বাংলাদেশ কি যুদ্ধে যেতে পারবে?
সৌদি
নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ না সংশোধন করে বাংলাদেশ
আত্মরক্ষার প্রয়োজন ব্যতিরেকে সীমান্তের বাইরে কোনো সামরিক জোটে যেতে পারে
না। কারণ, বাংলাদেশ সংবিধান নির্দিষ্টভাবে ‘শক্তি প্রয়োগ পরিহার’ করতে
বলেছে। প্রস্তাবিত জোটের ধরন কি হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম যদিও বলেছেন, এটা সামরিক জোট নয়। কিন্তু সৌদি আরব তার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এটিকে সামরিক জোট হিসেবেই বলছে। সৌদি আরবের কথায় ইসলামি মিলিটারি অ্যালায়েন্স। পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বিস্ময় প্রকাশ বা শিথিল মনোভাব দেখিয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা আরও জানতে চায়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, সৌদির মনে কী আছে সেটা আমরা জানতে চাইছি। রাশিয়াও বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় আছে। রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, প্যারিসে কী আলোচনা হয়েছে এবং সৌদি আরব কেন এই ঘোষণা দিল সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি। তুরস্ক স্বাগত জানিয়েছে। ইরান, ইরাক ও সিরিয়া বলেছে, এই ব্লকে যোগ দিতে সৌদি আরব তাদের আমন্ত্রণ জানায়নি।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন তার বইয়ের লিখেছেন, আমরা বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে প্রথম যে নীতি গ্রহণ করি তা হলো স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ নীতি। পাকিস্তান অনকে সামরিক জোটের পক্ষ হয়েছিল। আমরা তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে রাজি হইনি। সেসব জোট থেকে বেরিয়ে আসি। ড. কামালের কথায়, ‘পাকিস্তানের অন্তিম বছরগুলোতে সামরিক জোটে যোগদান করা নিয়ে পাকিস্তানের স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছিল, নিজের বিপদের সময় এসব ব্লকে থাকা কোনো কাজে দেয় না। ১৯৬২ সালের সিনো-ইন্ডিয়া যুদ্ধের পটভূমিতে পাকিস্তানের মিত্রদেরকে ভারতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে বাধা দেয়নি। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তারা চরম খেসারত দিয়েছে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকেই বাংলাদেশ তার সংবিধানে আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন দর্শন যুক্ত করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সুচিন্তিতভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন বিষয়ে তার বিদেশ নীতির মৌলনীতি চূড়ান্ত করেছিল। তার মূলমন্ত্র ছিল ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি বৈরিতা নয়’।
সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এসব নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন। তবে অনেকে বলেছেন, ২৫ অনুচ্ছেদটি সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি সংক্রান্ত পরিচ্ছেদে রয়েছে, সে কারণে তা সব সময় মেনে চলতে রাষ্ট্র বাধ্য নয়। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদ বলেছে, এই নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।
এ জোটে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাংলাদেশ সাংবিধানিক সংকটে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করবে। অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। এ দুটিকে যদি আমরা মূল বিষয় ধরি, তবে সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগদান সংবিধানের পরিপন্থি। সংবিধান অনুযায়ী, জাতিসংঘের অধীনে সামরিক কর্মকাণ্ডেই কেবল আমরা যোগ দিতে পারি। যার আওতায় শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা অংশ নিচ্ছি। সংবিধানের ১৪৫ অনুচ্ছেদও এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি সংসদে উত্থাপন করতে হবে। যেখানে সামরিক বাহিনীর যোগ দেয়ার প্রশ্ন জড়িত, সেখানে অবশ্যই সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সংসদে কোনো আলোচনা না করে হুট করে আমাদের এ জোটে যোগ দেয়া উচিত হয়নি। এটা নৈতিকভাবে অথবা সাংবিধানিক কোনোভাবেই উচিত হবে না। এ ব্যাপারে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এর পরই নিজেদের ভূমিকা নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, সৌদি সামরিক জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানে শিয়া-সুন্নির বিভাজনকে গুরুত্ব দেয়া, যা বাংলাদেশের জন্য মোটেও কাম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের টেনিস অঙ্গরাজ্যের অস্টিন পি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সন্ত্রাসবাদবিশেষজ্ঞ তাজ হাশমী বলেছেন, আইএসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যদি যুদ্ধে যায় তবে বাংলাদেশে আইএস নেই- এ কথা বেশিদিন বলা যাবে না।
উল্লেখ্য, সৌদি আরব বলেছে এই জোট তারা করেছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য নয়। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার এর আগে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং এখনও তাতে শরিক রয়েছে। পাকিস্তান তখন সুচিন্তিতভাবে ওই জোটে যোগদান থেকে বিরত থেকেছিল। বিচারপতি লতিফুর রহমানের কেয়ারটেকার সরকারের আমলে আমেরিকার অনুরোধে আফগানিস্তানে বহুজাতিগত কোয়ালিশনে বাংলাদেশ শরিক হয়েছিল। সেই বিষয়টি সংসদে আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে সমালোচনা হয়েছিল। আইনগত প্রশ্নও উঠেছিল।
