১০০ বছর পেরিয়ে চর্যাপদ : নির্যাতিত কবির নীরব বিদ্রোহ
চর্যাপদ আবিষ্কারের একশত বছর নিঃশব্দেই
পার হয়ে গেল। ১৯০৭ সালে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে
‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়; শিরোনামের পুঁথি উদ্ধার করে রীতিমত সাহিত্যিক
গবেষকদের মাঝে হইচই ফেলে দেন। বিশ্লেষিত হয় চর্যাপদের প্রতিটি অক্ষর। ড.
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, বিধূশেখর শাস্ত্রী,
মণীন্দ্রমোহন বসু প্রমুখ পণ্ডিতদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় এ কথাই প্রমাণিত হয়
নেপালে আবিষ্কৃত ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ পুঁথির মাঝেই লুকিয়ে আছে বাংলা
ভাষার অক্ষর এবং বাংলা সাহিত্য। অনুমিত হয় বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে বিভিন্ন
সময়ে বৌদ্ধভিক্ষু, সহযানি মতবাদে দীক্ষিত সিদ্ধাচার্য্যরো এ পদগুলো রচনা
করেছিলেন। চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৪ জন এবং তাদের রচিত চর্যা টীকার সংখ্যা
৫১টি আবিষ্কৃত হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন চর্যাপদের রচনাকাল
(৬৫০ খৃ:-১১০০ খৃ:।) চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিতদের মধ্যে
মতবিরোধ থাকলেও চর্যাপদ বিশ্লেষণে এ পদগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে সম্যক একটি
ধারণায় আসা যায়। এছাড়া এ ধারণাও অমূলক নয় যে চর্যাপদের কবিদের অবস্থান
একস্থানে ছিল না বৃহৎ বাংলার বিভিন্ন বিহারে বিভিন্ন সময়ে বা কালে
বৌদ্ধভিক্ষু সিদ্ধাচার্য্যরা এ দোঁহাগুলো রচনা করেছিলেন। সুতরাং নির্দিষ্ট
একটি সময়কে ছকে ফেলে চর্যাপদের রচনাকাল নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
এরা যে সবাই
বাঙালি ছিলেন তাও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। চর্যাপদের কবি ভুসুকু বঙ্গাল নিজে
বাঙালি কবি হিসেবে স্বীকার করেছেন তার রচিত চর্যাপদে। কালের মানদণ্ডে
বিচার করতে হলে এবং পণ্ডিতদের গবেষণায় একথাই স্বীকার্য্য বৌদ্ধ ধর্মের
ক্ষয়িষ্ণু কালেই এ পদগুলো রচিত হয়েছিল। নির্বাণে দেহসিদ্ধি ও গুরুভক্তির
মাধ্যমে জাগতিক লোভ লালসাকে ঠেলে দিয়ে এবং ইহলৌকিক জগতে নর-নারীর নিগূঢ়
প্রেমের মাধ্যমেই যে নির্বাণের পথ সুগম হয়। সে কথাটিই বৌদ্ধধর্মের সহযানি
ভিক্ষুরা তাদের পদের রচনার মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। নিঃসন্দেহে সে
পদগুলো ছিল বাংলার আদি অক্ষর নিংড়ানো পদ্যাকারে ছড়ানো কথামালা। বৌদ্ধ
দোঁহা, বৌদ্ধ প্রার্থনা সঙ্গীত যাই বলি না কেন, এ দোঁহার পেছনে বাঙালির
আবহমান লৌকিক জীবনের আনুুসঙ্গিক উপকরণাদির পাশাপাশি এক নীরব, কঠিন,
প্রতিবাদ, দ্রোহের ভাষা লুকিয়ে আছে তাকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই। পাল
আমলে বৃহৎ বাংলায় নালন্দা বিহার, শালবন বিহার, ভাসু বিহার, বিক্রমশীলা
বিহার, পাহাড়পুর বিহারের মতো এশিয়ার যে সুউচ্চ এবং উচ্চমার্গের
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল এবং সে শিক্ষালয়ে দেশী বিদেশী হাজার হাজার
শিক্ষার্থী এ সমস্ত বৌদ্ধ বিহারগুলোতে অধ্যায়নে ব্যাপৃত ছিল। এমন কি সুদূর
চীন থেকে হিউএনসাঙ বৃহৎ বাংলার বিহারগুলোতে এসেছিলেন, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের
দিকে এ বিহারগুলোর তখন ছিল যৌবনকাল। কিন্তু ইতিহাসের ঘটনা থেমে থাকেনি।
পালদের ক্ষমতা শেষ হবার পরপরই দাক্ষিণাত্যের সেনরা যখন ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে
এল বাংলায় তখনই ইতিহাসের ঘটনা দ্রুত আবর্তিত হয়েছিল। তখনকার সময়ে
বৌদ্ধতন্ত্র বাংলায় সেনেরা ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠলো। শুরু
হলো বৌদ্ধভিক্ষুদের সাথে সেন ব্রাহ্মণ্যবাদের গৃহযুদ্ধ। এ রক্তক্ষয়ী
গৃহযুদ্ধে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা হলো চরমভাবে কোণঠাসা। নির্যাতিত, নিপীড়িত বৌদ্ধ
ভিক্ষু, সিদ্ধাচার্য্যদের হত্যা, নির্বাসনে পাঠানো হলো। তপ, যপ, মন্ত্রে
ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা হয়ে উঠলো রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এশিয়ার সুউচ্চতম
বৌদ্ধ বিহারগুলো রাতারাতি হয়ে গেল শিক্ষার্থীশূন্য। এক সময়ের অধ্যায়নরত
হাজার হাজার দেশী-বিদেশী ছাত্রদের কলগুঞ্জনে যে শিক্ষালয়গুলো হীনযান,
মহাযান, তন্ত্রযান, শূন্যযানের নিগূঢ় তত্ত্বের ব্যাখ্যায় মশগুল থাকতো সে
শিক্ষালয়গুলো ব্রাহ্মণ্যবাদের নিগৃহে পরিণত হলো পরিত্যক্ত ভুতুড়ে এক জনবিরল
আতঙ্কিত আশ্রমে। কয়েক যুগের, শত বছরের ব্যবধানে বিহারগুলো হয়ে উঠলো গভীর
জঙ্গলাকীর্ণ। হিংস্র জন্তু এবং হিংস্র শ্বাপদের লীলাভূমিতে পরিণত হলো
এশিয়ার বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহারগুলো।
ড. নীহারঞ্জন রায় তাঁর ‘বাংলার ইতিহাস আদি
পর্বে’ উল্লেখ করেছেন। ব্রাহ্মণদের দেয়া হলো গ্রামের পর গ্রাম,
নিষ্করভূমি, রাজপুরোহিত হয়ে রাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়লো ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধ
সিদ্ধাচার্য এবং ভিক্ষুরা হলো নির্বাসিত। প্রাণের ভয়ে পালালো সিদ্ধাচার্যরা
তিব্বতে, আরাকানে, নেপালে, চীনে। পণ্ডিতদের ধারণা ‘চর্যাপদের’ পুঁথি
নেপালে প্রাপ্তির কারণ এটাই প্রাণভয়ে ভীত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা নেপালে আশ্রয়
নেবার সময় চর্যাপদের পুঁথি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। জাতপাতের সংগ্রাম,
উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের সংগ্রাম, ব্রাহ্মণদের নিগ্রহ, এমনকি শবরী বালিকাদের
যৌন অত্যাচার, লুণ্ঠন, ডাকাতি, কামাচারের সে সময়ের দুঃসহ ছবি এবং তার নীরব
প্রতিবাদ চর্যাপদের দোঁহার অন্তর্নিহিত বিষয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বৌদ্ধদের
গৃহযুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে সর্বশ্বান্ত হয়েছিল তার প্রমাণ। ‘টালত মোর ঘর
নাহি পড়বেশী। হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।’ (বস্তিতে আমার ঘর। কোনো
প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ প্রতিদিনই প্রেমিকের ভিড়) নিরন্ন
মানুষের ঘরে যেখানে ভাত নেই। সেখানে কামাতুর লোকের আগমন। এ সমস্ত কিসের
সঙ্কেত।
অসহায় সর্বহারা নির্যাতিত মানুষেরা তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
চর্যাপদের কবি বলেন- ‘কাহেরি যিনি মেলি অচ্ছহ কীসু বেটিল হাক পড়া চৌদিস’
(কাকে নিয়ে কাকে ছেড়ে কিভাবে যে আছি আমার চারপাশে ঘিরে তাক হাঁক পড়েছে)
কাকে নিয়ে কাকে ছেড়ে, কার ছায়ায়, অবলম্বনে মানুষ নিরাপদ আশ্রয় পাবে! এ
কিসের হাঁক, ণ্ডঙ্কার, একী মহাসেন, সামন্ত ব্রাহ্মণদের হাঁকডাক, ণ্ডঙ্কার!
চর্যাপদের কবির পয়ারে তাইতো বোঝা যায়। শুধু ধর্ম বিভাজন নয় ঘর গেরস্থালীতে
হামলা, নির্যাতনও চর্যাপদের দোঁহায় ফুটে উঠেছে। গৃহযুদ্ধের নির্মমতায়
সর্বস্বান্ত এক গ্রাম্যবধূর কথা ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ পুঁথিতে বর্ণিত আছে।
অঝোর ধারায় ছনের ঘরে ছাপিয়ে বৃষ্টি ঝরছে, বৃষ্টিতে আকীর্ণ উঠোনে ব্যাঙ,
সাপ, ডাকছে। গৃহিণী তাঁর চ্ছিন্ন কাঁথা সেলাই করার জন্যে সুঁচ খুঁজছে।
কিন্তু কোথায় পাবে সুঁচ, ঘরে এক মুষ্ঠি চাল বাড়ন্ত।’ চর্যাপদের কবিরা
প্রান্তিকজনের কবি ছিলেন নিঃসন্দেহে। এ প্রান্তিকজনের কবিরা কলমযুদ্ধে
নেমেছিলেন মহাসামন্তদের বিরুদ্ধে যেমন ‘নিতে নিতে ষিআলা ষিহে যম জুমহ’
শেয়ালের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীও (প্রজা) সিংহের (রাজার) সাথে আসম যুদ্ধে টিকে
থাকার জানবাজি সংগ্রামে লিপ্ত আছে। সে সময়ের কামাতুর সামন্তদের যৌন লিপ্সাও
ছিল প্রবল ‘আলো ডোম্বি তো এ সম করিবে ম সাঙ’ এই ডোম্বী সমাজের চোখে এমন
একজন জীব যাকে বিয়ে করতে চাইলে সমাজকে কঠিনতম অবজ্ঞা দেখানো সম্ভব হবে।
উচ্চবর্ণের কী স্পর্ধা, কী জাত্যাভিমান, অহংকার, জঘন্য কামাতুর দৃষ্টি।
উচ্চবর্ণের পাপাচারের বিরুদ্ধে এই যে বিদ্রোহ, বৌদ্ধদের দোঁহায় ও সাহিত্যে
তা অনন্যসাধারণ ভূমিকা নিয়ে এসেছিল।
মুণ্ডিত ব্রাহ্মণদের নিয়ে চর্যাপদে
প্রক্যাশ্য ব্যঙ্গও ছিল ‘ছইছোই যাই সো ব্রাহ্ম নড়িয়া।’ উচ্চশ্রেণীর
আড়ম্বরতা তাদের রাজকীয় জীবনযাপন তার বিপরীতে অসহায়ত দরিদ্র সহায় সম্বলহীন
মানুষের একমুঠো ভাতের জন্যে আর্তনাদ, ধর্মাচার বনাম ধর্মকে আশ্রয় করে
উৎপীড়ন নির্যাতন চর্যাপদের দোঁহায় নিভৃতভাবে ফুটে উঠেছে। ‘ভাবন ছোই অভাব
না জাই’ যারা দরিদ্র নিপীড়িত মানুষ তাদের কোনো ভাব হয় না এবং তাদের অভাবও
বিদূরিত হয় না। নির্যাতিত কবিরা নির্বাসিত হয়েছেন। আধুনিক বিশ্বেও তার
প্রমাণ আছে ভূরি ভূরি। স্বৈরশাসনের, একনায়কের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গিয়ে
কবি লেখকরা হন নির্যাতিত নিষ্পেষিত। নির্যাতিত কবিরা লাঞ্ছিত হন, অপহৃত হন
কখনো মৃত্যুও বরণ করেন। চর্যাপদের কবি ভুসুকু বঙ্গাল লিখেছেন- ‘বাজ নাব
দাড়ী পাউয়া খালে বাহিউ’/অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ॥
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী
ভইনী/নিঅ ঘরিনী চণ্ডালে নেনী॥ ডহিঅ পাঞ্চ পাটন ইন্দি বিসআ নঠা।/ন জানামি
চিঅ ঘোর কহি গই পইঠা।/সোন অ রূপ মোর ফিস্পিন থাকিউ’/চউকোড়ি ভণ্ডার মোর লইয়া
সেস।/জীবন্তে মইলে নাহি বিশেশ॥’ (অনুবাদ) পথ খাল বেয়ে বজরা নৌকা পাড়ি দিয়ে
যাচ্ছে। বাংলাদেশ লুণ্ঠিত হয়ে গেল। আজ ভুসুকু বাঙালি হয়ে গেল। নিজের
স্ত্রীকে চণ্ডালে নিয়ে গেছে। পঞ্চপাটন হলো দগ্ধ। নষ্টপ হলো ইন্দ্রিয় বিষয়।
না জানি আমার মন কোথায় গিয়ে প্রবেশ করে। আমার সোনা ও রুপা কিছুই থাকলো না।
নিজ পরিবারেই মহাসুখে থাকলাম। চারকোণা বিশিষ্টই আমার ভাণ্ডার শেষ করে দিল।
জীবিত অথবা মৃত এ দুটোর মাঝে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না।
চর্যাপদের
কবি ভুসুকু নিজকে বাঙালি কবি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তার এ চর্যাপদ সে
সময়ের অত্যাচারিত সমাজ ব্যবস্থার এক দুঃসহ চিত্রই প্রকাশ করে। সে সময়ের
সামন্ত, মহাসামন্তদের দ্বারা অত্যাচারিত ভুসুকু কি নৌকা পাড়ি দিয়ে
দেশান্তরী হচ্ছেন? বঙ্গাল দেশ লুণ্ঠনের কথা বলেছেন, নিশ্চয়ই সেই
লুণ্ঠনের সীমা কোনো পাড়া, মহল্লা ব্যাপি ছিল না। সম্ভবত ভুসুকু যা
দেখেছিলেন তা সর্বত্রই ছিল অত্যাচারের, নির্যাতন, লুণ্ঠনের এক ভয়াবহ নির্মম
স্বাক্ষর। ভুসুকু হয়তোবা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কিন্তু তার প্রিয়তমা
স্ত্রীর পরিণতি ছিল হৃদয়বিদারক। কামাতুর মহাসামন্ত, ব্রাহ্মণেরা ভুসুকের
শুধু সোনা রুপাই লুট করেনি তার স্ত্রীকেও অপহরণ করেছে। নিজ পরিবার নিয়ে
ভুসুকু মহাসুখেই ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে তার ঘরবাড়ী,
পঞ্চপাটন দগ্ধ হয়েছিল। সম্ভবত আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছিল,
হতভাগ্য, বিস্মিত, আতঙ্কিত ভুসুকুর, অস্থীর মন এখন কোথায় গিয়ে ঠাঁই নেবে,
ভুসুকু আজ তা বলতে পারে না। সে জীবিত কিংবা মৃত তার কোনো পার্থক্যই ভুসুকুম
বুঝতে পারে না।
এক দিকে জীবন রক্ষা করার সংগ্রাম অন্য দিকে ভাতের সংগ্রাম,
কী দুঃসহ শ্রেণী সংগ্রামকে বুকে চেপে চর্যাপদের কবিদের সময় পার হতে হয়েছে।
চর্যাপদের কবি টেণ্ডনপাদের কবিতায় এভাবেই বিধৃত হয়েছে শ্রেণী সংগ্রাম এবং
মুষ্ঠিবদ্ধ এক মুঠো ভাতের হাহাকার। ‘টলত মোর ঘর নাহি পর বেসী। হাঁড়ীত ভাত
নাহি নিতি আবেশী॥ বৈঙ্গস সাপ চড়িল জাই দুহিল দুধু কি বেন্টে সামাই॥ বলদ
বিআনে গবিআ বাঁঝে। পীঢ়া দুহিআই এ তীনি সাঝে॥ জো সো বুধী সোহি নিবুধি। জো সো
চোর সোহি সাধী॥ নিতি নিতি সিআলা সিহে সম জুঝই টেণ্ডন পা এর গীত বিরলে
বুঝই॥ অনুবাদ
বস্তিতে আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই কিন্তু মেহমান প্রতিদিনই
আসছে। ব্যাঙ দেখছি সাপকে আক্রমণ করছে। দোয়ানো দুধ কী বাঁটে ফেরানো সম্ভব?
বলদ প্রসব করল অথচ গাই বাঁঝা, পাত্র ভরে দোয়ানো হলো তিন সন্ধ্যা। যে
বুদ্ধিমান দেখছি, সেই হচ্ছে নির্বোধ, যে চোর সেই সাধু হয়ে বসে আছে।
প্রতিদিনই শেয়াল সিংহের সাথে যুদ্ধ করছে। টেণ্ডন পাদের গীত খুব লোকেই বুঝতে
পারে। হাঁড়িতে ভাত নেই কিন্তু নিতিনিত্য এ মেহমান কারা?
এ মেহমান কী
কামাতুর উচ্চবর্ণের লোকজন? ব্যাঙ কখনো সাপকে আক্রমণ করে না তাহলে কি
অত্যাচারিত মানুষ কি উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে লড়েছিল, দোহানো দুধ
যেমন বাঁটে প্রবেশ করানো সম্ভব নয় ঠিক তেমনি বলদেরও বাচ্চা প্রসব করা
কল্পনার অতীত। এক অসম অস্থীর সমাজচিত্রই টেণ্ডনপাদ তার এ কবিতায় তুলে
ধরেছেন। যেখানে চোর সাধু সেজে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে থাকে যেখানে
শৃগালের সাথে সিংহের নিত্য লড়াই চলে সে সমাজ এক ভয়ঙ্কর অস্থিতীশীল সমাজ,
নিয়ম কানুনের বেড়াজাল ভেঙে যেখানে দুর্বৃত্তদের সমাজ ব্যবস্থার একটি দেশের
কি হতে পারে কবি টেণ্ডনপাদ হয়তো ব্যাঙাত্মক বিশ্লেষণে তা যথার্থই তুলে
এনেছেন। সহস্রাধিক বছর পেরোনো চর্যাপদের কবিদের নীরব আর্তনাদ ইতিহাসের বাঁক
বদলের মোহনায় তা কি হারিয়ে গেছে?
No comments