গল্প- ফেসবুকে বন্ধুর মুখ by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
ভেবেছিলাম গল্পটা আপনাদের বলব না।
থানায় ঢুকে সোজা ওসি সাহেবের সামনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি একটা খুন করেছি, আমাকে অ্যারেস্ট করুন।’ টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে একটা রুল টানা কাগজে কী যেন লিখছিলেন, মাথা না তুলেই বললেন, ‘কাকে?’ তাঁর এই প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত ও হতাশ বোধ করলাম।
থানায় ঢুকে সোজা ওসি সাহেবের সামনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি একটা খুন করেছি, আমাকে অ্যারেস্ট করুন।’ টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে একটা রুল টানা কাগজে কী যেন লিখছিলেন, মাথা না তুলেই বললেন, ‘কাকে?’ তাঁর এই প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত ও হতাশ বোধ করলাম।
একটা নাটকীয় মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা
করছিলাম, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবেন, চিৎকার করে সেন্ট্রিকে ডেকে বলবেন,
অ্যারেস্ট করো...। সে সব কিছুই না, শান্ত নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘কাকে?’
যেন এ দেশে যত খুন-জখম হয় সব ক্ষেত্রে খুনিরা নিজেই থানায় এসে ধরা দেয়, যেন
এটাই স্বাভাবিক।
বললাম, ‘আমার এক বন্ধুকে।’
এবার চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে, সেই দৃষ্টিতেও তেমন বিস্ময় নেই, বললেন, ‘গুলি করেছেন, না ছুরি মেরে...?’
‘ঠিক সে রকম নয়..’
বললাম, ‘আমার এক বন্ধুকে।’
এবার চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে, সেই দৃষ্টিতেও তেমন বিস্ময় নেই, বললেন, ‘গুলি করেছেন, না ছুরি মেরে...?’
‘ঠিক সে রকম নয়..’
ভ্রু কুঁচকালেন, বিরক্তির রেখা ফুটল মুখে
‘সে রকম নয় তো কী রকম?’
‘তার মৃত্যুর জন্য আমি পরোক্ষভাবে দায়ী...না না, ঠিক পরোক্ষ বলা যায় না, আমি প্রত্যক্ষভাবেই...।’
‘বেরোও...।’
‘জি...?’
এবার প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি, ‘গেট লস্ট...কে ঢুকতে দিয়েছে এখানে? ...জাহিদ...জাহিদ...।’
জাহিদ আসার আগে নিজেই বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, শুনলাম ওসি সাহেব বিড়বিড় করছেন, ‘শালা, সকাল থেকে আসল কাজে বাঁচি না, কোত্থেকে ফালতু ঝুট-ঝামেলা...শালা ড্রাগ অ্যাডিক্ট...।’
ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমি ড্রাগ অ্যাডিক্ট না, স্যার।’
কথাটা পছন্দ হলো না তাঁর। তিনি মানুষ চেনেন, তিনি বলছেন আমি ড্রাগ অ্যাডিক্ট, অথচ আমি তা অস্বীকার করছি—এটা সহ্য করতে পারলেন না, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন, চিৎকার করে বললেন, ‘অ্যাই ব্যাটা বাইর অ, অহন বাইর অ, নাইলে...।’
আমি এবার বেরিয়ে এলাম বিনা বাক্যব্যয়ে। ওসির কক্ষের বাইরে করিডরের মতো একফালি জায়গা, স্থান-সংকুলানের জন্য সেখানেও টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসতে হয়েছে থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বেরিয়ে আসার মুখে চোখাচোখি হয়ে গেল একজন মহিলা পুলিশের সঙ্গে, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন, বললেন, ‘স্যারের মেজাজ আজ সকাল থেকে খারাপ। আপনার সমস্যা কী?’
আমি জীবনে এত সুন্দরী মহিলা পুলিশ দেখিনি। সুন্দরীদের হাসিতে মৃতসঞ্জীবনী সুধা থাকে, আর আমি তো এখনো জীবিত মানুষ, তাই এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও সামান্য ভালো বোধ করলাম! তাঁর সামনের চেয়ারে বসলাম। ভরসা পেয়ে গড় গড় করে আমার সব কথা খুলে বললাম। তিনি অসীম ধৈর্যে আমার কথা শুনলেন। শেষে প্রায় তাঁর হাত ধরার উপক্রম করে বললাম, ‘আমার শাস্তির ব্যবস্থা করুন, নইলে আমি আত্মহত্যা করব।’
তিনি কিছুক্ষণ গভীর কৌতূহলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, হয়তো চেহারার বৈশিষ্ট্য দেখে অনুমান করার চেষ্টা করছিলেন সত্যি আমি আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ কি না। তারপর করুণা ও সান্ত্বনা মেশানো গলায় বললেন, ‘আপনি ভিকটিমের পরিবারের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলুন, তারা যদি মামলা করে তাহলে আমরা আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারব।’
ভিকটিমের পরিবার মানে সাইদুলের বাবা-মা, আমি তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব? গিয়ে বলব, আপনাদের ছেলের মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব আমার? অসম্ভব! সেই স্কুল-বয়সে কত দিন খালাম্মা সাইদুল আর আমাকে একই প্লেট থেকে লোকমা তুলে ভাত খাইয়ে দিয়েছেন। তাঁকে গিয়ে বলব, আপনাদের ছেলেকে...উহ্, তার চেয়ে আমার মৃত্যু ভালো!
তাহলে গল্পটা আপনাদেরই বলি।
সাইদুল প্রায়ই বলত সে জীবনে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়বে না। বলত, কারণ আমার সঙ্গে সীমার ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটা তাকে প্রায় আমার সমান কষ্ট দিয়েছিল। আমি যতই বলি, এই পড়া না পড়ার ব্যাপারটা নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এটা দৈবনির্ভর, সে কিছুতেই মানবে না। কিন্তু আমি তো জানতাম সে পড়বেই, ছোটবেলা থেকে চিনি তো। যে ছেলে একটি ভালো কবিতা পড়ে আধঘণ্টা চুপচাপ একটিও কথা না বলে কাটিয়ে দেয়, গান শোনে চোখ বন্ধ করে, সিনেমা দেখে চোখের পানি আড়াল করতে পারে না, সে প্রেমে পড়বে না?
সাইদুল বলে, ‘দেখিস।’
আমি বললাম, ‘দেখি।’
একদিন মরীচিকা ছদ্মনামে একটি মেয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল তাকে। বলল, ‘কী বলিস, অ্যাকসেপ্ট করব?’
বললাম, ‘ভেবে দ্যাখ, সত্যি সত্যিই মেয়ে নাকি কেউ ফাজলামি করে।’
সাইদুল বলল, মেয়েটি তাকে ইনবক্সে জানিয়েছে আসল নাম ইশিতা ইসলাম, মেয়ে বলে নানা বিড়ম্বনার কারণে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে।
‘তাহলে আর কী, অ্যাকসেপ্ট কর।’
মরীচিকা, মানে ইশিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করল সাইদুল। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে এর আগে আর কখনোই অপরিচিত মেয়েকে ফেসবুকের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। বরং বলা যায় তার শ চারেক বন্ধুর যে তালিকা তাতে অপরিচিতের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এবার সাইদুলের জীবনটা পাল্টে গেল।
আমার সঙ্গে প্রতিদিনের আড্ডায় একবার ইশিতার প্রসঙ্গ আসবেই। প্রতিদিন নতুন নতুন বিস্ময়ের তথ্য নিয়ে হাজির হয় সাইদুল। ইশিতার সঙ্গে তার জীবনের অদ্ভুত সব মিল। যেমন সাইদুলরা দুই ভাই, ইশিতারা দুই বোন। সাইদুলের বড় ভাই মারা গিয়েছিল রোড অ্যাকসিডেন্টে, ইশিতার বড় বোনটিরও মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল একইভাবে। বড় ভাই আরিফকে এখনো ভুলতে পারে না সাইদুল। আর ইশিতা এখনো স্বপ্নে বড় বোনকে দেখে ধড়ফড় করে জেগে ওঠে, মনে হয় বিছানায় তার পাশেই যেন শুয়ে আছে নিকিতা। দুটি মানুষের জীবন কি করে এতটাই মিলে যেতে পারে ভেবে পায় না সাইদুল-ইশিতা কেউই। ক্লাস নাইনে থাকার সময়ে একবার বাবার ওপর রাগ করে ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সাইদুল। আর মা-বাবা এক ক্লাসমেটের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যে সন্দেহ করেছিল বলে সাতটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলেছিল ইশিতা। সে কী কাণ্ড...হাসপাতালে গিয়ে স্টমাক ওয়াশ করতে হয়েছিল।
সাইদুলের পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে ওকে ফার্স্ট হতে দেখে অভ্যস্ত আমরা। কিছুতেই নাগাল না পেয়ে ওর পেছনে দৌড়ানোটাই নিয়মে দাঁড়িয়েছে আমাদের। ক্লাসের মেয়েরা তো বটেই, নিচের ক্লাসের মেয়েরাও সাইদুল ভা...ই...ই বলে কেমন আইসক্রিমের মতো গলতে থাকে, সে তো আমাদের চোখের দেখা। আমার সঙ্গে সীমার ছাড়াছাড়ির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিল সাইদুলই, অথচ আমার ধারণা, সীমা আসলে ভালোবাসতে চেয়েছিল সাইদুলকেই।
আজ সেই সাইদুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে লেখাপড়া মাথায় তুলে ইশিতাকে নিয়ে মেতে আছে। ইশিতার প্রিয় রং নীল, সাইদুলের নীল-সবুজ দুটোই। আগে ইশিতার প্রিয় গানের শিল্পী ছিল জাস্টিন বিবার, এখন তার গান দূরে থাক নামই শুনতে ইচ্ছে করে না আর...এখন ব্রায়ান এডামসে ডুবে আছে সে। ব্রায়ান এডামস সাইদুলেরও প্রিয় শিল্পী, কিন্তু বাংলা গান শোনে বেশি, মৌসুমী ভৌমিকের গান. মাইলস, ভূমি বা চন্দ্রবিন্দুর মতো ব্যান্ডগুলোর অন্য রকম পরিবেশনা ভালো লাগে তার। ইশিতাও আজকাল নতুন করে সাইদুলের পছন্দের গানগুলো শুনতে শুরু করেছে।
সাইদুলের ইচ্ছা ছিল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবে, কিন্তু পরিবারের চাপে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ট্রিপল ই-তে ভর্তি হয়েছে সে। কী আশ্চর্য ইশিতাও চেয়েছিল বাংলা অনার্স পড়বে, কিন্তু বাধ্য হয়েছে মেডিকেল কলেজে পড়তে। বঙ্কিম, মানিক থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এমনকি সুনীল বা আনিসুল হকের উপন্যাস, শক্তি, গুণ, জয় গোস্বামীর কবিতা দুজনেরই কত কত রাত জাগার সঙ্গী হয়ে থাকে। দুজনের প্রিয় ঋতু বর্ষা। ইশিতা বৃষ্টিতে ভেজে ছাদে গিয়ে, সাইদুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উদ্দেশ্যহীন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
‘এ রকম কী করে হয় বল তো স্বপন, দুজনের ভাবনা কী করে এক বিন্দুতে মিলে যায়?’
আমি উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
আরও প্রায় ছয় মাস পর একদিন দেখা করার কথা তোলে সাইদুল। ফেসবুকে ছবি ছিল না ইশিতার, কভার ছবিতে মেঘলা আকাশ আর প্রোফাইল পিকচার একটা কাগজের নৌকা। দেখা করতে রাজি হয় না ইশিতা।
‘আমাকে দেখে যদি তোমার স্বপ্ন ভেঙে যায়?’
‘ভাঙবে না, কারণ আমি তো তোমার মন ছুঁয়ে দেখেছি।’
‘তবু একটা কল্পনার ছবি তো তৈরি হয় মনে...যদি না মেলে?’
‘না যদি মেলে মিলবে না, আমাদের দুজনের জীবনে এত এত মিল, এই একটা অমিল না হয় থাকলই।’
‘এখনই না, আমি বলব।’
‘ঠিক আছে আমার কোনো তাড়া নেই।’
একটু দমে গিয়েছিল বোধ হয়, কয়েকটা দিন খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। এসব কথা তো আমি ছাড়া আর কারও সঙ্গে শেয়ার করত না, এক বিকেলে ডিসি হিল পার্কের একটা বড় শিরীষগাছের গোড়ালিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম দুজনে, বলল, ‘ইশিতা হয়তো আমাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না।’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক, শুধু ফেসবুকে পরিচয়।’
আমাকে চমকে দিয়ে সাইদুল দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘না স্বপন, এ শুধু ফেসবুকের হঠাৎ পরিচয় নয়, এ পরিচয় পুরো এক জীবনের। কোনো না-কোনোভাবে কোথাও না কোথাও ওর সঙ্গে আমার দেখা হতোই।’
সেদিন বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আশৈশব বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে অনেক কথা ঘুরপাক খেতে থাকে মনে—কে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন, প্রেম হচ্ছে আসলে একটি ধারণামাত্র, প্রেমিক নিজের জন্য নিজেই সেই ধারণাটি তৈরি করে।
দুদিন পর আবার যখন দেখা হলো সাইদুলের সঙ্গে তখন সে খুশিতে উত্তেজনায় টগবগ করছে। ওকে ইশিতা বলেছে, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’
‘তুই কী বললি?’
‘আমি এক হাজারটা হ্যাঁ লিখে দিয়েছি পুরো পেজজুড়ে।’
‘বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলি? চিনিস না জানিস না একটা মেয়েকে...।’
‘চিনি না জানি না মানে? আমার চেয়ে বেশি আর কে চেনে ওকে? তুই চিনিস শালা, তুই চিনিস?’
এর মধ্যে ইশিতার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার দিন-তারিখ ঠিক হলো। কোথায় দেখা হবে আমাকে জানাতে চায় না সাইদুল, শুধু বলল, পরে সব জানাবে।
বিকেল পাঁচটায় ইশিতার আসার কথা। জানতাম তার অনেক আগে পতেঙ্গা নেভাল বিচের রাস্তায় হাজির হবে সাইদুল। আমি আড়াল থেকে দেখলাম, সুনীলের কবিতার বই হাতে নীল সালোয়ার-কামিজ পরা একটি মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা। পাঁচটা, ছয়টা, সাতটা...সময় যত গড়াচ্ছে তত উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে। নেভাল বিচের রাস্তায় সেদিন বেড়াতে আসা প্রতিটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে খুঁজছে নীল জামা, হাতে সুনীলের কবিতার বই!
আমি পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠল সে, বললাম, ‘আসেনি?’
গভীর বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাল সে। কেমন আতঙ্কিত চোখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল সাইদুল, আমার চেহারাটা কি হিংস্র দেখাচ্ছিল?
‘তুই কখনো প্রেমে পড়বি না বলেছিলি, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, তো?’
আমার ভেতরে লুকানো পশুটা কি বেরিয়ে পড়েছিল? এই সাইদুল জীবনে কখনো আমাকে ক্লাসে ফার্স্ট হতে দেয়নি। আমার প্রেমিকা শেষ পর্যন্ত ভালোবেসেছিল ওকে। অবচেতনে সঞ্চিত সব পরাজয়ের বোধ যেন হঠাৎ এসে দাঁড়ায় সামনে। সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটিয়ে দেয় আমার, বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত পড়লিই তো...এত বোকা তুই? একটা ফেক অ্যাকাউন্টের প্রেমে পড়লি!’
থরথর করে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সাইদুল, কী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। উফ্ কী দৃষ্টি! কী ঘৃণা, কী ঘৃণা সেই দৃষ্টিতে! আমি মিশে যাচ্ছিলাম ধুলায়-মাটিতে। দুই হাত আঁকড়ে ধরেছিলাম ওর, এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল, ‘তুই...? তুই...?’
পাগলের মতো ছুটতে শুরু করেছিল, আমি পেছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে ডেকেছি, ‘সাইদুল...সাইদুল...।’
পাইনি, অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল কোথায়...।
পরদিন সকালে আমরা জেনেছি, কর্ণফুলী নদী যেখানে মিশেছে সমুদ্রের সঙ্গে, সেই মোহনার তীরে বড় বড় সিমেন্টের ব্লকগুলোর ওপর পাওয়া গেছে এক রক্তাক্ত তরুণের লাশ। আত্মহত্যা যে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না কারও, কিন্তু কেন, তার কোনো কারণ জানা যায়নি।
মহিলা পুলিশটি বলেছিলেন, ভিকটিমের পরিবারকে জানান। আমি ভেবেছিলাম একবার। কিন্তু একই প্লেট থেকে দুজনকে ভাত খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্যটা যে কিছুতেই মুছতে পারি না মন থেকে...।
আপনারা বলুন, আমি এখন কী করব? আত্মহত্যা করার সাহস তো আমার নেই। বন্ধুকে খুন করার দায় বাকি জীবনে কী করে বহন করব আমি? একটি অদ্ভুত প্রেমের গল্প কি কিছুতেই পিছু ছাড়বে আমার?
‘তার মৃত্যুর জন্য আমি পরোক্ষভাবে দায়ী...না না, ঠিক পরোক্ষ বলা যায় না, আমি প্রত্যক্ষভাবেই...।’
‘বেরোও...।’
‘জি...?’
এবার প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি, ‘গেট লস্ট...কে ঢুকতে দিয়েছে এখানে? ...জাহিদ...জাহিদ...।’
জাহিদ আসার আগে নিজেই বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, শুনলাম ওসি সাহেব বিড়বিড় করছেন, ‘শালা, সকাল থেকে আসল কাজে বাঁচি না, কোত্থেকে ফালতু ঝুট-ঝামেলা...শালা ড্রাগ অ্যাডিক্ট...।’
ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমি ড্রাগ অ্যাডিক্ট না, স্যার।’
কথাটা পছন্দ হলো না তাঁর। তিনি মানুষ চেনেন, তিনি বলছেন আমি ড্রাগ অ্যাডিক্ট, অথচ আমি তা অস্বীকার করছি—এটা সহ্য করতে পারলেন না, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন, চিৎকার করে বললেন, ‘অ্যাই ব্যাটা বাইর অ, অহন বাইর অ, নাইলে...।’
আমি এবার বেরিয়ে এলাম বিনা বাক্যব্যয়ে। ওসির কক্ষের বাইরে করিডরের মতো একফালি জায়গা, স্থান-সংকুলানের জন্য সেখানেও টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসতে হয়েছে থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বেরিয়ে আসার মুখে চোখাচোখি হয়ে গেল একজন মহিলা পুলিশের সঙ্গে, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন, বললেন, ‘স্যারের মেজাজ আজ সকাল থেকে খারাপ। আপনার সমস্যা কী?’
আমি জীবনে এত সুন্দরী মহিলা পুলিশ দেখিনি। সুন্দরীদের হাসিতে মৃতসঞ্জীবনী সুধা থাকে, আর আমি তো এখনো জীবিত মানুষ, তাই এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও সামান্য ভালো বোধ করলাম! তাঁর সামনের চেয়ারে বসলাম। ভরসা পেয়ে গড় গড় করে আমার সব কথা খুলে বললাম। তিনি অসীম ধৈর্যে আমার কথা শুনলেন। শেষে প্রায় তাঁর হাত ধরার উপক্রম করে বললাম, ‘আমার শাস্তির ব্যবস্থা করুন, নইলে আমি আত্মহত্যা করব।’
তিনি কিছুক্ষণ গভীর কৌতূহলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, হয়তো চেহারার বৈশিষ্ট্য দেখে অনুমান করার চেষ্টা করছিলেন সত্যি আমি আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ কি না। তারপর করুণা ও সান্ত্বনা মেশানো গলায় বললেন, ‘আপনি ভিকটিমের পরিবারের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলুন, তারা যদি মামলা করে তাহলে আমরা আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারব।’
ভিকটিমের পরিবার মানে সাইদুলের বাবা-মা, আমি তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব? গিয়ে বলব, আপনাদের ছেলের মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব আমার? অসম্ভব! সেই স্কুল-বয়সে কত দিন খালাম্মা সাইদুল আর আমাকে একই প্লেট থেকে লোকমা তুলে ভাত খাইয়ে দিয়েছেন। তাঁকে গিয়ে বলব, আপনাদের ছেলেকে...উহ্, তার চেয়ে আমার মৃত্যু ভালো!
তাহলে গল্পটা আপনাদেরই বলি।
সাইদুল প্রায়ই বলত সে জীবনে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়বে না। বলত, কারণ আমার সঙ্গে সীমার ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটা তাকে প্রায় আমার সমান কষ্ট দিয়েছিল। আমি যতই বলি, এই পড়া না পড়ার ব্যাপারটা নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এটা দৈবনির্ভর, সে কিছুতেই মানবে না। কিন্তু আমি তো জানতাম সে পড়বেই, ছোটবেলা থেকে চিনি তো। যে ছেলে একটি ভালো কবিতা পড়ে আধঘণ্টা চুপচাপ একটিও কথা না বলে কাটিয়ে দেয়, গান শোনে চোখ বন্ধ করে, সিনেমা দেখে চোখের পানি আড়াল করতে পারে না, সে প্রেমে পড়বে না?
সাইদুল বলে, ‘দেখিস।’
আমি বললাম, ‘দেখি।’
একদিন মরীচিকা ছদ্মনামে একটি মেয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল তাকে। বলল, ‘কী বলিস, অ্যাকসেপ্ট করব?’
বললাম, ‘ভেবে দ্যাখ, সত্যি সত্যিই মেয়ে নাকি কেউ ফাজলামি করে।’
সাইদুল বলল, মেয়েটি তাকে ইনবক্সে জানিয়েছে আসল নাম ইশিতা ইসলাম, মেয়ে বলে নানা বিড়ম্বনার কারণে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে।
‘তাহলে আর কী, অ্যাকসেপ্ট কর।’
মরীচিকা, মানে ইশিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করল সাইদুল। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে এর আগে আর কখনোই অপরিচিত মেয়েকে ফেসবুকের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। বরং বলা যায় তার শ চারেক বন্ধুর যে তালিকা তাতে অপরিচিতের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এবার সাইদুলের জীবনটা পাল্টে গেল।
আমার সঙ্গে প্রতিদিনের আড্ডায় একবার ইশিতার প্রসঙ্গ আসবেই। প্রতিদিন নতুন নতুন বিস্ময়ের তথ্য নিয়ে হাজির হয় সাইদুল। ইশিতার সঙ্গে তার জীবনের অদ্ভুত সব মিল। যেমন সাইদুলরা দুই ভাই, ইশিতারা দুই বোন। সাইদুলের বড় ভাই মারা গিয়েছিল রোড অ্যাকসিডেন্টে, ইশিতার বড় বোনটিরও মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল একইভাবে। বড় ভাই আরিফকে এখনো ভুলতে পারে না সাইদুল। আর ইশিতা এখনো স্বপ্নে বড় বোনকে দেখে ধড়ফড় করে জেগে ওঠে, মনে হয় বিছানায় তার পাশেই যেন শুয়ে আছে নিকিতা। দুটি মানুষের জীবন কি করে এতটাই মিলে যেতে পারে ভেবে পায় না সাইদুল-ইশিতা কেউই। ক্লাস নাইনে থাকার সময়ে একবার বাবার ওপর রাগ করে ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সাইদুল। আর মা-বাবা এক ক্লাসমেটের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যে সন্দেহ করেছিল বলে সাতটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলেছিল ইশিতা। সে কী কাণ্ড...হাসপাতালে গিয়ে স্টমাক ওয়াশ করতে হয়েছিল।
সাইদুলের পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে ওকে ফার্স্ট হতে দেখে অভ্যস্ত আমরা। কিছুতেই নাগাল না পেয়ে ওর পেছনে দৌড়ানোটাই নিয়মে দাঁড়িয়েছে আমাদের। ক্লাসের মেয়েরা তো বটেই, নিচের ক্লাসের মেয়েরাও সাইদুল ভা...ই...ই বলে কেমন আইসক্রিমের মতো গলতে থাকে, সে তো আমাদের চোখের দেখা। আমার সঙ্গে সীমার ছাড়াছাড়ির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিল সাইদুলই, অথচ আমার ধারণা, সীমা আসলে ভালোবাসতে চেয়েছিল সাইদুলকেই।
আজ সেই সাইদুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে লেখাপড়া মাথায় তুলে ইশিতাকে নিয়ে মেতে আছে। ইশিতার প্রিয় রং নীল, সাইদুলের নীল-সবুজ দুটোই। আগে ইশিতার প্রিয় গানের শিল্পী ছিল জাস্টিন বিবার, এখন তার গান দূরে থাক নামই শুনতে ইচ্ছে করে না আর...এখন ব্রায়ান এডামসে ডুবে আছে সে। ব্রায়ান এডামস সাইদুলেরও প্রিয় শিল্পী, কিন্তু বাংলা গান শোনে বেশি, মৌসুমী ভৌমিকের গান. মাইলস, ভূমি বা চন্দ্রবিন্দুর মতো ব্যান্ডগুলোর অন্য রকম পরিবেশনা ভালো লাগে তার। ইশিতাও আজকাল নতুন করে সাইদুলের পছন্দের গানগুলো শুনতে শুরু করেছে।
সাইদুলের ইচ্ছা ছিল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবে, কিন্তু পরিবারের চাপে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ট্রিপল ই-তে ভর্তি হয়েছে সে। কী আশ্চর্য ইশিতাও চেয়েছিল বাংলা অনার্স পড়বে, কিন্তু বাধ্য হয়েছে মেডিকেল কলেজে পড়তে। বঙ্কিম, মানিক থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এমনকি সুনীল বা আনিসুল হকের উপন্যাস, শক্তি, গুণ, জয় গোস্বামীর কবিতা দুজনেরই কত কত রাত জাগার সঙ্গী হয়ে থাকে। দুজনের প্রিয় ঋতু বর্ষা। ইশিতা বৃষ্টিতে ভেজে ছাদে গিয়ে, সাইদুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উদ্দেশ্যহীন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
‘এ রকম কী করে হয় বল তো স্বপন, দুজনের ভাবনা কী করে এক বিন্দুতে মিলে যায়?’
আমি উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
আরও প্রায় ছয় মাস পর একদিন দেখা করার কথা তোলে সাইদুল। ফেসবুকে ছবি ছিল না ইশিতার, কভার ছবিতে মেঘলা আকাশ আর প্রোফাইল পিকচার একটা কাগজের নৌকা। দেখা করতে রাজি হয় না ইশিতা।
‘আমাকে দেখে যদি তোমার স্বপ্ন ভেঙে যায়?’
‘ভাঙবে না, কারণ আমি তো তোমার মন ছুঁয়ে দেখেছি।’
‘তবু একটা কল্পনার ছবি তো তৈরি হয় মনে...যদি না মেলে?’
‘না যদি মেলে মিলবে না, আমাদের দুজনের জীবনে এত এত মিল, এই একটা অমিল না হয় থাকলই।’
‘এখনই না, আমি বলব।’
‘ঠিক আছে আমার কোনো তাড়া নেই।’
একটু দমে গিয়েছিল বোধ হয়, কয়েকটা দিন খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। এসব কথা তো আমি ছাড়া আর কারও সঙ্গে শেয়ার করত না, এক বিকেলে ডিসি হিল পার্কের একটা বড় শিরীষগাছের গোড়ালিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম দুজনে, বলল, ‘ইশিতা হয়তো আমাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না।’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক, শুধু ফেসবুকে পরিচয়।’
আমাকে চমকে দিয়ে সাইদুল দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘না স্বপন, এ শুধু ফেসবুকের হঠাৎ পরিচয় নয়, এ পরিচয় পুরো এক জীবনের। কোনো না-কোনোভাবে কোথাও না কোথাও ওর সঙ্গে আমার দেখা হতোই।’
সেদিন বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আশৈশব বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে অনেক কথা ঘুরপাক খেতে থাকে মনে—কে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন, প্রেম হচ্ছে আসলে একটি ধারণামাত্র, প্রেমিক নিজের জন্য নিজেই সেই ধারণাটি তৈরি করে।
দুদিন পর আবার যখন দেখা হলো সাইদুলের সঙ্গে তখন সে খুশিতে উত্তেজনায় টগবগ করছে। ওকে ইশিতা বলেছে, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’
‘তুই কী বললি?’
‘আমি এক হাজারটা হ্যাঁ লিখে দিয়েছি পুরো পেজজুড়ে।’
‘বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলি? চিনিস না জানিস না একটা মেয়েকে...।’
‘চিনি না জানি না মানে? আমার চেয়ে বেশি আর কে চেনে ওকে? তুই চিনিস শালা, তুই চিনিস?’
এর মধ্যে ইশিতার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার দিন-তারিখ ঠিক হলো। কোথায় দেখা হবে আমাকে জানাতে চায় না সাইদুল, শুধু বলল, পরে সব জানাবে।
বিকেল পাঁচটায় ইশিতার আসার কথা। জানতাম তার অনেক আগে পতেঙ্গা নেভাল বিচের রাস্তায় হাজির হবে সাইদুল। আমি আড়াল থেকে দেখলাম, সুনীলের কবিতার বই হাতে নীল সালোয়ার-কামিজ পরা একটি মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা। পাঁচটা, ছয়টা, সাতটা...সময় যত গড়াচ্ছে তত উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে। নেভাল বিচের রাস্তায় সেদিন বেড়াতে আসা প্রতিটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে খুঁজছে নীল জামা, হাতে সুনীলের কবিতার বই!
আমি পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠল সে, বললাম, ‘আসেনি?’
গভীর বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাল সে। কেমন আতঙ্কিত চোখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল সাইদুল, আমার চেহারাটা কি হিংস্র দেখাচ্ছিল?
‘তুই কখনো প্রেমে পড়বি না বলেছিলি, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, তো?’
আমার ভেতরে লুকানো পশুটা কি বেরিয়ে পড়েছিল? এই সাইদুল জীবনে কখনো আমাকে ক্লাসে ফার্স্ট হতে দেয়নি। আমার প্রেমিকা শেষ পর্যন্ত ভালোবেসেছিল ওকে। অবচেতনে সঞ্চিত সব পরাজয়ের বোধ যেন হঠাৎ এসে দাঁড়ায় সামনে। সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটিয়ে দেয় আমার, বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত পড়লিই তো...এত বোকা তুই? একটা ফেক অ্যাকাউন্টের প্রেমে পড়লি!’
থরথর করে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সাইদুল, কী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। উফ্ কী দৃষ্টি! কী ঘৃণা, কী ঘৃণা সেই দৃষ্টিতে! আমি মিশে যাচ্ছিলাম ধুলায়-মাটিতে। দুই হাত আঁকড়ে ধরেছিলাম ওর, এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল, ‘তুই...? তুই...?’
পাগলের মতো ছুটতে শুরু করেছিল, আমি পেছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে ডেকেছি, ‘সাইদুল...সাইদুল...।’
পাইনি, অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল কোথায়...।
পরদিন সকালে আমরা জেনেছি, কর্ণফুলী নদী যেখানে মিশেছে সমুদ্রের সঙ্গে, সেই মোহনার তীরে বড় বড় সিমেন্টের ব্লকগুলোর ওপর পাওয়া গেছে এক রক্তাক্ত তরুণের লাশ। আত্মহত্যা যে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না কারও, কিন্তু কেন, তার কোনো কারণ জানা যায়নি।
মহিলা পুলিশটি বলেছিলেন, ভিকটিমের পরিবারকে জানান। আমি ভেবেছিলাম একবার। কিন্তু একই প্লেট থেকে দুজনকে ভাত খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্যটা যে কিছুতেই মুছতে পারি না মন থেকে...।
আপনারা বলুন, আমি এখন কী করব? আত্মহত্যা করার সাহস তো আমার নেই। বন্ধুকে খুন করার দায় বাকি জীবনে কী করে বহন করব আমি? একটি অদ্ভুত প্রেমের গল্প কি কিছুতেই পিছু ছাড়বে আমার?
No comments