শিল্পাচর্য জয়নুল আবেদিন : তাঁর সমাজ চেতনা
সমাজে
সচেতন মানুষ যারা তারা সাধারণত মানবতাবাদী হন। কারণ সমাজে বসবাসকারী
মানুষদের সাতে তারা গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একান্ত আপন করে নেন তাদেরকে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদনি এমনই একজন সমাজ চেতন এবং মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন।
যিনি একবার জয়নুলের সান্বিধ্যে গেছেন তিনিই মনে করেছেন জয়নুল তাকেই সবচেয়ে
বেশি ভালোবাসেন। তাকেই তিনি বেশি করে আপন করে নিয়েছেন। ফলে সকলেই ভেবেছেন
মানুষকে আপন করে নেবার জাদুকরি ক্ষমতা আছে জয়নুলের মাঝে। জাদুকরি ক্ষমতার
অধিকারী জয়নুলের ব্যবহার ও আচরণে মানবতাবাদের আদর্শ লক্ষ্য করে মানুষ
অভিভূত হয়েছে। গভীর শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন। অনেকেরই জানা মানবতা হচ্ছে- সমাজ ও
সমাজের মানুষের প্রতি দৃষ্টি দেয়া। বিশ্ব তথা বিশ্বের মানব জাতির গুরুত্ব
এবং আদর্শকে তুলে ধরা। প্রকৃতিগতভাবে সমাজে এবং বিশ্বে মানুষের স্থান কোথায়
তা নির্ধারণ করাই হচ্ছে মানবতাবাদের প্রধান লক্ষ্য। প্রধান লক্ষ্য মানুষের
মূল্য ও তার মর্যাদাকে নিরূপণ করা এবং তাকে যথাযথ মূল্য ও সম্মান দেওয়াও।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার সমগ্রজীবন সমাজ এবং সমাজের মানুষদের উন্নয়নের
লক্ষ্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
তিনি বলেছেন- ‘সমগ্র মানব জাতির জন্য সুন্দর
জীবন নির্মাণ করাই হচ্ছে শিল্পকলার মৌল উদ্দেশ্য। জীবনে সুন্দরের
প্রতিষ্ঠায় যে শক্তি বিরোধিতা করে, তাকে চিহ্নিত করাও এর লক্ষ্য। যে ছবি
মানুষকে সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে পারে,সেটাই হচ্ছে মহৎ ছবি। যে শিল্পী তা
পারেন তিনি মহৎ শিল্পী। আমার সারা জীবনের শিল্প-সাধনা ও শিল্প আন্দোলন আমার
জীবনকে এবং আমাদের সবার জীবনকে সেই সুন্দরের দিকে নিয়ে যাবার আন্দোলন’ (এ,
সাত্তার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পৃ. ১১)। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
কতটা সমাজ সচেতন এবং মানবতাবাদী শিল্পী ছিলেন তা উল্লিখিত তার বক্তব্য থেকে
স্পষ্ট। মানবতাবাদী ও সমাজ সচেতন শিল্পী, মানব দরদি শিল্পী জয়নুল আবেদিন
কোথাও মানবতার অবমাননা লক্ষ করলে রঙ-তুলি-কাগজ নিয়ে সেখানে ছুটে যেতেন। মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন এবং
প্রতিবাদ জানাতেন সেসব মানবতা বিরোধী বিষয়ের চিত্র এঁকে প্রদর্শনীর
মাধ্যমে। ১৯৪২-৪৩ সালে সমগ্র বাংলা জুড়ে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তা ছিল এক
শ্রেণী অর্থলোভী ক্ষমতাসীন মানুষেরই সৃষ্টি।
এই দুর্ভিক্ষের কারণে মানবতার
যে চরম অবমাননা জয়নুল লক্ষ করেছিলেন তার প্রতিবাদ তিনি করেছিলেন তার বলিষ্ঠ
তুলি ও কালির মাধ্যমে। অর্থাৎ তার সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের রেখাঞ্চলের মাধ্যমে।
আমাদের সমাজে দুঃখ এবং ক্ষতচিহ্ন অবলোকন করে শিল্পাচার্য যে সমস্ত
দুঃখ-বেদনা এবং প্রবঞ্চনার দহন থেকে মানব সত্তাকে, মানুষের মর্যাদাকে,
মূল্যবোধকে রক্ষা করতে সদা তৎপর ছিলেন। তার চিত্রাঙ্কনের উদ্দেশ্য ছিল দেশ,
সমাজ ও সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য। তিনি তার চিত্রের মাধ্যমে দেশের
মানুষকে, দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তিনি নিজে যেমন দেশ, দেশের মানুষকে
ভালোবাসতেন, তেমনি দেশের সকল স্তরের মানুষকে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে
উদ্বুদ্ধ মকরতেন। আর এ জন্যই দেশের কোথাও কোনো কারণে দেশের মানুষ
ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দেশের মানুষকে অবমূল্যায়নের কোনো কারণ ঘটলে তিনি সেখানে
ছুটে যেতেন। মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা রঙ-তুলির মাধ্যমে তুলে ধরতেন
দেশ বিদেশের মানুষের সামনে। ১৯৭৪ দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ
করলে জয়নুল আবারও অখণ্ড ভারতের ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের চিত্রের মত বাংলাদেশের
দুর্ভিক্ষের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। জয়নুল অঙ্কিত এ চিত্রও কলকাতায় অঙ্কিত
চিত্রের অনুরূপ।
কালো কালির সাহায্যে ব্রাশের বা তুলির ক্ষীপ্র টানে অভুক্ত
হাড্ডিসার মা তার হাড্ডিসার মৃতপ্রায় সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় বসে রয়েছে,
এমন একটি বিষয়কে তুলে ধরবার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষেরঅবর্ণনীয়
দৃশ্যকে ক্যানভাসে আবদ্ধ করে সে সময়কার দুর্ভিক্ষের কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে
দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই ১৯৭০ সালে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ
‘মনপুরা’র কথা ভুলে যায়নি। এ সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলে
প্রাকৃতিক বিপর্যয় জলোচ্ছ্বাসের বিভীষিকাময় ছোবলে কয়েক লাখ উপকূলবাসী প্রাণ
হারায়। মারা যায় অসংখ্য গবাদিপশু ও জীবজন্ত। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ
জীব মানুষের, জীবজন্তু ও অন্যান্য পশুর মৃতদেহ গাদাগাদি হয়ে পড়ে থাকতে
দেখা যায়। সে এক হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী দৃশ্য। সমগ্র দেশের মানুষ এ খবরে
বেদনাহত হয়েছিল। শিল্পী জয়নুলের হৃদয় নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠলো।
মনপুরা বিপর্যয়ে মানুষ ও পশুর গাদা গাদা মৃতদেহ যেন জয়নুলকে কলকাতায়
দুর্ভিক্ষের সময়কার হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। জয়নুল আবারও
রচনা করলেন বাংলার মানুষের করুণ ইতিহাস। তিনি ২৯ ফুট দীর্ঘ স্ক্রোল
চিত্রের মাধ্যমে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের করুণ ছবি আঁকলেন।
জয়নুলের তুলির
শক্তিশালী রেখায় আবদ্ধ হয় বাংলাদেশের চির অবহেলিত মানুষদের মৃতদেহ।
চিত্রের সর্বত্র মানুষ আর জীবজন্তুর গাদাগাদা মৃতদেহ। মৃত লাশের
ধ্বংসস্তূপের শেষ প্রান্তে উপবিষ্ট বিধ্বস্ত এক জীবন্ত মানুষের উপস্থিতি সে
সময়কার জীবন-মৃত্যুর রহস্য স্পষ্ট করেছে। ১৯৭০ সালে আঁকা শিল্পাচার্যের আর
একটি দীর্ঘ স্ক্রোল চিত্রের নাম নবান্ন। নবান্ন গ্রাম বাংলার সাধারণ
মানুষের প্রাণের উৎসব। এ চিত্র না হলে বাংলার মানুষের আচার অনুষ্ঠান,
পৌষ-পার্বণ ও নাইয়রের কথা আজকের এবং ভবিষ্যতের মানুষদের কাছে অজানাই থেকে
যেত। ১৯৫০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ নবান্ন চিত্রে শিল্পী বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক
শ্রেণীর সুখ-দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কৃষকের ধান বোনা, ধান কাটা, ধান
বহন করে বাড়ি নেয়া, ধান মাড়ানো, নতুন ধানের চাল প্রস্তুত প্রক্রিয়া, নবান্ন
উৎসব এবং উৎসব শেষে নিঃস্ব হয়ে আবার অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে পরিবার পরিজন
নিয়ে বেরিয়ে পড়া, এগুলোই হচ্ছে চিত্রের বিষয়।
অখণ্ড ভারতের কলকাতায় যখন
শিক্ষা উপলক্ষে জয়নুল অবস্থান করেছেন তখন ব্রিটিশদের অত্যাচার, জমিদার এবং
কৃষক শ্রেণীর বৈপরীত্য, ব্রিটিশ এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভারত
ভাগের প্রক্রিয়া, হিন্দু-মুসলমানদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত প্রভৃতি বিষয় জয়নুলকে
আলোড়িত এবং চিন্তিত করে। আর এ সকল বিষয় জয়নুলকে মানবতাবাদী এবং সমাজ সচেতন
হতে সাহায্য করে। জয়নুলকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী বিচলিত করেছিল সেটি হচ্ছে-
মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ। দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত। ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের
সময় জয়নুল এ সব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন। উপরে বর্ণিত
তথ্যচিত্র, পাকিস্তান সৃষ্টির পরের অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের
যুদ্ধবিগ্রহজনিত অশান্ত পরিবেশ জয়নুলকে সর্বদাই অশান্ত করে রেখেছিল। ফলে
তাকে সবসময় তার শানিত তুলি-তরবারির সাহায্যে যুদ্ধে নিয়োজিত থাকতে হয়েছে।
একের পর এক রচনা করেছেন বিপন্ন মানুষের ইতিহাস। সে ইতিহাস বাংলার ইতিহাস।
ইসরায়েল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত ফিলিস্তিনিদের
যুদ্ধের ইতিহাস (১৯৭০) সহ আরব রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস। এমন জনদরদী, সমাজ
সচেতন ও মানবতাবাদী শিল্পী বিশ্বে বিরল। তার সংগ্রামী চেতনা সমৃদ্ধ সফল
শিল্পকর্মের জন্য বারবার তাকে আমাদের স্মরণ করতে হয়। স্মরণ করতে হয়। স্মরণ
করতে এবং স্মরণ করাতে হয় এ জন্য যে, আমরা যেন তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে
সমাজের, দেশের সকল অনাচার ও অন্যায় দূর করতে একতাবদ্ধ হতে পারি। যেন সমাজের
অবহেলিত, নির্যাতিত এবং বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। প্রতিবাদ
করতে পারি
No comments