সপ্তাহের হালচাল- রংপুরের মেয়ে, প্রাণ যায় ঢাকার গার্মেন্টসে by আব্দুল কাইয়ুম
রংপুরে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে
জেলার উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র,
অধ্যাপক, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, বিশিষ্ট নাগরিকেরা, নারী নেতৃত্ব, সাংস্কৃতিক
ব্যক্তিত্ব—সবাই এসেছেন।
তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা মোস্তফা
সোহরাব চৌধুরী জেলার শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি। তিনি বললেন, রংপুরে যদি
গার্মেন্টস শিল্প গড়ে তোলার জন্য সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে, গ্যাস,
বিদ্যুৎ দেয়, ট্যাক্স হলিডে দেয়, তাহলে আমরা পুরো উত্তরাঞ্চলের চেহারাই
বদলে দেব। বেশ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তিনি কথাগুলো বললেন। কারণ, তিনি জানেন,
গার্মেন্টস-শ্রমিকেরা প্রধানত উত্তরাঞ্চল থেকেই যান ঢাকা, সাভার,
আশুলিয়ায়। তাঁরা ইতিমধ্যে পোশাক তৈরিতে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছেন। এখন
চাই তাঁদের দোরগোড়ায় গার্মেন্টস কারখানা।
আগে কখনো কথাটা মনে দাগ কাটেনি। সবাই তো জানি, গার্মেন্টস-শিল্প শ্রমিকদের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই আসে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে। মিঠাপুকুর, গাইবান্ধা, সাদুল্যাপুর, চিলমারী, উলিপুর, পীরগাছা, লালমনিরহাট—এসব জেলা থেকেই গার্মেন্টসে নারী শ্রমিকেরা যান। উদয়াস্ত শ্রম দেন, সামান্য বেতনে তাঁরা বিশ্বের অভিজাত বিপণি সাম্রাজ্যের জন্য জামাকাপড় তৈরি করেন। অথচ নিজেদের জন্য জোটে শতচ্ছিন্ন কাপড়-জামা। এঁরাই রানা প্লাজায় ভবনধসে প্রাণ দেন। পুড়ে মরেন তাজরীন ফ্যাশনসে। বিচার পান না। ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য ঘুরে বেড়ান দ্বারে দ্বারে।
গার্মেন্টস-পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। চীনের পরেই এর স্থান। কিন্তু এই শিল্প বাংলাদেশে নিতান্তই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। যেসব ভবনে মানুষ থাকার কথা, সেখানে চলে কারখানার শত শত মেশিন। কাপড়ের গুদামও একই ভবনে। ভবনধস বা আগুন লাগার জন্য এসব কারণই যথেষ্ট। গুরুতর অনিয়মগুলো দেখার পদ্ধতিগত ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।
রংপুরে পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টস শিল্পনগর গড়ে তোলার বিরাট এক সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে আছে বিস্তৃত জমি। আছে দক্ষ শ্রমিক। আর আছে অনেক শিল্পোদ্যোক্তার আগ্রহ।
আমি জিজ্ঞেস করি, কোন শিল্পপতি আসবেন এখানে গার্মেন্টসে বিনিয়োগ করতে? মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী জোর দিয়ে বলেন, গার্মেন্টস শিল্পপতি টিপু মুনশি রংপুরেরই মানুষ। আবুল কালাম আজাদ সাহেব পীরগঞ্জের সংসদ সদস্য। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে তাঁরা সবাই আসবেন এখানে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদি, এফবিবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ—তাঁরাও রংপুরে এসে বলে গেছেন এখানে গার্মেন্টস-শিল্প বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা, যদি গ্যাস-বিদ্যুৎ-যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা থাকে।
চৌধুরী সাহেব বললেন, ঢাকা থেকে গার্মেন্টস-শিল্পের অনেক কর্মী ফিরে এসে সৈয়দপুরে এখন ঘরে ঘরে পোশাক তৈরির ছোট ছোট কারখানা গড়ে তুলেছেন। তাঁদের তৈরি সুন্দর ও বিশ্বমানের আধুনিক জ্যাকেট, জিনসের প্যান্ট, টি-শার্ট যাচ্ছে আসাম, মেঘালয়, শিলিগুড়ি, ত্রিপুরায়।
এটা নতুন খবর। আমার সত্যিই বিশ্বাস হয় না। ফোন করলাম সালাম মুর্শেদিকে। জানালেন, সৈয়দপুরে গার্মেন্টস-শিল্পের বিস্তারের কথা তিনিও শুনেছেন। রংপুরে গার্মেন্টস-শিল্পের সম্ভাব্য বিকাশের বিষয়ে তিনি আস্থাশীল। রংপুরে একবার তিনি এ কথা বলে গেছেন।
রংপুরে গার্মেন্টস-শিল্পের বিকাশের জন্য দুটি জরুরি শর্ত পূরণ করতে হবে। গ্যাস আর ভালো যোগাযোগব্যবস্থা। রংপুরের মানুষ গ্যাসের দাবিতে সংগ্রাম করছে। গ্যাসের ব্যবস্থা করা কি এতই কঠিন? সিলেট থেকে জামালপুর জেলার মধ্য দিয়ে গাইবান্ধা জেলার বালাসী হয়ে রংপুর বিভাগের সব জেলায় গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব বলে রংপুরবাসী মনে করে।
বলা হয়, দেশে গ্যাসের টানাটানি। গ্যাস নেই। আগে শুনেছি, দেশ গ্যাসের সাগরে ভাসছে। এখন শুনি উল্টো কথা। অনেকে মনে করেন, মাটির নিচে যথেষ্ট গ্যাস আছে, কিন্তু সেই গ্যাস তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই।
সরকার যদি গ্যাস দিতে না পারে, কয়লা দিক। বড়পুকুরিয়ার কয়লা দিতে পারে। সে ব্যাপারে নতুন উদ্যোগ দরকার। অথবা জ্বালানি তেল, ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস বা জ্বালানি তেল দরকার। এ ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।
রংপুরে অবশ্য বিদ্যুতের অবস্থা ভালো। এখন তো ঢাকায় দিনে অন্তত দুবার এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং সইতে হয়। অথচ রংপুরে দুই দিনে একবারও লোডশেডিংয়ের দেখা পেলাম না! তবে শিল্পের জন্য আরও অনেক বিদ্যুৎ দরকার। গ্যাস দরকার। সেটা নেই।
শুধু গ্যাস বা বিদ্যুৎ হলেই তো হবে না, ভালো যোগাযোগব্যবস্থাও দরকার। রংপুরবাসী দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের মহাসড়কের দাবি করে আসছে। এটা করা খুবই সম্ভব। অন্য দিকে তারা আরেকটি দাবিও করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সড়কসহ রেলসেতু নির্মাণ করা হলে ঢাকায় পৌঁছতে ১০০ কিলোমিটার রাস্তা কমে যাবে। এখন তো ঢাকায় যেতে লাগে আট থেকে ১২-১৩ ঘণ্টা। চট্টগ্রামে যেতে ২২-২৩ ঘণ্টা। তাই যাতায়াতের সময় কমানোর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশে এখন মাথাপিছু গড় আয় এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী জানালেন, সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, গঙ্গাচরায় মানুষের গড় আয় মাত্র ১০০ ডলারের সামান্য বেশি। কোথায় এক হাজার আর কোথায় ১০০! এই অঞ্চলের মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি গরিব। রংপুরে গার্মেন্টস-শিল্প গড়ে উঠলে এদের ভাগ্য খুলে যাবে। এই গরিব মানুষদের কাজের সন্ধানে ছুটে যেতে হবে না ঢাকায়। নিজ এলাকায়ই এরা জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারবে।
রংপুর অঞ্চলে বিনিয়োগের আরও সুযোগ আছে। উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইরা হক জানালেন, শতরঞ্জি ও বেনারসি শাড়ি তৈরির শিল্প এখন বেশ প্রসার লাভ করেছে। আরও অনেক কুটিরশিল্পে মেয়েরা কাজ করছেন। অনেকে ঘরে বসেই ছোটখাটো কাজ করছেন। কিন্তু ব্যাংকঋণ পাওয়া তাঁদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বেসরকারি ব্যাংক নাকি বলে, ঘরে বসে এত ছোট ছোট কাজ হয়, ঋণ যে দেব, ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? আমি বললাম, বাংলাদেশ ব্যাংক তো নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ইরা হক জানালেন, ব্যাংকাররা নাকি তা মানতে চান না, অনেক ঘুরান!
শিল্প বিকাশের পথে একটি বড় অন্তরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা। রংপুরের বড় সুবিধা হলো, এখানে এই ঝামেলা কম। প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোজাফ্ফর হোসেন ও জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন কাদেরী আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা তিনজনই একমত হয়ে বলেন, রংপুরের উন্নয়ন ও শিল্পের বিকাশের প্রশ্নে তাঁরা সবাই একমত-একপথে হাঁটতে প্রস্তুত। দলীয় রাজনীতিতে যত বিভেদই থাকুক, রংপুরের ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে দ্বিমত নেই। প্রকৃতপক্ষে রংপুরে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুলনামূলক কম। এটা এখানে শিল্প বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
নবগঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন বলে গোলটেবিল বৈঠকে আসতে পানেননি। তাঁর পরিবর্তে এসেছিলেন প্যানেল মেয়র গোলাম কবীর। তিনি তরুণ ও প্রাণবন্ত। তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন, সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত আমাদের মতো তরুণ জনপ্রতিনিধিদের রয়েছে অফুরন্ত উদ্যম। তাঁরা রংপুরের উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা করতে চান। তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানান। তাঁর এই আহ্বানের তাৎপর্য আমরা সবাই বুঝি। সামনে নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা। রংপুর এই ঝোড়ো হাওয়ার বাইরে নয়। এখানেই মেয়রের উদ্বেগ। রাজনৈতিক ডামাডোলে সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।
সরকার আসবে-যাবে, কিন্তু দেশ, সিটি করপোরেশন থাকবে। কোনো রাজনৈতিক ঝড়ঝাপ্টা যেন উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
আগে কখনো কথাটা মনে দাগ কাটেনি। সবাই তো জানি, গার্মেন্টস-শিল্প শ্রমিকদের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই আসে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে। মিঠাপুকুর, গাইবান্ধা, সাদুল্যাপুর, চিলমারী, উলিপুর, পীরগাছা, লালমনিরহাট—এসব জেলা থেকেই গার্মেন্টসে নারী শ্রমিকেরা যান। উদয়াস্ত শ্রম দেন, সামান্য বেতনে তাঁরা বিশ্বের অভিজাত বিপণি সাম্রাজ্যের জন্য জামাকাপড় তৈরি করেন। অথচ নিজেদের জন্য জোটে শতচ্ছিন্ন কাপড়-জামা। এঁরাই রানা প্লাজায় ভবনধসে প্রাণ দেন। পুড়ে মরেন তাজরীন ফ্যাশনসে। বিচার পান না। ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য ঘুরে বেড়ান দ্বারে দ্বারে।
গার্মেন্টস-পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। চীনের পরেই এর স্থান। কিন্তু এই শিল্প বাংলাদেশে নিতান্তই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। যেসব ভবনে মানুষ থাকার কথা, সেখানে চলে কারখানার শত শত মেশিন। কাপড়ের গুদামও একই ভবনে। ভবনধস বা আগুন লাগার জন্য এসব কারণই যথেষ্ট। গুরুতর অনিয়মগুলো দেখার পদ্ধতিগত ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।
রংপুরে পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টস শিল্পনগর গড়ে তোলার বিরাট এক সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে আছে বিস্তৃত জমি। আছে দক্ষ শ্রমিক। আর আছে অনেক শিল্পোদ্যোক্তার আগ্রহ।
আমি জিজ্ঞেস করি, কোন শিল্পপতি আসবেন এখানে গার্মেন্টসে বিনিয়োগ করতে? মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী জোর দিয়ে বলেন, গার্মেন্টস শিল্পপতি টিপু মুনশি রংপুরেরই মানুষ। আবুল কালাম আজাদ সাহেব পীরগঞ্জের সংসদ সদস্য। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে তাঁরা সবাই আসবেন এখানে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদি, এফবিবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ—তাঁরাও রংপুরে এসে বলে গেছেন এখানে গার্মেন্টস-শিল্প বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা, যদি গ্যাস-বিদ্যুৎ-যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা থাকে।
চৌধুরী সাহেব বললেন, ঢাকা থেকে গার্মেন্টস-শিল্পের অনেক কর্মী ফিরে এসে সৈয়দপুরে এখন ঘরে ঘরে পোশাক তৈরির ছোট ছোট কারখানা গড়ে তুলেছেন। তাঁদের তৈরি সুন্দর ও বিশ্বমানের আধুনিক জ্যাকেট, জিনসের প্যান্ট, টি-শার্ট যাচ্ছে আসাম, মেঘালয়, শিলিগুড়ি, ত্রিপুরায়।
এটা নতুন খবর। আমার সত্যিই বিশ্বাস হয় না। ফোন করলাম সালাম মুর্শেদিকে। জানালেন, সৈয়দপুরে গার্মেন্টস-শিল্পের বিস্তারের কথা তিনিও শুনেছেন। রংপুরে গার্মেন্টস-শিল্পের সম্ভাব্য বিকাশের বিষয়ে তিনি আস্থাশীল। রংপুরে একবার তিনি এ কথা বলে গেছেন।
রংপুরে গার্মেন্টস-শিল্পের বিকাশের জন্য দুটি জরুরি শর্ত পূরণ করতে হবে। গ্যাস আর ভালো যোগাযোগব্যবস্থা। রংপুরের মানুষ গ্যাসের দাবিতে সংগ্রাম করছে। গ্যাসের ব্যবস্থা করা কি এতই কঠিন? সিলেট থেকে জামালপুর জেলার মধ্য দিয়ে গাইবান্ধা জেলার বালাসী হয়ে রংপুর বিভাগের সব জেলায় গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব বলে রংপুরবাসী মনে করে।
বলা হয়, দেশে গ্যাসের টানাটানি। গ্যাস নেই। আগে শুনেছি, দেশ গ্যাসের সাগরে ভাসছে। এখন শুনি উল্টো কথা। অনেকে মনে করেন, মাটির নিচে যথেষ্ট গ্যাস আছে, কিন্তু সেই গ্যাস তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই।
সরকার যদি গ্যাস দিতে না পারে, কয়লা দিক। বড়পুকুরিয়ার কয়লা দিতে পারে। সে ব্যাপারে নতুন উদ্যোগ দরকার। অথবা জ্বালানি তেল, ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস বা জ্বালানি তেল দরকার। এ ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।
রংপুরে অবশ্য বিদ্যুতের অবস্থা ভালো। এখন তো ঢাকায় দিনে অন্তত দুবার এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং সইতে হয়। অথচ রংপুরে দুই দিনে একবারও লোডশেডিংয়ের দেখা পেলাম না! তবে শিল্পের জন্য আরও অনেক বিদ্যুৎ দরকার। গ্যাস দরকার। সেটা নেই।
শুধু গ্যাস বা বিদ্যুৎ হলেই তো হবে না, ভালো যোগাযোগব্যবস্থাও দরকার। রংপুরবাসী দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের মহাসড়কের দাবি করে আসছে। এটা করা খুবই সম্ভব। অন্য দিকে তারা আরেকটি দাবিও করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সড়কসহ রেলসেতু নির্মাণ করা হলে ঢাকায় পৌঁছতে ১০০ কিলোমিটার রাস্তা কমে যাবে। এখন তো ঢাকায় যেতে লাগে আট থেকে ১২-১৩ ঘণ্টা। চট্টগ্রামে যেতে ২২-২৩ ঘণ্টা। তাই যাতায়াতের সময় কমানোর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশে এখন মাথাপিছু গড় আয় এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী জানালেন, সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, গঙ্গাচরায় মানুষের গড় আয় মাত্র ১০০ ডলারের সামান্য বেশি। কোথায় এক হাজার আর কোথায় ১০০! এই অঞ্চলের মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি গরিব। রংপুরে গার্মেন্টস-শিল্প গড়ে উঠলে এদের ভাগ্য খুলে যাবে। এই গরিব মানুষদের কাজের সন্ধানে ছুটে যেতে হবে না ঢাকায়। নিজ এলাকায়ই এরা জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারবে।
রংপুর অঞ্চলে বিনিয়োগের আরও সুযোগ আছে। উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইরা হক জানালেন, শতরঞ্জি ও বেনারসি শাড়ি তৈরির শিল্প এখন বেশ প্রসার লাভ করেছে। আরও অনেক কুটিরশিল্পে মেয়েরা কাজ করছেন। অনেকে ঘরে বসেই ছোটখাটো কাজ করছেন। কিন্তু ব্যাংকঋণ পাওয়া তাঁদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বেসরকারি ব্যাংক নাকি বলে, ঘরে বসে এত ছোট ছোট কাজ হয়, ঋণ যে দেব, ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? আমি বললাম, বাংলাদেশ ব্যাংক তো নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ইরা হক জানালেন, ব্যাংকাররা নাকি তা মানতে চান না, অনেক ঘুরান!
শিল্প বিকাশের পথে একটি বড় অন্তরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা। রংপুরের বড় সুবিধা হলো, এখানে এই ঝামেলা কম। প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোজাফ্ফর হোসেন ও জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন কাদেরী আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা তিনজনই একমত হয়ে বলেন, রংপুরের উন্নয়ন ও শিল্পের বিকাশের প্রশ্নে তাঁরা সবাই একমত-একপথে হাঁটতে প্রস্তুত। দলীয় রাজনীতিতে যত বিভেদই থাকুক, রংপুরের ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে দ্বিমত নেই। প্রকৃতপক্ষে রংপুরে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুলনামূলক কম। এটা এখানে শিল্প বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
নবগঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন বলে গোলটেবিল বৈঠকে আসতে পানেননি। তাঁর পরিবর্তে এসেছিলেন প্যানেল মেয়র গোলাম কবীর। তিনি তরুণ ও প্রাণবন্ত। তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন, সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত আমাদের মতো তরুণ জনপ্রতিনিধিদের রয়েছে অফুরন্ত উদ্যম। তাঁরা রংপুরের উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা করতে চান। তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানান। তাঁর এই আহ্বানের তাৎপর্য আমরা সবাই বুঝি। সামনে নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা। রংপুর এই ঝোড়ো হাওয়ার বাইরে নয়। এখানেই মেয়রের উদ্বেগ। রাজনৈতিক ডামাডোলে সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।
সরকার আসবে-যাবে, কিন্তু দেশ, সিটি করপোরেশন থাকবে। কোনো রাজনৈতিক ঝড়ঝাপ্টা যেন উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
রংপুর থেকে>> আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments