ইসলামে স্বাধীনতা ও বিজয়

মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ও জন্মগতভাবে স্বাধীন। স্বাধীনতা মানুষের মজ্জাগত, এটি মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। মানুষ মনোজগতে সব সময় স্বাধীন; তাই সে বস্তুজগতেও স্বাধীন থাকা পছন্দ করে। মানবতার মুক্তিদূত প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: ‘প্রত্যেক নবজাতক স্বভাবধর্মে জন্মে; তার পিতা-মাতা তাকে বিভিন্ন শৃঙ্খলাবদ্ধ করে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারও গোলামি করবে না, করবে না কারও দাসত্ব; এক আল্লাহর প্রভুত্ব ছাড়া কারও প্রভুত্ব স্বীকার করবে না; হোক সে নমরুদ-ফেরাউন বা কোনো দেব-দেবতা। জগতের সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। সবারই পিতা বাবা আদম (আ.), সবারই মাতা মা হাওয়া (আ.)। তাই সব মানুষ ভাই ভাই, তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো সে তো আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির অবদান। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ তৈরি করে না। কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে মানুষ! আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদিগকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সহিত পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩, পারা: ২৬)। বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) বলেছেন: ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বোখারি শরিফ)। অর্থাৎ কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না।
সবার একমাত্র প্রভু মহান আল্লাহ। ইসলামের মূল বাণী পবিত্র কলেমায় এই ঘোষণাই দেওয়া হয়েছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো প্রভু নেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’। এই ঘোষণার পর মানুষ মানব-দানব সকল প্রকার প্রভুর গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এবং আদর্শ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে গ্রহণ করে। স্বাধীনতা আল্লাহর নিয়ামত। স্বাধীনতা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি ইসলামের মূল শিক্ষা। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু দাসদের মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি দাসকে সন্তান বানিয়েছেন, তিনি ক্রীতদাসকে ভাইয়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন, তিনি গোলামকে সেনা অধিনায়ক বানিয়েছেন। বংশানুক্রমিক দাসানুদাস কৃষ্ণবর্ণ হাবশি বিলাল (রা.)-কে মসজিদে নববির প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে আরব-অনারব, ধনী-দরিদ্র সবাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। রোম, পারস্যসহ সারা পৃথিবীতে ইসলামের স্বাধীনতার বাণী বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতবর্ষের শ্রেণিবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের শিকার নির্যাতিত-নিপীড়িত কোটি কোটি মানবসন্তান স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার জন্য ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। মুক্তির সুধা পান করেছে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। স্বাধীনতা মানে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা, সত্য গ্রহণের স্বাধীনতা, সত্য প্রচারের স্বাধীনতা, সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা হলো সুন্দর, সুশীল, সুকুমারবৃত্তি চর্চার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে অসুন্দরকে বর্জন করার স্বাধীনতা, অসত্যকে অগ্রাহ্য করার স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা। দিনের পর রাত আসে, ভারতের মুক্ত আকাশে নেমে আসে অন্ধকার অমানিশা। ভারতের জনগণ আবার ব্রিটিশের জালে বন্দী হয়, হারায় তাদের স্বাধীনতা। মুক্তির জন্য ছটফট করে চিন্তাশীল ও বিবেকসম্পন্ন জনগণ।
কালক্রমে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তবে স্বাধীনতা অর্জন হলেও ইসলামের নামে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অপকৌশলে ইসলামের প্রকৃত মুক্তির স্বাদ জনগণকে উপহার দিতে পারেনি। ফলে ইয়াহিয়া, টিক্কা, আইয়ুব ও ভুট্টোর মতো নরাধমেরা আবার পূর্ব-পশ্চিমের পার্থক্য তৈরি করল; বাঙালি আর পাঞ্জাবির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দেয়াল সৃষ্টি করল। বাঙালি যেন স্বাধীন হয়েও আবার পরাধীন হলো। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হলো। এ আন্দোলনে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান। পবিত্র কোরআন শরিফে রয়েছে: ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। (সূরা-৩০ রূম, আয়াত: ২২ ও ২১, পারা: ২১)। তারপরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনমতের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে আবারও মুক্তিপাগল জনগণকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। কিন্তু এ দেশের জনগণ, যাদের ইমানে মুক্তির বাণী, বিশ্বাসে স্বাধীনতার ধ্বনি, তারা তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পরাজয় বরণ করে জালিম শাহি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে মুক্তিকামী জনগণ। জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। বিজয় কাঙ্ক্ষিত, বিজয় গৌরবের। কিন্তু বিজয় যদি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট আর বিজেতারা যদি হন নীতিভ্রষ্ট; কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ যদি পায় অগ্রাধিকার, তাহলে সে বিজয় প্রকৃত আনন্দ উপহার দেয় না। আমাদের প্রিয় হাবিব বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে নির্দেশনা প্রদান করেন: ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন; তিনি তো তওবা কবুলকারী।’ (সূরা-১১০ নাসর, আয়াত: ১-৩, পারা: ৩০)।
বিজয়-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কোরআন মজিদে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন: ‘আমি তাহাদিগকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজ নিষেধ করবে; আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ার। (সূরা-২২ হজ, আয়াত: ৪১, পারা: ১৭)। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের স্বাধীনতাকে কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রাখুন, মুক্তির প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের তাওফিক দান করুন এবং বিজয়-পরবর্তী করণীয় অনুধাবন ও প্রতিপালনের সুযোগ করে দিন। মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.