সরকার ও রাজনীতি- জনপ্রশাসনের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ by ইনাম আহমদ চৌধুরী
গত ২৬ সেপ্টেম্বর। সকালবেলা একটি খবরের
কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ও খবর দেখে ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে চমকে উঠলাম।
ছবিটিতে রয়েছেন উত্তোলিত তর্জনী দিয়ে হুমকি প্রদানরত আওয়ামী লীগের
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং এর
নিচেই তাঁর বক্তব্য—
‘সরকারের কর্মকর্তারা নির্দেশ না
মানলে কপালে দুঃখ আছে। যাঁরা প্রশাসনে আছেন, তাঁরা সরকারের নির্দেশ
অনুযায়ী কাজ করবেন। সরকারের কথা অনুযায়ী তাঁদের চলতে হবে। যাঁরা নির্দেশ
মানবেন না, তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
প্রশাসনে এ ধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ বা সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের নির্লজ্জ
হুমকি প্রদানের নজির আমি আগে কখনো দেখিনি। ভাষা ব্যবহারেও এ কী দৈন্য, এ কী
মানসিকতা, এ কী বিচারবুদ্ধিহীনতা! সরকারি কর্মকর্তারা কি কারও বাসার চাকর?
হুকুম না মানলে ঘরে ফেরত? আর কার হুকুম? কিসের হুকুম?
গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর মুখ্য সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন হয়েছে—কোন অধিকারে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা সরকারি কর্মকর্তাদের এজাতীয় কথা বলেন? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সঙ্গে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা বিস্মৃত হয়ে তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তা থেকে জনমনে এই ধারণাই জন্মাবে যে তিনি দলীয় নির্দেশকেই সরকারি নির্দেশ বলে মনে করছেন। তাঁর তো কোনো সরকারি অবস্থানই নেই। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রশাসক সম্মেলনে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ের নীতিনির্ধারক যেসব কথা বলেছেন, তাতে পরস্ফুিট হয়েছে, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কী ধরনের কার্যক্রম এবং কী প্রকারের ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’ আশা করা হচ্ছে। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তেই প্রশ্ন উঠেছে—তাঁর (জনাব নাসিমের) এই বক্তব্য কি তাঁর এবং সম্ভবত তাঁর দলের অন্তর্নিহিত ভীতিসঞ্জাত, যে প্রয়োজনের সময়ে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের নির্দেশ অনুসারে চলবেন না? তিনি কি আরেকটি ‘জনতার মঞ্চের’ ভয়ে শঙ্কাকুল?
এই বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এবার সরকারি দলের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
বস্তুত, এটা আজ অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, অনুগ্রহ প্রদান, তোষণ-পোষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে যেনতেন প্রকারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করিয়ে দিতে চায়। এই বদমতলবে রেফারি হিসেবে জোগান দিতে রয়েছে একটি নির্বাচনী কমিশন, যার ওপর গণমানুষের আস্থা নেই—যাকে অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন ও আজ্ঞাবহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, সাধারণ নির্বাচনের মূল কাজ করবেন নির্বাহী কর্মকর্তারা, ডিসি বা এডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, আর প্রিসাইডিং-পোলিং কর্মকর্তা হবেন আনুগত্য-পরীক্ষিত সরকারি বা আধা সরকারি কর্মচারী, যাঁদের সরকারি দলের আদেশ অনুসারে কাজ না করলে ‘বাড়ি চলে যেতে হবে’—তাদের কপালে থাকবে দুঃখ। এই সংকটাকীর্ণ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা নিরপেক্ষ থাকবেন, এ আশা করা অসম্ভব। প্রশাসনে দলীয়করণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, ডিসিরা বর্তমান অবস্থায় (অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায়) রিটার্নিং কর্মকর্তা হলে নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না। কোনো অবস্থাতেই সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যতিরেকে কোনো সাধারণ নির্বাচন সম্ভব হবে না, কেননা আমাদের নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সে জন্যই এটাই সবচেয়ে জরুরি যে সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে, তাঁদের দিয়ে সরকারদলীয় নির্দেশ পালন করানো নয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যে নির্দেশ দিলেন, তা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এতে একজন নাগরিক হিসেবেই শুধু নয়, একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে আমি সংক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। অপমানিত বোধ করেছি। আমার বিশ্বাস, সাবেক ও বর্তমান সব সরকারি কর্মকর্তা এভাবেই বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সর্বজনাব অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী, প্রশাসন, জ্বালানি ও অর্থ উপদেষ্টাত্রয় এবং এবংবিধ অনেকেই এই আওতায়ই পড়ছেন। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, দেশের প্রশাসকদের অবজ্ঞা করে, নিষ্পেষিত করে, ভয় দেখিয়ে যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিজেদের মতলব আদায় করতে চায়, তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়, তাহলে তো সারা দেশকেই পঙ্গু এবং নিষ্কর্মা করে তোলা হবে। বহু বছর ধরে ‘গণতন্ত্রে’র নামে সরকারি প্রশাসনব্যবস্থার ওপর এ ধরনের আঘাত আসছে। তাই প্রশাসনব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত—তাদের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অথচ সার্থক গণতন্ত্রের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হচ্ছে আস্থাভাজন, নির্দলীয় ও কর্মক্ষম প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে আমি ‘প্রশাসনের প্রহসন, না প্রহসনের প্রশাসন’—এই শীর্ষ নামে প্রথম আলোতে ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমার একটি বক্তব্য ছিল—‘আইনের শাসনের কাঠামো কয়েকটি নীতিভিত্তিক স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। একে একে সব স্তম্ভ যেন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণের শেষ নেই।’ ক্রম-নিম্নগামী বিবর্তন বর্তমানে প্রশাসনকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তা পরম নিরাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক। সম্প্রতি একজন সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশপ্রধান (জনাব শাহজাহান) মন্তব্য করেছেন—‘দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই।’
উল্লিখিত প্রবন্ধে আমি উদাহরণসহ বিবৃত করেছিলাম, ব্রিটিশরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক দস্যুবৃত্তি এবং পরস্বাপহরণ করলেও তারা একটি সুন্দর প্রশাসনিক কাঠামো সাবেক কলোনিগুলোতে সৃষ্টি করে গিয়েছিল, যা ফলপ্রসূ কর্মদক্ষতায়, আইননির্ভর বস্তুনিষ্ঠতায় এবং নীতিনিষ্ঠ নিরপেক্ষতায় বিভূষিত। অধ্যাপক সিরিল স্মিথের মতে, এই প্রশাসনিক উৎকর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ‘ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট’—অর্থাৎ বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়া দুর্ভাগ্যবশত স্বার্থপ্রণোদিত পরিবর্তন সাধন এবং ফরমায়েশি কাটছাঁট করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং কিছুটা শ্রীলঙ্কায় প্রশাসনব্যবস্থা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে হয়েছে এর চরম দুরবস্থা। অথচ মোগল-প্রশাসনিক ব্যবস্থার রেশ ধরে স্থাপিত কাঠামোর সুবিন্যস্তকরণ ও উৎকর্ষ সাধন করে যে ব্যবস্থা ব্রিটিশরা চালু করে গিয়েছিল, গণতান্ত্রিক পরিবেশে তার বিকাশ সাধন করে প্রতিবেশী ভারত তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যথেষ্ট নির্দলীয়, মেধাভিত্তিক, আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মক্ষম করে তুলতে পেরেছে। আর আমরা বাংলাদেশে কী করেছি?
গণতন্ত্রায়ণের নামে আমরা প্রশাসনে নিয়ে এসেছি সম্পূর্ণ দলীয়করণ। ভেঙে দিয়েছি তার ঋজু ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মনোভাব ও ক্ষমতা। পদ-নিয়োগকে করেছি কোটাভিত্তিক, অনুগ্রহনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদোন্নতি ও পদায়ন হচ্ছে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত তুষ্টিসাধনের ক্ষমতা যাচাই করে। ইদানীং তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পূর্বঘোষণা দিয়েই করা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মেধার সম্মান-প্রদান ও স্বীকৃতি নেই। তুলনামূলকভাবে তাদের আর্থিক পরিতোষণ ও নিয়মানুগতভাবে অন্যবিধ স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানও অত্যন্ত সীমিত। সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মসম্মানবোধকেও বারবার করা হচ্ছে কশাঘাত। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যদি (যার মধ্যে নির্বাচন কমিশনও অন্তর্ভুক্ত) নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও কর্মক্ষম রাখা যেত, তাহলে বর্তমানে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা মোটেই হতো না। রাজনৈতিক সংকটাবস্থায় জনগণ প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে পারত।
প্রশাসনের ক্রমাবনতি, এর স্খলন ও বিচ্যুতির জন্য মুখ্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। ব্রিটিশ প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার বিধান ছিল। এমনকি ‘সরকারপক্ষের’ অনুকূলে অনৈতিক বা আইনকানুন রীতিবিহর্গিত কাজ করা ছিল অপরাধ। ভারতে এখনো এবং পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে এই ব্যবস্থাই চালু ছিল। ভাষা-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বা কারাবরণ কোনো বাঙালি চাকরিপ্রত্যাশীর নিয়োগপ্রাপ্তিতে অন্তরায় হয়নি। কিন্তু কোনো কর্মকর্তারই যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বা সংসর্গ অগ্রহণযোগ্য ছিল। ভারতে বা পাকিস্তানে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কোনো আইএনএ সদস্যকে সরকারি কাজে নিযুক্তি দান করা হয়নি (যদিও তাদের অন্যবিধ সম্মান-স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল) রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে। নিয়মকানুনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করার প্রবণতাকে দমন করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি সাম্প্রতিক বক্তব্যের একাংশের উদ্ধৃতি দিতে চাইছি। তিনি বলেছেন, ‘অপরাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে রাষ্ট্র ও দলকে আলাদা করতে হবে। দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কোন বাংলাদেশ উপহার দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে দলীয় অনুষ্ঠান হয়। তাহলে দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য থাকে কীভাবে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘লোভের সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। ফ্ল্যাট, পদ, ক্ষমতার লোভে শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার—সবাই আজ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
‘শুধু রাজনীতিই নয়, দলের লেজুড়বৃত্তি করছেন, কখনো বিবেক সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ক্যাডারের ভূমিকায়।...এখান থেকে বের হওয়ার পথ দরকার। না হলে সমাজ অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।’ অনুগ্রহ বিতরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে (একান্ত বৈঠকের জন্য) ১৪০ জন সফরসঙ্গী যদি নেওয়া হয়, তাহলে তো তা সম্ভব হবে না। সর্বক্ষেত্রে এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্যই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে তীক্ষ নজরদারি যে অত্যাবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি এই নিবন্ধের পরিসমাপ্তি টানছি (বিষয়টি অবশ্য আরও আলোচনার দাবি রাখে) প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে—‘সরকারি কর্মকর্তারা কোনো ব্যক্তিবিশেষ, কোনো পরিবার বা অন্য কারও আজ্ঞাবহ দাস নন। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন নিজ গুণে রিপাবলিকের সেবক হিসেবে। তাঁদের অপমান করার অধিকার কারও নেই।’
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর মুখ্য সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন হয়েছে—কোন অধিকারে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা সরকারি কর্মকর্তাদের এজাতীয় কথা বলেন? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সঙ্গে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা বিস্মৃত হয়ে তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তা থেকে জনমনে এই ধারণাই জন্মাবে যে তিনি দলীয় নির্দেশকেই সরকারি নির্দেশ বলে মনে করছেন। তাঁর তো কোনো সরকারি অবস্থানই নেই। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রশাসক সম্মেলনে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ের নীতিনির্ধারক যেসব কথা বলেছেন, তাতে পরস্ফুিট হয়েছে, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কী ধরনের কার্যক্রম এবং কী প্রকারের ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’ আশা করা হচ্ছে। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তেই প্রশ্ন উঠেছে—তাঁর (জনাব নাসিমের) এই বক্তব্য কি তাঁর এবং সম্ভবত তাঁর দলের অন্তর্নিহিত ভীতিসঞ্জাত, যে প্রয়োজনের সময়ে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের নির্দেশ অনুসারে চলবেন না? তিনি কি আরেকটি ‘জনতার মঞ্চের’ ভয়ে শঙ্কাকুল?
এই বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এবার সরকারি দলের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
বস্তুত, এটা আজ অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, অনুগ্রহ প্রদান, তোষণ-পোষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে যেনতেন প্রকারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করিয়ে দিতে চায়। এই বদমতলবে রেফারি হিসেবে জোগান দিতে রয়েছে একটি নির্বাচনী কমিশন, যার ওপর গণমানুষের আস্থা নেই—যাকে অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন ও আজ্ঞাবহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, সাধারণ নির্বাচনের মূল কাজ করবেন নির্বাহী কর্মকর্তারা, ডিসি বা এডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, আর প্রিসাইডিং-পোলিং কর্মকর্তা হবেন আনুগত্য-পরীক্ষিত সরকারি বা আধা সরকারি কর্মচারী, যাঁদের সরকারি দলের আদেশ অনুসারে কাজ না করলে ‘বাড়ি চলে যেতে হবে’—তাদের কপালে থাকবে দুঃখ। এই সংকটাকীর্ণ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা নিরপেক্ষ থাকবেন, এ আশা করা অসম্ভব। প্রশাসনে দলীয়করণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, ডিসিরা বর্তমান অবস্থায় (অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায়) রিটার্নিং কর্মকর্তা হলে নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না। কোনো অবস্থাতেই সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যতিরেকে কোনো সাধারণ নির্বাচন সম্ভব হবে না, কেননা আমাদের নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সে জন্যই এটাই সবচেয়ে জরুরি যে সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে, তাঁদের দিয়ে সরকারদলীয় নির্দেশ পালন করানো নয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যে নির্দেশ দিলেন, তা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এতে একজন নাগরিক হিসেবেই শুধু নয়, একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে আমি সংক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। অপমানিত বোধ করেছি। আমার বিশ্বাস, সাবেক ও বর্তমান সব সরকারি কর্মকর্তা এভাবেই বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সর্বজনাব অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী, প্রশাসন, জ্বালানি ও অর্থ উপদেষ্টাত্রয় এবং এবংবিধ অনেকেই এই আওতায়ই পড়ছেন। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, দেশের প্রশাসকদের অবজ্ঞা করে, নিষ্পেষিত করে, ভয় দেখিয়ে যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিজেদের মতলব আদায় করতে চায়, তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়, তাহলে তো সারা দেশকেই পঙ্গু এবং নিষ্কর্মা করে তোলা হবে। বহু বছর ধরে ‘গণতন্ত্রে’র নামে সরকারি প্রশাসনব্যবস্থার ওপর এ ধরনের আঘাত আসছে। তাই প্রশাসনব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত—তাদের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অথচ সার্থক গণতন্ত্রের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হচ্ছে আস্থাভাজন, নির্দলীয় ও কর্মক্ষম প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে আমি ‘প্রশাসনের প্রহসন, না প্রহসনের প্রশাসন’—এই শীর্ষ নামে প্রথম আলোতে ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমার একটি বক্তব্য ছিল—‘আইনের শাসনের কাঠামো কয়েকটি নীতিভিত্তিক স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। একে একে সব স্তম্ভ যেন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণের শেষ নেই।’ ক্রম-নিম্নগামী বিবর্তন বর্তমানে প্রশাসনকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তা পরম নিরাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক। সম্প্রতি একজন সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশপ্রধান (জনাব শাহজাহান) মন্তব্য করেছেন—‘দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই।’
উল্লিখিত প্রবন্ধে আমি উদাহরণসহ বিবৃত করেছিলাম, ব্রিটিশরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক দস্যুবৃত্তি এবং পরস্বাপহরণ করলেও তারা একটি সুন্দর প্রশাসনিক কাঠামো সাবেক কলোনিগুলোতে সৃষ্টি করে গিয়েছিল, যা ফলপ্রসূ কর্মদক্ষতায়, আইননির্ভর বস্তুনিষ্ঠতায় এবং নীতিনিষ্ঠ নিরপেক্ষতায় বিভূষিত। অধ্যাপক সিরিল স্মিথের মতে, এই প্রশাসনিক উৎকর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ‘ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট’—অর্থাৎ বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়া দুর্ভাগ্যবশত স্বার্থপ্রণোদিত পরিবর্তন সাধন এবং ফরমায়েশি কাটছাঁট করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং কিছুটা শ্রীলঙ্কায় প্রশাসনব্যবস্থা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে হয়েছে এর চরম দুরবস্থা। অথচ মোগল-প্রশাসনিক ব্যবস্থার রেশ ধরে স্থাপিত কাঠামোর সুবিন্যস্তকরণ ও উৎকর্ষ সাধন করে যে ব্যবস্থা ব্রিটিশরা চালু করে গিয়েছিল, গণতান্ত্রিক পরিবেশে তার বিকাশ সাধন করে প্রতিবেশী ভারত তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যথেষ্ট নির্দলীয়, মেধাভিত্তিক, আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মক্ষম করে তুলতে পেরেছে। আর আমরা বাংলাদেশে কী করেছি?
