ভারত গণতন্ত্রের পক্ষে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে -৬৫ দফা যৌথ ঘোষণা
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ‘নতুন দিগন্ত উন্মোচন’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। দুই দিনের রাষ্ট্রীয় ওই সফরের সমাপনী লগ্নে গতকাল হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই তিনি সফরটিকে মূল্যায়ন করেন। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে বিদেশ সচিব জানান, তার দেশ এবং সরকারের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। ভারত গণতন্ত্রের সমর্থন করে তবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। সংবাদ সম্মেলনে সচিবের কাছে প্রশ্ন ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক নিয়ে। ওই বৈঠকে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি’র গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে বলে প্রতিনিধিদলের নেতারা জানিয়েছেন। তবে সেখানে মোদি বা ভারতের তরফে কি বলা হয়েছে সে সম্পর্কে বিএনপি মুখ খুলেনি। সঙ্গত কারণেই বিদেশ সচিবের কাছে মোদি-খালেদা বৈঠক নিয়ে জানতে চান সাংবাদিকরা। বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস. জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেন, ভারত যে গণতন্ত্রের সর্মথন করে এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে বৈঠকে। ৪০ মিনিটের এই বৈঠকের মধ্যে ১৫ মিনিট নরেন্দ্র মোদি এবং খালেদা জিয়া একান্তে আলাপ করেন। এদিকে দেশীয় বিভিন্ন বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, সেখানে আউটকাম নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দিয়েছেন ভারতীয় ওই কূটনীতিক। সেখানে তিনি বলেন, খুলনা-কলকাতা রুটে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু বিষয়ে এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। অচিরেই এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উন্নয়নে ভারত যৌথভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন এস. জয়শঙ্কর। ভেড়ামারা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ লাইনের কাজ এগিয়ে চলছে বলেও জানান দিনি। মুক্তিয?ুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন তিনি। এতে তারা গর্বিত বলেও উল্লেখ করেছেন। সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ, ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ ও ফার্স্ট সেক্রেটারি সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন।
৬৫ দফা যৌথ ঘোষণায় যা আছে: এদিকে বিকালের ওই সংবাদ সম্মেলনে দুই সরকার প্রধানের সম্মতিতে জারি হওয়া যৌথ ঘোষণা (জয়েন্ট ডিক্লারেশন) পাঠ করেন ভারতের বিদেশ সচিব। নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন ঘোষণা বা নয়া দিশা শীর্ষক ওই যৌথ ঘোষণায় ৬৫ দফা রয়েছে। সেখানে সফরের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। জানানো হয়েছে স্থলসীমান্ত চুক্তির দলিল হস্তান্তর এবং এ সংক্রান্ত নতুন প্রোটকল সই হওয়া যে ২২টি বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত ঐকমত্য হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ওই ঘোষণায়। সেখানে তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা এবং টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের একটি শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য সমাধানের পৌঁছানোর কথা যেমন রয়েছে, তেমনি শিক্ষা সংস্কৃতি পর্যটন বিনোদনের মতো বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার কথাও রয়েছে। এ কথায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যত বিষয় রয়েছে তার কম-বেশি সবই সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে বলে দাবি ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের। এই ঘোষণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উল্লিখিত বিষয়াদিতে আগামী দিনে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় যাবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। শনিবার থেকে রোববার সন্ধ্যা অবধি মোদি এখানে যেসব কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছেন তার সবই উল্লেখ রয়েছে ওই ঘোষণায়। সবচেয়ে শুরুত্বপূর্ণ যেসব চুক্তি হয়েছে তাহলো- স্থলসীমান্ত চুক্তি-প্রটোকল অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে। এ সফরে ভারতের দীর্ঘ দিনের চাওয়া সড়ক ও নৌ-পথে ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটির দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। দুটি সড়কে বাস চলাচলের উদ্বোধন হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়িকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। মোদির হাতে তা তুলে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। বঙ্গভবনের সেই আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। যৌথ ঘোষণায় সে সবের উল্লেখ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ বা চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে তার উল্লেখ রয়েছে ঘোষণাতেও। সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে মোদি অঙ্গীকার করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ-ভারত কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন মোদি-হাসিনা।
টিপাইমুখে একতরফা কিছু হবে না, সীমান্ত হত্যা ‘জিরো’তে নামানো হবে: যৌথ ঘোষণায় টিপাইমুখে একতরফা কোন পদক্ষেপ না নেয়ার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছেন মোদি। একই সঙ্গে সীমান্ত হত্যা জিরোতে নিয়ে আসার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন তিনি। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক এবং কনস্যুলার কার্যক্রম জোরদারে মোদি-হাসিনা উভয়ে সম্মত হয়েছেন। গোহাটিতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আগরতলায় ভিসা অফিসকে সহকারী হাইকমিশনে উন্নীত করা। একই সময় সিলেট এবং খুলনায় ভারতের সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বহুমুখী আর্থিক প্রাতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ এবং সংস্কারে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয়েছে যৌথ ওই ঘোষণায়।
‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ প্রসঙ্গে ঘোষণায় যা আছে: বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির গুরুত্ব ও প্রয়োজনের ওপর জোরদার করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। এক্ষেত্রে তিনি বেসরকারি খাতের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ভারতের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা (এসইজি) বরাদ্দ করতে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান মোদি। কোস্টাল শিপিং চুক্তি স্বাক্ষর স্বাগত জানিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। এ চুক্তি দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এ ছাড়াও তারা নতুন বাণিজ্য সুযোগ যোগ করার মধ্য দিয়ে প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড, পিআইডব্লিউটিটি নবায়ন করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুম নামের সাবেক একটি সংগঠনের উত্তরসূরি একটি সংগঠন গড়ে তুলতে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করবেন বলে সম্মত হয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের জন্য ভারত থেকে ঝামেলামুক্ত তুলা সরবরাহ করার বিষয়ে ভারতের আশ্বাসের প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পিপল টু পিপল যোগাযোগ নিশ্চিত করতে নির্বিঘ্ন মাল্টি-মোডাল কানেক্টিভিটির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। আর এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানা উদ্যোগের প্রশংসা করেছে ভারত। দুদেশের মধ্যে মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট এগ্রিমেন্ট নিয়ে সমঝোতা শুরু এবং এ নিয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠনেও তারা সম্মত হয়েছে। ঢাকা-শিলং-গোয়াহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-কলকাতা, এ দুটি বাস সেবা চালু হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ প্রস্তাবিত খুলনা-কলকাতা ও যশোর-কলকাতা এ দুটি নতুন বাস সেবাও উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা সম্পন্ন হবার পর কার্যকর হতে পারে বলে জানিয়েছেন মোদি। রেলওয়ে খাতে চলমান সহযোগিতা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ-ভারত সংযোগকারী কলকাতা-ঢাকা মৈত্রি বাসসহ রেল সেবার যাত্রীদের জন্য ভারতে উপযুক্ত একটি স্থানে ইন্টারন্যাশনাল প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন মোদি। কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কাজগুলো সহজ করতে এটা নির্মাণ করা হবে। ৮০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণ যা পরে অতিরিক্ত ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং ২০ কোটি ডলার বাড়ানো হয়েছিল তার যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে তাতে উভয় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মোদি ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় আরেকটি ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। বিদ্যুৎ, পানি সম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট এবং যোগাযোগ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সম্মত হয় উভয় প্রধানমন্ত্রী। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে স্থল সীমান্ত স্টেশনে বাণিজ্য সুবিধার উন্নয়ন করার সম্ভাব্য উপায় বিবেচনা করছেন চার দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন নতুন খাত যেমন পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মহাকাশ, স্বাস্থ্য, পাট ও বস্ত্র, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফিশারিজসহ অন্যান্য খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি’র অধীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহযোগিতার প্রশংসা করেন তারা। বাংলাদেশ থেকে আরও গবেষক ও বিজ্ঞানিদের ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণ এবং নিজেদের প্রতিভা বিকশিত করতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ ২০১৭ সালে মহাকাশে প্রেরণ করা হবে যা বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে। ভারত সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প গ্রহণ করায় ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। সমুদ্র সীমা নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতা হওয়ার উভয়েই সন্তোষ প্রকাশ করছেন। সমুদ্রভিত্তিক ব্লু ইকোনমি ও ম্যারিটাইম কো-অপারেশন উন্নয়নে পরস্পর নিবিড়ভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন তারা। জলবায়ু পরিবর্তনকে মানবজাতির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উভয়ে একমত হয়েছেন এবং তা মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্ব জোর দিয়ে বলেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে ৭০ হাজার উন্নত রান্নার চুলা স্থাপনের জন্য ইন্ডিয়া এনডাওমেন্ট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এর কাছ থেকে ৫ কোটি ভারতীয় রুপি সহায়তা বাস্তবায়ন করতে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। প্রযুক্তি বিষয়ক পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ পরিচালিত হোম-সিস্টেম স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষা খাতে চলমান সহযোগিতার স্বীকৃতি দিয়ে এ খাতে পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতা বিস্তৃত করতে সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। স্মল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টস সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে ভারতের দেয়া সহযোগিতার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইটিইসি কার্যক্রমের অধীনে বাংলাদেশের জন্য দক্ষতা তৈরি কার্যক্রমে স্বতন্ত্র শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভারতকে ধন্যবাদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৬৫ দফা যৌথ ঘোষণায় যা আছে: এদিকে বিকালের ওই সংবাদ সম্মেলনে দুই সরকার প্রধানের সম্মতিতে জারি হওয়া যৌথ ঘোষণা (জয়েন্ট ডিক্লারেশন) পাঠ করেন ভারতের বিদেশ সচিব। নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন ঘোষণা বা নয়া দিশা শীর্ষক ওই যৌথ ঘোষণায় ৬৫ দফা রয়েছে। সেখানে সফরের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। জানানো হয়েছে স্থলসীমান্ত চুক্তির দলিল হস্তান্তর এবং এ সংক্রান্ত নতুন প্রোটকল সই হওয়া যে ২২টি বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত ঐকমত্য হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ওই ঘোষণায়। সেখানে তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা এবং টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের একটি শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য সমাধানের পৌঁছানোর কথা যেমন রয়েছে, তেমনি শিক্ষা সংস্কৃতি পর্যটন বিনোদনের মতো বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার কথাও রয়েছে। এ কথায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যত বিষয় রয়েছে তার কম-বেশি সবই সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে বলে দাবি ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের। এই ঘোষণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উল্লিখিত বিষয়াদিতে আগামী দিনে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় যাবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। শনিবার থেকে রোববার সন্ধ্যা অবধি মোদি এখানে যেসব কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছেন তার সবই উল্লেখ রয়েছে ওই ঘোষণায়। সবচেয়ে শুরুত্বপূর্ণ যেসব চুক্তি হয়েছে তাহলো- স্থলসীমান্ত চুক্তি-প্রটোকল অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে। এ সফরে ভারতের দীর্ঘ দিনের চাওয়া সড়ক ও নৌ-পথে ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটির দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। দুটি সড়কে বাস চলাচলের উদ্বোধন হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়িকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। মোদির হাতে তা তুলে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। বঙ্গভবনের সেই আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। যৌথ ঘোষণায় সে সবের উল্লেখ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ বা চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে তার উল্লেখ রয়েছে ঘোষণাতেও। সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে মোদি অঙ্গীকার করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ-ভারত কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন মোদি-হাসিনা।
টিপাইমুখে একতরফা কিছু হবে না, সীমান্ত হত্যা ‘জিরো’তে নামানো হবে: যৌথ ঘোষণায় টিপাইমুখে একতরফা কোন পদক্ষেপ না নেয়ার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছেন মোদি। একই সঙ্গে সীমান্ত হত্যা জিরোতে নিয়ে আসার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন তিনি। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক এবং কনস্যুলার কার্যক্রম জোরদারে মোদি-হাসিনা উভয়ে সম্মত হয়েছেন। গোহাটিতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আগরতলায় ভিসা অফিসকে সহকারী হাইকমিশনে উন্নীত করা। একই সময় সিলেট এবং খুলনায় ভারতের সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বহুমুখী আর্থিক প্রাতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ এবং সংস্কারে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয়েছে যৌথ ওই ঘোষণায়।
‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ প্রসঙ্গে ঘোষণায় যা আছে: বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির গুরুত্ব ও প্রয়োজনের ওপর জোরদার করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। এক্ষেত্রে তিনি বেসরকারি খাতের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ভারতের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা (এসইজি) বরাদ্দ করতে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান মোদি। কোস্টাল শিপিং চুক্তি স্বাক্ষর স্বাগত জানিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। এ চুক্তি দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এ ছাড়াও তারা নতুন বাণিজ্য সুযোগ যোগ করার মধ্য দিয়ে প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড, পিআইডব্লিউটিটি নবায়ন করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুম নামের সাবেক একটি সংগঠনের উত্তরসূরি একটি সংগঠন গড়ে তুলতে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করবেন বলে সম্মত হয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের জন্য ভারত থেকে ঝামেলামুক্ত তুলা সরবরাহ করার বিষয়ে ভারতের আশ্বাসের প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পিপল টু পিপল যোগাযোগ নিশ্চিত করতে নির্বিঘ্ন মাল্টি-মোডাল কানেক্টিভিটির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। আর এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানা উদ্যোগের প্রশংসা করেছে ভারত। দুদেশের মধ্যে মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট এগ্রিমেন্ট নিয়ে সমঝোতা শুরু এবং এ নিয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠনেও তারা সম্মত হয়েছে। ঢাকা-শিলং-গোয়াহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-কলকাতা, এ দুটি বাস সেবা চালু হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ প্রস্তাবিত খুলনা-কলকাতা ও যশোর-কলকাতা এ দুটি নতুন বাস সেবাও উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা সম্পন্ন হবার পর কার্যকর হতে পারে বলে জানিয়েছেন মোদি। রেলওয়ে খাতে চলমান সহযোগিতা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ-ভারত সংযোগকারী কলকাতা-ঢাকা মৈত্রি বাসসহ রেল সেবার যাত্রীদের জন্য ভারতে উপযুক্ত একটি স্থানে ইন্টারন্যাশনাল প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন মোদি। কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কাজগুলো সহজ করতে এটা নির্মাণ করা হবে। ৮০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণ যা পরে অতিরিক্ত ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং ২০ কোটি ডলার বাড়ানো হয়েছিল তার যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে তাতে উভয় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মোদি ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় আরেকটি ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। বিদ্যুৎ, পানি সম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট এবং যোগাযোগ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সম্মত হয় উভয় প্রধানমন্ত্রী। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে স্থল সীমান্ত স্টেশনে বাণিজ্য সুবিধার উন্নয়ন করার সম্ভাব্য উপায় বিবেচনা করছেন চার দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন নতুন খাত যেমন পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মহাকাশ, স্বাস্থ্য, পাট ও বস্ত্র, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফিশারিজসহ অন্যান্য খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি’র অধীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহযোগিতার প্রশংসা করেন তারা। বাংলাদেশ থেকে আরও গবেষক ও বিজ্ঞানিদের ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণ এবং নিজেদের প্রতিভা বিকশিত করতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ ২০১৭ সালে মহাকাশে প্রেরণ করা হবে যা বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে। ভারত সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প গ্রহণ করায় ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। সমুদ্র সীমা নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতা হওয়ার উভয়েই সন্তোষ প্রকাশ করছেন। সমুদ্রভিত্তিক ব্লু ইকোনমি ও ম্যারিটাইম কো-অপারেশন উন্নয়নে পরস্পর নিবিড়ভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন তারা। জলবায়ু পরিবর্তনকে মানবজাতির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উভয়ে একমত হয়েছেন এবং তা মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্ব জোর দিয়ে বলেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে ৭০ হাজার উন্নত রান্নার চুলা স্থাপনের জন্য ইন্ডিয়া এনডাওমেন্ট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এর কাছ থেকে ৫ কোটি ভারতীয় রুপি সহায়তা বাস্তবায়ন করতে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। প্রযুক্তি বিষয়ক পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ পরিচালিত হোম-সিস্টেম স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষা খাতে চলমান সহযোগিতার স্বীকৃতি দিয়ে এ খাতে পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতা বিস্তৃত করতে সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। স্মল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টস সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে ভারতের দেয়া সহযোগিতার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইটিইসি কার্যক্রমের অধীনে বাংলাদেশের জন্য দক্ষতা তৈরি কার্যক্রমে স্বতন্ত্র শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভারতকে ধন্যবাদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
No comments