গোর by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
সিন্দুক কবরের ভেতরটা বেশ আঁটসাঁট। দূর থেকে শরীর বাঁকিয়ে উঁকি দিয়েই ঘাবড়ে গিয়েছেন ফয়েজ আহমেদ। নতুন কবর। বৃষ্টিতে নিচ থেকে পানি উঠছে দেখে কেমন শিরশিরে অনুভূতি শিরদাঁড়া দিয়ে নামল; অথবা আটকে রইল বুকের একপাশে। মাত্র কয়েক হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কিন্তু তাকালে মনে হয়, ভেতরের চারকোনা বরফের মতো অন্ধকারটা পৃথিবীর অন্যপাশ অবধি পৌঁছে গিয়েছে। আশপাশের দু-এক দিন বয়সী কবরগুলো সদ্য মা হওয়া নারীর তলপেটের মতো ফুলে আবার চুপসে গেছে পানিতে। ফয়েজ এবার গেটের দিকে খানিক এগিয়ে দাঁড়ালেন গাছের নিচে। বৃষ্টি ধরে এসেছে কিন্তু ওপর থেকে পাতা চুইয়ে পানি আসছে ফোঁটায় ফোঁটায়। একটু আগেই খুব বৃষ্টি ছিল এদিকে। সিদ্দিকের সঙ্গে দৌড়ে এসে গোরস্তানের অফিসঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন ফয়েজ। বারান্দা থেকে কয়েক পা নামতেই বাঁ দিকের দ্বিতীয় সারির একপাশে সদ্য খোঁড়া কবরে চোখ পড়ল তাঁর। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে আগ বাড়িয়ে বলল সিদ্দিক, ‘স্যার, হিন্দুক কব্বরটার কামই হ্যাস করলাম হপায়, আরেট্টা আছে, ওইডা বাক্স কব্বর।’
নেহাত দুর্ভাগ্য না হলে এমন ভরসন্ধ্যায় বৃষ্টির ভেতর কোনটা সিন্দুক আর কোনটা আলমারি, ওয়ার্ড-রোব কবর—এসব মারফতি জ্ঞান ফয়েজের নেওয়ার কথা না। এটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি যে বাইরে রাখা ফ্রিজের পানির বোতলের মতো ঘেমে উঠেছেন, সেটা টের পাচ্ছেন। রুমাল হাতড়ালেন পাঞ্জাবির পকেটে। নেই। একটা জিনিস যদি শিরিন মনে করে দিত! বৃষ্টি-ঘামে ভিজে ক্যাতকেতে সারা শরীর। কপালের ঘাম মুছলেন হাত দিয়ে। হাতের তালুতে লোনাপানিটা ঘোলাটে আলোয় দেখতে কেমন লাল রঙের মতো। সেই সকালে বেরিয়েছেন বাসা থেকে। এখন ভাবনাগুলোও কাজ করছে না ঠিকঠাক। এখান থেকে বের হওয়া দরকার, কিন্তু সিদ্দিক কথা বলেই যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্বাভাবিক মুখে শুনে যাচ্ছেন সব।
এক মাপে ধার কেটে চার ফুটের মতো গহ্বর তৈরি। কোদাল চালিয়ে ভেজা সুতি শাড়ির মতো মোলায়েম করে মেঝেটা বানানো।—সিদ্দিক কবর বোঝাতে খুব উন্মুখ; আর এটাই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ফয়েজকে।
: স্যার, হিন্দুক কব্বরে লাশ ঠিক মধ্যিখানে থাকে না। নামায়া ধাক্কা দিয়া ভিতর দিক ঢুকায় দিওয়া লাগে।
: কেন?
: হিয়াল-কুত্তার ভয়ে। এই কব্বরে টাইন্না বাইর করা যায় না।
: সবাই এ রকম কাটলেই পারে?
: জমি না কিনলি অনুমতি নাই। বড়লোকগো কব্বর।
: ও আচ্ছা।
কথাটি বলে খানিক চুপচাপ ফয়েজ। চাইলেও প্রসঙ্গটা এড়াতে পারছেন না। সিদ্দিক কথা বলেই যাচ্ছে, ‘কব্বর যেমনই কাডুক রক্ষা নাই, দ্যাহেন না তলের থ্যা পানি উডছে ক্যামায়!’
কপালে ভাঁজ তুলে সিদ্দিকের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পানি যদি না নামে তাহলে কী হবে?’ নিজের পান খাওয়া দাঁত বের করে নিষ্ঠুর প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলল সিদ্দিক, ‘এইডা মুর্দার পরিবারের ধৈর্যের পর নিব্বর করতেছে। হেরা অপেক্ষা করলি এট্টু না শুহান পর্যন্ত থ্যুয়া দিবি আর নইলি দুইডা কলাগাছ ফ্যালায়া বা এক বস্তা বালি ঢাইলা দিবেনে নামায়া।’
‘নামানো’ শব্দটা খুব নিষ্ঠুর শোনাল কানে। আগে কোনো গোরখোদকের সঙ্গে ফয়েজের আলাপ হয়নি। তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার নামে সিদ্দিক ইচ্ছে করে আতঙ্ক তৈরি করছে মনে হচ্ছে। অবশ্য সেটা অমূলক নয়। এই কাজটা সে করতেই পারে। আর তাকে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও ফয়েজের এখন নেই। তবু প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, ‘তুমি না ফলের ব্যবসা করতে। এখানে কাজ করছ কত দিন?’
: আমিও জানতাম নিকি এই কাম করা লাগবি? বছর দুই ধইরা, স্যার।
: আয় বেশি হয়?
: না, অন্য হিসাব আছে।
গোপনে ঢোঁক গিললেন ফয়েজ। সিদ্দিকের পরিবারের কথা জানতে চেয়েও সামলে নিলেন। এর মধ্যে তিনি যে সিদ্দিককে দুবার খুঁজেছেন, চেপে গেলেন তা-ও। ওর সঙ্গে আজ দ্বিতীয়বার দেখা। চিনতে পারার কথা না, কিন্তু মনে আছে একটা কারণে।
সেদিন রাতে বাসায় অনেক অতিথি খাবে বলে তিনি বাজার করতে গিয়েছিলেন কারওয়ান বাজারে। এফডিসির পাশে ভোরবেলা বেশ ভালো মাছ পাওয়া যায়। আড়তে তোলার আগেই পাইকারি দরে মাছ ব্যবসায়ীরা ভাগে বড় বড় মাছ তুলে দেয় পাল্লায়। দেখেশুনে মেহমানদের জন্য মাছ কিনে কাজের ছেলেটার হাতে ব্যাগটা দিয়ে হেঁটে এলেন ভেতর দিকটায়। সবজির দামদর করে প্রগতি ভবনের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখলেন, ফল নিয়ে বসেছে কয়েকজন। এরা চতুর্থ শ্রেণির দোকানদার। যারা আড়তের পাশে টিউব লাইট জ্বালিয়ে ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাট্টা করে, তারা হলো প্রথম শ্রেণির। চতুর্থ শ্রেণির দোকানদারদের মুখে পোড় খাওয়া বলিরেখা চিত্রাঙ্কন করা থাকে। চারুকলার ছেলেমেয়েদের প্রথম প্রথম এমন সোজা, বাঁকানো দাগ আঁকতে শেখানো হয়। চোখের কোণে বাসি পিচুটি লাগানো এসব মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তাদের পণ্যের অর্ধেক দামও বলা যায়। ঝাঁকা থেকে পাকা বেল আর পেঁপে তুলে যাচাই-বাছাই করলেন ফয়েজ।
: গিরস্ত বাড়ির, ওষুধপাত্তি দিয়া নাই, নিচ্চিন্তে ন্যান।
: সবগুলো কত রাখবা?
: ঠেইক্কা গেছি, এক টাহাও বেশি চাইতাম না, পনেরোডা বেল আর দুই হালি কম্ফা—সবগুলা বারো শ দিয়েন। খাইয়া আমারে বিচরাইবেন।
: ধুর মিয়া দাম বুইঝা চাও, কততে দিবা বলো?
: স্যার, মাইয়াডার পরীক্ষার ফি লাগব বইলা হেই বিহানে আইছি। বিশ্বাস করেন, বেশি চাই নাই।
: তোমাদের এই সমস্যা, সবকিছুতে সুযোগ খোঁজো। ফিসের সঙ্গে কী সম্পর্ক? একদাম বলো।
: আল্লার কিরা স্যার, কাইলকা লাস্ট তারিখ। ফি না দিলি পরীক্ষা দিতে দিবিন্যা। বারো শ— বেশি চাই নাই। জিনিস ভালো, নিয়া যান।
কার্তিক মাসেও গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ফলগুলো ডিপ ফ্রিজে রেখে দিলে অনেক দিন খাওয়া যাবে। এই ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন নাকি দোকানদারের বারবার স্যার ডাকায় কাজ হয়েছে, কে জানে। পাকা দরদাম করে ফয়েজ বললেন, ‘ঠিক আছে কথা বাড়িয়ো না। এক হাজার টাকা। ব্যাগে তোলো।’
প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে চকচকে নোটটা দিয়ে মনে মনে বেশ স্বস্তি বোধ করলেন। কোমরের লুঙ্গির গিঁটে টোপলামতো জায়গার প্যাঁচ খুলে টাকা রাখল লোকটা।
সিদ্দিককে তিনি আবার খুঁজতে এসেছিলেন দুদিন পর। অতিথিরা চলে যাওয়ার পরদিন ড্রয়িংরুমের সোফায় ক্যালকুলেটর আর কাগজপত্র নিয়ে ব্যবসার হিসাব মেলাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় সিঁড়িতে প্রথম শব্দটা শুনলেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দরজা খুলে যা দেখলেন, তাঁর বিশ্বাস হলো না। দীপ্র মেঝেতে পড়ে আছে। তার মাথার পেছনের রক্ত। দীপ্র অসম্ভব দুরন্ত বাচ্চা। ধারেকাছে কেউ নেই দেখেই হয়তো তার মাথায় বুদ্ধিটা এসেছে—নিজের সর্বোচ্চ মেধা খাটিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে পাশের ফ্লাটের বাচ্চার সঙ্গে। সিঁড়ির হাতলে বসে পিছলে পিছলে কার আগে কে নামতে পারে—প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে হাতল থেকে ছিটকে পড়েছে সিঁড়ির দুই স্তরের মাঝখানের সমান প্রশস্ত অংশে। মাথা ফেটে জামা-কাপড় রক্তে মাখামাখি। ছেলের মাথায় সেলাই-ব্যান্ডেজ দিয়ে আনলেন ফয়েজ। সকালে কাগজে-কলমে যে হিসাব নিয়ে বসেছিলেন, সেটা মিলেছে কিন্তু অন্য একটা হিসাব মেলাতে পারলেন না সারা রাতেও। পরদিন গেলেন কারওয়ান বাজারে। রাস্তার পাশের ফলের দোকানগুলোতে খুঁজলেন সেই ফলবিক্রেতাকে। নাম জানেন না, তাই ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না কাউকে। দুদিন পর আবারও গেলেন। ওই একই জায়গায় সেদিন এক বুড়ো ফলওয়ালাকে পেয়ে লোকটির বর্ণনা দিতেই শুনলেন ঘটনাটা। ফল নিয়ে বসা লোকটার মেয়ে মারা গেছে শুক্রবারে। অস্বাভাবিক মৃত্যু। আত্মহত্যা করেছে ১৬ বছরের মেয়েটা। এর বেশি কেউ জানে না। একজন আবার টিপ্পনী কাটল, ‘সিয়ানা মাইয়া প্যাট-পুট বাধায় হালাইছিল নাকি কইব কিডা, কিন্তু আপনে খুঁজেন ক্যা সিদ্দিকরে? টাহা পাননি?’
সব শুনে স্তব্ধ ফয়েজ। তখনই তিনি জেনেছেন, ভ্রাম্যমাণ ওই ফলবিক্রেতার নাম—সিদ্দিক। সে-ও তো বছর দুই আগের কথা।
হ্যাঁ, সেই সিদ্দিকের সামনে সন্ধ্যায় এই কবরস্থানে দাঁড়িয়ে অবশ হয়ে আসছে তাঁর শরীর। এখন বৃষ্টিও কমেছে অনেকটা। হিজলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভয় পেতে পেতে কেন যেন ফয়েজ মুগ্ধ হয়ে উঠেছেন গোরস্তানের নীরবতায়। দূরে দূরে টিউব লাইট জ্বলছে, তাই অন্ধকারের বদলে একটা ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে আছে পুরো জায়গাটায়। সব কবরের মাপ যে সমান নয়, তিনি এই প্রথম লক্ষ করলেন। চোখে পড়ল কিছু ছোট কবর। আহারে, এগুলো বাচ্চাদের হবে। কিছুটা দূরে নীল রঙের প্লাস্টিক টাঙিয়ে আরও একটা কবর খোঁড়া হচ্ছে। বৃষ্টি ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা। গর্তের ভেতর থেকে দুজন মানুষের মাথা ওঠানামা করছে, অনেকটা কচ্ছপের খোলের ভেতর থেকে মাথা বেরিয়ে আসার মতো। এরা নিচ থেকে মাটি তুলে রাখছে কবরের বাইরের দুপাশে।
প্রাচীরের চারপাশে লাগানো হিজল আর দেবদারুগাছের দিকে হঠাৎ তাকালে মনে হয়, সোনালি সাপ নামছে গা বেয়ে। বৃষ্টি হওয়ায় গোরস্তানের ভেতর কাঁচামাটি আর বাঁশের ঘ্রাণের মিথস্ক্রিয়া। প্রাণপণে কবরের ভাবনা ঝেড়ে ফেলার প্রস্তুতি নিলেন ফয়েজ। প্রায় এক ঘণ্টা হয়েছে এখানে আটকা পড়েছেন।
মোহাম্মদপুর থেকে বাসে নীলক্ষেত নামার পরই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। নিউমার্কেট ক্রস করতেই পুরুষ্ট হলো পানির ফোঁটা। দৌড়ে আজিমপুর কবরস্থানের গেটের টিনশেডের নিচে দাঁড়ালেন। তখনই সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা। নতুন কবর খুঁড়ে ছাতা নিয়ে বিড়ি খেতে বেরিয়েছে সিদ্দিক। পরিচয় না দিলে হঠাৎ চিনতেনও না, কিন্তু সিদ্দিক তাঁকে মনে রেখেছে দেখে এখন অস্বস্তিটা বেশি হচ্ছে।
সিদ্দিকই এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, চিনছেন? আপনি তো পুরাই ভিজ্জা গেছেন। ভিতরে আইসা অফিসরুমের বারান্দায় খাড়ান।’
দীর্ঘ সময় দম আটকে থাকার পর এখন তাঁর অস্থির লাগছে বাইরে যাওয়ার জন্য। মনে হচ্ছে, দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার। এই বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে ছেলেটা না আবার বেরিয়ে যায় সাইকেল নিয়ে। এখন নিশ্চয়ই দু-একটা রিকশা পাওয়া যাবে। চলে যাওয়ার আগে তবু মনে হলো, তিনি যে সিদ্দিককে খুঁজতে গিয়েছিলেন, খবরটা তাকে জানানো দরকার, তা ছাড়া তার মেয়ের কথাটা একবার জিজ্ঞেস না করাও অন্যায় হবে। অস্বস্তি নিয়েই সিদ্দিকের কাঁধে হাত রাখলেন ফয়েজ, ‘তোমার মেয়েটার কী হয়েছিল? আমি খুঁজতে গিয়েছিলাম তোমাকে।’
হাত সরিয়ে দিল সিদ্দিক।
: বাসি গতর স্যার, ধইরেন না। কব্বর কাটছি তো।
: কী হয়েছিল মেয়েটার?
সিদ্দিকের চোখের মণিতে কোনো মায়া নেই, বরং যেন আগুন জ্বলে উঠল।
: গরিবের পুলাপান। আপনে যেমতে পরথম বিশ্বাস করেন নাই ফলগুলানে ওষুধ দেই নাই, হের মাস্টারও বিশ্বাস করে নাই ফিয়ের একখান এক হাজার টাকার জাল নোট বাপে ইচ্ছা কইরা দেয় নাই। কেলাশের ছাত্রছাত্রীগো সামনে অপমান করছিল। আদুইরা মাইয়া তো...।
সিদ্দিকের কথায় নির্বাক ফয়েজ কেবল আমতা আমতা করে বললেন, ‘ভুলটা আমারই, কিন্তু না বুঝে হয়েছে ভুলটা। আমি তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।’
: না বুইজঝা করেন নাই। চালায় দিতে চাইছিলেন।
শক্ত করে ‘না’ বলার শক্তিটা এতক্ষণে হারিয়ে ফেলেছেন ফয়েজ। তাঁর বিদায় নেওয়া জরুরি। তবে এমন অপরাধী হয়ে ‘যাই’ বলেই তো আর যাওয়া যায় না। সামান্য দায় লাঘবের শেষ চেষ্টায় স্বগতোক্তি করলেন তিনি, ‘মেয়েটা তাই বলে আত্মহত্যা করে বসল!’
: বাপের মতো ঘিন সহ্য করা শিখে নাই। আমিই ঝুলা শরীলডা দড়ি কাইড্ডা নামাইছিলাম। এরপর থিকাই কব্বর কাটি, স্যার।
: কেন?
বুকের ভেতর জমাট আতঙ্ক ফয়েজের।
: আত্মহত্যার মাইনষের নাকি জানাজা হয় না। গ্রামের বাড়ি নিয়া গেছিলাম। নিজের মাইয়ার কব্বর নিজেই কাটছি। হেরপর থিকা কাডি আর অপেক্ষা করি।
: কিসের অপেক্ষা?
একটা হাসি দিল সিদ্দিক। মানুষের পক্ষে শব্দহীন সেই হাসি সহ্য করা অসম্ভব। ঘাড়ের রগটা দপদপ করছে ফয়েজের, বুঝতে পারছেন প্রেশার বেড়েছে। নিশ্বাস আটকে আসছে তাঁর। একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না গোরস্তানে। বৃষ্টি কমে আসায় এবার যাবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু পা বাড়াতেই তাঁর হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিল সিদ্দিক, ‘কই যান স্যার? আমার কব্বরের লাশ আইছে। দাফন দেইখা যান।’
স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফয়েজ আহমেদ। গোরস্তানের গেটে থেমেছে পিকআপ ভ্যানটা। অন্ধকার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পিকআপ থেকে মরদেহ নামাচ্ছে মৃতের আত্মীয়রা। আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। তিনি কি ভুল দেখলেন! সাদা পাঞ্জাবি গায়ে কাকে দেখলেন তিনি? শিরিনের ছোট ভাই আফাজ এখানে কী করে! আর আফাজের পাঞ্জাবির কোনা ধরে কি দীপ্র দাঁড়িয়ে আছে? অসম্ভব। হতেই পারে না। তিনি এগিয়ে যেতে চাইলেন, গাছের শিকড়ের মতো কিছু একটা মাটির নিচ থেকে আঁকড়ে ধরল তাঁর পা।
শব্দ করে ডাকলেন; কিন্তু এইমাত্র মুর্দা নিয়ে আসা পিকআপের যাত্রীরা তাকাল না কেউই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, দীপ্রর পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। ছেলেটা আবার জ্বর বাধাবে। তিনি আবারও ডাকলেন দীপ্রকে। না, কেউ তাকায়নি। তাঁর শব্দ শুনছে না কেউ!
