একবার না পারিলে দেখো ২১ বার by মো. সাইফুল্লাহ
গুনে গুনে ২০ বার ডিগ্রি পরীক্ষা
দিয়েছিলেন দিনাজপুরের খোশবুল আলম। পাসের দেখা পাননি। তারপর? পড়ুন ধৈর্য
আর অধ্যবসায়ের এক অসাধারণ কাহিনি
সকালেই দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন
মো. খোশবুল আলম।
ঢাকায় কী যেন একটা কাজ ছিল—সে কারণেই আসা। কথাবার্তা শেষে আমরা তখন
খোশবুলের ছবি তুলতে ব্যস্ত। এতক্ষণ হাত-পা নেড়ে উচ্ছল ভঙ্গিতে কথা বলে
যাওয়া মানুষটা কেন যেন ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েই গুটিসুটি মেরে গেলেন।
আলোকচিত্রী যতই বলেন, ‘আপনি একটু হাসেন। না হাসলে তো ছবি ভালো হবে না’,
খোশবুল আলম ততই গুটিয়ে নেন নিজেকে। পাশে দাঁড়ানো খোশবুলের ভাগনে এবার
কৌশলী হয়ে ওঠেন, ‘মামা, মনে করেন, আপনি আজকেই ডিগ্রি পাস করছেন। এবার
হাসেন।’ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নয়, খোশবুল ভাগনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
রহস্যময় হাসি। সেই হাসি আমাদের নিয়ে যায় অনেক পেছনে। সত্যিই তো, ২১ বার
পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে খোশবুল আলম যেদিন ডিগ্রি পাস করলেন, সেদিন তাঁর
হাসিটা কেমন দেখতে হয়েছিল?
পড়ালেখা করে যে...
ভগীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোশবুলের পড়ালেখার শুরু। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম।’ ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়া কৃষকপুত্র সে সময়ই পড়ালেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ জানান দিয়েছিলেন। ধারাবাহিকতার প্রমাণ পাওয়া গেল এসএসসি পরীক্ষায়ও। ‘মাঝে নানা সমস্যায় দু-একবার বছর গ্যাপ পড়ছিল। আশি সালে এসএসসি দিলাম। আমার এলাকায় আমিই প্রথম সেকেন্ড ডিভিশন পাইয়া পাস করলাম।’ বলছিলেন খোশবুল।
এরপর, ভর্তি হলেন দিনাজপুর কে বি এম কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেও, প্রথম বর্ষের পাট চোকার আগেই খোশবুলের কাছে ‘বিজ্ঞান’ ব্যাপারটা কঠিন মনে হলো। দ্বিতীয় বর্ষে তাই পরীক্ষা দিলেন মানবিক বিভাগ থেকে। ফলাফল: ‘থার্ড ডিভিশন’। ‘তখন এরশাদ সরকারের আমল। সে বছর ২০ পার্সেন্ট পাস করছিল। আরও ভালো করার আশা ছিল, তবে থার্ড ডিভিশন পাইয়াও খুব একটা অখুশি হই নাই।’
খোশবুল তখন নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালান। টিউশনি করেন। ক্লাস সিক্স-সেভেনের ৩০ থেকে ৪০ জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে পড়তে আসে তাঁর কাছে। ওদিকে ছাত্রছাত্রীদের ‘মাস্টার মশাই’য়ের দৃষ্টি তখন অনেক দূরে। ইচ্ছা ছিল ইংরেজি বিভাগে পড়বেন, কিন্তু কাছাকাছি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আর্থিক টানাপোড়েনও একটা বাধা বৈকি। পরিচিত একজন উপায় বাতলে দিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলে এক বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। তবে একটা শর্ত আছে, পাস করার পর সেই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে হবে! খোশবুল আকাশ থেকে পড়লেন! এমন অদ্ভুত শর্তে রাজি হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা দিনাজপুর ডিগ্রি কলেজেই স্নাতকে ভর্তি হলেন। ইচ্ছা, স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর করবেন। সুযোগ পেলে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরির চেষ্টা করবেন। মনোযোগী ছাত্রের মতো নিয়মিত ক্লাস করতে শুরু করলেন খোশবুল। ১৯৮৫ সাল। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। রাত-দিন পড়ালেখা করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘পরীক্ষা ভালোই হইছিল।’ হাজারো স্বপ্ন নিয়ে তখন রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। খোশবুল তখনো জানেন না, একটা গোলকধাঁধায় আটকা পড়তে যাচ্ছেন তিনি!
পড়ালেখা করে যে...
ভগীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোশবুলের পড়ালেখার শুরু। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম।’ ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়া কৃষকপুত্র সে সময়ই পড়ালেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ জানান দিয়েছিলেন। ধারাবাহিকতার প্রমাণ পাওয়া গেল এসএসসি পরীক্ষায়ও। ‘মাঝে নানা সমস্যায় দু-একবার বছর গ্যাপ পড়ছিল। আশি সালে এসএসসি দিলাম। আমার এলাকায় আমিই প্রথম সেকেন্ড ডিভিশন পাইয়া পাস করলাম।’ বলছিলেন খোশবুল।
এরপর, ভর্তি হলেন দিনাজপুর কে বি এম কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেও, প্রথম বর্ষের পাট চোকার আগেই খোশবুলের কাছে ‘বিজ্ঞান’ ব্যাপারটা কঠিন মনে হলো। দ্বিতীয় বর্ষে তাই পরীক্ষা দিলেন মানবিক বিভাগ থেকে। ফলাফল: ‘থার্ড ডিভিশন’। ‘তখন এরশাদ সরকারের আমল। সে বছর ২০ পার্সেন্ট পাস করছিল। আরও ভালো করার আশা ছিল, তবে থার্ড ডিভিশন পাইয়াও খুব একটা অখুশি হই নাই।’
খোশবুল তখন নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালান। টিউশনি করেন। ক্লাস সিক্স-সেভেনের ৩০ থেকে ৪০ জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে পড়তে আসে তাঁর কাছে। ওদিকে ছাত্রছাত্রীদের ‘মাস্টার মশাই’য়ের দৃষ্টি তখন অনেক দূরে। ইচ্ছা ছিল ইংরেজি বিভাগে পড়বেন, কিন্তু কাছাকাছি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আর্থিক টানাপোড়েনও একটা বাধা বৈকি। পরিচিত একজন উপায় বাতলে দিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলে এক বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। তবে একটা শর্ত আছে, পাস করার পর সেই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে হবে! খোশবুল আকাশ থেকে পড়লেন! এমন অদ্ভুত শর্তে রাজি হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা দিনাজপুর ডিগ্রি কলেজেই স্নাতকে ভর্তি হলেন। ইচ্ছা, স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর করবেন। সুযোগ পেলে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরির চেষ্টা করবেন। মনোযোগী ছাত্রের মতো নিয়মিত ক্লাস করতে শুরু করলেন খোশবুল। ১৯৮৫ সাল। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। রাত-দিন পড়ালেখা করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘পরীক্ষা ভালোই হইছিল।’ হাজারো স্বপ্ন নিয়ে তখন রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। খোশবুল তখনো জানেন না, একটা গোলকধাঁধায় আটকা পড়তে যাচ্ছেন তিনি!
পাস-ফেলের সমীকরণ
প্রথমবারের ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফল বের হলো। খোশবুল আলম অকৃতকার্য। একটু অবাক হলেও মেনে নিলেন খোশবুল। ভাবলেন, এ বছর হয়নি, পরের বছর হবে। আরও ভালো করে পড়ালেখা করতে হবে। ’৮৬ সালে পরীক্ষা দিলেন। ফলাফল: অপরিবর্তিত! এক বিষয়ে পাস, তো আরেক বিষয়ে ফেল। পাস-ফেলের সমীকরণে তখন এমনিতেই হাবুডুবু খাচ্ছেন, এরই মধ্যে বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ শুরু হলো। বাড়ির বড় ছেলের একটা ‘গতি’ করতে চান বাবা-মা। খোশবুল নারাজ। এহেন গতি তাঁর কাছে ‘ক্ষতি’ বলেই মনে হলো! ‘চাকরি নাই বাকরি নাই, এহনো ইন্টার পাস। বিয়া কি করমু?’ তাঁর এমন যুক্তি বাবা-মা মানলেন না। ১৯৮৬ সাল, ঘোরাবান্দের আবদুল হামিদের মেয়ে হামিদা বানুর পাশে বরের বেশে দেখা গেল খোশবুল আলমকে।
এরই মধ্যে প্রতিবছর পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছেন তিনি। ফল একই—অকৃতকার্য! ’৮৮ সালে এক ছেলের বাবা হলেন। ’৮৯ সালে ঘরে এল যমজ সন্তান। ভাবলেন, এবার হয়তো ভাগ্য ফিরবে। হলো না। দুঃখী মানুষটাকে আরও দুঃখী করে দিয়ে তিন দিনের মাথায় ছেলে দুটোর মৃত্যু হলো।
পরের বছরগুলো খোশবুলের জন্য খুবই ঘটনাবহুল। মেয়ে খালেদা খাতুনের জন্ম হলো। সরকারি চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে ’৯৫ সালে ভর্তি হলেন নীলফামারী হোমিওপ্যাথি কলেজে। অনেক পরিবর্তনের মাঝেও একটা বিষয় অপরিবর্তিত থেকে গেল। খোশবুলের ডিগ্রি পরীক্ষার ফল—অকৃতকার্য! নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও, খুব বিপাকে না পড়লে এর মাঝে প্রায় প্রতিবছরই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি। তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন কে বি এম কলেজ থেকে, বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন পর পর ১২ বার, এরপর দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিতে শুরু করলেন। অকৃতকার্যের ভূত তাঁর পিছু ছাড়ল না।
তত দিনে খোশবুলের স্কুল-কলেজের বন্ধুরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছেন। পরীক্ষার হলে গিয়ে বসতে হয় বন্ধুবান্ধবের ছেলেপুলেদের সঙ্গে! পরীক্ষার হলে যাঁরা দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাও বয়সে ছোট। এসব কোনো কিছুই আমলে নেননি তিনি। ‘সেই শুরু থেইকা প্রত্যেকটা পরীক্ষায় দেখছি, আশেপাশে সবাই বই খুইলা, কাগজপত্র বাইর কইরা, এইটা-ওইটা দেইখা লেখতেছে। আমি কখনোই নকল করি নাই। মনে হইত, যা পারি তা-ই লিখমু। এমনও হইছে, শিক্ষকেরা আমারে ভাই বা চাচা ডাইকা সামনে বই খুইলা দিছে। বলছে, “এইবার অন্তত আপনি পাস করেন।” কিন্তু আমি কী দেখমু? বইয়ে যা আছে, সব আমি জানি। সব পারি। নকল করার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু খাতায় লিখতে গেলেই কী জানি এলোমেলো হইয়া যায়!’
১৮, ১৯, ২০তম বার গেল! জেদি মানুষটাও এবার দুর্বল হয়ে পড়লেন। মানুষজনের কটাক্ষ, অপমান আর নিতে পারছিলেন না। ‘২১ বারের সময় পরীক্ষা দিতে যাইতেছি। খুব বেশি কিছু পড়ি নাই। নতুন কইরা কী পড়মু? এতবার পড়ছি! মনে মনে আল্লাহরে কইলাম, আল্লাহ, এইবার আমারে পাস করায়া হল থেইকা বাইর করো। নাইলে হল থেইকাই উঠাইয়া নিয়া যাও। সিদ্ধান্ত নিছিলাম, এইবার পাস না করলে দূরে চইলা যামু। পরিচিত মানুষগুলারে আর মুখ দেখামু না। রেজাল্টের আগে তাড়াহুড়া কইরা ছেলের বিয়া দিলাম। পরে যদি আমি না থাকি!’