গণতন্ত্রায়ণের নামে আমরা প্রশাসনে নিয়ে এসেছি সম্পূর্ণ দলীয়করণ। ভেঙে দিয়েছি তার ঋজু ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মনোভাব ও ক্ষমতা। পদ-নিয়োগকে করেছি কোটাভিত্তিক, অনুগ্রহনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদোন্নতি ও পদায়ন হচ্ছে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত তুষ্টিসাধনের ক্ষমতা যাচাই করে। ইদানীং তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পূর্বঘোষণা দিয়েই করা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মেধার সম্মান-প্রদান ও স্বীকৃতি নেই। তুলনামূলকভাবে তাদের আর্থিক পরিতোষণ ও নিয়মানুগতভাবে অন্যবিধ স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানও অত্যন্ত সীমিত। সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মসম্মানবোধকেও বারবার করা হচ্ছে কশাঘাত। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যদি (যার মধ্যে নির্বাচন কমিশনও অন্তর্ভুক্ত) নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও কর্মক্ষম রাখা যেত, তাহলে বর্তমানে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা মোটেই হতো না। রাজনৈতিক সংকটাবস্থায় জনগণ প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে পারত।
প্রশাসনের ক্রমাবনতি, এর স্খলন ও বিচ্যুতির জন্য মুখ্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। ব্রিটিশ প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার বিধান ছিল। এমনকি ‘সরকারপক্ষের’ অনুকূলে অনৈতিক বা আইনকানুন রীতিবিহর্গিত কাজ করা ছিল অপরাধ। ভারতে এখনো এবং পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে এই ব্যবস্থাই চালু ছিল। ভাষা-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বা কারাবরণ কোনো বাঙালি চাকরিপ্রত্যাশীর নিয়োগপ্রাপ্তিতে অন্তরায় হয়নি। কিন্তু কোনো কর্মকর্তারই যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বা সংসর্গ অগ্রহণযোগ্য ছিল। ভারতে বা পাকিস্তানে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কোনো আইএনএ সদস্যকে সরকারি কাজে নিযুক্তি দান করা হয়নি (যদিও তাদের অন্যবিধ সম্মান-স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল) রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে। নিয়মকানুনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করার প্রবণতাকে দমন করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি সাম্প্রতিক বক্তব্যের একাংশের উদ্ধৃতি দিতে চাইছি। তিনি বলেছেন, ‘অপরাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে রাষ্ট্র ও দলকে আলাদা করতে হবে। দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কোন বাংলাদেশ উপহার দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে দলীয় অনুষ্ঠান হয়। তাহলে দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য থাকে কীভাবে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘লোভের সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। ফ্ল্যাট, পদ, ক্ষমতার লোভে শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার—সবাই আজ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
‘শুধু রাজনীতিই নয়, দলের লেজুড়বৃত্তি করছেন, কখনো বিবেক সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ক্যাডারের ভূমিকায়।...এখান থেকে বের হওয়ার পথ দরকার। না হলে সমাজ অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।’ অনুগ্রহ বিতরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে (একান্ত বৈঠকের জন্য) ১৪০ জন সফরসঙ্গী যদি নেওয়া হয়, তাহলে তো তা সম্ভব হবে না। সর্বক্ষেত্রে এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্যই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে তীক্ষ নজরদারি যে অত্যাবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি এই নিবন্ধের পরিসমাপ্তি টানছি (বিষয়টি অবশ্য আরও আলোচনার দাবি রাখে) প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে—‘সরকারি কর্মকর্তারা কোনো ব্যক্তিবিশেষ, কোনো পরিবার বা অন্য কারও আজ্ঞাবহ দাস নন। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন নিজ গুণে রিপাবলিকের সেবক হিসেবে। তাঁদের অপমান করার অধিকার কারও নেই।’
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।
No comments