গল্প- অনামা সেই গাছের গল্প by আখতার হুসেন
মাঠের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা শহরের দিকে
চলে গেছে, তার চৌমোহনায় যে বড় সেতু, তার গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে সেই দুটো
গাছ। একটা আমের আর অন্যটার নাম নেই। একে সবাই ‘অনামা’ বলেই ডাকে। সে ফুল
দেয় না। ফল দেয় না। এই নিয়ে তার দুঃখের অন্ত নেই।
কেবল ওর
পাতাগুলো বড় বড়। ঘন সবুজ এদের রং। একবার এক প্রকৃতিপ্রেমিক একে দেখে
বলেছিলেন, এই গাছ আফ্রিকা মহাদেশের দু-একটি জায়গা ছাড়া কোথাও জন্মে না।
গাছটার বংশবিস্তার করতে হয় কলম করে। খুবই দুর্লভ প্রজাতির গাছ। এর কাঠ খুবই
ভালো। ঘরের আসবাব তৈরি করলে এর গায়ে আলাদা রং পলিশ করতে হয় না। ঘুণপোকাও
এর সহজে ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু হলে কী হবে, অনামা সেই গাছের বুক ফেটে
যায় ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছটার দিকে তাকিয়ে। একদিন সে বলেও ফেলে সে
কথা, ‘তুমি অনেক সুখী, আমগাছ!’
‘কেন, তুমিও তো সুখী’, আমগাছ জবাব দেয়। ‘তোমার পাতাগুলো কী সুন্দর। কী ঘন সবুজ!’
‘ওটা কোনো কথার কথাই নয়। তোমার মতো আমি ফুল-ফল কিছুরই জন্ম দিই না। যখন তোমার ডালে মুকুল ধরে, বোল হয়, তার থেকে পুরুষ্টু ফল হয়; তখন তোমার ডালগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েরা আসে। তোমার ফল পেড়ে পেড়ে খায়। পাকলে তো কথাই নেই! তখন তোমার কত-না কদর! কত-না সুনাম! আর আমি অনামা একটা গাছ। আমার কোনো গুণ নেই বলে আমার কাছে কেউই আসে না।’
আমগাছ এ কথার কী জবাব দেবে, কোন ভাষায় ওকে সান্ত্বনা দেবে, ভেবে পায় না। তাই চুপ করে থাকে।
‘কেন, তুমিও তো সুখী’, আমগাছ জবাব দেয়। ‘তোমার পাতাগুলো কী সুন্দর। কী ঘন সবুজ!’
‘ওটা কোনো কথার কথাই নয়। তোমার মতো আমি ফুল-ফল কিছুরই জন্ম দিই না। যখন তোমার ডালে মুকুল ধরে, বোল হয়, তার থেকে পুরুষ্টু ফল হয়; তখন তোমার ডালগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েরা আসে। তোমার ফল পেড়ে পেড়ে খায়। পাকলে তো কথাই নেই! তখন তোমার কত-না কদর! কত-না সুনাম! আর আমি অনামা একটা গাছ। আমার কোনো গুণ নেই বলে আমার কাছে কেউই আসে না।’
আমগাছ এ কথার কী জবাব দেবে, কোন ভাষায় ওকে সান্ত্বনা দেবে, ভেবে পায় না। তাই চুপ করে থাকে।
সেবার শীত পড়তেই গাছ
দুটোর অদূরে যে বিল, তাতে দূরদূরান্ত থেকে রং-বেরঙের অনেক পাখি এল। এদের
কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠল চারদিক। এর আগে এত পাখি কোনো দিন এই এলাকায় আসেনি।
এবারই প্রথম এল। কিন্তু শীত শেষে যখন এদের যাওয়ার সময় হলো, তখন অনেকেই থেকে
গেল। এদেরই কেউ কেউ উড়ে এসে আশ্রয় নিল সেই আম আর অনামা গাছটার ডালে।
‘এত দিন পর মনে হচ্ছে, আমি আর একলা-একা নই,’ মনে মনে বলে উঠল অনামা গাছটা। ‘পাখিগুলো এসে ভালোই হয়েছে। আমি এখন ওদের সঙ্গে যখন-তখন সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারব। পাখিগুলো যত দিন খুশি বাসা বেঁধে থাকুক না আমার ডালে!’
এদিকে আমগাছটাও খুশি হলো ওর ডালে পাখিদের কেউ কেউ ঠাঁই নেওয়ায়। অনামা গাছটাকে সেই খুশির কথা জানাতে সে বলল, ‘ভালো আছ তো ভাই?’
অনামা গাছটা বলল, ‘সে কথা আর বলতে। মনে হচ্ছে আমি আর একা নই। আর আমার জীবনটাও বৃথা নয়।’
আমগাছ জবাবে বলল, ‘জানো, আমারও খুব ভালো লাগছে। পাখিগুলো যখন-তখন গান গাইছে। ইচ্ছামতো উড়ছে-ঘুরছে। ওরা যেন চিরকাল আমার বুকজুড়ে থাকে। তোমার?’
‘আমারও সেই একই কামনা,’ বলল অনামা গাছটা।
এভাবে দিন পেরোতে লাগল। অবশেষে এল আমের গাছে মুকুল ধরার দিন। মুকুল থেকে বোল। বোল থেকে একদিন গুটি গুটি আম। আর সেই আম দেখে ছুটে এল ছেলেমেয়েরা। তারা আম পাড়তে গিয়ে ঢিলাতে শুরু করল। আর সেই ঢিলের আঘাতে কেবল আমই পড়ল না; মারা গেল ও আহত হলো বেশ কয়েকটা পাখি। এতে পাখিদের চিৎকার-আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠল আকাশ। সূর্য দুঃখ-বেদনায় মেঘের আড়ালে লুকাল তার মুখ। প্রতিবাদে বাতাস সারা দিন হাত নেড়ে নেড়ে তুলল স্লোগান। আর আমগাছের ডালে বাসা বেঁধে থাকা পাখিরা কী করল? ওরা ডাল ছেড়ে চলে গেল দূরে। অনেক দূরে। সেই দুঃখে আমগাছ কাঁদল। কাঁদল বুক ভাসিয়ে। এসবই শুনল কেবল সেই অনামা গাছটা। জিজ্ঞেস করল আমগাছকে, ‘কাঁদছ কেন তুমি?’
‘কাঁদছি দুঃখে। আমার ডালে পাখিরা আর কোনো দিন বাসা বেঁধে থাকবে না। আমিই ওদের থাকতে দেব না।’
‘কেন, কেন?’ প্রশ্ন করল অনামা গাছটা।
‘কেন আবার, পাখিরা আমার ডালে বাসা বাঁধুক আর ঢিল খেয়ে মরুক, সে আমি কোনোমতেই চাই না, ভাই,’ বলতে লাগল আমগাছটা। ‘আমিই ওদের মানা করে দিচ্ছি, যাতে ওরা আমার ডালে আর কোনো দিন বাসা বাঁধতে না আসে।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল আমগাছটা। তাই দেখে অনামা গাছটা মাথা নিচু করে থাকল।
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর সেই প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোক এলেন সেই দুর্লভ প্রজাতির গাছটাকে দেখতে। দেখেই তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। বলতে লাগলেন তাঁর সঙ্গীসাথিদের, ‘দেখেছ, গাছটায় পাখিদের কত বাসা! ডালে ডালে, পাতার খোপে খোপে। জীবনে এই প্রথম দেখলাম কোনো গাছে একসঙ্গে এত বিচিত্র সব পাখি। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই নিজেদের মধ্যে। গাছটা রীতিমতো পাখিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।’
প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোকের সঙ্গে আসা সহযোগী তাই শুনে বলেন, ‘স্যার, এক কাজ করলে হয় না?’
‘বলো, কী কাজ?’
‘কলম করে করে যদি এই অনামা দুর্লভ প্রজাতির গাছটার সংখ্যা বাড়ানো যায়, তাহলে কেমন হয়?’
‘দি আইডিয়া,’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোক। ‘তাহলে অসংখ্য পাখি নিরাপদে থাকার সুযোগ পাবে। ফলফলারির গাছে যেমন ইটপাটকেল পড়ে, এ গাছে তেমনটা হওয়ার আশঙ্কা নেই। তা-ই হবে, তা-ই হবে।’
প্রকৃতিবিদের কথাটা কানে গেল আমগাছের। সে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। অনামা গাছকে উদ্দেশ করে সে বলল, ‘তুমি এখন সুখী নও, ভাই?’
অনামা গাছ বলল, ‘সত্যিই আমি সুখী। আর কোনো খেদ নেই।’
তার এই কথা শুনে সূর্য হাসল। আকাশ হাসল। বাতাসেরা গান জুড়ে দিল। তাদের সে গান থামতেই চায় না।
‘এত দিন পর মনে হচ্ছে, আমি আর একলা-একা নই,’ মনে মনে বলে উঠল অনামা গাছটা। ‘পাখিগুলো এসে ভালোই হয়েছে। আমি এখন ওদের সঙ্গে যখন-তখন সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারব। পাখিগুলো যত দিন খুশি বাসা বেঁধে থাকুক না আমার ডালে!’
এদিকে আমগাছটাও খুশি হলো ওর ডালে পাখিদের কেউ কেউ ঠাঁই নেওয়ায়। অনামা গাছটাকে সেই খুশির কথা জানাতে সে বলল, ‘ভালো আছ তো ভাই?’
অনামা গাছটা বলল, ‘সে কথা আর বলতে। মনে হচ্ছে আমি আর একা নই। আর আমার জীবনটাও বৃথা নয়।’
আমগাছ জবাবে বলল, ‘জানো, আমারও খুব ভালো লাগছে। পাখিগুলো যখন-তখন গান গাইছে। ইচ্ছামতো উড়ছে-ঘুরছে। ওরা যেন চিরকাল আমার বুকজুড়ে থাকে। তোমার?’
‘আমারও সেই একই কামনা,’ বলল অনামা গাছটা।
এভাবে দিন পেরোতে লাগল। অবশেষে এল আমের গাছে মুকুল ধরার দিন। মুকুল থেকে বোল। বোল থেকে একদিন গুটি গুটি আম। আর সেই আম দেখে ছুটে এল ছেলেমেয়েরা। তারা আম পাড়তে গিয়ে ঢিলাতে শুরু করল। আর সেই ঢিলের আঘাতে কেবল আমই পড়ল না; মারা গেল ও আহত হলো বেশ কয়েকটা পাখি। এতে পাখিদের চিৎকার-আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠল আকাশ। সূর্য দুঃখ-বেদনায় মেঘের আড়ালে লুকাল তার মুখ। প্রতিবাদে বাতাস সারা দিন হাত নেড়ে নেড়ে তুলল স্লোগান। আর আমগাছের ডালে বাসা বেঁধে থাকা পাখিরা কী করল? ওরা ডাল ছেড়ে চলে গেল দূরে। অনেক দূরে। সেই দুঃখে আমগাছ কাঁদল। কাঁদল বুক ভাসিয়ে। এসবই শুনল কেবল সেই অনামা গাছটা। জিজ্ঞেস করল আমগাছকে, ‘কাঁদছ কেন তুমি?’
‘কাঁদছি দুঃখে। আমার ডালে পাখিরা আর কোনো দিন বাসা বেঁধে থাকবে না। আমিই ওদের থাকতে দেব না।’
‘কেন, কেন?’ প্রশ্ন করল অনামা গাছটা।
‘কেন আবার, পাখিরা আমার ডালে বাসা বাঁধুক আর ঢিল খেয়ে মরুক, সে আমি কোনোমতেই চাই না, ভাই,’ বলতে লাগল আমগাছটা। ‘আমিই ওদের মানা করে দিচ্ছি, যাতে ওরা আমার ডালে আর কোনো দিন বাসা বাঁধতে না আসে।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল আমগাছটা। তাই দেখে অনামা গাছটা মাথা নিচু করে থাকল।
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর সেই প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোক এলেন সেই দুর্লভ প্রজাতির গাছটাকে দেখতে। দেখেই তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। বলতে লাগলেন তাঁর সঙ্গীসাথিদের, ‘দেখেছ, গাছটায় পাখিদের কত বাসা! ডালে ডালে, পাতার খোপে খোপে। জীবনে এই প্রথম দেখলাম কোনো গাছে একসঙ্গে এত বিচিত্র সব পাখি। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই নিজেদের মধ্যে। গাছটা রীতিমতো পাখিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।’
প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোকের সঙ্গে আসা সহযোগী তাই শুনে বলেন, ‘স্যার, এক কাজ করলে হয় না?’
‘বলো, কী কাজ?’
‘কলম করে করে যদি এই অনামা দুর্লভ প্রজাতির গাছটার সংখ্যা বাড়ানো যায়, তাহলে কেমন হয়?’
‘দি আইডিয়া,’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোক। ‘তাহলে অসংখ্য পাখি নিরাপদে থাকার সুযোগ পাবে। ফলফলারির গাছে যেমন ইটপাটকেল পড়ে, এ গাছে তেমনটা হওয়ার আশঙ্কা নেই। তা-ই হবে, তা-ই হবে।’
প্রকৃতিবিদের কথাটা কানে গেল আমগাছের। সে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। অনামা গাছকে উদ্দেশ করে সে বলল, ‘তুমি এখন সুখী নও, ভাই?’
অনামা গাছ বলল, ‘সত্যিই আমি সুখী। আর কোনো খেদ নেই।’
তার এই কথা শুনে সূর্য হাসল। আকাশ হাসল। বাতাসেরা গান জুড়ে দিল। তাদের সে গান থামতেই চায় না।
No comments