প্রথমবারের ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফল বের হলো। খোশবুল আলম অকৃতকার্য। একটু অবাক হলেও মেনে নিলেন খোশবুল। ভাবলেন, এ বছর হয়নি, পরের বছর হবে। আরও ভালো করে পড়ালেখা করতে হবে। ’৮৬ সালে পরীক্ষা দিলেন। ফলাফল: অপরিবর্তিত! এক বিষয়ে পাস, তো আরেক বিষয়ে ফেল। পাস-ফেলের সমীকরণে তখন এমনিতেই হাবুডুবু খাচ্ছেন, এরই মধ্যে বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ শুরু হলো। বাড়ির বড় ছেলের একটা ‘গতি’ করতে চান বাবা-মা। খোশবুল নারাজ। এহেন গতি তাঁর কাছে ‘ক্ষতি’ বলেই মনে হলো! ‘চাকরি নাই বাকরি নাই, এহনো ইন্টার পাস। বিয়া কি করমু?’ তাঁর এমন যুক্তি বাবা-মা মানলেন না। ১৯৮৬ সাল, ঘোরাবান্দের আবদুল হামিদের মেয়ে হামিদা বানুর পাশে বরের বেশে দেখা গেল খোশবুল আলমকে।
এরই মধ্যে প্রতিবছর পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছেন তিনি। ফল একই—অকৃতকার্য! ’৮৮ সালে এক ছেলের বাবা হলেন। ’৮৯ সালে ঘরে এল যমজ সন্তান। ভাবলেন, এবার হয়তো ভাগ্য ফিরবে। হলো না। দুঃখী মানুষটাকে আরও দুঃখী করে দিয়ে তিন দিনের মাথায় ছেলে দুটোর মৃত্যু হলো।
পরের বছরগুলো খোশবুলের জন্য খুবই ঘটনাবহুল। মেয়ে খালেদা খাতুনের জন্ম হলো। সরকারি চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে ’৯৫ সালে ভর্তি হলেন নীলফামারী হোমিওপ্যাথি কলেজে। অনেক পরিবর্তনের মাঝেও একটা বিষয় অপরিবর্তিত থেকে গেল। খোশবুলের ডিগ্রি পরীক্ষার ফল—অকৃতকার্য! নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও, খুব বিপাকে না পড়লে এর মাঝে প্রায় প্রতিবছরই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি। তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন কে বি এম কলেজ থেকে, বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন পর পর ১২ বার, এরপর দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিতে শুরু করলেন। অকৃতকার্যের ভূত তাঁর পিছু ছাড়ল না।
তত দিনে খোশবুলের স্কুল-কলেজের বন্ধুরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছেন। পরীক্ষার হলে গিয়ে বসতে হয় বন্ধুবান্ধবের ছেলেপুলেদের সঙ্গে! পরীক্ষার হলে যাঁরা দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাও বয়সে ছোট। এসব কোনো কিছুই আমলে নেননি তিনি। ‘সেই শুরু থেইকা প্রত্যেকটা পরীক্ষায় দেখছি, আশেপাশে সবাই বই খুইলা, কাগজপত্র বাইর কইরা, এইটা-ওইটা দেইখা লেখতেছে। আমি কখনোই নকল করি নাই। মনে হইত, যা পারি তা-ই লিখমু। এমনও হইছে, শিক্ষকেরা আমারে ভাই বা চাচা ডাইকা সামনে বই খুইলা দিছে। বলছে, “এইবার অন্তত আপনি পাস করেন।” কিন্তু আমি কী দেখমু? বইয়ে যা আছে, সব আমি জানি। সব পারি। নকল করার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু খাতায় লিখতে গেলেই কী জানি এলোমেলো হইয়া যায়!’
১৮, ১৯, ২০তম বার গেল! জেদি মানুষটাও এবার দুর্বল হয়ে পড়লেন। মানুষজনের কটাক্ষ, অপমান আর নিতে পারছিলেন না। ‘২১ বারের সময় পরীক্ষা দিতে যাইতেছি। খুব বেশি কিছু পড়ি নাই। নতুন কইরা কী পড়মু? এতবার পড়ছি! মনে মনে আল্লাহরে কইলাম, আল্লাহ, এইবার আমারে পাস করায়া হল থেইকা বাইর করো। নাইলে হল থেইকাই উঠাইয়া নিয়া যাও। সিদ্ধান্ত নিছিলাম, এইবার পাস না করলে দূরে চইলা যামু। পরিচিত মানুষগুলারে আর মুখ দেখামু না। রেজাল্টের আগে তাড়াহুড়া কইরা ছেলের বিয়া দিলাম। পরে যদি আমি না থাকি!’
আলোর দেখা
২০১০ সাল। ভুল্লিরহাট বাজারে খোশবুলের হোমিওপ্যাথির দোকান ‘খালেদা হোমিও হল’। সন্ধ্যা থেকেই পাড়ার লোকজন তাঁর দোকানে আসা-যাওয়া করছেন, ‘খোশবুল, রেজাল্ট হইছে শুনলাম। তোমার খবর কী?’ খোশবুল কিছু বলেন না। ফলাফল দেখেননি, মনে মনে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে দোকানে এল বন্ধুর ছেলে রথীন, খোশবুলের সঙ্গেই সেবার পরীক্ষা দিয়েছেন। বললেন, ‘চাচা, রোল আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা কন। মোবাইলে দেখি।’ খোশবুল দিলেন। খানিক মুঠোফোন টিপাটিপি করে রথীনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর, ‘চাচা, আপনি তো পাস করছেন!’
২১ বার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ‘থার্ড ডিভিশন’ পেয়ে পাস করলেন খোশবুল। বাজারে পরিচিত-অপরিচিত সবাই ভিড় করতে লাগল খালেদা হোমিও হলে। ‘মিষ্টি খাওয়াও, মিষ্টি খাওয়াও!’ আশপাশে মিষ্টির দোকান নেই। সবাইকে ঝাল ঝাল পেঁয়াজু খাইয়ে খোশবুল উদ্যাপন করলেন তাঁর মিষ্টিসন্ধ্যাটা!
ছেলে আবদুল হাকিম, মেয়ে খালেদা, স্ত্রী, নাতি-নাতনিকে নিয়ে এখন ভালোই আছেন ‘ডিগ্রি পাস’ খোশবুল। ২০১১ সালে স্নাতকোত্তর করার জন্য রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ভালো একটা চাকরির স্বপ্ন, কিংবা জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ তাঁর এখনো ফিকে হয়ে যায়নি। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘২০টা অপমানের মাল্য আমার গলায় আছে। এইবার দেখি, ২০টা সম্মানের মাল্য গলায় পরা যায় কি না!’
২০১০ সাল। ভুল্লিরহাট বাজারে খোশবুলের হোমিওপ্যাথির দোকান ‘খালেদা হোমিও হল’। সন্ধ্যা থেকেই পাড়ার লোকজন তাঁর দোকানে আসা-যাওয়া করছেন, ‘খোশবুল, রেজাল্ট হইছে শুনলাম। তোমার খবর কী?’ খোশবুল কিছু বলেন না। ফলাফল দেখেননি, মনে মনে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে দোকানে এল বন্ধুর ছেলে রথীন, খোশবুলের সঙ্গেই সেবার পরীক্ষা দিয়েছেন। বললেন, ‘চাচা, রোল আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা কন। মোবাইলে দেখি।’ খোশবুল দিলেন। খানিক মুঠোফোন টিপাটিপি করে রথীনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর, ‘চাচা, আপনি তো পাস করছেন!’
২১ বার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ‘থার্ড ডিভিশন’ পেয়ে পাস করলেন খোশবুল। বাজারে পরিচিত-অপরিচিত সবাই ভিড় করতে লাগল খালেদা হোমিও হলে। ‘মিষ্টি খাওয়াও, মিষ্টি খাওয়াও!’ আশপাশে মিষ্টির দোকান নেই। সবাইকে ঝাল ঝাল পেঁয়াজু খাইয়ে খোশবুল উদ্যাপন করলেন তাঁর মিষ্টিসন্ধ্যাটা!
ছেলে আবদুল হাকিম, মেয়ে খালেদা, স্ত্রী, নাতি-নাতনিকে নিয়ে এখন ভালোই আছেন ‘ডিগ্রি পাস’ খোশবুল। ২০১১ সালে স্নাতকোত্তর করার জন্য রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ভালো একটা চাকরির স্বপ্ন, কিংবা জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ তাঁর এখনো ফিকে হয়ে যায়নি। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘২০টা অপমানের মাল্য আমার গলায় আছে। এইবার দেখি, ২০টা সম্মানের মাল্য গলায় পরা যায় কি না!’
ভুল্লিরহাটের
খোশবুল আলম
আসাদুল্লাহ্ সরকার, দিনাজপুর
বীরগঞ্জ উপজেলার ভগীরপাড়া, ভুল্লিরহাট। হাটের পশ্চিম-উত্তর কোনায় শেষ প্রান্তে চারদিকে বুক-বরাবর ইটের দুর্বল গাঁথুনির দেয়ালের উপরিভাগ বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা। ওপরে টিনের চালা। ঘরের প্রবেশদ্বারে জীর্ণ সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে ‘খালেদা হোমিও হল’।
হোমিও ডাক্তারখানায় শিশুপুত্র সুফিয়ানের চিকিৎসা নিতে এসেছেন ভগীরপাড়ার ভ্যানচালক তরিকুল ইসলামের স্ত্রী শাপলা খাতুন। তিনি জানান, হোমিও চিকিৎসক খোশবুল আলমই তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক।
রোগী বিদায় হলে শুরু হলো আলাপ। ২১ বার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ২০১০ সালে তৃতীয় বিভাগে ডিগ্রি পাস করেন খোশবুল।
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার ১০ নম্বর মোহানপুর ইউনিয়নের ভগীরপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। খোশবুল আলমের এক মেয়ে এক ছেলে। নিজে বাড়ি করেছেন বীরগঞ্জ শহরে। ছেলে আবদুল হাকিমের বীরগঞ্জে বাড়ির পাশে মোটরসাইকেল মেরামতের গ্যারেজ আছে। মেয়ে খালেদা আছেন শ্বশুরবাড়িতে। ভুল্লিরহাটে রোগী দেখেন খোশবুল। ভুল্লিরহাটে খোশবুলের হোমিও চিকিৎসালয়ে কথা হলো তাঁর তৃতীয় শ্রেণী থেকে কে বি এম কলেজে ডিগ্রি পড়া পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের সহপাঠী ইমদাদুল হকের সঙ্গে। ‘খোশবুলের ডিগ্রি পাসের লড়াইয়ের ইতিহাসে এলাকার মানুষ বিস্মিত, ‘আমি ভাবতে পারি না, ২৭ বছরে ও কী অসীম ধৈর্য নিয়ে ২১ বার ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছে।’ বলছিলেন তিনি।
কথা হলো খোশবুল আলমের পাড়ার বড় ভাই মো. বশির উদ্দিনের সঙ্গেও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার ছিলেন। এখন গ্রামের বাড়িতে অবসর যাপন করছেন। খোশবুলের ডিগ্রি পাসের ইতিহাস প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘শুনে আশ্চর্য লাগে, খোশবুল প্রমাণ করেছে, “পড়ালেখার নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই, নিজের ইচ্ছাশক্তিই আসল”।’
আসাদুল্লাহ্ সরকার, দিনাজপুর
বীরগঞ্জ উপজেলার ভগীরপাড়া, ভুল্লিরহাট। হাটের পশ্চিম-উত্তর কোনায় শেষ প্রান্তে চারদিকে বুক-বরাবর ইটের দুর্বল গাঁথুনির দেয়ালের উপরিভাগ বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা। ওপরে টিনের চালা। ঘরের প্রবেশদ্বারে জীর্ণ সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে ‘খালেদা হোমিও হল’।
হোমিও ডাক্তারখানায় শিশুপুত্র সুফিয়ানের চিকিৎসা নিতে এসেছেন ভগীরপাড়ার ভ্যানচালক তরিকুল ইসলামের স্ত্রী শাপলা খাতুন। তিনি জানান, হোমিও চিকিৎসক খোশবুল আলমই তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক।
রোগী বিদায় হলে শুরু হলো আলাপ। ২১ বার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ২০১০ সালে তৃতীয় বিভাগে ডিগ্রি পাস করেন খোশবুল।
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার ১০ নম্বর মোহানপুর ইউনিয়নের ভগীরপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। খোশবুল আলমের এক মেয়ে এক ছেলে। নিজে বাড়ি করেছেন বীরগঞ্জ শহরে। ছেলে আবদুল হাকিমের বীরগঞ্জে বাড়ির পাশে মোটরসাইকেল মেরামতের গ্যারেজ আছে। মেয়ে খালেদা আছেন শ্বশুরবাড়িতে। ভুল্লিরহাটে রোগী দেখেন খোশবুল। ভুল্লিরহাটে খোশবুলের হোমিও চিকিৎসালয়ে কথা হলো তাঁর তৃতীয় শ্রেণী থেকে কে বি এম কলেজে ডিগ্রি পড়া পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের সহপাঠী ইমদাদুল হকের সঙ্গে। ‘খোশবুলের ডিগ্রি পাসের লড়াইয়ের ইতিহাসে এলাকার মানুষ বিস্মিত, ‘আমি ভাবতে পারি না, ২৭ বছরে ও কী অসীম ধৈর্য নিয়ে ২১ বার ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছে।’ বলছিলেন তিনি।
কথা হলো খোশবুল আলমের পাড়ার বড় ভাই মো. বশির উদ্দিনের সঙ্গেও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার ছিলেন। এখন গ্রামের বাড়িতে অবসর যাপন করছেন। খোশবুলের ডিগ্রি পাসের ইতিহাস প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘শুনে আশ্চর্য লাগে, খোশবুল প্রমাণ করেছে, “পড়ালেখার নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই, নিজের ইচ্ছাশক্তিই আসল”।’
No comments