মোদির বিরুদ্ধে অসন্তোষ জমছে by জয়ন্ত ঘোষাল
২০১৫ বিদায় নিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই একটি বছর কেমন কাটল? শাহি দিল্লির সমাচার হলো, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই সরকার সম্পর্কে মানুষের যতটা মোহভঙ্গ হয়েছে, ঠিক ততটা প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কিন্তু কেন এমন হলো? আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদি এই দেশের জন্য কোনো কাজ করতে চাননি, শুধুই বিদেশ ঘুরেছেন এবং ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ বলে কাজকর্ম শিকেয় তুলেছেন, এমন অভিযোগ করাটা রাজনীতির বিশ্লেষণের অতি সরলীকরণ। কিন্তু এটাও সত্য, গোটা দেশ জুড়ে আপামর মানুষের অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান। মনমোহন সিংহ সরকারের দশ বছরে যাঁরা তিতিবিরক্ত হয়ে নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষমতায় এনেছেন, তারাই মাত্র দেড় বছরের মাথায় কেন অসন্তুষ্ট, সেটি বোঝার প্রয়োজনীয়তাটা প্রতিপক্ষের চেয়েও বেশি শাসক দলের। রাজনৈতিক বিশ্লেষণের একটি অসুবিধা হচ্ছে, আমি যদি বলি নরেন্দ্র মোদি কিছু ভাল কাজ করেছেন, তা হলে অনেকেই রে-রে করে উঠবেন। এবং বলবেন, আমি বিজেপির সমর্থক। আবার যদি বলি, নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা গত দেড় বছরে অনেক, তা হলেই সঙ্গে সঙ্গে আর এক পক্ষ রে-রে করে বলে উঠবেন, তার মানে আমি মোদি-বিরোধী তথা বিজেপি-বিরোধী। এর মাঝামাঝি একটা জায়গায় থেকেও তো একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ সম্ভব! প্রথমত, নরেন্দ্র মোদি কোনো কাজ করতে চান না বা ভারতের উন্নয়নের জন্য তার ভাবনা বা কর্মসূচি নেই, এ কথা যাঁরা বলেন আমি তাদের দলে নই। দ্বিতীয়ত, লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় বিজেপি নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে এতটাই গগনচুম্বী প্রত্যাশা গড়ে তুলেছিল আমজনতার হতাশ মনে, তাতে সাধারণ মানুষের চাহিদাটাও ছিল চরম। এখনই কেন জিনিসপত্রের দাম কমে যাচ্ছে না? কেন গরিব মানুষ এখনও গরিব থাকছেন? কেন গঙ্গা দূষণমুক্ত হয়ে যাচ্ছে না? মানুষ ভাবতে শুরু করেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি এক জন সুপার হিরো। অনেকটা জেমস বন্ড বা অরণ্যদেবের মতো। তিনি এসেই এই ঘুণ ধরা সমাজব্যবস্থার চালচিত্রটাই রাতারাতি আমূল বদলে দেবেন। আসলে একটা দেশ ও সমাজের সংস্কার যে সব সময় দীর্ঘমেয়াদি, সেটি সাধারণ মানুষ সবসময় বুঝতেও চান না। তা ছাড়া একটি অভিযোগ হলো, বিজেপিই তো প্রচারের সময় এই ‘হাইপ’ তৈরি করেছে। সুতরাং মোহভঙ্গের কারণ যদি সেটি হয়, তা হলে তার জন্যও দায়ী বিজেপি। সে দিন যদি প্রচারের মাধ্যমে সেটি মানুষকে বোঝাতে পারেন মোদি যে অচ্ছে দিন নিয়ে আসবেন, তা হলে দেড় বছরের মাথায় তারা ব্যর্থ হচ্ছেন কেন? আসলে সমস্যাটি রয়েছে একটি পারসেপশন বা ধারণার উপর। ভারতীয় রাজনীতিতে আজকার পারসেপশন একটি বড় শব্দ। নাবালক বিচার আইন সংসদে পাশ হয়ে যাওয়ার পরেও অধিকাংশ সাংসদ বলেছেন, আর একটু ধৈর্য ধরে বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে আলোচনা করলে বোধহয় ভাল হত। কিন্তু যখন ধর্ষিতার বাবা-মা সংসদের গ্যালারিতে উপবিষ্ট এবং গোটা দেশজুড়ে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে একটি আবেগ উত্তাল হয়ে উঠেছে, তখন সংসদকেও সেই সার্বভৌম আবেগের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। বিলটিকে তড়িঘড়ি পাশ করতে হয়েছে। এই ঘটনাটা দেখিয়ে দেয়, বাস্তবতার চেয়েও আজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কী ভাবে সেই রাজনৈতিক দলটি জনমানসের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। বারাণসীতে সংস্কার সাধনের জন্য স্টেশনের রূপান্তর পর্ব চলছে। রাস্তায় ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতে সাময়িক সমস্যাটি আরও বেড়ে গিয়েছে। নির্মাণ কাজের জন্য ট্রাফিক বেড়েছে, জঞ্জাল বেড়েছে, ট্রেন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এখন আমাদের মতো জনবহুল দেশে সংস্কার সাধন করতে গেলেও তাতে স্বল্পমেয়াদি সমস্যা আরও বেড়ে যায়। তখন মনে হয়, যদি কোনো কাজই মানুষ না করে, সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয় এবং প্রচারের ঢক্কানিনাদটা থাকলেই হয়, তাতে কিন্তু অনেক সময় মানুষের অসন্তোষ কম হয়। কালো টাকা বন্ধ করতে গিয়ে দিল্লিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই সমান্তরাল কালো টাকার অর্থনীতি যদি এখনও হই হই করে চলত, তাতে কিন্তু শেয়ার বাজার তেজি করা যেত বলে মনে করছে নির্মাণকারী সংস্থাগুলি। নরেন্দ্র মোদি সরকারের রথী-মহারথীরা বলছেন, কাজ অনেক হচ্ছে। ২০১৪ সাল প্রথম বছর। তাই সাময়িক সমস্যাগুলি অনেক বেশি বড় হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি বদলাবে এবং ২০১৬ থেকে এই ধ্যানধারণার পরিবর্তন হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? কোথাও একটা সরকার এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে যোগাযোগের ত্রুটি আছে। সে কথাও কিন্তু স্বীকার করতে হবে মোদি সরকারকে। তা না হলে যে নীতিপঙ্গুতার জন্য কংগ্রেস সরকারকে ক’দিন আগেও মানুষ গাল পেড়েছে, বিহারে নীতীশ লালুর জোটসঙ্গী হওয়ায় তাদের আসন বৃদ্ধি হয় কী করে? বিভিন্ন উপনির্বাচন, বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ পঞ্চায়েত নির্বাচন, এমনকী প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দত্তক নেওয়া গ্রামে বিপর্যয়, গুজরাতে গ্রামীণ ভোট হারানো- এ সবই কি অশনিসঙ্কেত নয়? সাধারণ মানুষের মনে একটি বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে, এই সরকার আর্থিক সংস্কার ও বৃদ্ধির পথেও হাঁটছে না। আবার এই সরকার গরিব মানুষেরও সরকার নয়। দু’দিক থেকেই বিপদে পড়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি মানুষের এই অসন্তোষ দূর করতে সক্রিয় হবেন। আর বিরোধী পক্ষ এই অসন্তোষকে মূলধন করে এগোতে সক্রিয় হবে। এটাই দেখার, কে জেতে আর কে হারে! জয়ন্ত ঘোষাল: নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ, আনন্দবাজার পত্রিকা
No comments