আমার প্রেসিডেন্ট- আমাদের প্রেসিডেন্ট! by গোলাম মাওলা রনি
সেবার আমি বেশ খানিকটা সময় নিয়ে মার্কিন মুলুকে ভ্রমণ করছিলাম। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের অনেক শহর-বন্দর, হাটবাজার ও গ্রামগঞ্জ দেখার পাশাপাশি সেখানকার অধিবাসীদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম। সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, মেয়র ও কাউন্সিলরদের মতো জনপ্রতিনিধি ছাড়াও বিচারক, অধ্যাপক, পুলিশকর্তা, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, প্রবাসী লোকজন এবং মার্কিন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু নিজেদের দেশের আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় তারা যে উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তা বিশ্বের আর কোথাও দেয়া যায় না। সাধারণ জনগণ, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারি সংস্থা, সংবাদমাধ্যম, এলিট সোসাইটি, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে সেখানে এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা নিজ চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারতাম না।
মার্কিন মুলুকের হাজারো ভালো-মন্দ জিনিসের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও শ্রদ্ধাবোধ। মার্কিন সমাজে রাজনীতিবিদদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশের জনগণ যেমন একটু সুযোগ পেলেই দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিবিদদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন, তেমন ঘটনা মার্কিন সমাজে বিরল। অন্য দিকে রাজনীতিবিদেরাও তাদের প্রতিপক্ষের মানসম্মানের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল থাকেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও পত্রিকাগুলো অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করে থাকে। পত্রিকার জ্বালায় রাজনীতিবিদ আত্মহত্যা পর্যন্ত করার ঘটনা ঘটে। অনেকে পদ-পদবি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং চিরদিনের জন্য রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা অনেকটাই নিরাপদ। মার্কিন পত্রপত্রিকা সাধারণত কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। সে দেশের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে কেবল বিল ক্লিনটন এবং তার ‘প্রেমিকা’ মনিকার কাহিনী নিয়ে মিডিয়াগুলো শোরগোল করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালে যখন একজন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের সাথে বিল ক্লিনটনের পরকীয়ার বিষয়টি তুললাম, তখন তিনি যা বললেন তার মোদ্দাকথা হলো- ক্লিনটনকে তার প্রেমের ঘটনার জন্য নাস্তানাবুদ করা হয়নি। কারণ ইতঃপূর্বে অনেক প্রেসিডেন্টের জীবনে প্রেমিকা হিসেবে অনেক নারীর আগমন ঘটেছিল। এমনকি প্রেসিডেন্টের স্ত্রীরা পর্যন্ত পরকীয়ায় আসক্ত ছিলেন। মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট কেনেডির বহুগামিতা, বিশেষ করে অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর সাথে পরকীয়া ছিল ওপেন সিক্রেট। মার্কিন নাগরিকেরা প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি একদম পছন্দ করেন না। তারা প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতাকে সহজে ক্ষমা করতে চান না। প্রেসিডেন্ট মিথ্যা কথা বলবেন, এমন ঘটনা মার্কিন মুলুকে কল্পনাও করা যায় না। ওই দেশে মিথ্যাকে মনে করা হয় মানুষের সবচেয়ে বড় চারিত্রিক দুর্বলতা এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ক্লিনটনের প্রধান দোষ ছিল- তিনি আদালতে শপথ করে বলেছিলেন, মনিকার সাথে তার কোনো অনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। পরবর্তীকালে যখন তদন্তে আসল ঘটনা বেরিয়ে এলো এবং প্রমাণ হলো, প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন, তখন পুরো দেশে তোলপাড় শুরু হলো। শেষপর্যায়ে ক্লিনটন যখন সত্য কথা বললেন এবং জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, তখন মার্কিনিরা তাকে সন্তুষ্টচিত্তে এই বলে ক্ষমা করে দিলেন যে, মনিকা ইস্যুটি প্রেসিডেন্টের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেবল প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ও কন্যাই ব্যাপারটিতে নাক গলাতে পারেন, সাধারণ মানুষের এতে করার কিছু নেই।
আমরা আলোচনা করছিলাম মার্কিন জনগণের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে। মার্কিনিরা সাধারণত তাদের নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধির মৃত্যুর পরও সাবেক শব্দটি প্রয়োগ করেন না। মেয়র, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর ও প্রেসিডেন্ট পদে কেউ একবার নির্বাচিত হলে রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের মানসপট তা চিরদিনের জন্য ধারণ করে রাখে। নির্বাচিত ব্যক্তিরা তাদের মেয়াদকালের পরও রাষ্ট্র থেকে সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়ে থাকেন। অন্য দিকে মার্কিন জনগণ তাদের সমাজের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে সম্বোধনের সময় বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন। কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা একান্ত আলোচনায় যদি কোনো জনপ্রতিনিধির নাম উচ্চারণ করতে হয়, তবে সাধারণত বলা হয়- মেয়র রিচার্ড ও ডেলি, কংগ্রেসম্যান স্টিভেন, সিনেটর কার্ল লেভিন, প্রেসিডেন্ট লিংকন, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রমুখ। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বা সাবেক শব্দটি ব্যবহৃত হয় না।
প্রেসিডেন্টদের মধ্যে যারা খুবই জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন, তাদের নামের সাথে অনেক সময় কিছুই যোগ করা হয় না। যেমন- জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, থমাস জেফারসন প্রমুখের নাম মার্কিন সমাজে এত বেশি উচ্চারিত হয় যে, তাদের পদ-পদবি উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। এসব বিষয় নিয়ে যখন আমার ফেলোশিপের মেন্টর ড. ড্যান ক্যান্টরেইলের সাথে আলাপ করছিলাম, তখন বাংলাদেশের অবস্থা মনে হতেই আমার ভীষণ হাসি পেয়ে বসল। ড. ড্যান মার্কিন প্রশাসনের মধ্যম শ্রেণীর পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং বেশ বয়স্ক হওয়ার পরও যথেষ্ট আমোদপ্রিয়। তিনি বেশ কৌতুক করে বললেন, বিশেষ কারো কথা মনে পড়েছে বুঝি! হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম এবং কৌশলে কোনো কিছু না বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। কারণ আমার যা মনে হয়েছিল তা মি. ড্যানের কাছে বলা সম্ভব ছিল না। তবে সম্মানিত পাঠকগণকে তো আর না বলে পারছি না।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন নেতা এবং ক্ষমতাহীন নেতার পদবি, প্রশংসা ও গ্রহণযোগ্যতায় যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি জীবিত ও মৃত নেতার ক্ষেত্রে ভিন্নতার পরিমাণ আরো বেশি। নেতার সামনে একধরনের কথা বলা হয়, আবার পেছনে গিয়ে বলা হয় সম্পূর্ণ উল্টো কথা। নেতার জন্য আয়োজিত দোয়া মাহফিলে উপস্থিত হয়ে কেউ কেউ নেতার সামনে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠেন। কিন্তু মনে মনে বলেন- ‘হালায় মরে না ক্যান।’ অন্য দিকে মৃত নেতার আত্মীয়স্বজন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা নেতার প্রশংসা করতে করতে শরীর ঘর্মাক্ত করে ফেলেন আর মনে মনে বলেন, ‘গুডিডা (গুটি বসন্তের বিষফোড়া) বাঁইচা থাকতেও জ্বালাইছে- অ্যাহন মইরা গিয়া আরো জ্বালার মধ্যে ফ্যালাইছে। মরার আর সময় পাইলো না। চৈত্র মাসের ঠাডাপড়া গরমের মধ্যে মইরা গিয়া আমাগোও মরনের দিকে টানতাছে। এত গরমের মধ্যে বক্তৃতা দেওয়া যায়! যতসব, ফালতু।’ আবার প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সে দেশের মানুষ অপমান করে না। তারা প্রেসিডেন্ট পদটিকে নিজেদের মর্যাদা, সাম্য, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য করে। আমাদের দেশের সরকারপ্রধানের মতো কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ছবি টানানো নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা বাড়াবাড়ি নেই। এমনকি মার্কিন জাতীয় পতাকার বিষয়েও তারা বাড়াবাড়ি করে না। একবার জনৈক ব্যক্তি প্রকাশ্যে মার্কিন পতাকা পুড়িয়ে ফেললেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হলো। অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করলেন- আমার টাকা দিয়ে পতাকা বানিয়ে পুড়িয়েছি, এখানে রাষ্ট্রের কী করার আছে। মামলা মার্কিন ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াল। সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে রায় দিলেন।
ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ব্যক্তি-অধিকার প্রয়োগের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে কোনো নাগরিক কি সীমা অতিক্রম করেন না কিংবা অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে আমাকে জানানো হলো, শৈশব থেকেই একজন নাগরিককে খুব ভালো করে শেখানো হয়, রাষ্ট্র থেকে সে কী কী অধিকার পেতে পারে। অন্য দিকে রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও তাকে সচেতন করে তোলা হয়। রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ, আইন মানার প্রবণতাও তৈরি করা হয়। প্রত্যেক নাগরিককে শৈশবে এমন স্বপ্ন দেখানো হয়, যাতে শিশুটি দ্রুত বড় হয়ে ওঠার আশায় এমনভাবে লেখাপড়া ও কাজকর্ম করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, যার ফলে সে পরনির্ভরতার পরিবর্তে আত্মমর্যাদাশীল ও স্বনির্ভর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে যায়। কারো গলগ্রহ হওয়া কিংবা কারো প্রতি নির্ভরশীলতা অথবা অন্যের অর্জিত সম্পত্তির ওপর লোভ-লালসা ও পরনির্ভরতার কারণে অলসতা পেয়ে না বসে, সে লক্ষ্যে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার একই আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কাজে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্র নীতিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভিন্নমত পোষণ এবং অন্যের থেকে আলাদা ও ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। মানুষ যাতে ভিন্নমত পোষণ করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে, সে জন্য শৈশব থেকেই স্কুলগুলোতে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয় অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে। সেসব ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের সামনে একটি বিষয় উপস্থাপন করা হয়। তারপর যেকোনো একজনকে বলা হয় বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করার জন্য। এরপর বলা হয় প্রথম বক্তার বক্তব্যের সাথে নতুন কিছু যুক্ত করার জন্য। সবার শেষে বলা হয়, বক্তাদের বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে সম্পূর্ণ নতুন কিছু উপস্থাপন করার জন্য। যেসব ছাত্রছাত্রী অভিনব ও ব্যতিক্রমী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারে, তাদের বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
তিনটি কারণে মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থা ভিন্নমতের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। প্রথমত, ভিন্নমতের কারণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয়। যিনি ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, তিনি তার মতাদর্শ অনুসারে কাজকর্ম করে ভিন্নমাত্রার কর্মযোগ সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়ত, ভিন্নমতের কারণে মানুষ আলাদা থেকে কাজকর্ম করতে বাধ্য হয়। তাতে করে ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটে খুবই দ্রুততার সাথে, যা কিনা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে পরিণত হয়। তৃতীয়ত, ভিন্নমতের কারণে মানুষ তার মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রকৃতির নিকৃষ্ট ও বোকা প্রাণীরা নেতাবিহীন অবস্থায় দলে-বলে চলাফেরা করে। যেমন ভেড়ার দল, মহিষ, হাঁস, শকুন ইত্যাদি। অন্য দিকে বাঘ, সিংহ ও চিতার মতো রাজকীয় প্রাণীরা একা চলে বটে, কিন্তু শিকারের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হতে একটুও দেরি করে না। পিঁপড়া ও মৌমাছি যুদ্ধ ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য তাদের নেতার অধীনে ও নিয়মের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। প্রকৃতির চিরায়ত বিধান মতে, যেসব মানুষ বিনা প্রয়োজনে দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কোনো ব্যক্তি বা নেতার কথামতো শুধু মাথা নাড়ে, তাদের যোগ্যতা ভেড়া, মহিষ বা শকুনের চেয়ে একটু কম নাকি একটু বেশি, তা নির্ধারণের জন্য গবেষণা প্রয়োজন। তবে ওই শ্রেণীর লোকজন কখনোই স্বাধীন, সার্বভৌম ও উন্নত মানুষ বলে কোনোকালে বিবেচিত হয়নি।
মার্কিন সমাজে যদি কোনো নাগরিকের সাথে হঠাৎ প্রেসিডেন্টের দেখা হয়ে যায়, তবে তিনি খুব উচ্ছ্বসিত হবেন না- আবার মুখ ফিরিয়ে অভদ্রতাও দেখাবেন না। কেউ আগবাড়িয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে খাতির করতে যাবেন না এবং দলবেঁধে প্রেসিডেন্টকে ঘিরে ধরে তার প্রশংসা বা তোষামোদিতে মেতে উঠবেন না। একটি লোকও পাওয়া যাবে না, যে কিনা প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে তার সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতা এবং বিশেষ যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করবেন। প্রেসিডেন্ট যদি হাত বাড়িয়ে দেন হ্যান্ডশেকের জন্য অথবা কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেন, তবে মানুষজন আনন্দ, বিনয় ও ভদ্রতার সংমিশ্রণে চমৎকার একটি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলবেন- মি. প্রেসিডেন্ট!...
বর্তমান প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যদি স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে তারা প্রথমেই বলবে, মাই প্রেসিডেন্ট অথবা আওয়ার প্রেসিডেন্ট। অর্থাৎ তারা প্রেসিডেন্টের নাম উচ্চারণ না করে বলবে, আমার প্রেসিডেন্ট অথবা আমাদের প্রেসিডেন্ট। তারপর প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে প্রযোজ্য বাক্যগুলো বলে তাদের বক্তব্য শেষ করবে।
আপনি যদি একটিবারের জন্য ওইসব শিশু-কিশোরের মুখের দিকে তাকান, তবে স্পষ্টতই বুঝতে পারবেন, প্রেসিডেন্ট শব্দটি তাদের বুকের মধ্যে অতি সযতনে আর মর্যাদার সাথে সংরক্ষিত। আপনার প্রশ্নের উত্তরে শিশুটি প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যেই না কিছু বলার চেষ্টা করল, অমনি প্রেসিডেন্টকে সে প্রথমে তার চোখের ওপর ফুটিয়ে তুলল। তারপর মুখমণ্ডল এবং অভিব্যক্তিতে প্রেসিডেন্টকে আনন্দময় ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করল। সবশেষে শব্দযন্ত্রের সাহায্যে মিষ্টি করে উচ্চারণ করল- আমার প্রেসিডেন্ট! আমাদের প্রেসিডেন্ট!...
মার্কিন মুলুকের হাজারো ভালো-মন্দ জিনিসের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও শ্রদ্ধাবোধ। মার্কিন সমাজে রাজনীতিবিদদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশের জনগণ যেমন একটু সুযোগ পেলেই দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিবিদদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন, তেমন ঘটনা মার্কিন সমাজে বিরল। অন্য দিকে রাজনীতিবিদেরাও তাদের প্রতিপক্ষের মানসম্মানের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল থাকেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও পত্রিকাগুলো অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করে থাকে। পত্রিকার জ্বালায় রাজনীতিবিদ আত্মহত্যা পর্যন্ত করার ঘটনা ঘটে। অনেকে পদ-পদবি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং চিরদিনের জন্য রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা অনেকটাই নিরাপদ। মার্কিন পত্রপত্রিকা সাধারণত কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। সে দেশের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে কেবল বিল ক্লিনটন এবং তার ‘প্রেমিকা’ মনিকার কাহিনী নিয়ে মিডিয়াগুলো শোরগোল করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালে যখন একজন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের সাথে বিল ক্লিনটনের পরকীয়ার বিষয়টি তুললাম, তখন তিনি যা বললেন তার মোদ্দাকথা হলো- ক্লিনটনকে তার প্রেমের ঘটনার জন্য নাস্তানাবুদ করা হয়নি। কারণ ইতঃপূর্বে অনেক প্রেসিডেন্টের জীবনে প্রেমিকা হিসেবে অনেক নারীর আগমন ঘটেছিল। এমনকি প্রেসিডেন্টের স্ত্রীরা পর্যন্ত পরকীয়ায় আসক্ত ছিলেন। মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট কেনেডির বহুগামিতা, বিশেষ করে অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর সাথে পরকীয়া ছিল ওপেন সিক্রেট। মার্কিন নাগরিকেরা প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি একদম পছন্দ করেন না। তারা প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতাকে সহজে ক্ষমা করতে চান না। প্রেসিডেন্ট মিথ্যা কথা বলবেন, এমন ঘটনা মার্কিন মুলুকে কল্পনাও করা যায় না। ওই দেশে মিথ্যাকে মনে করা হয় মানুষের সবচেয়ে বড় চারিত্রিক দুর্বলতা এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ক্লিনটনের প্রধান দোষ ছিল- তিনি আদালতে শপথ করে বলেছিলেন, মনিকার সাথে তার কোনো অনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। পরবর্তীকালে যখন তদন্তে আসল ঘটনা বেরিয়ে এলো এবং প্রমাণ হলো, প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন, তখন পুরো দেশে তোলপাড় শুরু হলো। শেষপর্যায়ে ক্লিনটন যখন সত্য কথা বললেন এবং জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, তখন মার্কিনিরা তাকে সন্তুষ্টচিত্তে এই বলে ক্ষমা করে দিলেন যে, মনিকা ইস্যুটি প্রেসিডেন্টের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেবল প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ও কন্যাই ব্যাপারটিতে নাক গলাতে পারেন, সাধারণ মানুষের এতে করার কিছু নেই।
আমরা আলোচনা করছিলাম মার্কিন জনগণের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে। মার্কিনিরা সাধারণত তাদের নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধির মৃত্যুর পরও সাবেক শব্দটি প্রয়োগ করেন না। মেয়র, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর ও প্রেসিডেন্ট পদে কেউ একবার নির্বাচিত হলে রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের মানসপট তা চিরদিনের জন্য ধারণ করে রাখে। নির্বাচিত ব্যক্তিরা তাদের মেয়াদকালের পরও রাষ্ট্র থেকে সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়ে থাকেন। অন্য দিকে মার্কিন জনগণ তাদের সমাজের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে সম্বোধনের সময় বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন। কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা একান্ত আলোচনায় যদি কোনো জনপ্রতিনিধির নাম উচ্চারণ করতে হয়, তবে সাধারণত বলা হয়- মেয়র রিচার্ড ও ডেলি, কংগ্রেসম্যান স্টিভেন, সিনেটর কার্ল লেভিন, প্রেসিডেন্ট লিংকন, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রমুখ। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বা সাবেক শব্দটি ব্যবহৃত হয় না।
প্রেসিডেন্টদের মধ্যে যারা খুবই জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন, তাদের নামের সাথে অনেক সময় কিছুই যোগ করা হয় না। যেমন- জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, থমাস জেফারসন প্রমুখের নাম মার্কিন সমাজে এত বেশি উচ্চারিত হয় যে, তাদের পদ-পদবি উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। এসব বিষয় নিয়ে যখন আমার ফেলোশিপের মেন্টর ড. ড্যান ক্যান্টরেইলের সাথে আলাপ করছিলাম, তখন বাংলাদেশের অবস্থা মনে হতেই আমার ভীষণ হাসি পেয়ে বসল। ড. ড্যান মার্কিন প্রশাসনের মধ্যম শ্রেণীর পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং বেশ বয়স্ক হওয়ার পরও যথেষ্ট আমোদপ্রিয়। তিনি বেশ কৌতুক করে বললেন, বিশেষ কারো কথা মনে পড়েছে বুঝি! হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম এবং কৌশলে কোনো কিছু না বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। কারণ আমার যা মনে হয়েছিল তা মি. ড্যানের কাছে বলা সম্ভব ছিল না। তবে সম্মানিত পাঠকগণকে তো আর না বলে পারছি না।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন নেতা এবং ক্ষমতাহীন নেতার পদবি, প্রশংসা ও গ্রহণযোগ্যতায় যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি জীবিত ও মৃত নেতার ক্ষেত্রে ভিন্নতার পরিমাণ আরো বেশি। নেতার সামনে একধরনের কথা বলা হয়, আবার পেছনে গিয়ে বলা হয় সম্পূর্ণ উল্টো কথা। নেতার জন্য আয়োজিত দোয়া মাহফিলে উপস্থিত হয়ে কেউ কেউ নেতার সামনে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠেন। কিন্তু মনে মনে বলেন- ‘হালায় মরে না ক্যান।’ অন্য দিকে মৃত নেতার আত্মীয়স্বজন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা নেতার প্রশংসা করতে করতে শরীর ঘর্মাক্ত করে ফেলেন আর মনে মনে বলেন, ‘গুডিডা (গুটি বসন্তের বিষফোড়া) বাঁইচা থাকতেও জ্বালাইছে- অ্যাহন মইরা গিয়া আরো জ্বালার মধ্যে ফ্যালাইছে। মরার আর সময় পাইলো না। চৈত্র মাসের ঠাডাপড়া গরমের মধ্যে মইরা গিয়া আমাগোও মরনের দিকে টানতাছে। এত গরমের মধ্যে বক্তৃতা দেওয়া যায়! যতসব, ফালতু।’ আবার প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সে দেশের মানুষ অপমান করে না। তারা প্রেসিডেন্ট পদটিকে নিজেদের মর্যাদা, সাম্য, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য করে। আমাদের দেশের সরকারপ্রধানের মতো কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ছবি টানানো নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা বাড়াবাড়ি নেই। এমনকি মার্কিন জাতীয় পতাকার বিষয়েও তারা বাড়াবাড়ি করে না। একবার জনৈক ব্যক্তি প্রকাশ্যে মার্কিন পতাকা পুড়িয়ে ফেললেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হলো। অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করলেন- আমার টাকা দিয়ে পতাকা বানিয়ে পুড়িয়েছি, এখানে রাষ্ট্রের কী করার আছে। মামলা মার্কিন ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াল। সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে রায় দিলেন।
ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ব্যক্তি-অধিকার প্রয়োগের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে কোনো নাগরিক কি সীমা অতিক্রম করেন না কিংবা অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে আমাকে জানানো হলো, শৈশব থেকেই একজন নাগরিককে খুব ভালো করে শেখানো হয়, রাষ্ট্র থেকে সে কী কী অধিকার পেতে পারে। অন্য দিকে রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও তাকে সচেতন করে তোলা হয়। রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ, আইন মানার প্রবণতাও তৈরি করা হয়। প্রত্যেক নাগরিককে শৈশবে এমন স্বপ্ন দেখানো হয়, যাতে শিশুটি দ্রুত বড় হয়ে ওঠার আশায় এমনভাবে লেখাপড়া ও কাজকর্ম করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, যার ফলে সে পরনির্ভরতার পরিবর্তে আত্মমর্যাদাশীল ও স্বনির্ভর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে যায়। কারো গলগ্রহ হওয়া কিংবা কারো প্রতি নির্ভরশীলতা অথবা অন্যের অর্জিত সম্পত্তির ওপর লোভ-লালসা ও পরনির্ভরতার কারণে অলসতা পেয়ে না বসে, সে লক্ষ্যে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার একই আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কাজে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্র নীতিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভিন্নমত পোষণ এবং অন্যের থেকে আলাদা ও ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। মানুষ যাতে ভিন্নমত পোষণ করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে, সে জন্য শৈশব থেকেই স্কুলগুলোতে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয় অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে। সেসব ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের সামনে একটি বিষয় উপস্থাপন করা হয়। তারপর যেকোনো একজনকে বলা হয় বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করার জন্য। এরপর বলা হয় প্রথম বক্তার বক্তব্যের সাথে নতুন কিছু যুক্ত করার জন্য। সবার শেষে বলা হয়, বক্তাদের বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে সম্পূর্ণ নতুন কিছু উপস্থাপন করার জন্য। যেসব ছাত্রছাত্রী অভিনব ও ব্যতিক্রমী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারে, তাদের বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
তিনটি কারণে মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থা ভিন্নমতের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। প্রথমত, ভিন্নমতের কারণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয়। যিনি ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, তিনি তার মতাদর্শ অনুসারে কাজকর্ম করে ভিন্নমাত্রার কর্মযোগ সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়ত, ভিন্নমতের কারণে মানুষ আলাদা থেকে কাজকর্ম করতে বাধ্য হয়। তাতে করে ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটে খুবই দ্রুততার সাথে, যা কিনা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে পরিণত হয়। তৃতীয়ত, ভিন্নমতের কারণে মানুষ তার মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রকৃতির নিকৃষ্ট ও বোকা প্রাণীরা নেতাবিহীন অবস্থায় দলে-বলে চলাফেরা করে। যেমন ভেড়ার দল, মহিষ, হাঁস, শকুন ইত্যাদি। অন্য দিকে বাঘ, সিংহ ও চিতার মতো রাজকীয় প্রাণীরা একা চলে বটে, কিন্তু শিকারের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হতে একটুও দেরি করে না। পিঁপড়া ও মৌমাছি যুদ্ধ ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য তাদের নেতার অধীনে ও নিয়মের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। প্রকৃতির চিরায়ত বিধান মতে, যেসব মানুষ বিনা প্রয়োজনে দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কোনো ব্যক্তি বা নেতার কথামতো শুধু মাথা নাড়ে, তাদের যোগ্যতা ভেড়া, মহিষ বা শকুনের চেয়ে একটু কম নাকি একটু বেশি, তা নির্ধারণের জন্য গবেষণা প্রয়োজন। তবে ওই শ্রেণীর লোকজন কখনোই স্বাধীন, সার্বভৌম ও উন্নত মানুষ বলে কোনোকালে বিবেচিত হয়নি।
মার্কিন সমাজে যদি কোনো নাগরিকের সাথে হঠাৎ প্রেসিডেন্টের দেখা হয়ে যায়, তবে তিনি খুব উচ্ছ্বসিত হবেন না- আবার মুখ ফিরিয়ে অভদ্রতাও দেখাবেন না। কেউ আগবাড়িয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে খাতির করতে যাবেন না এবং দলবেঁধে প্রেসিডেন্টকে ঘিরে ধরে তার প্রশংসা বা তোষামোদিতে মেতে উঠবেন না। একটি লোকও পাওয়া যাবে না, যে কিনা প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে তার সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতা এবং বিশেষ যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করবেন। প্রেসিডেন্ট যদি হাত বাড়িয়ে দেন হ্যান্ডশেকের জন্য অথবা কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেন, তবে মানুষজন আনন্দ, বিনয় ও ভদ্রতার সংমিশ্রণে চমৎকার একটি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলবেন- মি. প্রেসিডেন্ট!...
বর্তমান প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যদি স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে তারা প্রথমেই বলবে, মাই প্রেসিডেন্ট অথবা আওয়ার প্রেসিডেন্ট। অর্থাৎ তারা প্রেসিডেন্টের নাম উচ্চারণ না করে বলবে, আমার প্রেসিডেন্ট অথবা আমাদের প্রেসিডেন্ট। তারপর প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে প্রযোজ্য বাক্যগুলো বলে তাদের বক্তব্য শেষ করবে।
আপনি যদি একটিবারের জন্য ওইসব শিশু-কিশোরের মুখের দিকে তাকান, তবে স্পষ্টতই বুঝতে পারবেন, প্রেসিডেন্ট শব্দটি তাদের বুকের মধ্যে অতি সযতনে আর মর্যাদার সাথে সংরক্ষিত। আপনার প্রশ্নের উত্তরে শিশুটি প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যেই না কিছু বলার চেষ্টা করল, অমনি প্রেসিডেন্টকে সে প্রথমে তার চোখের ওপর ফুটিয়ে তুলল। তারপর মুখমণ্ডল এবং অভিব্যক্তিতে প্রেসিডেন্টকে আনন্দময় ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করল। সবশেষে শব্দযন্ত্রের সাহায্যে মিষ্টি করে উচ্চারণ করল- আমার প্রেসিডেন্ট! আমাদের প্রেসিডেন্ট!...
No comments