দরিয়া কিনারে এখনো দুঃখ অথৈ by ফারুক ওয়াসিফ
‘তাজা হাওয়া বয়, খুঁজিয়া দেশের ভুঁই, ও মোর স্বদেশী জাদু, কোথায় রহিলি তুই!’ ওয়েস্টল্যান্ড/টি এস এলিয়ট
‘জল দেখিলেই নির্বাসিতের দেশের কথা মনে পড়ে’; আত্মঘাতী বাঙালি পুস্তকখ্যাত কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার ছেলে নীরদ সি চৌধুরীর এই কথাটা অন্যভাবে ফলে গেল—আমাদের দেশহারা-সাগরভাসা তরুণদের বেলায়। অচেনা সমুদ্রে মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁদের কোন দেশের কথা মনে পড়ছিল? অভাবের তাড়নায় যে দেশ তারা ছেড়ে এসেছে, নাকি যে দেশে সুখ মিলবে সেই পরবাসের কথা? স্বদেশে করুণাবঞ্চিত হয়েই তারা ভিনদেশের জলসীমান্তে উপস্থিত। করুণা ভিক্ষা করেই তারা বলেছে, ভাসা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাতভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে করে এসে ঠেকেছি এই বিপাকে—পরিণামে। আমাদের কোলে-কাঁখে শিশু, ঘরপোড়া কাঠে কালো কালো যিশু। দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ, করজোড়ে বলি, গ্রহণ করো রহম করো ভাই।
তাঁদের গ্রহণে সব রাষ্ট্রেরই হৃদয় পাষাণ হয়ে যায়। তাঁরা বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের জলে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গলে-পাহাড়ে, আরবের মরুতে, রাশিয়া ও তুরস্কের তুষারে, কিংবা ভূমধ্যসাগরের চারপাশের যুধ্যমান সীমান্তগুলোতে মরে পড়ে থাকছেন। এই খবর এত দিন কমই জানা যেত। মানব পাচার, আধুনিক দাসত্ব, শ্রমদাসত্ব ইত্যাদির অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করাই ছিল আমাদের রাষ্ট্রীয় চল। উন্নয়নের মাড়াই কল থেকে রসের পাশাপাশি কী পরিমাণ গাদ ও ছিবড়া তৈরি হচ্ছে, তার পরিমাপ আমরা করতে রাজি ছিলাম না। প্রদীপের নিচেই রাজ্যের অন্ধকার জমে আছে, সেটা নীতিনির্ধারকেরা জেনেও জানেননি, শুনতেও চাননি। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নে দেশবাসীকে বিভোর করায় বদ্ধপরিকর ছিল আমাদের সরকার। কিন্তু এক ঝলকে দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, আমরা জানলাম আমাদের মানুষেরা কতটা অসহায় আর বিশ্বে আমরা কতটা বন্ধুহীন।
রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী যেমন প্রমাণ করিয়াছিল যে অন্তত মরবার আগ পর্যন্ত সে বেঁচেই ছিল; তেমনি সাগরে ভাসমান জীবিত ও মৃত এবং জঙ্গলে গোর পাওয়া বাংলাদেশিরা জানিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যুর আগে কোন দোজখে তারা বাঁচার চেষ্টা করছিল। দেশের ভেতরের বাঁচাও এমনই কঠিন যে প্রবাসে দৈবের বশে পড়তেও তারা দ্বিধা করেনি। এ রকম চরম অমানবিক অবস্থায় পড়া জীবনকে দাসত্ব বলা হয়। ওয়ার্ল্ড স্লেভারি ইনডেক্স নামক আন্তর্জাতিক জরিপে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৩৫ শতাংশ মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার। বিশ্বে এখন দাসত্বের জীবনে বন্দী মানুষের সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভাগে আছে প্রায় সাত লাখ। এর কয়েক গুণ বেশি মানুষ দাসত্বের হুমকির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি দাস আছে এমন দেশের তালিকায় ভারত প্রথম আর বাংলাদেশ নবম। এটা কিন্তু দেশের ভেতরের হিসাব। আমাদের যত লোক দেশের বাইরে দাসোপম পেশায় বন্দী, সেই হিসাব যোগ করলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। এ ধরনের দাসত্বের পরিস্থিতি দূর করায় কোন সরকার কতটা সচেষ্ট, সেই তালিকায় বাংলাদেশ ১৬৭ দেশের মধ্যে ৬০তম। র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে তিনটা সি। এর অর্থ আধুনিক দাসত্ব দূর করায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ খুবই কম। আক্রান্তদের পক্ষে কাজ করার মতো সেবা কার্যক্রমও অপ্রতুল।
পাচারের শিকারদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন তথা পাচারজালকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করায় আমাদের সরকারের নীতি, প্রতিষ্ঠান ও আইন পর্যাপ্ত নয়। তারা আক্রান্তদের বিষয়ে উদাসীন তো বটেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্তদেরই অপরাধী বলে দোষায় বা শাস্তি দেয় বা সে রকম আইন টিকিয়ে রাখে। সম্প্রতি বেআইনি পথে সাগর অতিক্রম করে বিদেশে যাওয়া হতভাগ্যদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি এবং স্বরাষ্ট্র-পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করার মধ্যেই পাচার হওয়া মানুষদের বিষয়ে ওয়ার্ল্ড স্লেভারি ইনডেক্সের মূল্যায়নের সত্যতা মিলে যায়। যাঁরা সরকারের সাফাই গাইবেন, তাঁদের ওই প্রতিবেদনের প্রথম পৃষ্ঠায় মনীষী উইলবার উইলবারফোর্সের উক্তিটি জানাতে পারি: তুমি হয়তো অন্যভাবে বিষয়টাকে দেখতে পারো, কিন্তু তুমি আর কখনোই বলতে পারবে না যে তুমি জানতে না!
এই জরিপে দাসত্ব বাড়ার শর্তগুলোর মধ্যে বলা হয়েছে, যেসব দেশের উন্নয়ন বিষম অথবা ধীর, মানবাধিকার হুমকিগ্রস্ত এবং রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতা বেশি, সেখানেই দাসত্ব সৃষ্টির ঝুঁকি বেশি। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সে রকম একটি দেশ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। ২০০৯-১১ সালের থেকে ২০১২-১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের মাত্রা ধেই ধেই করে বেড়েছে (যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন)। এক হিসাবে গত ১০ বছরে পাকিস্তানেই পাচার হয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার নারী-শিশু ও যুবক। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গমনকারীদের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। এদের অনেকেই জোরপূর্বক যৌন দাসত্ব অথবা গৃহ দাসত্বে আটক। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায়ও আমরা আছি। কাতারের ৯০ শতাংশ মানুষই বিদেশি। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও ব্যাপক। তাদের কত অংশ অমানবিক দশায় দিন কাটায়, তার কোনো হিসাবই আমরা রাখিনি। একসময় মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হওয়া বাংলাদেশি বালকদের দুর্ভাগ্যের গল্প আন্তর্জাতিক শিরোনাম হতো। এখন প্রচারিত হয় বিরাট বিরাট ইমারত তৈরিতে দাসত্ব খাটা বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের কথা। এতে নাকি সরকারের ভাবমূর্তি যায়। মানবতার মূর্তির চাইতে ভাবের গরিমা বড় হয়ে গেলে সেই ভাব টেকানো মুশকিলই বটে।
মিয়ানমারকে অনেকেই বলছেন শরণার্থী/দাস তৈরির কারখানা। পরিকল্পিতভাবে সেখানে শরণার্থী তৈরি করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা গণহত্যা ও নিপীড়ন, ধর্ষণের মুখে শরণার্থী হচ্ছে। কিন্তু খোলা সাগরে বাদামের খোলার মতো নৌকায় কে ওঠাচ্ছে বাংলাদেশিদের? শুধুই কি দালালেরা দায়ী? অর্থনীতি দায়ী নয় মোটেই? আমাদের কৃষক অঢেল ফলন ফলিয়েও মুনাফা তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই ওঠাতে পারে না। এই কৃষকের সন্তান তো দেশছাড়া হতে চাইবেই। বাংলাদেশের ইটখোলাগুলোতে, চিংড়িঘেরে, চা-বাগানে, অবহেলার শিকার আইলা ও সিডর দুর্গত এলাকায়, জলবায়ু দুর্যোগে পেশা ও আবাসন হারানো জনপদে একেবারে তলার মানুষেরা কী অবস্থায় দিন যাপন করে, সেটা কি আমরা জানি? রানা প্লাজা ও তাজরীনের ঘটনার পরে তো আর গোপন নেই যে পোশাকশিল্পের একটি অংশে অকহতব্য অমানবিকতা এখনো চলছে। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু লাখ লাখ দরিদ্র আর ওই সাত-আট লাখ দাসকে যদি বলা হয়, সাগরপথে পালালে আরও ভালোভাবে বাঁচতে পারবে; তারা কি যাবে না? বিদেশ মানেই ডলার, এই গল্প তো আমরা প্রচার করেছি। মধ্যপ্রাচ্যে জেনেশুনে কাফালা নামক শ্রমদাসত্বের মধ্যে তো আমরাই সরকারিভাবে তরুণদের পাঠাই। আরবের যে দেশগুলোতে নারীর জন্য অধিকার বলতে কিছু নেই, সেসব দেশে গৃহপরিচারিকার মতো অনানুষ্ঠানিক দাসত্বের মধ্যে তো সরকারিভাবে চুক্তি করেই পাঠানো হচ্ছে নারীদের! আমাদের ডলার-দিনার আসে দেশের ভেতরে নিম্ন মজুরির রপ্তানিমুখী শিল্প এবং বিদেশে শ্রমদাসত্বের সুবাদে। বিশ্বায়ন ও উন্নয়নের সব গালগল্প মনে নিয়েই বলতে হচ্ছে, এই একচোখা উন্নয়নের পাশেই রয়েছে আরেক চোখের নির্মম অন্ধত্ব।
এই উন্নয়ন এক কূল গড়ে তো আরেক কূল ভাঙে। এই বিশ্বায়ন ক্ষমতাবানদের জন্য সব সীমান্ত, বেড়া, দেয়াল, চেকপোস্ট উঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু শ্রমকে করেছে বাধাগ্রস্ত। পুঁজি, বিনিয়োগ, পণ্য, পর্যটকেরা তরলের মতো অবাধে কিংবা পাখির মতো মুক্ত ডানায় দশদিকে ছুটে যেতে পারলেও, সসম্মানে জীবিকা অর্জনে ইচ্ছুক মানুষেরা পদে পদে থমকান। তারা যেন বিশ্বায়িত মহাসমুদ্রে আটকে পড়া দ্বীপবাসীর মতো। এলিটরা যতটাই আন্তর্জাতিক, তাঁরা ততটাই অঞ্চলবন্দী। আজ যদি আমরা কর্মপ্রত্যাশী অভিবাসীদের ক্লাস এইট পাস করিয়ে কিছুটা প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘অবৈধ’ পথেও পাঠাতাম, তাহলেও সস্তা শ্রমের লোভে মালয়েশিয়া বা কাতারের মতো দেশ তাদের ফিরিয়ে দিত না। ক্ষুধা ও উচ্চাশা ছাড়া আর কোনো অর্থনৈতিক যোগ্যতাই এসব মানুষকে আমরা দিতে পারিনি! তাদের ভুখা-নাঙা শরীর চলমান উন্নয়নের অমানবিকতার দর্পণ। থাই-মালয়ের সাগরে-জঙ্গলে এই বিশ্বায়ন ও প্রগতির গর্ব গুম হয়ে গেছে।
মানবসমাজ চিরকাল অভিবাসনপ্রবণই ছিল। সভ্যতা ও সমাজ বিস্তারের চালিকাশক্তি ছিল অভিবাসন। পুঁজি ও পণ্যের মতো, জ্ঞান ও চিন্তার মতো, শ্রমের অবাধ চলাচল বহুদিনের বহু মানুষের দাবি। কার্যত, শ্রমের চলাচল ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির সুষম বিকাশ হবে না, ভারসাম্য আসবে না। অভিবাসন তাই অবৈধ হয় না, বরং একে আইনি কাঠামোর মধ্যে কীভাবে আরও সহজ করা যায়, সেই পথ বের করতে হবে। তা ছাড়া উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর যে সমৃদ্ধি একসময়কার উপনিবেশিত দেশগুলোর সম্পদে হয়েছে, সেই উন্নতিতে গরিব দেশের মানুষেরও হক আছে।
যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে আসছিল, চাইছিল আমাদের রহম, তখন আমরা তাদের সাগরে ঠেলে দিয়ে যা করেছি, আজ আমাদের লোকের সঙ্গে সেটাই করছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ। তারা দেখেও না দেখে, জেনেও না জেনে এদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে রাখছিল। আজ যদি আমাদের উন্নয়নের মডেল, আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং আমাদের রাজনীতির নিষ্ঠুরতার সংশোধন না করি, তাহলে সাগরে দিশা হারানো এই মানুষগুলোর পরিণতিই বরণ করবে লাখো বাংলাদেশি। জলবায়ু দুর্যোগে যখন অনেক অঞ্চল বিরান, জলমগ্ন ও বন্ধ্যা হয়ে যাবে, যখন প্রাকৃতিক নিয়মে মাটির উর্বরতা শক্তি ফুরিয়ে যাবে, যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতি আরও ভেঙে পড়বে, কিংবা আমরা পড়ব ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে, তখন সমুদ্র ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। আজকের দুর্দশার মধ্যে সেই দুর্দিনের ইশারা।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
‘জল দেখিলেই নির্বাসিতের দেশের কথা মনে পড়ে’; আত্মঘাতী বাঙালি পুস্তকখ্যাত কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার ছেলে নীরদ সি চৌধুরীর এই কথাটা অন্যভাবে ফলে গেল—আমাদের দেশহারা-সাগরভাসা তরুণদের বেলায়। অচেনা সমুদ্রে মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁদের কোন দেশের কথা মনে পড়ছিল? অভাবের তাড়নায় যে দেশ তারা ছেড়ে এসেছে, নাকি যে দেশে সুখ মিলবে সেই পরবাসের কথা? স্বদেশে করুণাবঞ্চিত হয়েই তারা ভিনদেশের জলসীমান্তে উপস্থিত। করুণা ভিক্ষা করেই তারা বলেছে, ভাসা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাতভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে করে এসে ঠেকেছি এই বিপাকে—পরিণামে। আমাদের কোলে-কাঁখে শিশু, ঘরপোড়া কাঠে কালো কালো যিশু। দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ, করজোড়ে বলি, গ্রহণ করো রহম করো ভাই।
তাঁদের গ্রহণে সব রাষ্ট্রেরই হৃদয় পাষাণ হয়ে যায়। তাঁরা বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের জলে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গলে-পাহাড়ে, আরবের মরুতে, রাশিয়া ও তুরস্কের তুষারে, কিংবা ভূমধ্যসাগরের চারপাশের যুধ্যমান সীমান্তগুলোতে মরে পড়ে থাকছেন। এই খবর এত দিন কমই জানা যেত। মানব পাচার, আধুনিক দাসত্ব, শ্রমদাসত্ব ইত্যাদির অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করাই ছিল আমাদের রাষ্ট্রীয় চল। উন্নয়নের মাড়াই কল থেকে রসের পাশাপাশি কী পরিমাণ গাদ ও ছিবড়া তৈরি হচ্ছে, তার পরিমাপ আমরা করতে রাজি ছিলাম না। প্রদীপের নিচেই রাজ্যের অন্ধকার জমে আছে, সেটা নীতিনির্ধারকেরা জেনেও জানেননি, শুনতেও চাননি। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নে দেশবাসীকে বিভোর করায় বদ্ধপরিকর ছিল আমাদের সরকার। কিন্তু এক ঝলকে দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, আমরা জানলাম আমাদের মানুষেরা কতটা অসহায় আর বিশ্বে আমরা কতটা বন্ধুহীন।
রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী যেমন প্রমাণ করিয়াছিল যে অন্তত মরবার আগ পর্যন্ত সে বেঁচেই ছিল; তেমনি সাগরে ভাসমান জীবিত ও মৃত এবং জঙ্গলে গোর পাওয়া বাংলাদেশিরা জানিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যুর আগে কোন দোজখে তারা বাঁচার চেষ্টা করছিল। দেশের ভেতরের বাঁচাও এমনই কঠিন যে প্রবাসে দৈবের বশে পড়তেও তারা দ্বিধা করেনি। এ রকম চরম অমানবিক অবস্থায় পড়া জীবনকে দাসত্ব বলা হয়। ওয়ার্ল্ড স্লেভারি ইনডেক্স নামক আন্তর্জাতিক জরিপে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৩৫ শতাংশ মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার। বিশ্বে এখন দাসত্বের জীবনে বন্দী মানুষের সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভাগে আছে প্রায় সাত লাখ। এর কয়েক গুণ বেশি মানুষ দাসত্বের হুমকির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি দাস আছে এমন দেশের তালিকায় ভারত প্রথম আর বাংলাদেশ নবম। এটা কিন্তু দেশের ভেতরের হিসাব। আমাদের যত লোক দেশের বাইরে দাসোপম পেশায় বন্দী, সেই হিসাব যোগ করলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। এ ধরনের দাসত্বের পরিস্থিতি দূর করায় কোন সরকার কতটা সচেষ্ট, সেই তালিকায় বাংলাদেশ ১৬৭ দেশের মধ্যে ৬০তম। র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে তিনটা সি। এর অর্থ আধুনিক দাসত্ব দূর করায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ খুবই কম। আক্রান্তদের পক্ষে কাজ করার মতো সেবা কার্যক্রমও অপ্রতুল।
পাচারের শিকারদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন তথা পাচারজালকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করায় আমাদের সরকারের নীতি, প্রতিষ্ঠান ও আইন পর্যাপ্ত নয়। তারা আক্রান্তদের বিষয়ে উদাসীন তো বটেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্তদেরই অপরাধী বলে দোষায় বা শাস্তি দেয় বা সে রকম আইন টিকিয়ে রাখে। সম্প্রতি বেআইনি পথে সাগর অতিক্রম করে বিদেশে যাওয়া হতভাগ্যদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি এবং স্বরাষ্ট্র-পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করার মধ্যেই পাচার হওয়া মানুষদের বিষয়ে ওয়ার্ল্ড স্লেভারি ইনডেক্সের মূল্যায়নের সত্যতা মিলে যায়। যাঁরা সরকারের সাফাই গাইবেন, তাঁদের ওই প্রতিবেদনের প্রথম পৃষ্ঠায় মনীষী উইলবার উইলবারফোর্সের উক্তিটি জানাতে পারি: তুমি হয়তো অন্যভাবে বিষয়টাকে দেখতে পারো, কিন্তু তুমি আর কখনোই বলতে পারবে না যে তুমি জানতে না!
এই জরিপে দাসত্ব বাড়ার শর্তগুলোর মধ্যে বলা হয়েছে, যেসব দেশের উন্নয়ন বিষম অথবা ধীর, মানবাধিকার হুমকিগ্রস্ত এবং রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতা বেশি, সেখানেই দাসত্ব সৃষ্টির ঝুঁকি বেশি। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সে রকম একটি দেশ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। ২০০৯-১১ সালের থেকে ২০১২-১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের মাত্রা ধেই ধেই করে বেড়েছে (যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন)। এক হিসাবে গত ১০ বছরে পাকিস্তানেই পাচার হয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার নারী-শিশু ও যুবক। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গমনকারীদের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। এদের অনেকেই জোরপূর্বক যৌন দাসত্ব অথবা গৃহ দাসত্বে আটক। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায়ও আমরা আছি। কাতারের ৯০ শতাংশ মানুষই বিদেশি। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও ব্যাপক। তাদের কত অংশ অমানবিক দশায় দিন কাটায়, তার কোনো হিসাবই আমরা রাখিনি। একসময় মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হওয়া বাংলাদেশি বালকদের দুর্ভাগ্যের গল্প আন্তর্জাতিক শিরোনাম হতো। এখন প্রচারিত হয় বিরাট বিরাট ইমারত তৈরিতে দাসত্ব খাটা বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের কথা। এতে নাকি সরকারের ভাবমূর্তি যায়। মানবতার মূর্তির চাইতে ভাবের গরিমা বড় হয়ে গেলে সেই ভাব টেকানো মুশকিলই বটে।
মিয়ানমারকে অনেকেই বলছেন শরণার্থী/দাস তৈরির কারখানা। পরিকল্পিতভাবে সেখানে শরণার্থী তৈরি করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা গণহত্যা ও নিপীড়ন, ধর্ষণের মুখে শরণার্থী হচ্ছে। কিন্তু খোলা সাগরে বাদামের খোলার মতো নৌকায় কে ওঠাচ্ছে বাংলাদেশিদের? শুধুই কি দালালেরা দায়ী? অর্থনীতি দায়ী নয় মোটেই? আমাদের কৃষক অঢেল ফলন ফলিয়েও মুনাফা তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই ওঠাতে পারে না। এই কৃষকের সন্তান তো দেশছাড়া হতে চাইবেই। বাংলাদেশের ইটখোলাগুলোতে, চিংড়িঘেরে, চা-বাগানে, অবহেলার শিকার আইলা ও সিডর দুর্গত এলাকায়, জলবায়ু দুর্যোগে পেশা ও আবাসন হারানো জনপদে একেবারে তলার মানুষেরা কী অবস্থায় দিন যাপন করে, সেটা কি আমরা জানি? রানা প্লাজা ও তাজরীনের ঘটনার পরে তো আর গোপন নেই যে পোশাকশিল্পের একটি অংশে অকহতব্য অমানবিকতা এখনো চলছে। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু লাখ লাখ দরিদ্র আর ওই সাত-আট লাখ দাসকে যদি বলা হয়, সাগরপথে পালালে আরও ভালোভাবে বাঁচতে পারবে; তারা কি যাবে না? বিদেশ মানেই ডলার, এই গল্প তো আমরা প্রচার করেছি। মধ্যপ্রাচ্যে জেনেশুনে কাফালা নামক শ্রমদাসত্বের মধ্যে তো আমরাই সরকারিভাবে তরুণদের পাঠাই। আরবের যে দেশগুলোতে নারীর জন্য অধিকার বলতে কিছু নেই, সেসব দেশে গৃহপরিচারিকার মতো অনানুষ্ঠানিক দাসত্বের মধ্যে তো সরকারিভাবে চুক্তি করেই পাঠানো হচ্ছে নারীদের! আমাদের ডলার-দিনার আসে দেশের ভেতরে নিম্ন মজুরির রপ্তানিমুখী শিল্প এবং বিদেশে শ্রমদাসত্বের সুবাদে। বিশ্বায়ন ও উন্নয়নের সব গালগল্প মনে নিয়েই বলতে হচ্ছে, এই একচোখা উন্নয়নের পাশেই রয়েছে আরেক চোখের নির্মম অন্ধত্ব।
এই উন্নয়ন এক কূল গড়ে তো আরেক কূল ভাঙে। এই বিশ্বায়ন ক্ষমতাবানদের জন্য সব সীমান্ত, বেড়া, দেয়াল, চেকপোস্ট উঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু শ্রমকে করেছে বাধাগ্রস্ত। পুঁজি, বিনিয়োগ, পণ্য, পর্যটকেরা তরলের মতো অবাধে কিংবা পাখির মতো মুক্ত ডানায় দশদিকে ছুটে যেতে পারলেও, সসম্মানে জীবিকা অর্জনে ইচ্ছুক মানুষেরা পদে পদে থমকান। তারা যেন বিশ্বায়িত মহাসমুদ্রে আটকে পড়া দ্বীপবাসীর মতো। এলিটরা যতটাই আন্তর্জাতিক, তাঁরা ততটাই অঞ্চলবন্দী। আজ যদি আমরা কর্মপ্রত্যাশী অভিবাসীদের ক্লাস এইট পাস করিয়ে কিছুটা প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘অবৈধ’ পথেও পাঠাতাম, তাহলেও সস্তা শ্রমের লোভে মালয়েশিয়া বা কাতারের মতো দেশ তাদের ফিরিয়ে দিত না। ক্ষুধা ও উচ্চাশা ছাড়া আর কোনো অর্থনৈতিক যোগ্যতাই এসব মানুষকে আমরা দিতে পারিনি! তাদের ভুখা-নাঙা শরীর চলমান উন্নয়নের অমানবিকতার দর্পণ। থাই-মালয়ের সাগরে-জঙ্গলে এই বিশ্বায়ন ও প্রগতির গর্ব গুম হয়ে গেছে।
মানবসমাজ চিরকাল অভিবাসনপ্রবণই ছিল। সভ্যতা ও সমাজ বিস্তারের চালিকাশক্তি ছিল অভিবাসন। পুঁজি ও পণ্যের মতো, জ্ঞান ও চিন্তার মতো, শ্রমের অবাধ চলাচল বহুদিনের বহু মানুষের দাবি। কার্যত, শ্রমের চলাচল ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির সুষম বিকাশ হবে না, ভারসাম্য আসবে না। অভিবাসন তাই অবৈধ হয় না, বরং একে আইনি কাঠামোর মধ্যে কীভাবে আরও সহজ করা যায়, সেই পথ বের করতে হবে। তা ছাড়া উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর যে সমৃদ্ধি একসময়কার উপনিবেশিত দেশগুলোর সম্পদে হয়েছে, সেই উন্নতিতে গরিব দেশের মানুষেরও হক আছে।
যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে আসছিল, চাইছিল আমাদের রহম, তখন আমরা তাদের সাগরে ঠেলে দিয়ে যা করেছি, আজ আমাদের লোকের সঙ্গে সেটাই করছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ। তারা দেখেও না দেখে, জেনেও না জেনে এদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে রাখছিল। আজ যদি আমাদের উন্নয়নের মডেল, আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং আমাদের রাজনীতির নিষ্ঠুরতার সংশোধন না করি, তাহলে সাগরে দিশা হারানো এই মানুষগুলোর পরিণতিই বরণ করবে লাখো বাংলাদেশি। জলবায়ু দুর্যোগে যখন অনেক অঞ্চল বিরান, জলমগ্ন ও বন্ধ্যা হয়ে যাবে, যখন প্রাকৃতিক নিয়মে মাটির উর্বরতা শক্তি ফুরিয়ে যাবে, যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতি আরও ভেঙে পড়বে, কিংবা আমরা পড়ব ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে, তখন সমুদ্র ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। আজকের দুর্দশার মধ্যে সেই দুর্দিনের ইশারা।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments