সংবাদপত্রের অবদমিত স্বাধীনতা by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
আজকের
পৃথিবীতে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এবং এর
অগণিত দর্শক-পাঠক নবতর গুরুত্বের মূল কারণ। তথ্যপ্রযুক্তির বৈপ্লবিক
সম্প্রসারণের কারণে রাজনীতিতেও এর জোরালো প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে।
গণমাধ্যমের ব্যাপক উপস্থিতি পুলিশের চেয়েও শক্তিধর প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং
‘রাজা রাজ্য রাজধানী’তে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের প্রতি নজর, নিয়ন্ত্রণ এবং
নির্মমতা প্রকট হয়ে উঠছে। একই সাথে গণমাধ্যমের বিকাশ এবং বিস্তৃতির সাথে
সাথে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে
পড়ছে। প্রতিনিয়ত সংবাদ অনুকূলে অথবা প্রতিকূলে প্রবাহিত হচ্ছে। ক্রমশ এগুলো
রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রক্ষমতা, দলতন্ত্র এবং বাণিজ্যতন্ত্র এর
মালিক মোক্তার রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক
‘গডফাদার’ এর মত ‘মিডিয়া ফাদার’দের ভীতিকর উদ্ভব পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক
সুবিধা হাসিলের বাহন হিসেবে নিত্য নতুন গণমাধ্যমের জন্ম হচ্ছে। নিজেদের
বাণিজ্যিক স্বার্থে এরা স্বৈরতন্ত্রের বাহন হিসেবে কাজ করছে। অপর দিকে
স্বাধীন গণমাধ্যম-সংবাদপত্র, চ্যানেল এবং স্বাধীন ব্যক্তিত্ব রাজনীতিক
নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র জগতে এমনই একজন স্বাধীন, অকুতোভয় আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন, দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ‘সময়ের সাহসী পুরুষ’ মাহমুদুর রহমান। তার সম্পাদিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে তিনি পাঠক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। দেশপ্রেম এবং জতীয় মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এই অর্জনের মধ্যদিয়ে তিনি তার জন্য শাসক বৈরিতা অনিবার্য করে তুলেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সাংবাদিক, রাজনীতি এবং সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে তার মুক্তির আন্দোলন জোরদার হলেও ক্রমশ সাংবাদিক বিভাজন এবং সরকারী বাধা বিপত্তির মখে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু জনমনে তার অবস্থান যে দুর্বল হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় জনগণের পক্ষ থেকে প্রকাশিত উদ্বেগ- উৎকণ্ঠায়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকপর্যায়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন অব্যাহতভাবে তার মুক্তির দাবি করে আসছে। গত সপ্তাহে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংগঠন তার মুক্তির দাবিটি পুনর্ব্যক্ত করে। এসব সংগঠন হচ্ছে The Observatory for the Protection of Human Rights Defenders, Asian Human Rights Commission Ges International Human Rights Watch.
এসব সংগঠনের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয় সরকার বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্যই তাকে আটক রেখেছে। তারা অনতিবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবি জানান। তার মুক্তির জন্য রাজনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। অথচ তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না সরকার ছলে বলে কলে কৌশলে তার মুক্তির প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করছে। যেখানে ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে সেখানে মাহমুদুর রহমানের মতো একজন আলোকিত মানুষের মুক্তি নিয়ে টালবাহানা করায় সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সরকার এ রকম একজন মানুষকে এতটা রাজনৈতিক গুরুত্ব দেয়ায় নাগরিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যখন তারস্বরে গণতন্ত্রের কথা বলছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলছে, তখন মাহমুদুর রহমানের মুক্তি তরান্বিত করে তারা সহনশীলতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।
আজকে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি বিবেচনা করা হয়। বহমান রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দানে গণমাধ্যম বা সংবাদপত্র অপ্রতিরুদ্ধ বিবেচনা করা হয়। নিকট অতীতে জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলার সংবাদপত্রের রাজনৈতিক গুরুত্ব যথার্থভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। তার প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘মেইন ক্যাম্প’ এর প্রমাণ। মাকর্সবাদীরা স্বাধীন সংবাদপত্রকে এতটাই শত্রুতা জ্ঞান করেন যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোনো গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের অস্তিত্ব তারা স্বীকার করেন না। বাংলাদেশে বাকশাল ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজস্ব স্টাইলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নাকচ করা হয় এবং শুধুমাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে সব ধরনের মতামত প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তাদের উত্তরসূরি ক্ষমতাসীন সরকারও গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করণের পথে বাধা মনে করে। পার্থক্য এই যে বাকশাল একটি নেতিবাচক আইনি ঘোষণার মাধ্যমে বেআইনি কাজটি করেছে, আর বর্তমান সরকার ইতিবাচক আইনি ঘোষণার মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দলন করছে। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো: নিজামুল হকের সাথে বিদেশী একজন পরামর্শকের সংলাপ প্রকাশ করা। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের সময় কোনো রূপ আইনানুগতা ব্যতিরেকে পুলিশ আমার দেশ পত্রিকা তছনছ করে, সংবাদিক এবং প্রেস কর্মচারীদের মারধর করে এবং অবশেষে আমার দেশ পত্রিকা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। সেই থেকে দৈনিক আমাদের দেশ কোনো রকম সরকারি বৈধ আদেশ ব্যতিরেকেই কার্যত বন্ধ রয়েছে।
মাহমুদুর রহমান গ্রেফতারের পর থেকে এ পযর্ন্ত (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) প্রায় ৩ বছর ধরে অবরুদ্ধ রয়েছেন। মাহমুদুর রহমান যে সরকারি নিপীড়ন নির্যাতনের নিকৃষ্ট শিকারে পরিণত হয়েছেন তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, যখন সম্পদের বিবরণী যথাসময়ে দাখিল না করার নামমাত্র অজুহাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট এই অপরাধে আদালত তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। এর আগে জনাব রহমান শাসকদলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হন। তার পত্রিকায় শাসকদলের শীর্ষ ব্যক্তিদের দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ করে। মাহমুদুর রহমান সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে বিচার বিভাগের শাস্তির সম্মুখীন হন। প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে আদালতের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে অভিযোগ পত্র দায়ের করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুল স্বীকার করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমান আত্মবিশ্বাস ও আত্¥মর্যাদায় এতটাই বলীয়ান যে তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন। ফলে তাকে কারাবরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে এ দেশে একরকম স্বেচ্ছায় কারাবরণের ইতিহাস বিরল। তাকে এভাবে অবদমিত করতে না পেরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা এবং মানহানির মামলা করা হয়। এ সময়ে ২০১০ সালের জুন মাসে তাকে হয়রানি, অপমান এবং নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আরেকবার কারাবরণ করতে হয়। তার বিরুদ্ধে ৭০টি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। এসব মামলার হাজিরা দিতে সপ্তাহে তাকে তিন-চারবার কাশিমপুর কারাগার থেকে পুরনো ঢাকার আদালতে যেতে হয়। অস্বাস্থ্যকর এবং অপমানজনক অবস্থায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে চার-পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। এ ধরনের যাতায়াত, বিভিন্নপর্যায়ে নিপীড়ন-নির্যাতন এবং নানাবিধ রোগে আক্রান্ত, ৬৩ বছর বয়সী এই মানুষটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়। প্রায় চার বছর হলো কাশিমপুর জেলে তিনি এভাবে জীবন অতিবাহিত করছেন।
ভয়ভীতি ব্যতীত একটি স্বাধীন পরিবেশে মতামত প্রকাশ, প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা বিশ্বব্যাপী অনুসৃত মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ব্যক্তির মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে অলঙ্ঘণীয় বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান সম্ভবত ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। এর তৃতীয় ভাগ জুড়ে আছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। অনুচ্ছেদ ৩৯ এর ২ (খ) ধারায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় সংবিধানের এত দৃঢ় রক্ষাকবচ সত্ত্বেও আমাদের সব শাসক গোষ্ঠী সংবাদপত্রের প্রতি খড়গহস্ত হয়েছে। শাসকদলের ক্ষেত্রে মাত্রাটা একটু বেশি। অবশ্য ২০০৭-০৮ সালের সামরিক সমর্থিত সরকারের সময়ে মাত্রাজ্ঞান ছিল না। এখন প্রকাশিত হচ্ছে কিভাবে কারণে অথবা অকারণে সংবাদপত্রগুলো সত্যতা নিরুপণের সুযোগ ছাড়াই মতামত প্রকাশ করতে হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক তার সদবিশ্বাসের কারণে ভুল স্বীকার করতে গিয়ে যে বিড়ম্বনার কারণ হয়েছেন তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য হতে পারে না। যে ভাষায় জাতীয় সংসদে তার নাম ধরে গালাগালি করা হয়েছে এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। মাহমুদুর রহমানের মতো তার নামেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা দেয়া হয়েছে। সরকারের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তির মুখে নরম সুর পরিলক্ষিত হলেও দেখা যাচ্ছে, ‘রাজা যা বলে পারিষদ বলে তার শতগুণ।’
স্বাধীন মতামত তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি আওয়ামী ঘরানার মনোভাব কখনই অনুকূল ছিল না। বাকশাল আমলে বাক স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। এই সময়টায় (২০০৯-১৬) তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। কার্যকাল ঘেঁটে দেখা যায় বিগত আট বছরে তারা গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের ওপর সবচেয়ে বেশি তলোয়ার চালিয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়ে তারা দৈনিক বাংলা এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ করে দেয়। এবার তারা একে একে বন্ধ করে চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি এবং দিগন্ত টিভি। তারা আমার জানা মতে সমঝে ছিল। তাদের ভয় ছিল সরকার যেকোনো সময় তাদের ওপর চড়াও হতে পারে। যে সময়ে এবং যে পরিস্থিতিতে চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় তা ছিল অপ্রয়োজনীয়। সরকারের একটি ধমক তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। দৈনিক আমার দেশের প্রসঙ্গটিতে আসা যাক। সংবাদপত্র পরিচালনার জন্য আইন আছে, বিধি নিষেধ আছে, আরো আছে সেন্সরশিপ। তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তান আমলের মতো সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও ‘স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ’ প্রত্যাশা করে- যে ব্যবস্থায় নিজ নিজ চ্যানেল বা সংবাদপত্রগুলো সরকারের মর্জিমাফিক চলাফেরা করে। সরকার এমনভাবে আমার দেশ পত্রিকাটি কৌশলে বন্ধ করে দিলো যাতে তারা আইনের আশ্রয় নেয়ারও সুযোগ পেল না। পুলিশের জোরে আমার দেশ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেল। স্রেফ গায়ের জোরে চ্যানেল দখলের ঘটনাও ঘটল। সরকার নিজের অজান্তে এসব ঘটনার মাধ্যমে অযথাই বদনাম কামিয়েছে। এত দিন গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলে বলে যারা মূখে খৈ ফুটিয়েছেন এখন তারা যখন সংবাদপত্রের দলনের জন্য খৈ ফোটাচ্ছেন তখন বলতে ইচ্ছা করে, ‘সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।’এ ধরনের মতাদর্শ কেন্দ্রিক একপেশে তথ্য ব্যবস্থাপনার ফলেই দেশ আজ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক নিচে নেমে গেছে।
গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্র একে অপরের পরিপূরক। মূলত এই দেশে, এই সময়ে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র গণতান্ত্রিক সমাজের শেষ আলোটুকু জালিয়ে রেখেছে। অতীতে বুদ্ধিজীবীরা সংবাদ পত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বলে গুরুত্ব দিয়েছেন। আজ তথ্য প্রযুক্তির এই জগতে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে অবনমিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হবে- সচেতন নাগরিক সাধারণের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
email: mal55ju@yahoo.com
বাংলাদেশে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র জগতে এমনই একজন স্বাধীন, অকুতোভয় আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন, দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ‘সময়ের সাহসী পুরুষ’ মাহমুদুর রহমান। তার সম্পাদিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে তিনি পাঠক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। দেশপ্রেম এবং জতীয় মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এই অর্জনের মধ্যদিয়ে তিনি তার জন্য শাসক বৈরিতা অনিবার্য করে তুলেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সাংবাদিক, রাজনীতি এবং সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে তার মুক্তির আন্দোলন জোরদার হলেও ক্রমশ সাংবাদিক বিভাজন এবং সরকারী বাধা বিপত্তির মখে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু জনমনে তার অবস্থান যে দুর্বল হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় জনগণের পক্ষ থেকে প্রকাশিত উদ্বেগ- উৎকণ্ঠায়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকপর্যায়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন অব্যাহতভাবে তার মুক্তির দাবি করে আসছে। গত সপ্তাহে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংগঠন তার মুক্তির দাবিটি পুনর্ব্যক্ত করে। এসব সংগঠন হচ্ছে The Observatory for the Protection of Human Rights Defenders, Asian Human Rights Commission Ges International Human Rights Watch.
এসব সংগঠনের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয় সরকার বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্যই তাকে আটক রেখেছে। তারা অনতিবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবি জানান। তার মুক্তির জন্য রাজনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। অথচ তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না সরকার ছলে বলে কলে কৌশলে তার মুক্তির প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করছে। যেখানে ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে সেখানে মাহমুদুর রহমানের মতো একজন আলোকিত মানুষের মুক্তি নিয়ে টালবাহানা করায় সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সরকার এ রকম একজন মানুষকে এতটা রাজনৈতিক গুরুত্ব দেয়ায় নাগরিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যখন তারস্বরে গণতন্ত্রের কথা বলছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলছে, তখন মাহমুদুর রহমানের মুক্তি তরান্বিত করে তারা সহনশীলতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।
আজকে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি বিবেচনা করা হয়। বহমান রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দানে গণমাধ্যম বা সংবাদপত্র অপ্রতিরুদ্ধ বিবেচনা করা হয়। নিকট অতীতে জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলার সংবাদপত্রের রাজনৈতিক গুরুত্ব যথার্থভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। তার প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘মেইন ক্যাম্প’ এর প্রমাণ। মাকর্সবাদীরা স্বাধীন সংবাদপত্রকে এতটাই শত্রুতা জ্ঞান করেন যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোনো গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের অস্তিত্ব তারা স্বীকার করেন না। বাংলাদেশে বাকশাল ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজস্ব স্টাইলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নাকচ করা হয় এবং শুধুমাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে সব ধরনের মতামত প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তাদের উত্তরসূরি ক্ষমতাসীন সরকারও গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করণের পথে বাধা মনে করে। পার্থক্য এই যে বাকশাল একটি নেতিবাচক আইনি ঘোষণার মাধ্যমে বেআইনি কাজটি করেছে, আর বর্তমান সরকার ইতিবাচক আইনি ঘোষণার মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দলন করছে। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো: নিজামুল হকের সাথে বিদেশী একজন পরামর্শকের সংলাপ প্রকাশ করা। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের সময় কোনো রূপ আইনানুগতা ব্যতিরেকে পুলিশ আমার দেশ পত্রিকা তছনছ করে, সংবাদিক এবং প্রেস কর্মচারীদের মারধর করে এবং অবশেষে আমার দেশ পত্রিকা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। সেই থেকে দৈনিক আমাদের দেশ কোনো রকম সরকারি বৈধ আদেশ ব্যতিরেকেই কার্যত বন্ধ রয়েছে।
মাহমুদুর রহমান গ্রেফতারের পর থেকে এ পযর্ন্ত (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) প্রায় ৩ বছর ধরে অবরুদ্ধ রয়েছেন। মাহমুদুর রহমান যে সরকারি নিপীড়ন নির্যাতনের নিকৃষ্ট শিকারে পরিণত হয়েছেন তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, যখন সম্পদের বিবরণী যথাসময়ে দাখিল না করার নামমাত্র অজুহাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট এই অপরাধে আদালত তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। এর আগে জনাব রহমান শাসকদলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হন। তার পত্রিকায় শাসকদলের শীর্ষ ব্যক্তিদের দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ করে। মাহমুদুর রহমান সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে বিচার বিভাগের শাস্তির সম্মুখীন হন। প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে আদালতের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে অভিযোগ পত্র দায়ের করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুল স্বীকার করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমান আত্মবিশ্বাস ও আত্¥মর্যাদায় এতটাই বলীয়ান যে তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন। ফলে তাকে কারাবরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে এ দেশে একরকম স্বেচ্ছায় কারাবরণের ইতিহাস বিরল। তাকে এভাবে অবদমিত করতে না পেরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা এবং মানহানির মামলা করা হয়। এ সময়ে ২০১০ সালের জুন মাসে তাকে হয়রানি, অপমান এবং নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আরেকবার কারাবরণ করতে হয়। তার বিরুদ্ধে ৭০টি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। এসব মামলার হাজিরা দিতে সপ্তাহে তাকে তিন-চারবার কাশিমপুর কারাগার থেকে পুরনো ঢাকার আদালতে যেতে হয়। অস্বাস্থ্যকর এবং অপমানজনক অবস্থায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে চার-পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। এ ধরনের যাতায়াত, বিভিন্নপর্যায়ে নিপীড়ন-নির্যাতন এবং নানাবিধ রোগে আক্রান্ত, ৬৩ বছর বয়সী এই মানুষটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়। প্রায় চার বছর হলো কাশিমপুর জেলে তিনি এভাবে জীবন অতিবাহিত করছেন।
ভয়ভীতি ব্যতীত একটি স্বাধীন পরিবেশে মতামত প্রকাশ, প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা বিশ্বব্যাপী অনুসৃত মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ব্যক্তির মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে অলঙ্ঘণীয় বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান সম্ভবত ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। এর তৃতীয় ভাগ জুড়ে আছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। অনুচ্ছেদ ৩৯ এর ২ (খ) ধারায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় সংবিধানের এত দৃঢ় রক্ষাকবচ সত্ত্বেও আমাদের সব শাসক গোষ্ঠী সংবাদপত্রের প্রতি খড়গহস্ত হয়েছে। শাসকদলের ক্ষেত্রে মাত্রাটা একটু বেশি। অবশ্য ২০০৭-০৮ সালের সামরিক সমর্থিত সরকারের সময়ে মাত্রাজ্ঞান ছিল না। এখন প্রকাশিত হচ্ছে কিভাবে কারণে অথবা অকারণে সংবাদপত্রগুলো সত্যতা নিরুপণের সুযোগ ছাড়াই মতামত প্রকাশ করতে হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক তার সদবিশ্বাসের কারণে ভুল স্বীকার করতে গিয়ে যে বিড়ম্বনার কারণ হয়েছেন তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য হতে পারে না। যে ভাষায় জাতীয় সংসদে তার নাম ধরে গালাগালি করা হয়েছে এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। মাহমুদুর রহমানের মতো তার নামেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা দেয়া হয়েছে। সরকারের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তির মুখে নরম সুর পরিলক্ষিত হলেও দেখা যাচ্ছে, ‘রাজা যা বলে পারিষদ বলে তার শতগুণ।’
স্বাধীন মতামত তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি আওয়ামী ঘরানার মনোভাব কখনই অনুকূল ছিল না। বাকশাল আমলে বাক স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। এই সময়টায় (২০০৯-১৬) তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। কার্যকাল ঘেঁটে দেখা যায় বিগত আট বছরে তারা গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের ওপর সবচেয়ে বেশি তলোয়ার চালিয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়ে তারা দৈনিক বাংলা এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ করে দেয়। এবার তারা একে একে বন্ধ করে চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি এবং দিগন্ত টিভি। তারা আমার জানা মতে সমঝে ছিল। তাদের ভয় ছিল সরকার যেকোনো সময় তাদের ওপর চড়াও হতে পারে। যে সময়ে এবং যে পরিস্থিতিতে চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় তা ছিল অপ্রয়োজনীয়। সরকারের একটি ধমক তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। দৈনিক আমার দেশের প্রসঙ্গটিতে আসা যাক। সংবাদপত্র পরিচালনার জন্য আইন আছে, বিধি নিষেধ আছে, আরো আছে সেন্সরশিপ। তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তান আমলের মতো সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও ‘স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ’ প্রত্যাশা করে- যে ব্যবস্থায় নিজ নিজ চ্যানেল বা সংবাদপত্রগুলো সরকারের মর্জিমাফিক চলাফেরা করে। সরকার এমনভাবে আমার দেশ পত্রিকাটি কৌশলে বন্ধ করে দিলো যাতে তারা আইনের আশ্রয় নেয়ারও সুযোগ পেল না। পুলিশের জোরে আমার দেশ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেল। স্রেফ গায়ের জোরে চ্যানেল দখলের ঘটনাও ঘটল। সরকার নিজের অজান্তে এসব ঘটনার মাধ্যমে অযথাই বদনাম কামিয়েছে। এত দিন গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলে বলে যারা মূখে খৈ ফুটিয়েছেন এখন তারা যখন সংবাদপত্রের দলনের জন্য খৈ ফোটাচ্ছেন তখন বলতে ইচ্ছা করে, ‘সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।’এ ধরনের মতাদর্শ কেন্দ্রিক একপেশে তথ্য ব্যবস্থাপনার ফলেই দেশ আজ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক নিচে নেমে গেছে।
গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্র একে অপরের পরিপূরক। মূলত এই দেশে, এই সময়ে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র গণতান্ত্রিক সমাজের শেষ আলোটুকু জালিয়ে রেখেছে। অতীতে বুদ্ধিজীবীরা সংবাদ পত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বলে গুরুত্ব দিয়েছেন। আজ তথ্য প্রযুক্তির এই জগতে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে অবনমিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হবে- সচেতন নাগরিক সাধারণের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
email: mal55ju@yahoo.com
No comments