমে পাঠানো হয়। হবিগঞ্জের এই নারীসহ বিমানবন্দরে প্রত্যেকে তাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। এদিকে বিভিন্ন সময় ফিরে আসা নারীদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ তথ্য জানা গেছে। রেশমা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী বলেন, তিনি যে বাড়িতে কাজ করতেন সেই বাড়িন গৃহকর্তা ও তার ছেলে দু’জনেই যৌন নির্যাতন চালাতো। পরে পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। আকলিমা (ছদ্মনাম) জানান, তাকে সৌদি নিয়ে যাওয়ার পর জেদ্দার যে বাড়িতে রাখা হয়, সেখানে শুধু ১০-১২ জন পুরুষ ছিল। তারা তার ওপর অমানাবিক নির্যাতন চালাতো। আনোয়ারা নামের একজন জানান, শারীরিক নির্যাতন শেষে তাকে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়া হয়। ফলে পা ভেঙে যায়। সে জানায়, প্রথমে পালানোর সময় ধরা পড়ে। এরপর থেকেই তার ওপর চলতে থাকে নির্যাতন। বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার এক নারী জানান, গত বছর জুন মাসে সৌদি আরব যান তিনি। সেখানে ছয় মাস নিয়োগকর্তা ও তার ছেলের যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন দূতাবাসে। মুন্সীগঞ্জের এক নারী জড়ায়ুতে ইনফেকশন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ফরিদপুরের অপর এক নারীর হাতের হাড় ভেঙ্গে অন্য স্থান দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ১০ মাস অবস্থান কালে আট মাসের বেতন ছাড়াই ২৬ জন নারীর সঙ্গে তিনিও ফিরেছেন।
সৌদির গৃহকর্মীর বর্তমান অবস্থা ও এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গত ২-৩ মাসে তারা ১১৮ পরিবারের কাছ নির্যাতেনের অভিযোগ পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ব্র্যাকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ৭১ জনকে ফেরত আনা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে যখন বিভিন্ন দেশ সৌদি আরবে তাদের নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়, তখন বাংলাদেশের নারী কর্মীর চাহিদা তৈরি হয়। ওই সময় নির্যাতনের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছিল। তারা (সৌদি) সে সময় নির্যাতিত হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যারা ফেরত আসছে তারা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং দিনকে দিন এ সমস্যা বাড়ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমরা তাদেরকে (সৌদির নিয়োগকর্তা) কিছুই বলছি না। এতে করে তারা ভেবে নিয়েছে- বাংলাদেশের নারীদের যা ইচ্ছা তাই করা যায়। এমনকি সেইফ হোমে নির্যাতিত যেসব নারীরা আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই নিয়োগ কর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শরিফুল হাসান আরো বলেন, আমরা শুধু সংখ্যার বিচার করছি। কিন্তু কতজন নির্যাতিত হচ্ছে, কতজন ফেরত আসছে, সে হিসাব আমাদের কাছে নেই। শুধুমাত্র যারা ফেরত আসছে তাদের কাছ থেকেই ঘটনাগুলো জানতে পারছি। তিনি বলেন, সংখ্যা না দেখে, তাদের সেফটির বিষয়টি ভাবা উচিত। তিনি আরো বলেন, যেসব নারীরা ফেরত আসছে তারাও ভালো নেই। অনেকে ট্রমাটাইজড্ হয়ে যাচ্ছে। এই অভিবাসী অধিকার কর্মী বলেন, এখন সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার- সেখানে আমরা নারী কর্মী পাঠাবো, না কি পাঠাবো না। অন্য দেশে পাঠালেও সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে নতুন করে ভাবা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
No comments