অদ্ভুত এক আইনের শাসন! by কামাল আহমেদ
আমাদের
সদা পরিবর্তনশীল এবং নাটকীয়তায় ভরা রাজনৈতিক ডামাডোলের চাপে বাইরের
দুনিয়ার অনেক বড় বড় ঘটনা সংবাদপত্রের পাতা এবং টেলিভিশনের পর্দায় প্রায়
উপেক্ষিতই থেকে যায়। বেশি দূরের নয়, ভারত মহাসাগরেরই এ রকম একটি দেশের
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার অনেক কিছুর সঙ্গেই আমাদের অদ্ভুত রকমের মিল। আর ওই
সাদৃশ্যগুলোর জন্যই ভবিষ্যতের ঝুঁকিগুলোও প্রায় এক। ওই দ্বীপরাষ্ট্রে
প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর রাজনীতি প্রতিপক্ষকে যেভাবে কোণঠাসা করে প্রায়
নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টায় রত, ঠিক সেভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে
বিচারপ্রার্থীর শেষ ভরসাস্থল আদালতকে তা কীভাবে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় নিয়ে
গেছে তা অবিশ্বাস্য। এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই
রাষ্ট্রটির এসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ধসে পড়ার প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
জানালেও বাস্তবে তারা নিরুপায় দর্শক মাত্র। প্রায় ৩০ বছর দেশটি একজন
স্বৈরশাসকের শাসনে পরিচালিত হলেও তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি খুব একটা খারাপ ছিল
না। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকারের আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণে ২০০৮ সালে দেশটিতে
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় একটি অবাধ নির্বাচন, যার গ্রহণযোগ্যতা দেশটির
ভেতরে এবং বাইরে সর্বত্র একেবারে প্রশ্নাতীত ছিল। একেবারে নতুন প্রজন্মের
এক নেতার নেতৃত্বে গঠিত সরকার তার গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নিয়ে চার বছর খুব
ভালোই দেশ চালায়। কিন্তু পরাস্ত স্বৈরশাসকের অনুসারী ও সহযোগীদের
পুনরুজ্জীবন ২০১২ সালে দেশটিতে সৃষ্টি করে চরম অস্থিরতার। ওই অস্থিরতার
সূত্রপাত বিচার বিভাগের সংস্কারের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে। সুপ্রিম কোর্ট,
পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং সাবেক স্বৈরশাসকের রাজনৈতিক সহযোগীদের যোগসাজশে
নির্বাচিত সরকার উৎখাত—সেই সরকারপ্রধানকে বিচারের মুখোমুখি করা, ভবিষ্যতে
সব নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার উদ্যোগ—এসবই ছিল ছকবঁাধা প্রতিশোধের রাজনীতি।
ঘটনাক্রম যদি এখানেই থামত, তা-ও হয়তো দেশটিকে আবার গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন স্বৈরশাসকের যেসব উত্তরসূরি পুনর্জন্ম লাভ করেছেন, তঁারা নিজেদের অবস্থান আরও সংহত করতে চান। সুপ্রিম কোর্টে কোনো ধরনের স্বাধীনচেতা বিচারকের অবস্থান যাতে আর না থাকে, তা নিশ্চিত করার মানসে তঁারা আইন সংশোধন করে বিচারকের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে প্রধান বিচারপতিসহ দুজনকে বাদ দিয়ে আদালত পুনর্গঠনের কাজটি করে ফেলেছেন। দেশটির বিচার বিভাগে এখন যা চলছে, তাকে অনেকেই বেছে বেছে ফৌজদারি আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা বা ‘সিলেক্টিভ ইউজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিস’ বলে অভিহিত করেছেন (সূত্র: ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য, চার্লস ট্যানকের নিবন্ধ-প্যারাডাইজ ইন পেরিল: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৫ মে ২০১৫)।
পাশাপাশি সেই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিককে এক ফৌজদারি মামলায় তড়িঘড়ি বিচার করে ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। যে মামলায় তাঁকে দণ্ডিত করা হয়েছে, তাঁর বিচার সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হোসেইন গত ১৩ মার্চ এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে বিচারটি একদিকে যেমন ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হয়নি, তেমনি তা দেশটির নিজস্ব সংবিধান ও আইনও অনুসরণ করেনি। ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করার পর মাত্র ১৯ দিনের মধ্যে ১১ দিনে শুনানি করে তঁাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেওয়া হয়। তঁাকে আপিলের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতেও অবিশ্বাস্য তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। কেননা, আপিলে সবাই যেখানে ৯০ দিন সময় পান, তঁাকে দেওয়া হয়েছে ১০ দিন (সূত্র: জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি)। ওই রাজনীতিকের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের আরও কয়েকজনকে একই ধরনের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে এবং সর্বসম্প্রতি অন্য একটি বিরোধী দলের নেতার বিরুদ্ধেও জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য, চার্লস ট্যানক যে দ্বীপমালার রাষ্ট্রকে স্বর্গ বলে অভিহিত করেছেন, সেই দেশটি আমাদেরই প্রতিবেশী—সার্কের অন্যতম সদস্য মালদ্বীপ। ৩০ বছরের স্বৈরশাসক হলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম, প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ এবং বর্তমানের শাসক গাইয়ুম পরিবারের প্রতিনিধি, তাঁর সৎভাই আবদুল্লাহ ইয়ামিন। নাশিদের ক্ষমতাচ্যুতির পর তঁাকে জেলে পোরা এবং তঁার দলের ওপর যে দমনমূলক কার্যক্রম চলেছিল, তার পটভূমিতে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে প্রাথমিক বাধা পেরিয়ে নাশিদ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। কিন্তু প্রথম দফায় ২০ শতাংশ ভোট বেশি পেলেও তা বাতিল করে যে দ্বিতীয় দফা ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, তাতে নানা অনিয়মের মধ্যে তিনি হেরে যান এবং বিস্ময়কর বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হন ইয়ামিন।
মালদ্বীপের রাজনীতিতে সংকট যতটা, তার সূত্রপাত যে আদালতকে কেন্দ্র করে, এই নিবন্ধের মূল বিষয় সেই আদালত। মালদ্বীপে বিচারকদের নিয়োগ এবং শৃঙ্খলার বিষয়গুলো পরিচালনা ও তদারকের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনামলে একটি আইন প্রণীত হয়, যা জুডিকেচার অ্যাক্ট নামে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর গত ১১ ডিসেম্বর দেশটির পার্লামেন্ট (পিপলস মজলিশ) জুডিকেচার অ্যাক্টের একটি সংশোধনী পাস করে। আর ঠিক তার তিন দিন পর ১৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা সাতজন থেকে কমিয়ে পঁাচজনে নামানো, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আহমেদ ফয়েজ এবং আরেকজন বিচারপতি মুতাসিম আদনানকে অপসারণের সিদ্ধান্ত ওই পিপলস মজলিশে অনুমোদিত হয়।
বিচার বিভাগের ওপর এই অভাবিত এবং বিরল হস্তক্ষেপের ঘটনায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। বিচারক এবং আইনজীবীদের স্বাধীনতার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি, স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার, গ্যাব্রিয়েলা ক্নাউল ২২ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় এই দুজন বিচারপতিকে অপসারণ করা হয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি এবং তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। কোন কারণে তঁাদের অপসারণ করা হয়েছে, তা প্রকাশ না করার বিষয়টি বিশেষভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এই সিদ্ধান্ত দেশটির বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে এবং সর্বস্তরে ভীতিকর প্রভাব ফেলবে। বিবৃতিতে মিস ক্নাউল বলেন যে মালদ্বীপের সংবিধান অনুযায়ী জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন তখনই কোনো বিচারককে অপসারণের সুপারিশ করতে পারে, যখন তিনি চরম অযোগ্যতা অথবা অসদাচরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী অক্ষমতা অথবা ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হওয়ার বিষয়ে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ছাড়া কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় না বলে উল্লেখ করে তিনি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের প্রতি ওই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার আহ্বান জানান।
মালদ্বীপের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর রাজনীতির এই খড়্গ চেপে বসার পেছনের ইতিহাসটিও বেশ গুরুত্ববহ। ৩০ বছরের স্বৈরশাসনকালে গাইয়ুম পরিবার এবং তঁাদের আশীর্বাদপুষ্টরাই মূলত বিচার বিভাগে প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে মোহাম্মদ নাশিদের উত্থান-পরবর্তী গণতন্ত্রায়ণের কালে তঁাদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি থেকেই গেছে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ফৌজদারি আদালতের একজন প্রভাবশালী বিচারক আবদুল্লা মোহাম্মদকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়ার পর যে হাঙ্গামা শুরু হয়, তাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যোগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট নাশিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এখন সেই বিচারককে জোর করে অপহরণ এবং আটকের আদেশ দেওয়ার অপরাধেই নাশিদের কারাদণ্ড হলো। এই অভিযোগে একবার তিনি অব্যাহতি পাওয়ার পর তঁাকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচার করে এই সাজা দেওয়া হয় (মালদিভস এক্স লিডার মোহাম্মদ নাশিদ জেইলড ফর থার্টিন ইয়ারস, বিবিসি, ১৩ মার্চ, ২০১৫)।
তবে মালদ্বীপে বিচার বিভাগকে ঘিরে নাটকীয়তার সবচেয়ে করুণ অধ্যায়টি হচ্ছে অপসারিত প্রধান বিচারপতি আহমেদ ফয়েজকে ঘিরেই। বিচারপতি ফয়েজই প্রেসিডেন্ট নাশিদকে উৎখাতের বিষয়টিকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। আবার নির্বাচনের যে দফায় নাশিদ এগিয়ে ছিলেন, সেই নির্বাচনকে বাতিলের কাজটিও তিনিই করেছিলেন। নির্বাচন কমিশনের অন্তত চারজনকে তিনি কথিত আদালতের কর্তৃত্ব উপেক্ষার দায়ে জেলে পাঠিয়েছেন। এমনকি তিনি দেশটির আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার বিচার শুরু করেছিলেন। কারণ, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে পেশ করা মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা ছিল। দুর্ভাগ্য, বিচারপতি ফয়েজের যে তিনি অপরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর তঁার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এবং কোনো কারণ না দেখিয়েই তঁাকে অপসারণ করা হয়েছে। তঁার সঙ্গে অন্য যে বিচারপতি অপসারিত হয়েছেন, সেই বিচারপতি মুহতাসিম আদনানকে অবশ্য আদালতের একমাত্র স্বাধীন বিবেক বলে মনে করা হতো (সূত্র: মিউটিনি অব দ্য স্টেট: মালদিভস গেটস অ্যাওয়ে উইথ অ্যানাদার ক্যু দেতাঁ, আইসাথ ভেলেজিনির ব্লগ)। সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং বিচার বিভাগ যখন ক্ষমতাসীন নেতা প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের হাতের মুঠোয়, তখন দেশের ভেতরের ভিন্নমত কিংবা বিদেশিদের উদ্বেগ-সমালোচনা এগুলোর কোনো কিছুই কি আর কাজে আসে? এ এক অদ্ভুত আইনের শাসন—নবজীবনপ্রাপ্ত স্বৈরশাসন!
বাড়তি হিসেবে ইয়ামিন সরকার কাকতালীয়ভাবে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির একটি অপ্রত্যাশিত সুবিধাও পেয়ে গেছে। চীন এবং ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের খেলায় ভারত ক্ষমতাসীনদের রুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে কোনোভাবেই রাজি নয়, কেননা চীন মালদ্বীপের একটি দ্বীপে তার নৌঘাঁটি বানানোর প্রস্তাব দিয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলে জোর আলোচনা রয়েছে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
ঘটনাক্রম যদি এখানেই থামত, তা-ও হয়তো দেশটিকে আবার গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন স্বৈরশাসকের যেসব উত্তরসূরি পুনর্জন্ম লাভ করেছেন, তঁারা নিজেদের অবস্থান আরও সংহত করতে চান। সুপ্রিম কোর্টে কোনো ধরনের স্বাধীনচেতা বিচারকের অবস্থান যাতে আর না থাকে, তা নিশ্চিত করার মানসে তঁারা আইন সংশোধন করে বিচারকের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে প্রধান বিচারপতিসহ দুজনকে বাদ দিয়ে আদালত পুনর্গঠনের কাজটি করে ফেলেছেন। দেশটির বিচার বিভাগে এখন যা চলছে, তাকে অনেকেই বেছে বেছে ফৌজদারি আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা বা ‘সিলেক্টিভ ইউজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিস’ বলে অভিহিত করেছেন (সূত্র: ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য, চার্লস ট্যানকের নিবন্ধ-প্যারাডাইজ ইন পেরিল: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৫ মে ২০১৫)।
পাশাপাশি সেই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিককে এক ফৌজদারি মামলায় তড়িঘড়ি বিচার করে ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। যে মামলায় তাঁকে দণ্ডিত করা হয়েছে, তাঁর বিচার সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হোসেইন গত ১৩ মার্চ এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে বিচারটি একদিকে যেমন ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হয়নি, তেমনি তা দেশটির নিজস্ব সংবিধান ও আইনও অনুসরণ করেনি। ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করার পর মাত্র ১৯ দিনের মধ্যে ১১ দিনে শুনানি করে তঁাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেওয়া হয়। তঁাকে আপিলের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতেও অবিশ্বাস্য তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। কেননা, আপিলে সবাই যেখানে ৯০ দিন সময় পান, তঁাকে দেওয়া হয়েছে ১০ দিন (সূত্র: জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি)। ওই রাজনীতিকের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের আরও কয়েকজনকে একই ধরনের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে এবং সর্বসম্প্রতি অন্য একটি বিরোধী দলের নেতার বিরুদ্ধেও জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য, চার্লস ট্যানক যে দ্বীপমালার রাষ্ট্রকে স্বর্গ বলে অভিহিত করেছেন, সেই দেশটি আমাদেরই প্রতিবেশী—সার্কের অন্যতম সদস্য মালদ্বীপ। ৩০ বছরের স্বৈরশাসক হলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম, প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ এবং বর্তমানের শাসক গাইয়ুম পরিবারের প্রতিনিধি, তাঁর সৎভাই আবদুল্লাহ ইয়ামিন। নাশিদের ক্ষমতাচ্যুতির পর তঁাকে জেলে পোরা এবং তঁার দলের ওপর যে দমনমূলক কার্যক্রম চলেছিল, তার পটভূমিতে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে প্রাথমিক বাধা পেরিয়ে নাশিদ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। কিন্তু প্রথম দফায় ২০ শতাংশ ভোট বেশি পেলেও তা বাতিল করে যে দ্বিতীয় দফা ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, তাতে নানা অনিয়মের মধ্যে তিনি হেরে যান এবং বিস্ময়কর বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হন ইয়ামিন।
মালদ্বীপের রাজনীতিতে সংকট যতটা, তার সূত্রপাত যে আদালতকে কেন্দ্র করে, এই নিবন্ধের মূল বিষয় সেই আদালত। মালদ্বীপে বিচারকদের নিয়োগ এবং শৃঙ্খলার বিষয়গুলো পরিচালনা ও তদারকের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনামলে একটি আইন প্রণীত হয়, যা জুডিকেচার অ্যাক্ট নামে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর গত ১১ ডিসেম্বর দেশটির পার্লামেন্ট (পিপলস মজলিশ) জুডিকেচার অ্যাক্টের একটি সংশোধনী পাস করে। আর ঠিক তার তিন দিন পর ১৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা সাতজন থেকে কমিয়ে পঁাচজনে নামানো, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আহমেদ ফয়েজ এবং আরেকজন বিচারপতি মুতাসিম আদনানকে অপসারণের সিদ্ধান্ত ওই পিপলস মজলিশে অনুমোদিত হয়।
বিচার বিভাগের ওপর এই অভাবিত এবং বিরল হস্তক্ষেপের ঘটনায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। বিচারক এবং আইনজীবীদের স্বাধীনতার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি, স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার, গ্যাব্রিয়েলা ক্নাউল ২২ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় এই দুজন বিচারপতিকে অপসারণ করা হয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি এবং তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। কোন কারণে তঁাদের অপসারণ করা হয়েছে, তা প্রকাশ না করার বিষয়টি বিশেষভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এই সিদ্ধান্ত দেশটির বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে এবং সর্বস্তরে ভীতিকর প্রভাব ফেলবে। বিবৃতিতে মিস ক্নাউল বলেন যে মালদ্বীপের সংবিধান অনুযায়ী জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন তখনই কোনো বিচারককে অপসারণের সুপারিশ করতে পারে, যখন তিনি চরম অযোগ্যতা অথবা অসদাচরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী অক্ষমতা অথবা ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হওয়ার বিষয়ে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ছাড়া কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় না বলে উল্লেখ করে তিনি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের প্রতি ওই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার আহ্বান জানান।
মালদ্বীপের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর রাজনীতির এই খড়্গ চেপে বসার পেছনের ইতিহাসটিও বেশ গুরুত্ববহ। ৩০ বছরের স্বৈরশাসনকালে গাইয়ুম পরিবার এবং তঁাদের আশীর্বাদপুষ্টরাই মূলত বিচার বিভাগে প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে মোহাম্মদ নাশিদের উত্থান-পরবর্তী গণতন্ত্রায়ণের কালে তঁাদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি থেকেই গেছে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ফৌজদারি আদালতের একজন প্রভাবশালী বিচারক আবদুল্লা মোহাম্মদকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়ার পর যে হাঙ্গামা শুরু হয়, তাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যোগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট নাশিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এখন সেই বিচারককে জোর করে অপহরণ এবং আটকের আদেশ দেওয়ার অপরাধেই নাশিদের কারাদণ্ড হলো। এই অভিযোগে একবার তিনি অব্যাহতি পাওয়ার পর তঁাকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচার করে এই সাজা দেওয়া হয় (মালদিভস এক্স লিডার মোহাম্মদ নাশিদ জেইলড ফর থার্টিন ইয়ারস, বিবিসি, ১৩ মার্চ, ২০১৫)।
তবে মালদ্বীপে বিচার বিভাগকে ঘিরে নাটকীয়তার সবচেয়ে করুণ অধ্যায়টি হচ্ছে অপসারিত প্রধান বিচারপতি আহমেদ ফয়েজকে ঘিরেই। বিচারপতি ফয়েজই প্রেসিডেন্ট নাশিদকে উৎখাতের বিষয়টিকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। আবার নির্বাচনের যে দফায় নাশিদ এগিয়ে ছিলেন, সেই নির্বাচনকে বাতিলের কাজটিও তিনিই করেছিলেন। নির্বাচন কমিশনের অন্তত চারজনকে তিনি কথিত আদালতের কর্তৃত্ব উপেক্ষার দায়ে জেলে পাঠিয়েছেন। এমনকি তিনি দেশটির আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার বিচার শুরু করেছিলেন। কারণ, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে পেশ করা মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা ছিল। দুর্ভাগ্য, বিচারপতি ফয়েজের যে তিনি অপরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর তঁার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এবং কোনো কারণ না দেখিয়েই তঁাকে অপসারণ করা হয়েছে। তঁার সঙ্গে অন্য যে বিচারপতি অপসারিত হয়েছেন, সেই বিচারপতি মুহতাসিম আদনানকে অবশ্য আদালতের একমাত্র স্বাধীন বিবেক বলে মনে করা হতো (সূত্র: মিউটিনি অব দ্য স্টেট: মালদিভস গেটস অ্যাওয়ে উইথ অ্যানাদার ক্যু দেতাঁ, আইসাথ ভেলেজিনির ব্লগ)। সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং বিচার বিভাগ যখন ক্ষমতাসীন নেতা প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের হাতের মুঠোয়, তখন দেশের ভেতরের ভিন্নমত কিংবা বিদেশিদের উদ্বেগ-সমালোচনা এগুলোর কোনো কিছুই কি আর কাজে আসে? এ এক অদ্ভুত আইনের শাসন—নবজীবনপ্রাপ্ত স্বৈরশাসন!
বাড়তি হিসেবে ইয়ামিন সরকার কাকতালীয়ভাবে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির একটি অপ্রত্যাশিত সুবিধাও পেয়ে গেছে। চীন এবং ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের খেলায় ভারত ক্ষমতাসীনদের রুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে কোনোভাবেই রাজি নয়, কেননা চীন মালদ্বীপের একটি দ্বীপে তার নৌঘাঁটি বানানোর প্রস্তাব দিয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলে জোর আলোচনা রয়েছে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments