বিএনপির বিদেশনীতি: বদলে যাচ্ছে ভারতবিরোধী অবস্থান by সালমান তারেক শাকিল
প্রতিবেশী
রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে শুধু ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক’ সম্পর্ক না রেখে
দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীল সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহী বিএনপি। এক্ষেত্রে বৈদেশিক
নীতিতে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ‘সর্বজনীন নীতি’ গ্রহণের পরিকল্পনা
রয়েছে। একইসঙ্গে ‘প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী’ প্রচার থাকলেও ভেতরে-ভেতরে এই
অবস্থান পাল্টাতে শুরু করেছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র নেতাদের একটি ক্ষুদ্র
অংশ ‘যেনতেনভাবে’ ভারতকে বুঝিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চিন্তা করলেও বড় অংশটি
চায় এই ‘ফেনোমেনা’ থেকে বেরিয়ে যেতে। বিশেষ করে, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের
স্বার্থগত সংঘর্ষের বিষয়টি মাথায় রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্য চায়
বিএনপি। দলটির আগামী দিনের বিদেশনীতি সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে এ বিষয়টি
জানা গেছে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিএনপির পররাষ্ট্র উইং কাজে নেমেছে। বিশেষ করে, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে কেন্দ্র করে জোরদার হয়েছে দলটির বিদেশনীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়া। উইংয়ের দায়িত্বশীল ও বিগত দিনে দলটির বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে থাকা সম্পর্ক বিচার-বিশ্লেষণ করে এ বিষয়গুলো উঠে আসে। দলীয়ভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের দিকটি দেখভাল করার দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এই উইংয়ে কাজ করছেন ব্যবসায়ী নেতা, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল।
কূটনৈতিক উইংয়ে একটি অংশ বলছে, এই বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ভারতের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে বিএনপি। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের ভারত সফর, প্রতিবেশী দেশটির বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনগুলোও আমলে নিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব আমলে নিয়ে প্রয়োজনে বিএনপি তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটি আমাদের প্রতিবেশী কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।’ যিনি ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র খালাসের সময় বিএনপি-জোট সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। ওই মামলায় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর দণ্ডিত হয়েছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বিএনপির কাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের বিষয়টি গত কয়েক বছরে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৬ সালের জাতীয় কাউন্সিল, ভিশন ২০৩০ ঘোষণা ও কারাবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যেও উঠে আসে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মাটিকে কোনোভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না—এমন ভাষ্যও দলটি দিয়ে এসেছে। ‘ভিশন ২০৩০’-এর পররাষ্ট্রনীতি’র একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি অন্য কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও অন্য কোনও রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে না।’ মূলত ২০১২ সালের শেষদিকে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপির সরে আসার ইঙ্গিত মেলে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর ভারত সফর করেন চেয়ারপারসন। ওই সফরে তিনি তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, বিরোধীদলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই, জাতীয় নিরপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকেও বিএনপি চেয়ারপারসন বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে না দেওয়ার কথা বলেছিলেন।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেননি খালেদা জিয়া। জামায়াতের হরতালের কারণে তিনি সাক্ষাৎ করতে যাননি।
কূটনৈতিক উইংয়ের সূত্র বলছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ভারতকে সন্তুষ্ট করা না গেলেও ‘রাগানোর’ বিপক্ষে। এর প্রতিফলন ঘটেছে গত মার্চের শেষ দিকে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বিএনপির তরফে চীনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এর সমাধান চেয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। দলের কূটনৈতিক উইংয়ের এই পরিকল্পনা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন লন্ডন প্রবাসে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ভারতকে কোনোভাবেই চটানো যাবে না, এ মর্মে রোহিঙ্গা-সমাধানে প্রস্তাব থেকে বিরত রয়েছে বিএনপি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপির কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, ‘ভারতবিরোধী কোনও স্ট্যান্ড নেই। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কথাই বলা হচ্ছে। কংগ্রেস ক্ষমতাকালে ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, তার থেকে এখন কিছুটা ভিন্ন। তবে কতটুকু পরিমাণ, সে হিসাব করা শক্ত। পাবলিকলি তারা বলে যে আমরা তাদের প্রতিবেশী।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি হয়তো টের পেয়েছে যে ভারতের সহায়তা ছাড়া আমরা (বিএনপি) জিততে পারবে না। অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন হবে না। আওয়ামী লীগের মতো ভারত তাদের (বিএনপিকে) তেমন পছন্দ করে না।’
জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, বাণিজ্য প্রসার, পানিবণ্টন প্রক্রিয়া, ট্রানজিট চুক্তিগুলোর বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেবে বিএনপি। এই সম্পর্কগুলোকে কো-অপারেশনের ভিত্তিতে টলারেবল জায়গা নিয়ে যাওয়ার পক্ষে বিএনপি। আর এই সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুধু নির্বাচনকেই বেছে নেবে না দলটি। দলটির ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনও ভারতকে বুঝিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করলেও শীর্ষমহল ও তরুণরা এই সম্পর্কে অনাগ্রহী।
বিএনপি চায় আগামীতে ভারত সীমান্তে স্থায়ীভাবে মানুষহত্যা বন্ধ করুক। দেশটিকে এই মানসিকতা দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে হবে বলে মনে করে দলটি।
ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়েও বিএনপির অভ্যন্তরে কোনও আপত্তি নেই। এক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড় দেওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দেবে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, চায়না থেকে মাত্র ৭/৮ ঘণ্টায় মালামাল আনতে ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। আর এ কারণে ভারতকে ট্রানজিট দিতে বিএনপি নেতৃত্বের কোনও বাধা নেই।
তিস্তাচুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সম্পর্কে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘তিস্তা, ট্রানজিট, এগুলো আরও অন্য বিষয়গুলো টেবিলের ওপর থাকবে। এগুলো সমাধান করতে হবে। সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে এসব বিষয়ের সমাধান করা দরকার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।’
দলীয় কূটনৈতিক উইং বলছে, ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ার পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে ঢাকার স্বার্থগত সম্পর্ক বেশি। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যান্য ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো তাদের পার্শ্ববর্তী বড় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এক ধরনের ‘ভালোবাসা-ঘৃণা’র সম্পর্ক রয়েছে। এই বিবেচনায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কও একই বৃত্তাবদ্ধ। এছাড়া দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দিকটি বিবেচ্য হয়ে আসছে। এ কারণেই বিএনপির ফরেইন উইংয়ের একটি শক্তিশালী পক্ষ চায়, বাংলাদেশ-ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা পক্ষের সঙ্গে না হোক। উভয় দেশের জনগণ ও সরকারের সঙ্গে কেবল সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক থাকবে, কোনও গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়। এটা হচ্ছে সত্যিকার সম্পর্ক। এটাই হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক। অন্য সব সম্পর্ক যেগুলো হয়, সেগুলো আন্ডার দ্য টেবিল। এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সম্পর্ক আরও ক্ষতি করে।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘ভারতের কোনও একটি পক্ষ যদি সেদিকে যায়, তাহলে সেটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে। কারণ, সম্পর্ক হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক। এখানে কোনও বিশেষ গ্রুপ বা দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক হলে বাংলাদেশের মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে।’
কূটনৈতিক উইংয়ের সূত্রটির ভাষ্য, উপমহাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্র বিদেশি রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে বহুদলীয় ঐক্য স্থাপন করেছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও মায়ানমার—এই রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সম্পর্ক সমন্বয় করছে। এদিক থেকে বিএনপিও আগামী নির্বাচনের আগে প্রত্যেকটি প্রতিবেশী দেশকে কনভিন্স করতে চায় নতুন এই অবস্থান সম্পর্কে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘বিদেশিরা স্বার্থহীন কোনও সম্পর্ক গড়ে তোলে না। কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে যেকোনও সরকারের বেলায় ‘জাতীয় পলিসি’ এক থাকে। আমাদের এখানে এক দল আরেক দলকে পর্যুদস্ত করতে চায়। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’’
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিএনপির পররাষ্ট্র উইং কাজে নেমেছে। বিশেষ করে, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে কেন্দ্র করে জোরদার হয়েছে দলটির বিদেশনীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়া। উইংয়ের দায়িত্বশীল ও বিগত দিনে দলটির বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে থাকা সম্পর্ক বিচার-বিশ্লেষণ করে এ বিষয়গুলো উঠে আসে। দলীয়ভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের দিকটি দেখভাল করার দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এই উইংয়ে কাজ করছেন ব্যবসায়ী নেতা, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল।
কূটনৈতিক উইংয়ে একটি অংশ বলছে, এই বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ভারতের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে বিএনপি। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের ভারত সফর, প্রতিবেশী দেশটির বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনগুলোও আমলে নিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব আমলে নিয়ে প্রয়োজনে বিএনপি তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটি আমাদের প্রতিবেশী কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।’ যিনি ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র খালাসের সময় বিএনপি-জোট সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। ওই মামলায় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর দণ্ডিত হয়েছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বিএনপির কাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের বিষয়টি গত কয়েক বছরে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৬ সালের জাতীয় কাউন্সিল, ভিশন ২০৩০ ঘোষণা ও কারাবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যেও উঠে আসে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মাটিকে কোনোভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না—এমন ভাষ্যও দলটি দিয়ে এসেছে। ‘ভিশন ২০৩০’-এর পররাষ্ট্রনীতি’র একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি অন্য কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও অন্য কোনও রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে না।’ মূলত ২০১২ সালের শেষদিকে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপির সরে আসার ইঙ্গিত মেলে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর ভারত সফর করেন চেয়ারপারসন। ওই সফরে তিনি তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, বিরোধীদলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই, জাতীয় নিরপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকেও বিএনপি চেয়ারপারসন বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে না দেওয়ার কথা বলেছিলেন।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেননি খালেদা জিয়া। জামায়াতের হরতালের কারণে তিনি সাক্ষাৎ করতে যাননি।
কূটনৈতিক উইংয়ের সূত্র বলছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ভারতকে সন্তুষ্ট করা না গেলেও ‘রাগানোর’ বিপক্ষে। এর প্রতিফলন ঘটেছে গত মার্চের শেষ দিকে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বিএনপির তরফে চীনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এর সমাধান চেয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। দলের কূটনৈতিক উইংয়ের এই পরিকল্পনা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন লন্ডন প্রবাসে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ভারতকে কোনোভাবেই চটানো যাবে না, এ মর্মে রোহিঙ্গা-সমাধানে প্রস্তাব থেকে বিরত রয়েছে বিএনপি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপির কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, ‘ভারতবিরোধী কোনও স্ট্যান্ড নেই। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কথাই বলা হচ্ছে। কংগ্রেস ক্ষমতাকালে ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, তার থেকে এখন কিছুটা ভিন্ন। তবে কতটুকু পরিমাণ, সে হিসাব করা শক্ত। পাবলিকলি তারা বলে যে আমরা তাদের প্রতিবেশী।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি হয়তো টের পেয়েছে যে ভারতের সহায়তা ছাড়া আমরা (বিএনপি) জিততে পারবে না। অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন হবে না। আওয়ামী লীগের মতো ভারত তাদের (বিএনপিকে) তেমন পছন্দ করে না।’
জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, বাণিজ্য প্রসার, পানিবণ্টন প্রক্রিয়া, ট্রানজিট চুক্তিগুলোর বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেবে বিএনপি। এই সম্পর্কগুলোকে কো-অপারেশনের ভিত্তিতে টলারেবল জায়গা নিয়ে যাওয়ার পক্ষে বিএনপি। আর এই সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুধু নির্বাচনকেই বেছে নেবে না দলটি। দলটির ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনও ভারতকে বুঝিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করলেও শীর্ষমহল ও তরুণরা এই সম্পর্কে অনাগ্রহী।
বিএনপি চায় আগামীতে ভারত সীমান্তে স্থায়ীভাবে মানুষহত্যা বন্ধ করুক। দেশটিকে এই মানসিকতা দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে হবে বলে মনে করে দলটি।
ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়েও বিএনপির অভ্যন্তরে কোনও আপত্তি নেই। এক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড় দেওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দেবে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, চায়না থেকে মাত্র ৭/৮ ঘণ্টায় মালামাল আনতে ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। আর এ কারণে ভারতকে ট্রানজিট দিতে বিএনপি নেতৃত্বের কোনও বাধা নেই।
তিস্তাচুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সম্পর্কে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘তিস্তা, ট্রানজিট, এগুলো আরও অন্য বিষয়গুলো টেবিলের ওপর থাকবে। এগুলো সমাধান করতে হবে। সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে এসব বিষয়ের সমাধান করা দরকার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।’
দলীয় কূটনৈতিক উইং বলছে, ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ার পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে ঢাকার স্বার্থগত সম্পর্ক বেশি। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যান্য ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো তাদের পার্শ্ববর্তী বড় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এক ধরনের ‘ভালোবাসা-ঘৃণা’র সম্পর্ক রয়েছে। এই বিবেচনায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কও একই বৃত্তাবদ্ধ। এছাড়া দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দিকটি বিবেচ্য হয়ে আসছে। এ কারণেই বিএনপির ফরেইন উইংয়ের একটি শক্তিশালী পক্ষ চায়, বাংলাদেশ-ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা পক্ষের সঙ্গে না হোক। উভয় দেশের জনগণ ও সরকারের সঙ্গে কেবল সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক থাকবে, কোনও গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়। এটা হচ্ছে সত্যিকার সম্পর্ক। এটাই হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক। অন্য সব সম্পর্ক যেগুলো হয়, সেগুলো আন্ডার দ্য টেবিল। এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সম্পর্ক আরও ক্ষতি করে।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘ভারতের কোনও একটি পক্ষ যদি সেদিকে যায়, তাহলে সেটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে। কারণ, সম্পর্ক হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক। এখানে কোনও বিশেষ গ্রুপ বা দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক হলে বাংলাদেশের মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে।’
কূটনৈতিক উইংয়ের সূত্রটির ভাষ্য, উপমহাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্র বিদেশি রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে বহুদলীয় ঐক্য স্থাপন করেছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও মায়ানমার—এই রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সম্পর্ক সমন্বয় করছে। এদিক থেকে বিএনপিও আগামী নির্বাচনের আগে প্রত্যেকটি প্রতিবেশী দেশকে কনভিন্স করতে চায় নতুন এই অবস্থান সম্পর্কে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘বিদেশিরা স্বার্থহীন কোনও সম্পর্ক গড়ে তোলে না। কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে যেকোনও সরকারের বেলায় ‘জাতীয় পলিসি’ এক থাকে। আমাদের এখানে এক দল আরেক দলকে পর্যুদস্ত করতে চায়। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’’
No comments