মুসলমান এবং ইউরোপের প্রধান সমস্যা by রবার্ট স্কিডেলস্কি; অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ
মুসলমানদের
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের (মার্কিন
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী) আহ্বান
জানানোর প্রেক্ষাপটে দুই তরুণ বন্ধুর সাথে আমার কথোপকথনটি হয়েছিল এমন : আমি
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কি মুসলিম অভিবাসন এবং উদার নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষার
মধ্যে বেছে নেয়া! তোমাদের মত কী?’ তাদের দু’জনই প্রশ্নটির প্রথম প্রস্তাবনা
অস্বীকার করল। তাদের অভিমত ছিল, অভিবাসীদের নিজেদের হয়তো প্রতিক্রিয়াশীল
নৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান ব্রিটেন, আমেরিকা বা কন্টিনেন্টাল
ইউরোপে জন্ম নেয়া তাদের সন্তানেরা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা কি সত্য?
আমার প্রশ্নটি ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে (ট্রাম্পের বিষোদগারের আপাতযুক্তি) লক্ষ্য করে ছিল না; বরং ছিল ব্যাপক মুসলিম অভিবাসনের কারণে নৈতিক বিধিমালায় হুমকি নিয়ে, যা ইউরোপের বেশির ভাগ শিক্ষিত লোকের মতো আমার এই দুই তরুণ বন্ধুও এখন বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইসলাম যদি ব্রিটেনের আইন ও রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থায় আসে তবে তাতে, সন্ত্রাসবাদ বাদ দিলেও, কি তারা উদ্বিগ্ন হবে না?
এটা স্রেফ সম্ভাব্য সম্ভাবনা নয়। ২০১০ সালে ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৪৪.১ শতাংশ, তথা মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। ২০০১ সালের ১৬ লাখ মুসলমান থেকে বেড়ে ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে মুসলমান দাঁড়ায় ২৭ লাখ (মোট জনসংখ্যার ৪.৮ শতাংশ)। সাম্প্রতিক অভিবাসনপ্রবণতা এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলমানদের সাধারণ গড়ের চেয়ে বেশি হারে জন্মদানের (ব্রিটেনে গড় হার ১.৮ হলেও মুসলিম পরিবারগুলোতে পরিবারে সন্তান থাকে তিনটি) বিষয়টি বিবেচনায় নিলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যায় মুসলিম অংশ ব্যাপকভাবে বাড়তে বাধ্য।
ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকাতেই জনসংখ্যার এ চিত্রই দেখা যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জনসংখ্যা নিখুঁত বিজ্ঞান নয়। বয়স, জীবনযাত্রার মান, বৈষম্য ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর এটা নির্ভর করে। তাই আগে হোক আর পরে হোক, মুসলমানদের জন্মহার জাতীয় গড়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণই হয়ে যাবে। তবে তত দিনে মুসলিমরা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১০-২০ ভাগে উন্নীত হয়ে যাবে। এর পরিণাম কী হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
উদারমনাদের জাতিগত জনমিতি নিয়ে উদ্বেগ নেই। কারণ ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত যে সমাজে তারা বাস করে, সেখানকার রীতিপ্রথা অনুসরণ করবে বলে তাদের অনুমান। আদর্শ যুক্তি অনুযায়ী, অসহনীয় যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া অভিবাসীরা স্বাগতিক দেশের সমৃদ্ধি সাধন করে। বিশেষভাবে তাদের রাজনৈতিক আচরণ সাধারণ মানুষের ধারাকেই অনুসরণ করে।
এটা যদি সত্য হয়, তবে জনসংখ্যার জাতিগত উপাদানে পরিবর্তনের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব হবে নিরপেক্ষ, এমনকি কল্যাণকরও হতে পারে। আলজেরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা তুরস্ক থেকে আসা অভিবাসীরা এক বা দুই প্রজন্ম পর দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিতে ইউরোপিয়ানে পরিণত হবে। তাদের ধর্ম তাদের কাছে বর্তমানের বেশির ভাগ ইউরোপিয়ানের মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হবে এবং সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা স্থানীয়দের সাথে মিশে যাবে।
তবে ওই ঐতিহাসিক চিত্র, আমার দৃষ্টিতে, অনেকাংশেই নির্ভর করে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর ছোট আকার এবং দেশের জনসংখ্যার সাথে তাদের সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতার ওপর। (এবং সে ক্ষেত্রেও একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিকতা থেকে অনেক দূরে।) ইউরোপে যুদ্ধ-পরবর্তী অভিবাসন, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব থেকে, বিপুলসংখ্যক এবং অনেক ব্যবধানযুক্ত সংস্কৃতির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিণাম সম্পর্কে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা সামান্যই নির্দেশনা দেয়।
সমস্যাটির মূল হলো সমসাময়িক ইউরোপিয়ান সভ্যতা হলো সেকুলার, আর মুসলিম সভ্যতা হলো ধর্মীয়। ইউরোপে আইন, বিধানিক, শিক্ষা, নৈতিকতা এবং ব্যবসায়িক জীবনের কাছে ধর্ম তার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ইসলামি বিশ্ব এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়নি। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পদ্ধতিগত বিভাজন হয়নি, ব্যক্তি নয়, পরিবার এখনো মৌলিক সামাজিক ইউনিট হিসেবে রয়ে গেছে। আধুনিক ইউরোপের রাজনৈতিক জীবনের মৌলিক উপাদানগুলোর (যেমন ব্যক্তি অধিকার ও কর্তব্য, সরকারের পরিচালনাগত জবাবদিহিতা) বিশেষ করে আরব মধ্যপ্রাচ্যে অভাব রয়েছে।সেকুলারকরণের প্রয়াস সত্ত্বেও মুসলিম ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গিগত, যদি থাকে, ব্যবধান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো বেড়েছে, বেশির ভাগ মুসলিম দেশে ধর্ম আবার প্রাধান্যমূলক অবস্থানে উঠছে। চরম আকারে শরিয়াহ ধর্মীয় আইন (ব্যভিচার, সমকামিতা ইত্যাদি বিষয়ে পাশ্চাত্য আইন করে অবৈধ ঘোষণার পথ ছেড়ে দিলেও এসব দেশে সেগুলো মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ গণ্য হচ্ছে) তাদের আইনি বিধানকে প্রভাবান্বিত করছে। অধিকন্তু, অনেক দেশেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বলছে, শরিয়াহ হওয়া উচিত দেশের আইন।
ইউরোপে ইসলাম হলো দ্রুততম বর্ধিষ্ণু ধর্ম, এবং শরিয়াহ ইউরোপিয়ান আইনি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ এবং অন্যান্য পারিবারিক জটিলতা নিরসনে ব্রিটেনে ১০০ শরিয়াহ আদালত রয়েছে। এ কারণে শরিয়াহ আদালত ‘ব্রিটিশ মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নির্ধারণ’ করার পর্যালোচনা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে’কে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে।
সেকুলারকরণ অনিবার্য নয়। রাজনৈতিক দার্শনিক ল্যারি সাইডেটপ বলেছেন, ‘সেকুলারকরণ হলো বিশ্বকে দেয়া খ্রিষ্টান ধর্মের উপহার।’ তার মতে, খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো উদার ব্যক্তিবাদের দিকে পরিচালিত করে এবং অন্য সব প্রধান ধর্মে সেগুলো অনুপস্থিত।
অন্য দিকে, সেকুলারবাদের মহান উপহার হলো সহিষ্ণুতা। বিশ শতকে ইউরোপে ভয়াবহ পশ্চাৎগামিতার পঙ্কিলতা থাকলেও সেকুলারবাদ গোঁড়ামিকে তীব্র হতে দেয় না। কারণ ধর্মীয় নির্দেশনার বিপরীতে সেকুলার যুক্তিবাদ কখনো শেষ হওয়ার নয়।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অভিবাসন হলো অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের সন্ধানে ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা। তারা প্রবীণ জনসংখ্যাজনিত বিরূপতা হ্রাস করা কিংবা ‘নোংরা চাকরি’ করার শ্রমিক জোগানোর জন্য আরো অভিবাসনের আহ্বান জানান। কিন্তু ‘অর্থনৈতিক মানুষকে’ এভাবে ডেকে আনায় অভিবাসনের একটি প্রধান মাত্রাকে মিস করা হয় : রাজনৈতিক সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় লোকজন তাদের সংস্কৃতিকেও সাথে নিয়ে আসে। আমরা ধরে নিতে পারি না যে, অর্থনৈতিক সাফল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাংস্কৃতিক একীভূত হওয়ার পথে চালিত করে।
এটাই আমাদের ট্রাম্পকে সমর্থনের দিকে নিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে যা-ই ঘটুক না কেন, ইউরোপে মুসলিম অভিবাসন অব্যাহত থাকবে এবং আগামী কয়েক বছরে এমনকি বাড়বেও। এক সিরিয়া বিপর্যয়ই এটা নিশ্চিত করে ফেলবে। অভিবাসী ও স্বাগতিক জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য সংলাপ ও শিক্ষাসহ সব কিছুই করতে হবে। কিন্তু তবুও তা ধর্মীয় রাজনীতি এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির আনা সঙ্ঘাত সম্ভবত প্রতিরোধ করতে পারবে না। আমরা যদি অত্যন্ত গোলযোগপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে অচেতনভাবে চলতে থাকা এড়াতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে- সন্ত্রাসবাদ নয়, বরং ব্যর্থ একীভূতকরণ আমাদের সামনে থাকা প্রধান সমস্যা।
রবার্ট স্কিডেলস্কি : ওয়ারউইকশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল ইকোনমির প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ইতিহাস ও অর্থনীতিবিষয়ক ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির ফেলো, ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য। তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে।
আমার প্রশ্নটি ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে (ট্রাম্পের বিষোদগারের আপাতযুক্তি) লক্ষ্য করে ছিল না; বরং ছিল ব্যাপক মুসলিম অভিবাসনের কারণে নৈতিক বিধিমালায় হুমকি নিয়ে, যা ইউরোপের বেশির ভাগ শিক্ষিত লোকের মতো আমার এই দুই তরুণ বন্ধুও এখন বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইসলাম যদি ব্রিটেনের আইন ও রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থায় আসে তবে তাতে, সন্ত্রাসবাদ বাদ দিলেও, কি তারা উদ্বিগ্ন হবে না?
এটা স্রেফ সম্ভাব্য সম্ভাবনা নয়। ২০১০ সালে ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৪৪.১ শতাংশ, তথা মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। ২০০১ সালের ১৬ লাখ মুসলমান থেকে বেড়ে ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে মুসলমান দাঁড়ায় ২৭ লাখ (মোট জনসংখ্যার ৪.৮ শতাংশ)। সাম্প্রতিক অভিবাসনপ্রবণতা এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলমানদের সাধারণ গড়ের চেয়ে বেশি হারে জন্মদানের (ব্রিটেনে গড় হার ১.৮ হলেও মুসলিম পরিবারগুলোতে পরিবারে সন্তান থাকে তিনটি) বিষয়টি বিবেচনায় নিলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যায় মুসলিম অংশ ব্যাপকভাবে বাড়তে বাধ্য।
ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকাতেই জনসংখ্যার এ চিত্রই দেখা যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জনসংখ্যা নিখুঁত বিজ্ঞান নয়। বয়স, জীবনযাত্রার মান, বৈষম্য ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর এটা নির্ভর করে। তাই আগে হোক আর পরে হোক, মুসলমানদের জন্মহার জাতীয় গড়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণই হয়ে যাবে। তবে তত দিনে মুসলিমরা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১০-২০ ভাগে উন্নীত হয়ে যাবে। এর পরিণাম কী হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
উদারমনাদের জাতিগত জনমিতি নিয়ে উদ্বেগ নেই। কারণ ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত যে সমাজে তারা বাস করে, সেখানকার রীতিপ্রথা অনুসরণ করবে বলে তাদের অনুমান। আদর্শ যুক্তি অনুযায়ী, অসহনীয় যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া অভিবাসীরা স্বাগতিক দেশের সমৃদ্ধি সাধন করে। বিশেষভাবে তাদের রাজনৈতিক আচরণ সাধারণ মানুষের ধারাকেই অনুসরণ করে।
এটা যদি সত্য হয়, তবে জনসংখ্যার জাতিগত উপাদানে পরিবর্তনের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব হবে নিরপেক্ষ, এমনকি কল্যাণকরও হতে পারে। আলজেরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা তুরস্ক থেকে আসা অভিবাসীরা এক বা দুই প্রজন্ম পর দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিতে ইউরোপিয়ানে পরিণত হবে। তাদের ধর্ম তাদের কাছে বর্তমানের বেশির ভাগ ইউরোপিয়ানের মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হবে এবং সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা স্থানীয়দের সাথে মিশে যাবে।
তবে ওই ঐতিহাসিক চিত্র, আমার দৃষ্টিতে, অনেকাংশেই নির্ভর করে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর ছোট আকার এবং দেশের জনসংখ্যার সাথে তাদের সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতার ওপর। (এবং সে ক্ষেত্রেও একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিকতা থেকে অনেক দূরে।) ইউরোপে যুদ্ধ-পরবর্তী অভিবাসন, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব থেকে, বিপুলসংখ্যক এবং অনেক ব্যবধানযুক্ত সংস্কৃতির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিণাম সম্পর্কে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা সামান্যই নির্দেশনা দেয়।
সমস্যাটির মূল হলো সমসাময়িক ইউরোপিয়ান সভ্যতা হলো সেকুলার, আর মুসলিম সভ্যতা হলো ধর্মীয়। ইউরোপে আইন, বিধানিক, শিক্ষা, নৈতিকতা এবং ব্যবসায়িক জীবনের কাছে ধর্ম তার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ইসলামি বিশ্ব এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়নি। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পদ্ধতিগত বিভাজন হয়নি, ব্যক্তি নয়, পরিবার এখনো মৌলিক সামাজিক ইউনিট হিসেবে রয়ে গেছে। আধুনিক ইউরোপের রাজনৈতিক জীবনের মৌলিক উপাদানগুলোর (যেমন ব্যক্তি অধিকার ও কর্তব্য, সরকারের পরিচালনাগত জবাবদিহিতা) বিশেষ করে আরব মধ্যপ্রাচ্যে অভাব রয়েছে।সেকুলারকরণের প্রয়াস সত্ত্বেও মুসলিম ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গিগত, যদি থাকে, ব্যবধান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো বেড়েছে, বেশির ভাগ মুসলিম দেশে ধর্ম আবার প্রাধান্যমূলক অবস্থানে উঠছে। চরম আকারে শরিয়াহ ধর্মীয় আইন (ব্যভিচার, সমকামিতা ইত্যাদি বিষয়ে পাশ্চাত্য আইন করে অবৈধ ঘোষণার পথ ছেড়ে দিলেও এসব দেশে সেগুলো মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ গণ্য হচ্ছে) তাদের আইনি বিধানকে প্রভাবান্বিত করছে। অধিকন্তু, অনেক দেশেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বলছে, শরিয়াহ হওয়া উচিত দেশের আইন।
ইউরোপে ইসলাম হলো দ্রুততম বর্ধিষ্ণু ধর্ম, এবং শরিয়াহ ইউরোপিয়ান আইনি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ এবং অন্যান্য পারিবারিক জটিলতা নিরসনে ব্রিটেনে ১০০ শরিয়াহ আদালত রয়েছে। এ কারণে শরিয়াহ আদালত ‘ব্রিটিশ মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নির্ধারণ’ করার পর্যালোচনা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে’কে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে।
সেকুলারকরণ অনিবার্য নয়। রাজনৈতিক দার্শনিক ল্যারি সাইডেটপ বলেছেন, ‘সেকুলারকরণ হলো বিশ্বকে দেয়া খ্রিষ্টান ধর্মের উপহার।’ তার মতে, খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো উদার ব্যক্তিবাদের দিকে পরিচালিত করে এবং অন্য সব প্রধান ধর্মে সেগুলো অনুপস্থিত।
অন্য দিকে, সেকুলারবাদের মহান উপহার হলো সহিষ্ণুতা। বিশ শতকে ইউরোপে ভয়াবহ পশ্চাৎগামিতার পঙ্কিলতা থাকলেও সেকুলারবাদ গোঁড়ামিকে তীব্র হতে দেয় না। কারণ ধর্মীয় নির্দেশনার বিপরীতে সেকুলার যুক্তিবাদ কখনো শেষ হওয়ার নয়।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অভিবাসন হলো অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের সন্ধানে ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা। তারা প্রবীণ জনসংখ্যাজনিত বিরূপতা হ্রাস করা কিংবা ‘নোংরা চাকরি’ করার শ্রমিক জোগানোর জন্য আরো অভিবাসনের আহ্বান জানান। কিন্তু ‘অর্থনৈতিক মানুষকে’ এভাবে ডেকে আনায় অভিবাসনের একটি প্রধান মাত্রাকে মিস করা হয় : রাজনৈতিক সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় লোকজন তাদের সংস্কৃতিকেও সাথে নিয়ে আসে। আমরা ধরে নিতে পারি না যে, অর্থনৈতিক সাফল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাংস্কৃতিক একীভূত হওয়ার পথে চালিত করে।
এটাই আমাদের ট্রাম্পকে সমর্থনের দিকে নিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে যা-ই ঘটুক না কেন, ইউরোপে মুসলিম অভিবাসন অব্যাহত থাকবে এবং আগামী কয়েক বছরে এমনকি বাড়বেও। এক সিরিয়া বিপর্যয়ই এটা নিশ্চিত করে ফেলবে। অভিবাসী ও স্বাগতিক জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য সংলাপ ও শিক্ষাসহ সব কিছুই করতে হবে। কিন্তু তবুও তা ধর্মীয় রাজনীতি এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির আনা সঙ্ঘাত সম্ভবত প্রতিরোধ করতে পারবে না। আমরা যদি অত্যন্ত গোলযোগপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে অচেতনভাবে চলতে থাকা এড়াতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে- সন্ত্রাসবাদ নয়, বরং ব্যর্থ একীভূতকরণ আমাদের সামনে থাকা প্রধান সমস্যা।
রবার্ট স্কিডেলস্কি : ওয়ারউইকশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল ইকোনমির প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ইতিহাস ও অর্থনীতিবিষয়ক ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির ফেলো, ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য। তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে।
No comments