সরল গরল- প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস এক নয় by মিজানুর রহমান খান
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারিক আদালতের
কার্যক্রম নিয়ে অসতর্ক মন্তব্য এবং তাকে কেন্দ্র করে আদালত অবমাননার
ক্রমাগত রুল জারির ঘটনা সিয়েরা লিয়ন, রুয়ান্ডা ও কেনিয়ার প্রেক্ষাপট
স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এসব দেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার চলছে।
আর তাতে স্কাইপ, খসড়া রায় ও ট্রাইব্যুনাল লিকস ধরনের
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি ডিজিটাল
প্রচেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার কথিত খসড়া
রায় প্রকাশ তারই সর্বশেষ উদাহরণ। এখন কেবল ট্রাইব্যুনাল নন, পুরো সুপ্রিম
কোর্টকেই সজাগ হতে হবে।
বাংলাদেশে কম্পিউটারে বাংলা প্রবর্তনের পথিকৃৎ মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হলো, সাকার ঘটনাটির হদিস বের করা অসম্ভব নয়। তিনি বলেন, রিয়েল আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) বের করার প্রযুক্তি র্যাব, পুলিশ ও আর্মির আছে। এখন একটি জিও-এনজিও সহযোগিতায় তদন্ত হতে পারে। এটিতে ম্যাকবুক প্রো ল্যাপটপ ব্যবহার করা হয়েছে। এর সফটওয়্যারও দেশের প্রচলিত উইন্ডোজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আইন মন্ত্রণালয়ের এটি নেই। আইটি ফরেনসিকে রিয়েল আইপি বের করা কঠিন কাজ নয়। এর ফলে দেশের কোন কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছে, তা-ও বের করা যাবে। গুগল ম্যাপ দিয়ে দেশের কোন এলাকা থেকে এটি করা হয়েছে, তা-ও নির্দিষ্ট করা সম্ভব বলেও জানালেন তিনি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর হেগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আইসিসিতে সভাপতিত্বকারী বিচারক এবো-ওসুজু আদেশ জারি করেছেন যে, যাঁরা যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাক্ষী হবেন, তাঁদের পরিচয়ের গোপনীয়তা ফাঁস করা আদালত অবমাননা। এই বিচারক ব্লগার ও সাংবাদিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কেবল ইন্টারনেটের সূত্র ব্যবহার করে তথ্য প্রকাশ করে পার পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনও তাই বলে। তথাকথিত খসড়া রায় কোথাও পেলে তা ডাউনলোড বা প্রিন্ট করে নিয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে তারস্বরে চিৎকার করা দণ্ডনীয়। যদি তাতে আদালতকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য থাকে। খসড়া রায়ের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সেটা ঘটানোর মুখ্য দায় দৃশ্যত সাকা ও তাঁর পরিবারের। তাঁদের এ জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এটা নাশকতাও হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে কেউ এটা পেনড্রাইভে বা ই-মেইলে পাঠাতে পারে। এবং সেখান থেকে তা ফাঁস করা হতে পারে। চক্রান্তকারীদের পক্ষে এ রকম কিছু করা যে অসম্ভব, তা বলা যাবে না। এই বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের মানুষের অস্বস্তি কম নয়। তারা বিচার চায়, কিন্তু দলীয় রাজনীতিটা বাদ দিয়ে। আর ক্ষমতাসীন দল তা দিতে একদম অনিচ্ছুক। আগামী নির্বাচনী প্রচারণায় এটাকে তারা অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং করবেই করবে। তাই এ-সংক্রান্ত তদন্তকে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি যে ক্ষমতায় গেলে এই বিচার এগিয়ে নেবে, তার ভরসা নেই। জনমনে সে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টাও তাদের নেই। সুতরাং তাদের কৌশল হচ্ছে এই বিচার-প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব প্রশ্নবিদ্ধ করা। কালিঝুলি মাখিয়ে দেওয়া। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এমনভাবে কথা বললেন, যাতে মনে হতে পারে, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাটা তাঁর বা দলের পকেটেই আছে। থাকলে বের করুন।
সাকা চৌধুরী আদালতকক্ষে পরিষ্কার বলেছেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ। কারণ এ রায় সেখান থেকে বেরিয়েছে।’ রায়ের দিন সকালের দিকে একটি ওয়েব লিংক পেলাম। আগের রাতেই নাকি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু হয়েছিল। ওই লিংকে তথ্য ছিল ‘১৭টি’ অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বিকেলে রায় পেলাম। সেখানে ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার তথ্যে মিল আছে। সেখানে আরও লেখা ছিল, পর্যবেক্ষণে কী কী থাকবে। সেখানে দুটি তথ্যের মিল আছে। এরপর ট্রাইব্যুনাল মুখপাত্রের ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়েও বিএনপির বিচারদূষণ-প্রক্রিয়া দেখলাম। এর উৎস কীভাবে ‘আইন মন্ত্রণালয়’, সেটাই সর্বাগ্রে উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন। স্কাইপ বিতর্কের তদন্ত হয়নি। তবে এ ঘটনার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। তা না করে যদি এটাকে ক্ষমতাসীনদের মুখরা প্রচারবিদদের খাদ্যে পরিণত করা হয়, তাহলে সমূহ বিপদ। এ ঘটনার একটি শুনানি মূল আপিল শুনানির আগে আপিল বিভাগেই হওয়া উচিত।
এ ঘটনা নির্দেশ করে যে ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের উপযুক্ত সংশোধনী দরকার। বিএনপি এটিকে যেভাবে করে রেখে গেছে, তাতে ক্ষমতাসীনেরা এটিকে নিকৃষ্ট উপায়ে অপব্যবহার করতে পারে। কেনিয়ার সিটিজেন টেলিভিশনের রিপোর্টার উইলিস রাবুরু আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হন। কারণ, তাঁর টুইট অ্যাকাউন্ট থেকে একজন সাক্ষীর নাম প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে। চলতি বছরের গোড়ায় কেনীয় ব্লগার ডেনিশ আইতুম্বির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ এনেছিল যে আইসিসির ই-মেইল হ্যাক করেছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ সম্ভবত এই যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাঁরা ‘জনসেবক’ তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও দাপ্তরিক জীবনের সর্বত্র যথাসম্ভব নৈতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। একজন মানুষের প্রকাশ্য ও ঘরোয়া জীবনের তফাত আকাশ-পাতালের মতো হওয়ার নয়। বিশেষ করে জনসেবকদের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কিংবদন্তিতে আরও রং মেশানোর যুগ এটা নয়। অভিন্স মাতিনদে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘টেক মোরান’ নামের একটি ওয়েবসাইটে হেগের আদালতে সাংবাদিক ও ব্লগারদের হুঁশিয়ার করা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে ‘কেউ একজন বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন, আজকের যুগে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণা একটি রূপকথা কি না।’ আমি তাঁর সঙ্গে একমত। স্কাইপ আলোচনায় একজন বিচারপতির একান্ত ঘরোয়া কথোপকথনের অনেক কিছুই নৈতিক মানদণ্ডে উতরানোর মতো বিষয় ছিল না। যাঁরা যত স্পর্শকাতর মর্যাদায় আসীন থাকবেন, তাঁদের ততটাই সজাগ থাকতে হবে।
বিএনপি গতকাল সারা দেশে বিক্ষোভ করলেও তারা জামায়াতি পদাঙ্ক নিশ্চয় অনুসরণ করেনি। তদুপরি ভুল বার্তাই তারা দিল। প্রমাণিত হলো, তাদের সমালোচনা নৈতিক নয়, সুবিধাবাদী। একই আদালতের দেওয়া পাঁচটি ফাঁসি তাদের টলাতে পারেনি। নীরবতা ভাঙতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রস্তাবও একটি স্ববিরোধিতা। আইনের মানদণ্ডে নয়, তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে খন্দকার মাহবুব দু-দুবারের নির্বাচিত সভাপতি। ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রতিটি দলের রাজনীতিক নিজেদের বিচারের ঊর্ধ্বে থাকতে ঠিক এমন খোঁড়া অজুহাতই খাড়া করে থাকেন।
২৪ ঘণ্টা বিলম্বে দেওয়া বিএনপির আনুষ্ঠানিক অভিমত দুর্ভাগ্যজনক। এটিকে আইনসম্মত শুদ্ধ বিবৃতি দাবি করা যায় না। কারণ, মির্জা ফখরুল যখন তাঁদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নেতার সুরে ‘আইন মন্ত্রণালয়ে রায় লেখা হয়েছে’ বলে দাবি করছেন, তখন সুপ্রিম কোর্টের বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী সমিতি (১৪ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে কেবল একজন আওয়ামীপন্থী সদস্য) আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে সর্বসম্মতভাবে একটি ভিন্ন রূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সিদ্ধান্ত এবং মির্জা ফখরুলের বিবৃতি সাংঘর্ষিক। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে। এর অর্থ, তারা ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। অথচ একে তারা ‘প্রহসনের বিচার’ও বলছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া এবং উত্তরপত্র ফাঁস হওয়া কিন্তু এক পাল্লায় মাপা যায় না। রায়ের মুসাবিদা প্রস্তুত করাই হচ্ছিল জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য। ট্রাইব্যুনালের মুখপাত্র খুব সতর্ক থাকলে তিনি ‘খসড়া রায়’ শব্দটি পরিহার করতে পারতেন। খসড়া রায় বলে আইনের চোখে কিছু নেই। প্রয়াত বরেণ্য আইনবিদ গাজী শামছুর রহমান পাকিস্তান আমলে জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। তাঁর আদালত থেকে দুই ধরনের রায় বিচারপ্রার্থীদের হাতে পড়েছিল। হাইকোর্ট এ মামলার নিষ্পত্তি করে বলেছেন, বিচারক যে রায়ের খসড়ায় সই দেননি, সেটি রায় নয়। তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে রায় পাঠ করেছেন এবং যাতে দস্তখত করেছেন, সেটিই হলো রায়।
আমরা অবশ্যই খসড়া রায়ের অংশত বেহাত হওয়ার ঘটনাকে খাটো করে দেখি না। তবে আজকের বাংলাদেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রের অবস্থা যে আফ্রিকার ওই দেশগুলো থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন, তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে কেবল যদি প্রমাণ করা যায় যে ওই রায় আইন মন্ত্রণালয় বা অন্যত্র লেখা হয়েছে, তাহলে বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে পারে। তবে এ ধরনের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বিচার-প্রক্রিয়ায় আগাম কালি ছিটানোর মনোভাব বা এটাকে একটা প্রপাগান্ডার হাতিয়ারে পরিণত করার যেকোনো চেষ্টা অগ্রহণীয়, নিন্দনীয় এবং দণ্ডনীয়ও বটে।
ডিবির তদন্ত এবং আদালত অবমাননা রুলের নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে বিষয়টি শেষ হওয়া উচিত নয়। বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী সমিতির প্রস্তাবে সাড়া দিলে সেটি দেশের প্রধান বিরোধী দলকে পরোক্ষভাবে হলেও বিচার-প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা বলে প্রতীয়মান হবে। এ রকম একটি সংস্থার প্রস্তাবকে সম্মান দেখানো উচিত। আর এটাই গণতন্ত্রের দাবি। বারের প্রস্তাব নাকচ করা হবে ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেওয়া।
সংসদীয় গণতন্ত্রের জিগির দিয়ে শাসকগোষ্ঠী কখনোই বিরোধী দলকে পাত্তা দেয়নি। বেলাডুবির সময়ে অন্তত একটি নজির স্থাপিত হোক। দেশের জন্য সব ভালো কেবল ক্ষমতাসীনেরাই বোঝে, সেটা তো ঠিক নয়। বিএনপিকে এই বিচার-প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে উৎসাহী দেখা যায়নি। আমি সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রস্তাবকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই উৎসাহ হিসেবে গণ্য করি। এর ফলে সাকার বিচার-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা আরও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সাকার পরিবারের আদালত অবমাননাকারী ‘সন্দেহভাজন’ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। স্কাইপের পরে এবারও যদি কেবল ভয় ও ক্ষমতার দম্ভ দেখানোর নীতি অনুসরণ করা হয়, তা হবে আত্মঘাতী।
বাংলাদেশে কম্পিউটারে বাংলা প্রবর্তনের পথিকৃৎ মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হলো, সাকার ঘটনাটির হদিস বের করা অসম্ভব নয়। তিনি বলেন, রিয়েল আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) বের করার প্রযুক্তি র্যাব, পুলিশ ও আর্মির আছে। এখন একটি জিও-এনজিও সহযোগিতায় তদন্ত হতে পারে। এটিতে ম্যাকবুক প্রো ল্যাপটপ ব্যবহার করা হয়েছে। এর সফটওয়্যারও দেশের প্রচলিত উইন্ডোজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আইন মন্ত্রণালয়ের এটি নেই। আইটি ফরেনসিকে রিয়েল আইপি বের করা কঠিন কাজ নয়। এর ফলে দেশের কোন কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছে, তা-ও বের করা যাবে। গুগল ম্যাপ দিয়ে দেশের কোন এলাকা থেকে এটি করা হয়েছে, তা-ও নির্দিষ্ট করা সম্ভব বলেও জানালেন তিনি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর হেগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আইসিসিতে সভাপতিত্বকারী বিচারক এবো-ওসুজু আদেশ জারি করেছেন যে, যাঁরা যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাক্ষী হবেন, তাঁদের পরিচয়ের গোপনীয়তা ফাঁস করা আদালত অবমাননা। এই বিচারক ব্লগার ও সাংবাদিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কেবল ইন্টারনেটের সূত্র ব্যবহার করে তথ্য প্রকাশ করে পার পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনও তাই বলে। তথাকথিত খসড়া রায় কোথাও পেলে তা ডাউনলোড বা প্রিন্ট করে নিয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে তারস্বরে চিৎকার করা দণ্ডনীয়। যদি তাতে আদালতকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য থাকে। খসড়া রায়ের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সেটা ঘটানোর মুখ্য দায় দৃশ্যত সাকা ও তাঁর পরিবারের। তাঁদের এ জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এটা নাশকতাও হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে কেউ এটা পেনড্রাইভে বা ই-মেইলে পাঠাতে পারে। এবং সেখান থেকে তা ফাঁস করা হতে পারে। চক্রান্তকারীদের পক্ষে এ রকম কিছু করা যে অসম্ভব, তা বলা যাবে না। এই বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের মানুষের অস্বস্তি কম নয়। তারা বিচার চায়, কিন্তু দলীয় রাজনীতিটা বাদ দিয়ে। আর ক্ষমতাসীন দল তা দিতে একদম অনিচ্ছুক। আগামী নির্বাচনী প্রচারণায় এটাকে তারা অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং করবেই করবে। তাই এ-সংক্রান্ত তদন্তকে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি যে ক্ষমতায় গেলে এই বিচার এগিয়ে নেবে, তার ভরসা নেই। জনমনে সে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টাও তাদের নেই। সুতরাং তাদের কৌশল হচ্ছে এই বিচার-প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব প্রশ্নবিদ্ধ করা। কালিঝুলি মাখিয়ে দেওয়া। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এমনভাবে কথা বললেন, যাতে মনে হতে পারে, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাটা তাঁর বা দলের পকেটেই আছে। থাকলে বের করুন।
সাকা চৌধুরী আদালতকক্ষে পরিষ্কার বলেছেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ। কারণ এ রায় সেখান থেকে বেরিয়েছে।’ রায়ের দিন সকালের দিকে একটি ওয়েব লিংক পেলাম। আগের রাতেই নাকি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু হয়েছিল। ওই লিংকে তথ্য ছিল ‘১৭টি’ অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বিকেলে রায় পেলাম। সেখানে ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার তথ্যে মিল আছে। সেখানে আরও লেখা ছিল, পর্যবেক্ষণে কী কী থাকবে। সেখানে দুটি তথ্যের মিল আছে। এরপর ট্রাইব্যুনাল মুখপাত্রের ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়েও বিএনপির বিচারদূষণ-প্রক্রিয়া দেখলাম। এর উৎস কীভাবে ‘আইন মন্ত্রণালয়’, সেটাই সর্বাগ্রে উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন। স্কাইপ বিতর্কের তদন্ত হয়নি। তবে এ ঘটনার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। তা না করে যদি এটাকে ক্ষমতাসীনদের মুখরা প্রচারবিদদের খাদ্যে পরিণত করা হয়, তাহলে সমূহ বিপদ। এ ঘটনার একটি শুনানি মূল আপিল শুনানির আগে আপিল বিভাগেই হওয়া উচিত।
এ ঘটনা নির্দেশ করে যে ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের উপযুক্ত সংশোধনী দরকার। বিএনপি এটিকে যেভাবে করে রেখে গেছে, তাতে ক্ষমতাসীনেরা এটিকে নিকৃষ্ট উপায়ে অপব্যবহার করতে পারে। কেনিয়ার সিটিজেন টেলিভিশনের রিপোর্টার উইলিস রাবুরু আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হন। কারণ, তাঁর টুইট অ্যাকাউন্ট থেকে একজন সাক্ষীর নাম প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে। চলতি বছরের গোড়ায় কেনীয় ব্লগার ডেনিশ আইতুম্বির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ এনেছিল যে আইসিসির ই-মেইল হ্যাক করেছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ সম্ভবত এই যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাঁরা ‘জনসেবক’ তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও দাপ্তরিক জীবনের সর্বত্র যথাসম্ভব নৈতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। একজন মানুষের প্রকাশ্য ও ঘরোয়া জীবনের তফাত আকাশ-পাতালের মতো হওয়ার নয়। বিশেষ করে জনসেবকদের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কিংবদন্তিতে আরও রং মেশানোর যুগ এটা নয়। অভিন্স মাতিনদে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘টেক মোরান’ নামের একটি ওয়েবসাইটে হেগের আদালতে সাংবাদিক ও ব্লগারদের হুঁশিয়ার করা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে ‘কেউ একজন বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন, আজকের যুগে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণা একটি রূপকথা কি না।’ আমি তাঁর সঙ্গে একমত। স্কাইপ আলোচনায় একজন বিচারপতির একান্ত ঘরোয়া কথোপকথনের অনেক কিছুই নৈতিক মানদণ্ডে উতরানোর মতো বিষয় ছিল না। যাঁরা যত স্পর্শকাতর মর্যাদায় আসীন থাকবেন, তাঁদের ততটাই সজাগ থাকতে হবে।
বিএনপি গতকাল সারা দেশে বিক্ষোভ করলেও তারা জামায়াতি পদাঙ্ক নিশ্চয় অনুসরণ করেনি। তদুপরি ভুল বার্তাই তারা দিল। প্রমাণিত হলো, তাদের সমালোচনা নৈতিক নয়, সুবিধাবাদী। একই আদালতের দেওয়া পাঁচটি ফাঁসি তাদের টলাতে পারেনি। নীরবতা ভাঙতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রস্তাবও একটি স্ববিরোধিতা। আইনের মানদণ্ডে নয়, তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে খন্দকার মাহবুব দু-দুবারের নির্বাচিত সভাপতি। ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রতিটি দলের রাজনীতিক নিজেদের বিচারের ঊর্ধ্বে থাকতে ঠিক এমন খোঁড়া অজুহাতই খাড়া করে থাকেন।
২৪ ঘণ্টা বিলম্বে দেওয়া বিএনপির আনুষ্ঠানিক অভিমত দুর্ভাগ্যজনক। এটিকে আইনসম্মত শুদ্ধ বিবৃতি দাবি করা যায় না। কারণ, মির্জা ফখরুল যখন তাঁদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নেতার সুরে ‘আইন মন্ত্রণালয়ে রায় লেখা হয়েছে’ বলে দাবি করছেন, তখন সুপ্রিম কোর্টের বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী সমিতি (১৪ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে কেবল একজন আওয়ামীপন্থী সদস্য) আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে সর্বসম্মতভাবে একটি ভিন্ন রূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সিদ্ধান্ত এবং মির্জা ফখরুলের বিবৃতি সাংঘর্ষিক। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে। এর অর্থ, তারা ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। অথচ একে তারা ‘প্রহসনের বিচার’ও বলছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া এবং উত্তরপত্র ফাঁস হওয়া কিন্তু এক পাল্লায় মাপা যায় না। রায়ের মুসাবিদা প্রস্তুত করাই হচ্ছিল জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য। ট্রাইব্যুনালের মুখপাত্র খুব সতর্ক থাকলে তিনি ‘খসড়া রায়’ শব্দটি পরিহার করতে পারতেন। খসড়া রায় বলে আইনের চোখে কিছু নেই। প্রয়াত বরেণ্য আইনবিদ গাজী শামছুর রহমান পাকিস্তান আমলে জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। তাঁর আদালত থেকে দুই ধরনের রায় বিচারপ্রার্থীদের হাতে পড়েছিল। হাইকোর্ট এ মামলার নিষ্পত্তি করে বলেছেন, বিচারক যে রায়ের খসড়ায় সই দেননি, সেটি রায় নয়। তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে রায় পাঠ করেছেন এবং যাতে দস্তখত করেছেন, সেটিই হলো রায়।
আমরা অবশ্যই খসড়া রায়ের অংশত বেহাত হওয়ার ঘটনাকে খাটো করে দেখি না। তবে আজকের বাংলাদেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রের অবস্থা যে আফ্রিকার ওই দেশগুলো থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন, তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে কেবল যদি প্রমাণ করা যায় যে ওই রায় আইন মন্ত্রণালয় বা অন্যত্র লেখা হয়েছে, তাহলে বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে পারে। তবে এ ধরনের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বিচার-প্রক্রিয়ায় আগাম কালি ছিটানোর মনোভাব বা এটাকে একটা প্রপাগান্ডার হাতিয়ারে পরিণত করার যেকোনো চেষ্টা অগ্রহণীয়, নিন্দনীয় এবং দণ্ডনীয়ও বটে।
ডিবির তদন্ত এবং আদালত অবমাননা রুলের নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে বিষয়টি শেষ হওয়া উচিত নয়। বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী সমিতির প্রস্তাবে সাড়া দিলে সেটি দেশের প্রধান বিরোধী দলকে পরোক্ষভাবে হলেও বিচার-প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা বলে প্রতীয়মান হবে। এ রকম একটি সংস্থার প্রস্তাবকে সম্মান দেখানো উচিত। আর এটাই গণতন্ত্রের দাবি। বারের প্রস্তাব নাকচ করা হবে ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেওয়া।
সংসদীয় গণতন্ত্রের জিগির দিয়ে শাসকগোষ্ঠী কখনোই বিরোধী দলকে পাত্তা দেয়নি। বেলাডুবির সময়ে অন্তত একটি নজির স্থাপিত হোক। দেশের জন্য সব ভালো কেবল ক্ষমতাসীনেরাই বোঝে, সেটা তো ঠিক নয়। বিএনপিকে এই বিচার-প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে উৎসাহী দেখা যায়নি। আমি সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রস্তাবকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই উৎসাহ হিসেবে গণ্য করি। এর ফলে সাকার বিচার-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা আরও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সাকার পরিবারের আদালত অবমাননাকারী ‘সন্দেহভাজন’ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। স্কাইপের পরে এবারও যদি কেবল ভয় ও ক্ষমতার দম্ভ দেখানোর নীতি অনুসরণ করা হয়, তা হবে আত্মঘাতী।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments