মোদির সফর- বাংলাদেশের সঙ্গে সদ্ভাব কেন জরুরি? by আলী রীয়াজ
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বাংলাদেশে তাঁর দুই দিনের সফরের
প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক
আলোচনা, নৈশভোজ এবং বিভিন্ন চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
হয়েছে। আজ রোববার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং অন্যান্য
আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি যখন ফিরতি যাত্রা করবেন, তখন গণমাধ্যমের প্রধান
বিষয় হবে এ সফর কতটা সফল, দুই পক্ষ এ সফর থেকে কী অর্জন করেছে। ভারতীয়
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ হবে কি না, এ
বিষয়ে বিস্তর অনুমান এবং প্রচারণার পরে তাঁদের আজ রোববার সাক্ষাতের কথা;
ফলে সারা দিন এবং সম্ভবত তার পরেও এ নিয়ে আলোচনা চলবে। গত কয়েক দিনে যেমন
বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব
মুখার্জির সঙ্গে দেখা না করার অবিবেচক সিদ্ধান্তের পরিণতি বিএনপির জন্য
ভালো হয়নি, তেমনি উল্লিখিত হবে এ সাক্ষাতের জন্য বিএনপি এবং তার নেত্রীকে
তাঁর আগের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কতটা সরে আসতে হয়েছে। আজ মোদি
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে যে বক্তব্য দেবেন তার বিষয় ও সুর দুই-ই ভালো
করে লক্ষ করার বিষয়।
গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশেই, বিশেষত বাংলাদেশে, উৎসাহ ছিল অভূতপূর্ব। সম্ভবত অতীতে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে জামায়াতে ইসলামী থেকে সিপিবি পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দল এতটা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়নি। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন ঢাকা সফর করেন, সে সময় যতটা আগ্রহ ও উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়েছিল, এবার উৎসাহের মাত্রা তার চেয়ে বেশি বলেই মনে হয়েছে। এই সফরের সাফল্য বিবেচনা করতে হলে কী কারণে উৎসাহ তৈরি হয়েছে, সেটা মনে রাখা দরকার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বড় ধরনের উন্নতি ঘটবে। ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে দলগতভাবে এবং আদর্শিক অবস্থান থেকেও আওয়ামী লীগের যোগাযোগ থাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর তাঁর জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে ঢাকা আসবেন, সেটা ছিল নিশ্চিত বিষয়, সেটা না হলেই বরং বিস্ময়ের কারণ তৈরি হতো।
বিপরীতক্রমে ২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতার হাতবদলের পর অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল, আপাতদৃষ্টে আদর্শিকভাবে বিপরীতমুখী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতো উষ্ণ থাকবে কি না। বাংলাদেশে সরকারবিরোধীদের একাংশ, প্রধানত বিএনপির নেতারা তাঁদের ‘প্রত্যাশা’কে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ’ বলে মনে করে আনন্দিত হয়েছিলেন; তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে একধরনের চাপের মুখে পড়বে। ভারত তার জাতীয় স্বার্থেই আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছে, দলীয় বিবেচনায় নয়, সেটা তাঁরা বুঝতে সক্ষম হননি।
এতত্সত্ত্বেও অনেকে ভেবেছিলেন যে ২০১৪ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনে কংগ্রেস যতটা আগ বাড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছে, বিজেপি সম্ভবত তাতে রাশ টেনে ধরবে। ফলে অনেকেই গত বছরে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক অনুসরণ করেছেন। মোদির সফরের আগে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমানা চুক্তিটি পার্লামেন্টে পাস করানোর পর ধরে নেওয়া হচ্ছে যে বিজেপি সরকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিতে আগ্রহী এবং তার লক্ষ্য ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ানো। এটা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, অন্য প্রতিবেশীদের বিষয়েও এ ধরনের ইঙ্গিতই মোদি সরকার দিয়েছে। এ বিবেচনায় মনমোহন সিংয়ের সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারের পররাষ্ট্রনীতির একটা পার্থক্য আছে। গত কয়েক মাসে দক্ষিণ
এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোদি সরকারের উদ্যোগ এবং পদক্ষেপের মধ্যেই এটা স্পষ্ট। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ভারতের আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি দুই বিবেচনাকে মাথায় রেখে অনেকে মোদির এ সফরকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কেবল এ দুই বিবেচনার আলোকে বিচার করাই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয় না। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ—যার উপাদান হচ্ছে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং ভূরাজনৈতিক—সেগুলো বিবেচনায় রেখেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দেখছে। ভারতের এ চিন্তাকাঠামোয় তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে, বিশেষত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক খুবই জরুরি। ভারতের বিবেচনা কেবল দ্বিপক্ষীয় নয়, তার একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনা রয়েছে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘লুক ইস্ট’ নীতিকে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিতে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ভারত গত এক বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। আর তার পেছনে কাজ করছে চীনের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারত চীনকেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে এবং সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হিসেবে সে দক্ষিণ এশিয়া নয়, দেখছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে। সেখানে তারা বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তা দুভাবেই চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জোরদার করছে। উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বাড়ছে, গত বছরে তার মোট বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ ছিল ওই অঞ্চলে, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের চেয়ে বেশি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য গত বছরে ছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলারের মতো, তার পরিমাণ এখন আরও বাড়ছে।
বাণিজ্যিকভাবেই কেবল নয়, সামরিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে ভারত এ অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। প্রযুক্তিগতভাবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে অগ্রসর নৌ-শক্তি জাপানের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির চেষ্টার লক্ষ্য ভারত মহাসাগরে তার প্রভাবকে জোরদার করা। চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে ভারত ভিয়েতনামকে কেবল ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণই দেয়নি, একই সঙ্গে নৌযানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার প্রস্তাবও দিয়েছে। ভারত দক্ষিণ চীন উপসাগরে চলাচলের ভিয়েতনামের অধিকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে, যা চীনের মোটেই পছন্দের বিষয় নয়। মিয়ানমারে ভারতের বিনিয়োগ এবং তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার উদ্দেশ্যও একই। যুক্তরাষ্ট্র যদিও ভারত মহাসাগরে ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে, কিন্তু চীনের প্রভাবকে মোকাবিলায় স্থানীয় শক্তিগুলোর মধ্যে ভারতের কোনো বিকল্প নেই বলেই সে ধরে নিয়েছে। ভারত সেই সুযোগকে যতটা সম্ভব তার স্বার্থে ব্যবহার করছে।
ভারতের এই আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই যুক্ত আছে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক, কেননা ভারত অবশ্যই আশা করে যে চীনের প্রভাব বিস্তার মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকবে; অন্ততপক্ষে চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না। একই সঙ্গে ভারত এটাও আশা করে যে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালাবে না। গত এক দশকে চীন যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ায় তার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে এবং তার প্রভাবের মাত্রা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে, সেহেতু ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে সেই প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখা। শুধু তা-ই নয়, ভারত অবশ্যই আশা করে যে তার নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ যেন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে না ওঠে। বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য কোনো রকমভাবে চ্যালেঞ্জ হলে ভারতকে কেবল এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে এবং তার সম্পদ ব্যবহার করতে হবে তা নয়, ভৌগোলিক কারণে চীন তা থেকে সুবিধা পাবে। এসব বিবেচনায়ই ভারত মনে করে, বাংলাদেশে এমন সরকার থাকা দরকার, যার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল সৌহার্দ্যপূর্ণই নয়, নির্ভরযোগ্য বলেও বিবেচিত হতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক রাজনীতির এ বিবেচনাই এখন পর্যন্ত ভারতের বাংলাদেশ নীতির নিয়ামক বলে মনে হয়। সেই দিক থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি বিজেপি সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে দুটো প্রশ্ন উঠতে পারে; প্রথমত, সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বিএনপির ভারতবিষয়ক নীতিতে পরিবর্তন ভারতের নীতিনির্ধারকদের ওপরে কোনো রকম প্রভাব ফেলবে কি না; দ্বিতীয়ত, স্বল্প মেয়াদে এ নীতি ভারতের জন্য সুফলদায়ক হলেও বাংলাদেশ যদি অব্যাহতভাবে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তবে সেটা মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ভারতের জন্য ইতিবাচক কি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশেই, বিশেষত বাংলাদেশে, উৎসাহ ছিল অভূতপূর্ব। সম্ভবত অতীতে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে জামায়াতে ইসলামী থেকে সিপিবি পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দল এতটা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়নি। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন ঢাকা সফর করেন, সে সময় যতটা আগ্রহ ও উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়েছিল, এবার উৎসাহের মাত্রা তার চেয়ে বেশি বলেই মনে হয়েছে। এই সফরের সাফল্য বিবেচনা করতে হলে কী কারণে উৎসাহ তৈরি হয়েছে, সেটা মনে রাখা দরকার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বড় ধরনের উন্নতি ঘটবে। ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে দলগতভাবে এবং আদর্শিক অবস্থান থেকেও আওয়ামী লীগের যোগাযোগ থাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর তাঁর জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে ঢাকা আসবেন, সেটা ছিল নিশ্চিত বিষয়, সেটা না হলেই বরং বিস্ময়ের কারণ তৈরি হতো।
বিপরীতক্রমে ২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতার হাতবদলের পর অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল, আপাতদৃষ্টে আদর্শিকভাবে বিপরীতমুখী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতো উষ্ণ থাকবে কি না। বাংলাদেশে সরকারবিরোধীদের একাংশ, প্রধানত বিএনপির নেতারা তাঁদের ‘প্রত্যাশা’কে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ’ বলে মনে করে আনন্দিত হয়েছিলেন; তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে একধরনের চাপের মুখে পড়বে। ভারত তার জাতীয় স্বার্থেই আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছে, দলীয় বিবেচনায় নয়, সেটা তাঁরা বুঝতে সক্ষম হননি।
এতত্সত্ত্বেও অনেকে ভেবেছিলেন যে ২০১৪ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনে কংগ্রেস যতটা আগ বাড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছে, বিজেপি সম্ভবত তাতে রাশ টেনে ধরবে। ফলে অনেকেই গত বছরে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক অনুসরণ করেছেন। মোদির সফরের আগে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমানা চুক্তিটি পার্লামেন্টে পাস করানোর পর ধরে নেওয়া হচ্ছে যে বিজেপি সরকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিতে আগ্রহী এবং তার লক্ষ্য ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ানো। এটা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, অন্য প্রতিবেশীদের বিষয়েও এ ধরনের ইঙ্গিতই মোদি সরকার দিয়েছে। এ বিবেচনায় মনমোহন সিংয়ের সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারের পররাষ্ট্রনীতির একটা পার্থক্য আছে। গত কয়েক মাসে দক্ষিণ
এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোদি সরকারের উদ্যোগ এবং পদক্ষেপের মধ্যেই এটা স্পষ্ট। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ভারতের আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি দুই বিবেচনাকে মাথায় রেখে অনেকে মোদির এ সফরকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কেবল এ দুই বিবেচনার আলোকে বিচার করাই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয় না। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ—যার উপাদান হচ্ছে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং ভূরাজনৈতিক—সেগুলো বিবেচনায় রেখেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দেখছে। ভারতের এ চিন্তাকাঠামোয় তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে, বিশেষত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক খুবই জরুরি। ভারতের বিবেচনা কেবল দ্বিপক্ষীয় নয়, তার একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনা রয়েছে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘লুক ইস্ট’ নীতিকে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিতে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ভারত গত এক বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। আর তার পেছনে কাজ করছে চীনের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারত চীনকেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে এবং সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হিসেবে সে দক্ষিণ এশিয়া নয়, দেখছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে। সেখানে তারা বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তা দুভাবেই চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জোরদার করছে। উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বাড়ছে, গত বছরে তার মোট বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ ছিল ওই অঞ্চলে, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের চেয়ে বেশি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য গত বছরে ছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলারের মতো, তার পরিমাণ এখন আরও বাড়ছে।
বাণিজ্যিকভাবেই কেবল নয়, সামরিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে ভারত এ অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। প্রযুক্তিগতভাবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে অগ্রসর নৌ-শক্তি জাপানের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির চেষ্টার লক্ষ্য ভারত মহাসাগরে তার প্রভাবকে জোরদার করা। চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে ভারত ভিয়েতনামকে কেবল ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণই দেয়নি, একই সঙ্গে নৌযানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার প্রস্তাবও দিয়েছে। ভারত দক্ষিণ চীন উপসাগরে চলাচলের ভিয়েতনামের অধিকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে, যা চীনের মোটেই পছন্দের বিষয় নয়। মিয়ানমারে ভারতের বিনিয়োগ এবং তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার উদ্দেশ্যও একই। যুক্তরাষ্ট্র যদিও ভারত মহাসাগরে ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে, কিন্তু চীনের প্রভাবকে মোকাবিলায় স্থানীয় শক্তিগুলোর মধ্যে ভারতের কোনো বিকল্প নেই বলেই সে ধরে নিয়েছে। ভারত সেই সুযোগকে যতটা সম্ভব তার স্বার্থে ব্যবহার করছে।
ভারতের এই আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই যুক্ত আছে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক, কেননা ভারত অবশ্যই আশা করে যে চীনের প্রভাব বিস্তার মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকবে; অন্ততপক্ষে চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না। একই সঙ্গে ভারত এটাও আশা করে যে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালাবে না। গত এক দশকে চীন যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ায় তার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে এবং তার প্রভাবের মাত্রা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে, সেহেতু ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে সেই প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখা। শুধু তা-ই নয়, ভারত অবশ্যই আশা করে যে তার নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ যেন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে না ওঠে। বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য কোনো রকমভাবে চ্যালেঞ্জ হলে ভারতকে কেবল এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে এবং তার সম্পদ ব্যবহার করতে হবে তা নয়, ভৌগোলিক কারণে চীন তা থেকে সুবিধা পাবে। এসব বিবেচনায়ই ভারত মনে করে, বাংলাদেশে এমন সরকার থাকা দরকার, যার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল সৌহার্দ্যপূর্ণই নয়, নির্ভরযোগ্য বলেও বিবেচিত হতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক রাজনীতির এ বিবেচনাই এখন পর্যন্ত ভারতের বাংলাদেশ নীতির নিয়ামক বলে মনে হয়। সেই দিক থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি বিজেপি সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে দুটো প্রশ্ন উঠতে পারে; প্রথমত, সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বিএনপির ভারতবিষয়ক নীতিতে পরিবর্তন ভারতের নীতিনির্ধারকদের ওপরে কোনো রকম প্রভাব ফেলবে কি না; দ্বিতীয়ত, স্বল্প মেয়াদে এ নীতি ভারতের জন্য সুফলদায়ক হলেও বাংলাদেশ যদি অব্যাহতভাবে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তবে সেটা মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ভারতের জন্য ইতিবাচক কি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments