অলস রুটি ও একটি সড়কের গল্প
আব্বার
ওপর মেজাজ খারাপ হয়ে যায় প্রায়ই। ইদানীং বারবার বলার পরও তিনি মনে রাখতে
পারেন না যে ছুটির দিন একটু দেরি করে ঘুম ভাঙে। কাজেই অন্তত নয়টার আগে ফোন
দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু আব্বা তা একেবারেই মনে রাখেন না। ছোটখাটো বিষয়
যেমন ঠাণ্ডা কাশি জ্বরজারি হলেও ফোন দিয়ে পাগল বানিয়ে রাখেন ছেলেকে। নিজেও
কষ্ট করেন আবার ছেলে নজরুল মুনশির মেজাজও টঙ করে রাখেন। এমনিতে প্রচণ্ড
গরম। তার ওপর বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা তো সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়। আর ওই
যে গান বাদ্য। গানের শব্দে ঘুমানো তো দায়, তার চেয়ে বড়ো কথা হলো হিন্দি
গানের মিউজিক আর সব রক গানের বিকট শব্দে রাতের ঘুম হারাম মহল্লার সবার
কিন্তু এর প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারো। কোন পোড়া কপাল নিয়ে যে নজরুল মুনশি
কবরের পাশে বাসা নিয়েছিল। কবরের পাশে সিটি করপোরেশনের কমিউনিটি সেন্টার।
ওখানে প্রায়ই বিয়ে খতনা জন্ম বার্ষিকীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ছোটখাটো আলোচনা ও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে গান বাজনা না হলে যেন পাপ হবে এটা
মনে করেই চলে ধুম ধারাক্কা। পাশেই কবর। কবরে শুয়ে আছেন পীর আওলিয়া
মুক্তিযোদ্ধার মতো অনেক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা।
তারাও রাতে ঘুমাতে পারেন না
‘লুঙ্গি ডান্সের’ মতো হিন্দি গানের শব্দে।ভয়ে ভয়ে কমিশনারকে বলেও কাজ হয়নি।
মসজিদে ওয়াজ করানো হলো- তাতেও বন্ধ হয়নি এখন উলঙ্গ নৃত্য ও গানের আকাশ
ফাটানো শব্দতরঙ্গ। শেষ পর্যন্ত নজরুল মুনশি নিজেই ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা
করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় এই নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। আজব ব্যাপার,
দুই দিন পরই ওখানে ছোট্ট নোটিশ বোর্ড টানানো : রাত দশটার পর এখানে কোনো
অনুষ্ঠান, গান বাজনা নিষিদ্ধ। নোটিশ দাতার জন্য দোয়া করে সে, যেন মৃত্যুর
পর আল্লাহ নোটিশ দানকারীকে জান্নাত দান করেন। আসলে এই কার্যক্রমটি ছোট্ট
শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য এবং সর্বোপরি অসুস্থ মানুষগুলো জন্য বন্ধ হওয়া
অতীব প্রয়োজন ছিল। ধন্যবাদ সিটি করপোরেশনকে। অনেক বছর পর হলেও অন্তত একটি
নোটিশ ঝুলেছে এখানে। অন্তত কিছুটা হলেও নির্যাতনের পথ বন্ধ হলো। ফোন পেয়ে
ধড়মড় করে ওঠে সে। আব্বা রেগে যান। বলেন- তোমাকে সেই সকাল থাইকা ফোন দিতাছি।
ধরো না কেন?
-আমি ঘুমাইছিলাম।
-অত বেলা পর্যন্ত ঘুমাইবা না। শরীর নষ্ট কইরো না। বেলা কইরা ঘুমাইলে শয়তানে শরীর টিপে। শরীরের অসুখ বান্দে।
-আব্বা আজকেতো ছুটির দিন।
-তো কি অইলো। দিন তো দিনই। শনি মঙ্গল সকল রাইত এক নিয়মে চলে। আমারে দেখছো এই আশি বছর বয়সে কোনো অনিয়ম করতে?
তর্ক না করে সে বলে- আচ্ছা বলেন কেন ফোন দিছেন?
-বাড়ির পাশের রাস্তার কাম শুরু অইবো।
-খুব ভালো সংবাদ। জন্মের পর থাইকা শুনতেছি সড়ক অইবো। এ বছর হেই বছর করতে করতে চল্লিশ বছর হইলো। তো আব্বা এই খরবটা আরেকটু পরে দিলে কী হইতো?
-শোন বেশি খুশির সংবাদ মনে কইরো না। টেকা লাগবো দশ হাজার। নজরুল ওঠে বিছানায় বসে। এবার সত্যি ঘুম কেটে যায় পুরোপুরি। বলে- টেকা লাগবো ক্যান?
সরকারি রাস্তা, টেকা লাগবো ক্যান আব্বা?
-তা ও লাগবো। এলাকার নেতারা আইছিল। বলছে মাটি দেন নাইলে টেকা দেন।
-অ বুঝছি। তাইলে ঠিক আছে, নেতাগো বিরুদ্ধে যাইয়েন না। ওনারা বলছে টেকা দিমু। আপনে চিন্তা কইরেন না। ওল্টাপাল্টা কিছু বইলেন না আব্বা, ঝামেলা করবো।
-ঠিক আছে টেকা পাঠাইয়া দিও। নাইলে বাড়িতে আইসো। রাখি।
দুই. নজরুল মুনশি ওঠে হাতমুখ ধুয়ে নিউজ পেপারে নজর দেয়। কুমিল্লায় তনু নামের এক যুবতী হত্যার খবর বেরিয়েছে। লোমহর্ষক কাহিনী। মনকে সান্ত্বনা দেয়- থাক, প্রতিদিনই পড়ছি হত্যা ধর্ষণ ছিনতাই আর রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক কাজের ফিরিস্তি। হতে থাকুক আরো ঘটুক এসব, ঘটতে ঘটতে আমরা আরো নিঃশেষ হয়ে যাই। তার পর হয়তো একটা রেভ্যুলেশন আসবে। আসুক-নতুন আরেক ধারা চালু হোক এ দেশে। খুব দরকার পরিবর্তন। সে সন্তানদের খোঁজ নেয়। ওরা পড়াশোনায় ব্যস্ত। ভালো লাগল। আব্বার কাছ থেকে বাড়ির খবর শোনার পর সন্তানদের এ দৃশ্যটিও সত্যি তাকে সুখী করে। আসলে সুখ তো সন্তান পরিবার নিয়েই। চার পাশে কী হচ্ছে আজকাল কে অত খবর রাখে? তার পর রান্না ঘরে উঁকি মারে। শাশুড়ি আম্মা তার অলস রুটি বানানো নিয়ে ব্যস্ত। আম্মার এই রুটি বানানো পদ্ধতিটি সে বেশ এনজয় করে। গত মাস থেকে পারমানেন্ট হাউজ সেক্রেটারি পারমানেন্টলি বিদায় নিয়েছে।
-আমি ঘুমাইছিলাম।
-অত বেলা পর্যন্ত ঘুমাইবা না। শরীর নষ্ট কইরো না। বেলা কইরা ঘুমাইলে শয়তানে শরীর টিপে। শরীরের অসুখ বান্দে।
-আব্বা আজকেতো ছুটির দিন।
-তো কি অইলো। দিন তো দিনই। শনি মঙ্গল সকল রাইত এক নিয়মে চলে। আমারে দেখছো এই আশি বছর বয়সে কোনো অনিয়ম করতে?
তর্ক না করে সে বলে- আচ্ছা বলেন কেন ফোন দিছেন?
-বাড়ির পাশের রাস্তার কাম শুরু অইবো।
-খুব ভালো সংবাদ। জন্মের পর থাইকা শুনতেছি সড়ক অইবো। এ বছর হেই বছর করতে করতে চল্লিশ বছর হইলো। তো আব্বা এই খরবটা আরেকটু পরে দিলে কী হইতো?
-শোন বেশি খুশির সংবাদ মনে কইরো না। টেকা লাগবো দশ হাজার। নজরুল ওঠে বিছানায় বসে। এবার সত্যি ঘুম কেটে যায় পুরোপুরি। বলে- টেকা লাগবো ক্যান?
সরকারি রাস্তা, টেকা লাগবো ক্যান আব্বা?
-তা ও লাগবো। এলাকার নেতারা আইছিল। বলছে মাটি দেন নাইলে টেকা দেন।
-অ বুঝছি। তাইলে ঠিক আছে, নেতাগো বিরুদ্ধে যাইয়েন না। ওনারা বলছে টেকা দিমু। আপনে চিন্তা কইরেন না। ওল্টাপাল্টা কিছু বইলেন না আব্বা, ঝামেলা করবো।
-ঠিক আছে টেকা পাঠাইয়া দিও। নাইলে বাড়িতে আইসো। রাখি।
দুই. নজরুল মুনশি ওঠে হাতমুখ ধুয়ে নিউজ পেপারে নজর দেয়। কুমিল্লায় তনু নামের এক যুবতী হত্যার খবর বেরিয়েছে। লোমহর্ষক কাহিনী। মনকে সান্ত্বনা দেয়- থাক, প্রতিদিনই পড়ছি হত্যা ধর্ষণ ছিনতাই আর রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক কাজের ফিরিস্তি। হতে থাকুক আরো ঘটুক এসব, ঘটতে ঘটতে আমরা আরো নিঃশেষ হয়ে যাই। তার পর হয়তো একটা রেভ্যুলেশন আসবে। আসুক-নতুন আরেক ধারা চালু হোক এ দেশে। খুব দরকার পরিবর্তন। সে সন্তানদের খোঁজ নেয়। ওরা পড়াশোনায় ব্যস্ত। ভালো লাগল। আব্বার কাছ থেকে বাড়ির খবর শোনার পর সন্তানদের এ দৃশ্যটিও সত্যি তাকে সুখী করে। আসলে সুখ তো সন্তান পরিবার নিয়েই। চার পাশে কী হচ্ছে আজকাল কে অত খবর রাখে? তার পর রান্না ঘরে উঁকি মারে। শাশুড়ি আম্মা তার অলস রুটি বানানো নিয়ে ব্যস্ত। আম্মার এই রুটি বানানো পদ্ধতিটি সে বেশ এনজয় করে। গত মাস থেকে পারমানেন্ট হাউজ সেক্রেটারি পারমানেন্টলি বিদায় নিয়েছে।
মেয়েটি চলে যাবার
পর সংসারের ভেতর অলসতার মাকড়সা জাল বুনে। এক সময় খাবার টেবিলে রকমারি নাশতা
বা দুপুরের খাবারের দিকে তাকালে জিভে পানি এসে যেত। এখন আর সে রকম কিছুই
হয় না। এ ছাড়া দিন দিন জিনিসপত্রে চড়া দামের কারণে সংসারের অনেক প্রয়োজনকে
সঙ্কুচিত করে নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন নজরুল মুনশি ভাবে সংসারের ‘অতীব
প্রয়োজন’ কোন আইটেমটি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ বালি ভরা ভেজা বস্তার মতো
ভারী মনে হয় তার কাছে। অত বাড়তি খরচে তাই আগের মতো মাছ মুরগি ফল ফলাদি
বা আয়েশ শখের হিসাবগুলো সংক্ষেপ করতে হয়েছে। তার ওপর মেয়েটি নেই, কে অত
কষ্ট করে রুটি পরোটা বানিয়ে টেবিলে রাখবে? কে অত ফল বা সবজি-ডিম তৈরি করে
ডেকে উঠবে- নাশতা রেডি...। জীবনের অলসতার সাথে নতুন এই অলস রুটি যোগ করে
আম্মা টেবিলে দিয়ে বললেন- দেখো খাইতে পারো কি না। নজরুল এক পলক তাকিয়ে
খাবার মুখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বলে- আম্মা আমার জন্য খুবই ভালো।
ক’দিন বাজারের ব্রেড খেয়ে ব্লাড সুগার বেড়ে গেছে। থ্যাংকস আম্মা।
কিন্তু এই
অলস রুটির নিয়মটা বলেন আম্মা। মুখে হাসি যোগ করে আম্মা বলেন- একদম সোজা।
তুমিও পারবা। আটা পানিতে গুইলা শুধু তাওয়ায় সেক্বা। -বলেন কী আম্মা? অতো
সোজা? তাইলে আপনারা না থাকলেও আমি নিজে কইরাই খাইতে পারমু। নাশতা সেরে
স্ত্রীকে আব্বার ইনফরমেশনটি শোনায়। কথা শোনে নাজমা মহাখুশি। -বলো কী? যাক
অনেক বছর হলো গাড়ি নিয়ে বাড়ি যেতে পারি না। এবার উঠোনে গাড়ি ঢুকবে। আহ্ কত
শান্তি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়–য়া তাদের মেয়ে আদিবা এ খবরে মায়ের গা জড়িয়ে ঢঙ
করে বলে- আম্মু আমরা কবে দাদুর বাড়ি যাচ্ছি?
-যাবো। মাসখানেক লাগবে হয়তো রাস্তা শেষ করতে। মাটি শক্ত হতে আরো এক মাস। ওকে, তোমাদের সামার ভেকেশনে যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি।
তিন. অফিসে নিজের রুমে নজরুল মুনশি। আজ একটু কাজ হালকা। পাশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির বৃক্ষ বাগানে চিত্রা হরিণগুলো পায়চারী করছে। একেবারে রুমের পাশেই ওরা এসে গেছে। গুনে গুনে দেখে এগারোটি। বাচ্চা হরিণ। উপরে গাছের ডালে বড় বড় চিল ও অন্যান্য ক’টি পাখি বসে আছে। গেল সপ্তাহের ঝড়ে একটি গাছের ডাল ভেঙে গেছে। অদূরে ক’টি গাছে হলুদ ফুল ফুটেছে। এই বৃক্ষটির নাম জানে না সে। নাম জানা উচিত ছিল। নজরুল অনেক কিছুই জানে না। অনেক কম জানে। এ বিষয়টি স্ত্রী এবং ইংলিশ ভার্সনে পড়–য়া মেয়েটিও প্রমাণ করেছে। অথচ সে ভাবে কম জানাই শ্রেয়। প্রচণ্ড গরম আজ। টেম্পারেচার হয়তো চল্লিশ হতে পারে। ঘেমে যাচ্ছে। পিয়ন চায়ের কাপ নিয়ে গেল। ওর পেছনের অংশ চোখে পড়ে। ভাবে-ও কেমন আছে? ওর ক’টি বাচ্চা কোনো দিন প্রশ্ন করেনি। ওর বাড়ি কোথায় জানতে চায়নি। আসলে আমরা কেমন হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। নাহ এটা ঠিক হলো না। অধীনস্থদের খোঁজ নিতে হয় মাঝে মধ্যে। কালকে ওকে দুই শ’ টাকা দিয়ে বলব শিশুদের জন্য কিছু নিয়ে যেতে। আব্বাকে টাকা পাঠাবে নাকি কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি যাবে তা ভাবছে। প্রবলেম যে একা যেতে ভালো লাগে না। ছোট ভাইকে সাথে নেবে। ওকে জানানোর জন্য মোবাইল হাতে নিতেই মেয়ের স্কুল থেকে মোবাইলে মেসেজ আসে আগামী জুলাই পর্যন্ত সব বকেয়া বেতন ও গাড়ি ভাড়া পরিশোধ করে এডমিট কার্ড নিতে হবে। কষ্ট হলো ভাবতে। ওপরে ফ্যান ঠিকমতো চলছে কি না একবার খেয়াল করে নজরুল মুনশি।
চার. ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি আসে। আব্বার হাতে টাকা দিয়ে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখে। দখিনের পুকুরে মাছ আছে কি না জানে না। পশ্চিমের পুকুরে ছোট ভাই রীতিমতো মাছ চাষ করে। রশি ঘরের ওপর জাম্বুরা গাছ নজর পড়ে। জাম্বুরা ঝুলে আছে ক’টি-যেন দেখভাল করার কেউ নেই, অনাদরে অবহেলায় বিমর্ষ। আমগাছে বেশ আম আছে- ঝড় হলে বিপদ। কাঁঠালে ভরে আছে গাছগুলো। তার মন ভালো হয়। আব্বা-আম্মার জন্য মায়া হয়। এ বাড়ির পেছনে তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম জড়ানো। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে তার। তাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বাড়িটির একটি নিউ প্ল্যান করে মনে মনে। আব্বা টাকা দেয়ার জন্য ওই নেতাকে মোবাইল করে- আমার ছেলে আসছে, টেকা নিয়া যান। ছেলে চইলা যাইবো। একটু তাড়াতাড়ি আইসেন। কাউছার আসার আগেই আব্বার সাথে একটা শর্ট কাউন্সিলিং করে নজরুল। বলে- আমি তো নেতার সামনে যামু না। নেতারে ঘরে ডাইকেন না। ওই গোপাটে থাইক্কা টেকা দিয়েন। আমার ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই। আব্বা ছেলের ভেতরের ভাব বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু বলেন না।
-যাবো। মাসখানেক লাগবে হয়তো রাস্তা শেষ করতে। মাটি শক্ত হতে আরো এক মাস। ওকে, তোমাদের সামার ভেকেশনে যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি।
তিন. অফিসে নিজের রুমে নজরুল মুনশি। আজ একটু কাজ হালকা। পাশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির বৃক্ষ বাগানে চিত্রা হরিণগুলো পায়চারী করছে। একেবারে রুমের পাশেই ওরা এসে গেছে। গুনে গুনে দেখে এগারোটি। বাচ্চা হরিণ। উপরে গাছের ডালে বড় বড় চিল ও অন্যান্য ক’টি পাখি বসে আছে। গেল সপ্তাহের ঝড়ে একটি গাছের ডাল ভেঙে গেছে। অদূরে ক’টি গাছে হলুদ ফুল ফুটেছে। এই বৃক্ষটির নাম জানে না সে। নাম জানা উচিত ছিল। নজরুল অনেক কিছুই জানে না। অনেক কম জানে। এ বিষয়টি স্ত্রী এবং ইংলিশ ভার্সনে পড়–য়া মেয়েটিও প্রমাণ করেছে। অথচ সে ভাবে কম জানাই শ্রেয়। প্রচণ্ড গরম আজ। টেম্পারেচার হয়তো চল্লিশ হতে পারে। ঘেমে যাচ্ছে। পিয়ন চায়ের কাপ নিয়ে গেল। ওর পেছনের অংশ চোখে পড়ে। ভাবে-ও কেমন আছে? ওর ক’টি বাচ্চা কোনো দিন প্রশ্ন করেনি। ওর বাড়ি কোথায় জানতে চায়নি। আসলে আমরা কেমন হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। নাহ এটা ঠিক হলো না। অধীনস্থদের খোঁজ নিতে হয় মাঝে মধ্যে। কালকে ওকে দুই শ’ টাকা দিয়ে বলব শিশুদের জন্য কিছু নিয়ে যেতে। আব্বাকে টাকা পাঠাবে নাকি কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি যাবে তা ভাবছে। প্রবলেম যে একা যেতে ভালো লাগে না। ছোট ভাইকে সাথে নেবে। ওকে জানানোর জন্য মোবাইল হাতে নিতেই মেয়ের স্কুল থেকে মোবাইলে মেসেজ আসে আগামী জুলাই পর্যন্ত সব বকেয়া বেতন ও গাড়ি ভাড়া পরিশোধ করে এডমিট কার্ড নিতে হবে। কষ্ট হলো ভাবতে। ওপরে ফ্যান ঠিকমতো চলছে কি না একবার খেয়াল করে নজরুল মুনশি।
চার. ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি আসে। আব্বার হাতে টাকা দিয়ে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখে। দখিনের পুকুরে মাছ আছে কি না জানে না। পশ্চিমের পুকুরে ছোট ভাই রীতিমতো মাছ চাষ করে। রশি ঘরের ওপর জাম্বুরা গাছ নজর পড়ে। জাম্বুরা ঝুলে আছে ক’টি-যেন দেখভাল করার কেউ নেই, অনাদরে অবহেলায় বিমর্ষ। আমগাছে বেশ আম আছে- ঝড় হলে বিপদ। কাঁঠালে ভরে আছে গাছগুলো। তার মন ভালো হয়। আব্বা-আম্মার জন্য মায়া হয়। এ বাড়ির পেছনে তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম জড়ানো। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে তার। তাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বাড়িটির একটি নিউ প্ল্যান করে মনে মনে। আব্বা টাকা দেয়ার জন্য ওই নেতাকে মোবাইল করে- আমার ছেলে আসছে, টেকা নিয়া যান। ছেলে চইলা যাইবো। একটু তাড়াতাড়ি আইসেন। কাউছার আসার আগেই আব্বার সাথে একটা শর্ট কাউন্সিলিং করে নজরুল। বলে- আমি তো নেতার সামনে যামু না। নেতারে ঘরে ডাইকেন না। ওই গোপাটে থাইক্কা টেকা দিয়েন। আমার ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই। আব্বা ছেলের ভেতরের ভাব বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু বলেন না।
টেকা
নিয়া উঠোনের দখিন পাশে পায়চারী করেন। বললে হয়তো তিনি কাউছারকে নিয়ে উঠোনে
চেয়ার পেতে বসতেন, গালগপ্প করতেন কিছু সময়। কিন্তু নজরুলের ওসব ভালো লাগে
না। এমনিতে নিজের অভাব ঢেকে রেখে দান দক্ষিণা দিচ্ছে বলে মেজাজ খারাপ। তার
ওপর আবার ঘুষখোরকে নিয়ে মোজ করা? কাউছার ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বাড়ির ভেতরে কিছু
দেখার চেষ্টা করে। ও অনেকটা বেটে এবং চেহারা কালো বিকৃত। মুখমণ্ডল বীভৎস
আকার বললে অতিরিক্ত বলা হবে না। এই লোকটি এলাকার বিগ লিডার। সবাই তাকে ভয়
বা সমীহ করে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকেই এক দমকা বাতাস এসে ঘরে
ঢুকে। পচা দুর্গন্ধ, কোনো পশু মরার গন্ধ। সাধারণত গ্রামে কুকুর বিড়াল মরে
গেলে এ রকম দুর্গন্ধ আসে। মনে হলো এই গন্ধ কাউছারের গায়ের গন্ধ। নজরুলের
চোখে নাকে নেতার চেহারা ও গায়ের গন্ধ ভাসে। তার দম নিতে কষ্ট হয়।
No comments