এদিকে, সৌদি আরবের নেতৃত্বে নতুন সন্ত্রাসবিরোধী ইসলামিক সামরিক জোট গঠনের ঘোষণায় পাকিস্তানের পর বিস্ময় প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। মঙ্গলবার সৌদি আরবের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স, দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এ জোট গঠনের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বলেছে, তারা এখনও এ জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মত হয়নি। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। ওদিকে এ জোট নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কোন খবরে বলা হয়েছে, জোটের সদস্যরা এমন ঘোষণা শুনে প্রশ্ন করছেন- এই জোট কী? ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা এ জোটে যোগ দেবে কিনা সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাকার্তা পোস্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরমানাথা নাসির বলেছেন, সৌদি আরব যে সামরিক জোট গঠন করেছে তার ধরন কি হয় তা পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। অপেক্ষা করছে। মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিশামুুদ্দিন হোসেন বলেছেন, তারা এ জোটকে সমর্থন করেন। তবে কুয়ালালামপুর থেকে কোন সামরিক বিষয়ে জড়িত হওয়ার বিষয় প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের এ উদ্যোগে কোনো সামরিক প্রতিশ্রুতি নেই। ওদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব ইজাজ চৌধুরীও এ বিষয়ে এর আগে কথা বলেছেন। তাকে উদ্ধৃত করে অনলাইন ডন লিখেছে, জোট ঘোষণার খবরে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে তিনি রিয়াদে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দেন। বুধবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, জোটের বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে বিস্তারিত জানার পর সিদ্ধান্ত নেবে। ওদিকে গতকাল অনলাইন গার্ডিয়ান ‘ইজ সৌদি এরাবিয়াস এন্টি-টেররিস্ট এলায়েন্স রিয়েল?’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অলিভার মাইলসের লেখা ওই প্রতিবেদনে এ জোটের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, এটা এমন একটি উদ্যোগ যাতে সবাই বিস্মিত হয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কে টান থাকলেও এ জোটে নেয়া হয়েছে কাতারকে। ওদিকে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের শিরোনাম ‘কনফিউশন ক্লাউডস সৌদি এরাবিয়াস এন্টি-ইসলামিক স্টেট ইসলামিক মিলিটারি কোয়ালিশন’। অ্যাঙ্গাস ম্যাকডোয়েলের লেখা এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামিক স্টেটবিরোধী সৌদি আরবের ইসলামিক সামরিক জোট নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এতে বলা হয়, ৩৪ জাতির এ জোটের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সদস্য রাষ্ট্র এ জোট নিয়ে মৌলিক একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তা হলো- আসলে এটা কী? ইন্দোনেশিয়া এ জোটে যোগ দিচ্ছে না। পাকিস্তানি একজন সিনিয়র এমপি জোট গঠনের খবর শুনেছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একজন সাংবাদিকের কাছে। পশ্চিমা সরকারগুলো এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও কীভাবে এ জোট কাজ করবে তা অনিশ্চিত। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, সৌদি আরব এ জোট নিয়ে কীভাবে কাজ করে আমরা সে বিষয়ে আরও জানতে চাই।
বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, প্রথমদিকে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করলেও পরে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সামরিক জোটে অংশ নেয়া নিশ্চিত করেছে পাকিস্তান। তবে রিয়াদ এ জোটের বিষয়ে বিস্তারিত শেয়ার করার পর পাকিস্তান নির্ধারণ করবে তারা কি ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান এ জোট সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য অপেক্ষা করছে। জোটে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কি ধরনের অংশগ্রহণ হবে সে বিষয়ে জেনে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওদিকে, সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সামরিক জোটে যোগ দিতে হলে ইরানকে নীতি পালটাতে হবে। বহির্বিশ্বে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন ও আরব আর মুসলিম দেশগুলোকে হুমকি দেয়া বন্ধ করতে হবে। সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ আল-আসিরি এ মন্তব্য করেছেন। এ খবর দিয়েছে আরব নিউজ। আল আসিরি বলেছেন, আমরা এখন সন্ত্রাসকে পরাজিত করতে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছি। তেহরান যদি এ জোটের অংশ হতে চায় তাহলে তাদের অবশ্যই সিরিয়া ও ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং লেবানন ও ইরাকে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, রিয়াদে ইসলামিক সামরিক জোটের জন্য যৌথ একটি অপারেশন্স সেন্টার গঠন করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম যদিও বলেছেন, এটা সামরিক জোট নয়। কিন্তু সৌদি আরব তার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এটিকে সামরিক জোট হিসেবেই বলছে। সৌদি আরবের কথায় ইসলামি মিলিটারি অ্যালায়েন্স। পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বিস্ময় প্রকাশ বা শিথিল মনোভাব দেখিয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা আরও জানতে চায়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, সৌদির মনে কী আছে সেটা আমরা জানতে চাইছি। রাশিয়াও বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় আছে। রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, প্যারিসে কী আলোচনা হয়েছে এবং সৌদি আরব কেন এই ঘোষণা দিল সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি। তুরস্ক স্বাগত জানিয়েছে। ইরান, ইরাক ও সিরিয়া বলেছে, এই ব্লকে যোগ দিতে সৌদি আরব তাদের আমন্ত্রণ জানায়নি।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন তার বইয়ের লিখেছেন, আমরা বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে প্রথম যে নীতি গ্রহণ করি তা হলো স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ নীতি। পাকিস্তান অনকে সামরিক জোটের পক্ষ হয়েছিল। আমরা তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে রাজি হইনি। সেসব জোট থেকে বেরিয়ে আসি। ড. কামালের কথায়, ‘পাকিস্তানের অন্তিম বছরগুলোতে সামরিক জোটে যোগদান করা নিয়ে পাকিস্তানের স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছিল, নিজের বিপদের সময় এসব ব্লকে থাকা কোনো কাজে দেয় না। ১৯৬২ সালের সিনো-ইন্ডিয়া যুদ্ধের পটভূমিতে পাকিস্তানের মিত্রদেরকে ভারতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে বাধা দেয়নি। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তারা চরম খেসারত দিয়েছে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকেই বাংলাদেশ তার সংবিধানে আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন দর্শন যুক্ত করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সুচিন্তিতভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন বিষয়ে তার বিদেশ নীতির মৌলনীতি চূড়ান্ত করেছিল। তার মূলমন্ত্র ছিল ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি বৈরিতা নয়’।
সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এসব নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন। তবে অনেকে বলেছেন, ২৫ অনুচ্ছেদটি সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি সংক্রান্ত পরিচ্ছেদে রয়েছে, সে কারণে তা সব সময় মেনে চলতে রাষ্ট্র বাধ্য নয়। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদ বলেছে, এই নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।
এ জোটে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাংলাদেশ সাংবিধানিক সংকটে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করবে। অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। এ দুটিকে যদি আমরা মূল বিষয় ধরি, তবে সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগদান সংবিধানের পরিপন্থি। সংবিধান অনুযায়ী, জাতিসংঘের অধীনে সামরিক কর্মকাণ্ডেই কেবল আমরা যোগ দিতে পারি। যার আওতায় শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা অংশ নিচ্ছি। সংবিধানের ১৪৫ অনুচ্ছেদও এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি সংসদে উত্থাপন করতে হবে। যেখানে সামরিক বাহিনীর যোগ দেয়ার প্রশ্ন জড়িত, সেখানে অবশ্যই সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সংসদে কোনো আলোচনা না করে হুট করে আমাদের এ জোটে যোগ দেয়া উচিত হয়নি। এটা নৈতিকভাবে অথবা সাংবিধানিক কোনোভাবেই উচিত হবে না। এ ব্যাপারে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এর পরই নিজেদের ভূমিকা নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, সৌদি সামরিক জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানে শিয়া-সুন্নির বিভাজনকে গুরুত্ব দেয়া, যা বাংলাদেশের জন্য মোটেও কাম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের টেনিস অঙ্গরাজ্যের অস্টিন পি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সন্ত্রাসবাদবিশেষজ্ঞ তাজ হাশমী বলেছেন, আইএসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যদি যুদ্ধে যায় তবে বাংলাদেশে আইএস নেই- এ কথা বেশিদিন বলা যাবে না।
উল্লেখ্য, সৌদি আরব বলেছে এই জোট তারা করেছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য নয়। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার এর আগে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং এখনও তাতে শরিক রয়েছে। পাকিস্তান তখন সুচিন্তিতভাবে ওই জোটে যোগদান থেকে বিরত থেকেছিল। বিচারপতি লতিফুর রহমানের কেয়ারটেকার সরকারের আমলে আমেরিকার অনুরোধে আফগানিস্তানে বহুজাতিগত কোয়ালিশনে বাংলাদেশ শরিক হয়েছিল। সেই বিষয়টি সংসদে আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে সমালোচনা হয়েছিল। আইনগত প্রশ্নও উঠেছিল।
এদিকে, সৌদি আরবের নেতৃত্বে নতুন সন্ত্রাসবিরোধী ইসলামিক সামরিক জোট গঠনের ঘোষণায় পাকিস্তানের পর বিস্ময় প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। মঙ্গলবার সৌদি আরবের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স, দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এ জোট গঠনের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বলেছে, তারা এখনও এ জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মত হয়নি। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। ওদিকে এ জোট নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কোন খবরে বলা হয়েছে, জোটের সদস্যরা এমন ঘোষণা শুনে প্রশ্ন করছেন- এই জোট কী? ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা এ জোটে যোগ দেবে কিনা সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাকার্তা পোস্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরমানাথা নাসির বলেছেন, সৌদি আরব যে সামরিক জোট গঠন করেছে তার ধরন কি হয় তা পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। অপেক্ষা করছে। মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিশামুুদ্দিন হোসেন বলেছেন, তারা এ জোটকে সমর্থন করেন। তবে কুয়ালালামপুর থেকে কোন সামরিক বিষয়ে জড়িত হওয়ার বিষয় প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের এ উদ্যোগে কোনো সামরিক প্রতিশ্রুতি নেই। ওদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব ইজাজ চৌধুরীও এ বিষয়ে এর আগে কথা বলেছেন। তাকে উদ্ধৃত করে অনলাইন ডন লিখেছে, জোট ঘোষণার খবরে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে তিনি রিয়াদে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দেন। বুধবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, জোটের বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে বিস্তারিত জানার পর সিদ্ধান্ত নেবে। ওদিকে গতকাল অনলাইন গার্ডিয়ান ‘ইজ সৌদি এরাবিয়াস এন্টি-টেররিস্ট এলায়েন্স রিয়েল?’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অলিভার মাইলসের লেখা ওই প্রতিবেদনে এ জোটের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, এটা এমন একটি উদ্যোগ যাতে সবাই বিস্মিত হয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কে টান থাকলেও এ জোটে নেয়া হয়েছে কাতারকে। ওদিকে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের শিরোনাম ‘কনফিউশন ক্লাউডস সৌদি এরাবিয়াস এন্টি-ইসলামিক স্টেট ইসলামিক মিলিটারি কোয়ালিশন’। অ্যাঙ্গাস ম্যাকডোয়েলের লেখা এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামিক স্টেটবিরোধী সৌদি আরবের ইসলামিক সামরিক জোট নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এতে বলা হয়, ৩৪ জাতির এ জোটের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সদস্য রাষ্ট্র এ জোট নিয়ে মৌলিক একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তা হলো- আসলে এটা কী? ইন্দোনেশিয়া এ জোটে যোগ দিচ্ছে না। পাকিস্তানি একজন সিনিয়র এমপি জোট গঠনের খবর শুনেছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একজন সাংবাদিকের কাছে। পশ্চিমা সরকারগুলো এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও কীভাবে এ জোট কাজ করবে তা অনিশ্চিত। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, সৌদি আরব এ জোট নিয়ে কীভাবে কাজ করে আমরা সে বিষয়ে আরও জানতে চাই।
বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, প্রথমদিকে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করলেও পরে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সামরিক জোটে অংশ নেয়া নিশ্চিত করেছে পাকিস্তান। তবে রিয়াদ এ জোটের বিষয়ে বিস্তারিত শেয়ার করার পর পাকিস্তান নির্ধারণ করবে তারা কি ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান এ জোট সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য অপেক্ষা করছে। জোটে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কি ধরনের অংশগ্রহণ হবে সে বিষয়ে জেনে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওদিকে, সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সামরিক জোটে যোগ দিতে হলে ইরানকে নীতি পালটাতে হবে। বহির্বিশ্বে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন ও আরব আর মুসলিম দেশগুলোকে হুমকি দেয়া বন্ধ করতে হবে। সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ আল-আসিরি এ মন্তব্য করেছেন। এ খবর দিয়েছে আরব নিউজ। আল আসিরি বলেছেন, আমরা এখন সন্ত্রাসকে পরাজিত করতে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছি। তেহরান যদি এ জোটের অংশ হতে চায় তাহলে তাদের অবশ্যই সিরিয়া ও ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং লেবানন ও ইরাকে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, রিয়াদে ইসলামিক সামরিক জোটের জন্য যৌথ একটি অপারেশন্স সেন্টার গঠন করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
No comments