শবযাত্রীর দলে আরও পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছেন ফয়েজ। তারই গা ঘেঁষে মরদেহের খাটিয়া নিয়ে সবাই গেল নতুন কাটা সিন্দুক কবরটার কাছে। সিদ্দিককে দেখা যাচ্ছে। লাশ নামাতে কবরের ভেতরে নেমেছে সে। পানির ভেতরই কি নামাচ্ছে ওরা? কিন্তু কার লাশ? কাফনের কাপড়ে মৃতদেহের মাথার কাছটায় গেরো দেওয়া। মুখ দেখার উপায় নেই।
কবরের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই। চাটাই দেওয়া হচ্ছে। ফয়েজ আহমেদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি কি আসলে বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠেছিলেন? মনে পড়ছে না।
পুরোপুরি নিশ্বাস আটকে আসছে ফয়েজের। সামনে ঘিরে ধরছে অন্ধকার। আশ্চর্য, এতক্ষণ যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দেখতে পাচ্ছেন না সেটা! পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন। গুম গুম শব্দ হচ্ছে সবার ফিরে যাওয়ার। চিৎকার করে ছেলের নাম ধরে ডাকলেন তিনি, জবাব না পেয়ে ডাকলেন সিদ্দিককে। অবাক ব্যাপার, সবার পায়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছেন; কিন্তু তাঁর ডাক শুনছে না কেউ! একবার মনে হলো, অল্প বয়সী একটা মেয়ে দ্রুত সরে গেল পাশ দিয়ে। তখনই ‘আইজ থিকা আর কব্বর কাটুম না’ বলে অট্টহাসি দিল কেউ একজন।
নেহাত দুর্ভাগ্য না হলে এমন ভরসন্ধ্যায় বৃষ্টির ভেতর কোনটা সিন্দুক আর কোনটা আলমারি, ওয়ার্ড-রোব কবর—এসব মারফতি জ্ঞান ফয়েজের নেওয়ার কথা না। এটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি যে বাইরে রাখা ফ্রিজের পানির বোতলের মতো ঘেমে উঠেছেন, সেটা টের পাচ্ছেন। রুমাল হাতড়ালেন পাঞ্জাবির পকেটে। নেই। একটা জিনিস যদি শিরিন মনে করে দিত! বৃষ্টি-ঘামে ভিজে ক্যাতকেতে সারা শরীর। কপালের ঘাম মুছলেন হাত দিয়ে। হাতের তালুতে লোনাপানিটা ঘোলাটে আলোয় দেখতে কেমন লাল রঙের মতো। সেই সকালে বেরিয়েছেন বাসা থেকে। এখন ভাবনাগুলোও কাজ করছে না ঠিকঠাক। এখান থেকে বের হওয়া দরকার, কিন্তু সিদ্দিক কথা বলেই যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্বাভাবিক মুখে শুনে যাচ্ছেন সব।
এক মাপে ধার কেটে চার ফুটের মতো গহ্বর তৈরি। কোদাল চালিয়ে ভেজা সুতি শাড়ির মতো মোলায়েম করে মেঝেটা বানানো।—সিদ্দিক কবর বোঝাতে খুব উন্মুখ; আর এটাই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ফয়েজকে।
: স্যার, হিন্দুক কব্বরে লাশ ঠিক মধ্যিখানে থাকে না। নামায়া ধাক্কা দিয়া ভিতর দিক ঢুকায় দিওয়া লাগে।
: কেন?
: হিয়াল-কুত্তার ভয়ে। এই কব্বরে টাইন্না বাইর করা যায় না।
: সবাই এ রকম কাটলেই পারে?
: জমি না কিনলি অনুমতি নাই। বড়লোকগো কব্বর।
: ও আচ্ছা।
কথাটি বলে খানিক চুপচাপ ফয়েজ। চাইলেও প্রসঙ্গটা এড়াতে পারছেন না। সিদ্দিক কথা বলেই যাচ্ছে, ‘কব্বর যেমনই কাডুক রক্ষা নাই, দ্যাহেন না তলের থ্যা পানি উডছে ক্যামায়!’
কপালে ভাঁজ তুলে সিদ্দিকের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পানি যদি না নামে তাহলে কী হবে?’ নিজের পান খাওয়া দাঁত বের করে নিষ্ঠুর প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলল সিদ্দিক, ‘এইডা মুর্দার পরিবারের ধৈর্যের পর নিব্বর করতেছে। হেরা অপেক্ষা করলি এট্টু না শুহান পর্যন্ত থ্যুয়া দিবি আর নইলি দুইডা কলাগাছ ফ্যালায়া বা এক বস্তা বালি ঢাইলা দিবেনে নামায়া।’
‘নামানো’ শব্দটা খুব নিষ্ঠুর শোনাল কানে। আগে কোনো গোরখোদকের সঙ্গে ফয়েজের আলাপ হয়নি। তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার নামে সিদ্দিক ইচ্ছে করে আতঙ্ক তৈরি করছে মনে হচ্ছে। অবশ্য সেটা অমূলক নয়। এই কাজটা সে করতেই পারে। আর তাকে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও ফয়েজের এখন নেই। তবু প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, ‘তুমি না ফলের ব্যবসা করতে। এখানে কাজ করছ কত দিন?’
: আমিও জানতাম নিকি এই কাম করা লাগবি? বছর দুই ধইরা, স্যার।
: আয় বেশি হয়?
: না, অন্য হিসাব আছে।
গোপনে ঢোঁক গিললেন ফয়েজ। সিদ্দিকের পরিবারের কথা জানতে চেয়েও সামলে নিলেন। এর মধ্যে তিনি যে সিদ্দিককে দুবার খুঁজেছেন, চেপে গেলেন তা-ও। ওর সঙ্গে আজ দ্বিতীয়বার দেখা। চিনতে পারার কথা না, কিন্তু মনে আছে একটা কারণে।
সেদিন রাতে বাসায় অনেক অতিথি খাবে বলে তিনি বাজার করতে গিয়েছিলেন কারওয়ান বাজারে। এফডিসির পাশে ভোরবেলা বেশ ভালো মাছ পাওয়া যায়। আড়তে তোলার আগেই পাইকারি দরে মাছ ব্যবসায়ীরা ভাগে বড় বড় মাছ তুলে দেয় পাল্লায়। দেখেশুনে মেহমানদের জন্য মাছ কিনে কাজের ছেলেটার হাতে ব্যাগটা দিয়ে হেঁটে এলেন ভেতর দিকটায়। সবজির দামদর করে প্রগতি ভবনের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখলেন, ফল নিয়ে বসেছে কয়েকজন। এরা চতুর্থ শ্রেণির দোকানদার। যারা আড়তের পাশে টিউব লাইট জ্বালিয়ে ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাট্টা করে, তারা হলো প্রথম শ্রেণির। চতুর্থ শ্রেণির দোকানদারদের মুখে পোড় খাওয়া বলিরেখা চিত্রাঙ্কন করা থাকে। চারুকলার ছেলেমেয়েদের প্রথম প্রথম এমন সোজা, বাঁকানো দাগ আঁকতে শেখানো হয়। চোখের কোণে বাসি পিচুটি লাগানো এসব মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তাদের পণ্যের অর্ধেক দামও বলা যায়। ঝাঁকা থেকে পাকা বেল আর পেঁপে তুলে যাচাই-বাছাই করলেন ফয়েজ।
: গিরস্ত বাড়ির, ওষুধপাত্তি দিয়া নাই, নিচ্চিন্তে ন্যান।
: সবগুলো কত রাখবা?
: ঠেইক্কা গেছি, এক টাহাও বেশি চাইতাম না, পনেরোডা বেল আর দুই হালি কম্ফা—সবগুলা বারো শ দিয়েন। খাইয়া আমারে বিচরাইবেন।
: ধুর মিয়া দাম বুইঝা চাও, কততে দিবা বলো?
: স্যার, মাইয়াডার পরীক্ষার ফি লাগব বইলা হেই বিহানে আইছি। বিশ্বাস করেন, বেশি চাই নাই।
: তোমাদের এই সমস্যা, সবকিছুতে সুযোগ খোঁজো। ফিসের সঙ্গে কী সম্পর্ক? একদাম বলো।
: আল্লার কিরা স্যার, কাইলকা লাস্ট তারিখ। ফি না দিলি পরীক্ষা দিতে দিবিন্যা। বারো শ— বেশি চাই নাই। জিনিস ভালো, নিয়া যান।
কার্তিক মাসেও গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ফলগুলো ডিপ ফ্রিজে রেখে দিলে অনেক দিন খাওয়া যাবে। এই ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন নাকি দোকানদারের বারবার স্যার ডাকায় কাজ হয়েছে, কে জানে। পাকা দরদাম করে ফয়েজ বললেন, ‘ঠিক আছে কথা বাড়িয়ো না। এক হাজার টাকা। ব্যাগে তোলো।’
প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে চকচকে নোটটা দিয়ে মনে মনে বেশ স্বস্তি বোধ করলেন। কোমরের লুঙ্গির গিঁটে টোপলামতো জায়গার প্যাঁচ খুলে টাকা রাখল লোকটা।
সিদ্দিককে তিনি আবার খুঁজতে এসেছিলেন দুদিন পর। অতিথিরা চলে যাওয়ার পরদিন ড্রয়িংরুমের সোফায় ক্যালকুলেটর আর কাগজপত্র নিয়ে ব্যবসার হিসাব মেলাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় সিঁড়িতে প্রথম শব্দটা শুনলেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দরজা খুলে যা দেখলেন, তাঁর বিশ্বাস হলো না। দীপ্র মেঝেতে পড়ে আছে। তার মাথার পেছনের রক্ত। দীপ্র অসম্ভব দুরন্ত বাচ্চা। ধারেকাছে কেউ নেই দেখেই হয়তো তার মাথায় বুদ্ধিটা এসেছে—নিজের সর্বোচ্চ মেধা খাটিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে পাশের ফ্লাটের বাচ্চার সঙ্গে। সিঁড়ির হাতলে বসে পিছলে পিছলে কার আগে কে নামতে পারে—প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে হাতল থেকে ছিটকে পড়েছে সিঁড়ির দুই স্তরের মাঝখানের সমান প্রশস্ত অংশে। মাথা ফেটে জামা-কাপড় রক্তে মাখামাখি। ছেলের মাথায় সেলাই-ব্যান্ডেজ দিয়ে আনলেন ফয়েজ। সকালে কাগজে-কলমে যে হিসাব নিয়ে বসেছিলেন, সেটা মিলেছে কিন্তু অন্য একটা হিসাব মেলাতে পারলেন না সারা রাতেও। পরদিন গেলেন কারওয়ান বাজারে। রাস্তার পাশের ফলের দোকানগুলোতে খুঁজলেন সেই ফলবিক্রেতাকে। নাম জানেন না, তাই ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না কাউকে। দুদিন পর আবারও গেলেন। ওই একই জায়গায় সেদিন এক বুড়ো ফলওয়ালাকে পেয়ে লোকটির বর্ণনা দিতেই শুনলেন ঘটনাটা। ফল নিয়ে বসা লোকটার মেয়ে মারা গেছে শুক্রবারে। অস্বাভাবিক মৃত্যু। আত্মহত্যা করেছে ১৬ বছরের মেয়েটা। এর বেশি কেউ জানে না। একজন আবার টিপ্পনী কাটল, ‘সিয়ানা মাইয়া প্যাট-পুট বাধায় হালাইছিল নাকি কইব কিডা, কিন্তু আপনে খুঁজেন ক্যা সিদ্দিকরে? টাহা পাননি?’
সব শুনে স্তব্ধ ফয়েজ। তখনই তিনি জেনেছেন, ভ্রাম্যমাণ ওই ফলবিক্রেতার নাম—সিদ্দিক। সে-ও তো বছর দুই আগের কথা।
হ্যাঁ, সেই সিদ্দিকের সামনে সন্ধ্যায় এই কবরস্থানে দাঁড়িয়ে অবশ হয়ে আসছে তাঁর শরীর। এখন বৃষ্টিও কমেছে অনেকটা। হিজলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভয় পেতে পেতে কেন যেন ফয়েজ মুগ্ধ হয়ে উঠেছেন গোরস্তানের নীরবতায়। দূরে দূরে টিউব লাইট জ্বলছে, তাই অন্ধকারের বদলে একটা ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে আছে পুরো জায়গাটায়। সব কবরের মাপ যে সমান নয়, তিনি এই প্রথম লক্ষ করলেন। চোখে পড়ল কিছু ছোট কবর। আহারে, এগুলো বাচ্চাদের হবে। কিছুটা দূরে নীল রঙের প্লাস্টিক টাঙিয়ে আরও একটা কবর খোঁড়া হচ্ছে। বৃষ্টি ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা। গর্তের ভেতর থেকে দুজন মানুষের মাথা ওঠানামা করছে, অনেকটা কচ্ছপের খোলের ভেতর থেকে মাথা বেরিয়ে আসার মতো। এরা নিচ থেকে মাটি তুলে রাখছে কবরের বাইরের দুপাশে।
প্রাচীরের চারপাশে লাগানো হিজল আর দেবদারুগাছের দিকে হঠাৎ তাকালে মনে হয়, সোনালি সাপ নামছে গা বেয়ে। বৃষ্টি হওয়ায় গোরস্তানের ভেতর কাঁচামাটি আর বাঁশের ঘ্রাণের মিথস্ক্রিয়া। প্রাণপণে কবরের ভাবনা ঝেড়ে ফেলার প্রস্তুতি নিলেন ফয়েজ। প্রায় এক ঘণ্টা হয়েছে এখানে আটকা পড়েছেন।
মোহাম্মদপুর থেকে বাসে নীলক্ষেত নামার পরই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। নিউমার্কেট ক্রস করতেই পুরুষ্ট হলো পানির ফোঁটা। দৌড়ে আজিমপুর কবরস্থানের গেটের টিনশেডের নিচে দাঁড়ালেন। তখনই সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা। নতুন কবর খুঁড়ে ছাতা নিয়ে বিড়ি খেতে বেরিয়েছে সিদ্দিক। পরিচয় না দিলে হঠাৎ চিনতেনও না, কিন্তু সিদ্দিক তাঁকে মনে রেখেছে দেখে এখন অস্বস্তিটা বেশি হচ্ছে।
সিদ্দিকই এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, চিনছেন? আপনি তো পুরাই ভিজ্জা গেছেন। ভিতরে আইসা অফিসরুমের বারান্দায় খাড়ান।’
দীর্ঘ সময় দম আটকে থাকার পর এখন তাঁর অস্থির লাগছে বাইরে যাওয়ার জন্য। মনে হচ্ছে, দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার। এই বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে ছেলেটা না আবার বেরিয়ে যায় সাইকেল নিয়ে। এখন নিশ্চয়ই দু-একটা রিকশা পাওয়া যাবে। চলে যাওয়ার আগে তবু মনে হলো, তিনি যে সিদ্দিককে খুঁজতে গিয়েছিলেন, খবরটা তাকে জানানো দরকার, তা ছাড়া তার মেয়ের কথাটা একবার জিজ্ঞেস না করাও অন্যায় হবে। অস্বস্তি নিয়েই সিদ্দিকের কাঁধে হাত রাখলেন ফয়েজ, ‘তোমার মেয়েটার কী হয়েছিল? আমি খুঁজতে গিয়েছিলাম তোমাকে।’
হাত সরিয়ে দিল সিদ্দিক।
: বাসি গতর স্যার, ধইরেন না। কব্বর কাটছি তো।
: কী হয়েছিল মেয়েটার?
সিদ্দিকের চোখের মণিতে কোনো মায়া নেই, বরং যেন আগুন জ্বলে উঠল।
: গরিবের পুলাপান। আপনে যেমতে পরথম বিশ্বাস করেন নাই ফলগুলানে ওষুধ দেই নাই, হের মাস্টারও বিশ্বাস করে নাই ফিয়ের একখান এক হাজার টাকার জাল নোট বাপে ইচ্ছা কইরা দেয় নাই। কেলাশের ছাত্রছাত্রীগো সামনে অপমান করছিল। আদুইরা মাইয়া তো...।
সিদ্দিকের কথায় নির্বাক ফয়েজ কেবল আমতা আমতা করে বললেন, ‘ভুলটা আমারই, কিন্তু না বুঝে হয়েছে ভুলটা। আমি তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।’
: না বুইজঝা করেন নাই। চালায় দিতে চাইছিলেন।
শক্ত করে ‘না’ বলার শক্তিটা এতক্ষণে হারিয়ে ফেলেছেন ফয়েজ। তাঁর বিদায় নেওয়া জরুরি। তবে এমন অপরাধী হয়ে ‘যাই’ বলেই তো আর যাওয়া যায় না। সামান্য দায় লাঘবের শেষ চেষ্টায় স্বগতোক্তি করলেন তিনি, ‘মেয়েটা তাই বলে আত্মহত্যা করে বসল!’
: বাপের মতো ঘিন সহ্য করা শিখে নাই। আমিই ঝুলা শরীলডা দড়ি কাইড্ডা নামাইছিলাম। এরপর থিকাই কব্বর কাটি, স্যার।
: কেন?
বুকের ভেতর জমাট আতঙ্ক ফয়েজের।
: আত্মহত্যার মাইনষের নাকি জানাজা হয় না। গ্রামের বাড়ি নিয়া গেছিলাম। নিজের মাইয়ার কব্বর নিজেই কাটছি। হেরপর থিকা কাডি আর অপেক্ষা করি।
: কিসের অপেক্ষা?
একটা হাসি দিল সিদ্দিক। মানুষের পক্ষে শব্দহীন সেই হাসি সহ্য করা অসম্ভব। ঘাড়ের রগটা দপদপ করছে ফয়েজের, বুঝতে পারছেন প্রেশার বেড়েছে। নিশ্বাস আটকে আসছে তাঁর। একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না গোরস্তানে। বৃষ্টি কমে আসায় এবার যাবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু পা বাড়াতেই তাঁর হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিল সিদ্দিক, ‘কই যান স্যার? আমার কব্বরের লাশ আইছে। দাফন দেইখা যান।’
স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফয়েজ আহমেদ। গোরস্তানের গেটে থেমেছে পিকআপ ভ্যানটা। অন্ধকার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পিকআপ থেকে মরদেহ নামাচ্ছে মৃতের আত্মীয়রা। আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। তিনি কি ভুল দেখলেন! সাদা পাঞ্জাবি গায়ে কাকে দেখলেন তিনি? শিরিনের ছোট ভাই আফাজ এখানে কী করে! আর আফাজের পাঞ্জাবির কোনা ধরে কি দীপ্র দাঁড়িয়ে আছে? অসম্ভব। হতেই পারে না। তিনি এগিয়ে যেতে চাইলেন, গাছের শিকড়ের মতো কিছু একটা মাটির নিচ থেকে আঁকড়ে ধরল তাঁর পা।
শব্দ করে ডাকলেন; কিন্তু এইমাত্র মুর্দা নিয়ে আসা পিকআপের যাত্রীরা তাকাল না কেউই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, দীপ্রর পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। ছেলেটা আবার জ্বর বাধাবে। তিনি আবারও ডাকলেন দীপ্রকে। না, কেউ তাকায়নি। তাঁর শব্দ শুনছে না কেউ!
শবযাত্রীর দলে আরও পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছেন ফয়েজ। তারই গা ঘেঁষে মরদেহের খাটিয়া নিয়ে সবাই গেল নতুন কাটা সিন্দুক কবরটার কাছে। সিদ্দিককে দেখা যাচ্ছে। লাশ নামাতে কবরের ভেতরে নেমেছে সে। পানির ভেতরই কি নামাচ্ছে ওরা? কিন্তু কার লাশ? কাফনের কাপড়ে মৃতদেহের মাথার কাছটায় গেরো দেওয়া। মুখ দেখার উপায় নেই।
কবরের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই। চাটাই দেওয়া হচ্ছে। ফয়েজ আহমেদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি কি আসলে বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠেছিলেন? মনে পড়ছে না।
পুরোপুরি নিশ্বাস আটকে আসছে ফয়েজের। সামনে ঘিরে ধরছে অন্ধকার। আশ্চর্য, এতক্ষণ যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দেখতে পাচ্ছেন না সেটা! পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন। গুম গুম শব্দ হচ্ছে সবার ফিরে যাওয়ার। চিৎকার করে ছেলের নাম ধরে ডাকলেন তিনি, জবাব না পেয়ে ডাকলেন সিদ্দিককে। অবাক ব্যাপার, সবার পায়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছেন; কিন্তু তাঁর ডাক শুনছে না কেউ! একবার মনে হলো, অল্প বয়সী একটা মেয়ে দ্রুত সরে গেল পাশ দিয়ে। তখনই ‘আইজ থিকা আর কব্বর কাটুম না’ বলে অট্টহাসি দিল কেউ একজন।
No comments