ভারতকে বলার আছে অনেক কিছুই by মেজর সুধীর সাহা(অব.)
বাংলাদেশের
তিন দিকে ভারত এবং একদিকে বঙ্গোপসাগর। অর্থাৎ স্থলপথের বর্ডারের প্রায়
সবটুকুজুড়ে আছে ভারত। বর্ডারের সমস্যা বাংলাদেশ এবং ভারতকে অনেক সময়ই
মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দুই দেশ থেকেই অবৈধভাবে
প্রবেশ করার ক্ষেত্রে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের গুলিতে মানুষ মরার
খবরগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষভাবে বিগত বছরগুলোতে ভারতের বিএসএফের
গুলিতে বাংলাদেশের নাগরিকের মৃত্যু সব সময়ই বাংলাদেশে ক্ষোভের বিষয় ছিল।
কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থার মতে, গত দশ বছরে ভারতের বিএসএফের হাতে শত শত
বাংলাদেশী প্রাণ দিয়েছে। বর্ডারে এমন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে দু’দেশের শীর্ষ
পর্যায়ে অনেক সময়ই আলোচনা হয়েছে এবং ভারতের পক্ষ থেকে অনেক সময়ই ‘আর গুলি
নয়’ এমন ধরনের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সময়ে
বর্ডারে মৃত্যুর হার কিছুটা হ্রাস পেলেও বিএসএফের গুলি করে হত্যা করা
একবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এমন একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছিল ফেলানী হত্যাকাণ্ড।
গত ৭ জানুয়ারি ২০১১-তে ১৫ বছরের ফেলানী ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে
সীমান্ত পার হচ্ছিল। কাঁটাতারের ওপর দিয়ে যখন ফেলানী সীমান্ত পার হচ্ছিল,
তখন ভারতের বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে ফেলানীর মৃত্যু ঘটে। ফেলানী
হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক
আলোচনা-সমালোচনার মুখে ভারতের বিএসএফ তার নিজস্ব আদালতে গত ১৩ আগস্ট-২০১৩
অমিয় ঘোষের বিচার শুরু করে। পাঁচ সদস্যের বিএসএফের বিশেষ আদালত আসামি অমিয়
ঘোষকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে রায় কার্যকর করার জন্য বিএসএফের ডিজির
অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করেন।
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তটি অনেকটাই কানাডা-আমেরিকার সীমান্তের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কানাডার বিশাল এলাকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত। দু’দেশের ভিসা পদ্ধতি আছে, আবার অবৈধ পথে মানুষ ও দ্রব্য চোরাচালানের ব্যবস্থাও বিদ্যমান আছে। এক দেশের সীমান্তে অন্য দেশের পতাকাও উড়তে দেখা যায় এই দুটি দেশে। প্রখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দু’পাশেই পৎপৎ করে উড়ে চলছে দু’দেশের জাতীয় পতাকা। গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে একজন মানুষেরও মৃত্যু ঘটেছে এমন সংবাদ কোনো গণমাধ্যমে কেউ পড়তে সক্ষম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তটি চোরাচালানিদের জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য সীমান্ত হলেও সেখানে কখনও কোনো সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে মানুষের মৃত্যু হলে তা হয়ে ওঠে দু’দেশেরই মিডিয়ার হেডলাইন সংবাদ। সেই সঙ্গে তুলনা করলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আমাদের। কী ঘটছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে? চোরাচালানি হচ্ছে, অবৈধভাবে ভিসাবিহীন যাতায়াত হচ্ছে, জঙ্গিরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে থাকছে এ সবই সত্য। এমনটা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বর্ডারেও হচ্ছে। কিন্তু যেটা মিলছে না তা হল, ভারতের বিএসএফের গুলিতে মানুষের মৃত্যু। হইচই হওয়া ফেলানী হত্যার বিচার করতে গিয়ে ভারতের বিএসএফ প্রহসনের বিচার করছে। হত্যাকারী শনাক্ত হওয়ার পরও সসম্মানে মুক্তি পাচ্ছে। এমন একটি স্পর্শকাতর বিচার কেন বিএসএফের নিজস্ব আদালতে হচ্ছে? কেন সে দেশের সাধারণ আদালতে এ বিচার হচ্ছে না? কেন হত্যাকারী অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে হত্যার অভিযোগটি আনয়ন করা হয়নি? এসব প্রশ্নের জবাব ভারত সরকারকে দিতে হবে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের জনগণ এবং ভারতের জনগণের কাছে? কেননা ফেলানী বাংলাদেশের মেয়ে এবং ফেলানী একজন মানুষ।
ভারতের বর্তমান কংগ্রেস সরকার সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করার বিলটি তাদের সংসদে উত্থাপনই করতে পারেনি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের প্রথম প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় অসম গণপরিষদের বাধার কারণে। এর পরের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেল বিজেপির বাধার কারণে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিজেপির সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলির সঙ্গে দেন-দরবার করলেন, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহমেদ করিম বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানি, নরেন্দ্র মোদির মন ভেজাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না। বিলটি পেশ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার পথে নতুন করে বাদ সাধলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জি। বিলটি পাস করা দূরে থাক, সংসদে পেশ করার কাজটিও করতে পারল না সরকার। এ সেই মমতা ব্যানার্জি যার আর এক ধাক্কায় তিস্তা চুক্তিটিও বাস্তবায়িত করতে পারেনি ভারত সরকার। ভারত সরকার খাদ্য সুরক্ষা, জমি অধিগ্রহণ বিলের মতো অসম্ভব কাজকে সংসদে পাস করিয়ে নিতে পারলেও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমস্যা জাগিয়ে রেখেছে যে তিস্তা চুক্তি ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিল, সে ব্যাপারে কার্যত কিছুই করতে পারেনি। এ দুটি অমীমাংসিত বিষয়ের দিকে তাকালেই বাংলাদেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বাস্তব অবস্থা বোঝা যায়।
বাংলাদেশের পুরো বর্ডারটি ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে দিয়েছে। এটা করতে গিয়ে তাদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বিপুল অংকের খরচকে মেনে নিতে হয়েছে। এর পরও ভারতের বিএসএফ প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো নিরীহ-নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করছে। তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া, ছিটমহল জটিলতা জিইয়ে রাখা, টিপাইমুখ বাঁধ করার প্রস্তুতি নেয়া, সীমান্তে গুলি করে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা করা এসব কিছু মোটেও একজন ভালো প্রতিবেশীর স্বাক্ষর রাখে না। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড় একটি দেশ। অর্থে, জনবলে, ভূমিতে সব দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড় দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। তার তুলনায় বাংলাদেশ অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ। বড় প্রতিবেশীর দায়িত্ব একটু বেশিই থাকে। দেওয়া-নেওয়ার হিসাব আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিদ্যমান থাকলেও সবসময় বড় প্রতিবেশীকেই ছাড় দিতে হয় অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিবেশীকে। যেমনটা আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে দেখি, যেমনটা আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে দেখি। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে বড় প্রতিবেশী হিসেবে এবং প্রকৃত বন্ধু হিসেবেই দেখতে চায় সবসময়। ভারতকেও তেমনভাবেই ভাবতে হবে। মমতা ব্যানার্জির দোহাই দিয়ে তিস্তা বাস্তবায়ন না করে, সীমান্ত বিল পাস না করে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এবং সীমান্তে ফেলানীর মতো নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা করে আর যা-ই দেখানো সম্ভব হোক না কেন, বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো, বড় ভাইয়ের ইমেজ দেখানো সম্ভব নয়। আর্থিকভাবে, ব্যবসা সম্প্রসারণে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের যেমন ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ যতই ছোট হোক, যেহেতু সে ভারতের প্রতিবেশী তাই তার বন্ধুত্বও ভারতের সমানভাবেই প্রয়োজন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের যে সমস্যা ভারতকে গ্রহণ করতে হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে তো ভারতের সেই সমস্যা গ্রহণ করতে হচ্ছে না! বাংলাদেশ-ভারত বিশাল সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্বের একটি স্থায়ী সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজনীয়তা ভারতের আছে। ফেলানী হত্যার বিচার প্রহসন এবং তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়গুলো ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে- এই সহজ বিষয়টি ভারত সরকার এবং জনগণকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
কংগ্রেস সরকার যা পারছে না, বিজেপি সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী আর তা আশা করতে পারে? সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান কংগ্রেস সরকারকে আরও মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি আর কৃষ্টিতে যথেষ্ট মিল রয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের মধ্যে। সীমান্ত এলাকায় সুসম্পর্কের এক ধরনের সুবাতাস বইছে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে। এমন দুটি দেশের কর্তৃপক্ষের সতর্ক অবস্থায় বিবেচনা করা প্রয়োজন দু’দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো। আর বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে বড় প্রতিবেশীকেই অধিক ছাড় দেয়ার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলামিস্ট
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তটি অনেকটাই কানাডা-আমেরিকার সীমান্তের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কানাডার বিশাল এলাকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত। দু’দেশের ভিসা পদ্ধতি আছে, আবার অবৈধ পথে মানুষ ও দ্রব্য চোরাচালানের ব্যবস্থাও বিদ্যমান আছে। এক দেশের সীমান্তে অন্য দেশের পতাকাও উড়তে দেখা যায় এই দুটি দেশে। প্রখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দু’পাশেই পৎপৎ করে উড়ে চলছে দু’দেশের জাতীয় পতাকা। গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে একজন মানুষেরও মৃত্যু ঘটেছে এমন সংবাদ কোনো গণমাধ্যমে কেউ পড়তে সক্ষম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তটি চোরাচালানিদের জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য সীমান্ত হলেও সেখানে কখনও কোনো সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে মানুষের মৃত্যু হলে তা হয়ে ওঠে দু’দেশেরই মিডিয়ার হেডলাইন সংবাদ। সেই সঙ্গে তুলনা করলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আমাদের। কী ঘটছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে? চোরাচালানি হচ্ছে, অবৈধভাবে ভিসাবিহীন যাতায়াত হচ্ছে, জঙ্গিরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে থাকছে এ সবই সত্য। এমনটা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বর্ডারেও হচ্ছে। কিন্তু যেটা মিলছে না তা হল, ভারতের বিএসএফের গুলিতে মানুষের মৃত্যু। হইচই হওয়া ফেলানী হত্যার বিচার করতে গিয়ে ভারতের বিএসএফ প্রহসনের বিচার করছে। হত্যাকারী শনাক্ত হওয়ার পরও সসম্মানে মুক্তি পাচ্ছে। এমন একটি স্পর্শকাতর বিচার কেন বিএসএফের নিজস্ব আদালতে হচ্ছে? কেন সে দেশের সাধারণ আদালতে এ বিচার হচ্ছে না? কেন হত্যাকারী অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে হত্যার অভিযোগটি আনয়ন করা হয়নি? এসব প্রশ্নের জবাব ভারত সরকারকে দিতে হবে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের জনগণ এবং ভারতের জনগণের কাছে? কেননা ফেলানী বাংলাদেশের মেয়ে এবং ফেলানী একজন মানুষ।
ভারতের বর্তমান কংগ্রেস সরকার সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করার বিলটি তাদের সংসদে উত্থাপনই করতে পারেনি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের প্রথম প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় অসম গণপরিষদের বাধার কারণে। এর পরের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেল বিজেপির বাধার কারণে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিজেপির সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলির সঙ্গে দেন-দরবার করলেন, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহমেদ করিম বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানি, নরেন্দ্র মোদির মন ভেজাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না। বিলটি পেশ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার পথে নতুন করে বাদ সাধলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জি। বিলটি পাস করা দূরে থাক, সংসদে পেশ করার কাজটিও করতে পারল না সরকার। এ সেই মমতা ব্যানার্জি যার আর এক ধাক্কায় তিস্তা চুক্তিটিও বাস্তবায়িত করতে পারেনি ভারত সরকার। ভারত সরকার খাদ্য সুরক্ষা, জমি অধিগ্রহণ বিলের মতো অসম্ভব কাজকে সংসদে পাস করিয়ে নিতে পারলেও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমস্যা জাগিয়ে রেখেছে যে তিস্তা চুক্তি ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিল, সে ব্যাপারে কার্যত কিছুই করতে পারেনি। এ দুটি অমীমাংসিত বিষয়ের দিকে তাকালেই বাংলাদেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বাস্তব অবস্থা বোঝা যায়।
বাংলাদেশের পুরো বর্ডারটি ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে দিয়েছে। এটা করতে গিয়ে তাদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বিপুল অংকের খরচকে মেনে নিতে হয়েছে। এর পরও ভারতের বিএসএফ প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো নিরীহ-নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করছে। তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া, ছিটমহল জটিলতা জিইয়ে রাখা, টিপাইমুখ বাঁধ করার প্রস্তুতি নেয়া, সীমান্তে গুলি করে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা করা এসব কিছু মোটেও একজন ভালো প্রতিবেশীর স্বাক্ষর রাখে না। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড় একটি দেশ। অর্থে, জনবলে, ভূমিতে সব দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড় দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। তার তুলনায় বাংলাদেশ অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ। বড় প্রতিবেশীর দায়িত্ব একটু বেশিই থাকে। দেওয়া-নেওয়ার হিসাব আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিদ্যমান থাকলেও সবসময় বড় প্রতিবেশীকেই ছাড় দিতে হয় অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিবেশীকে। যেমনটা আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে দেখি, যেমনটা আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে দেখি। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে বড় প্রতিবেশী হিসেবে এবং প্রকৃত বন্ধু হিসেবেই দেখতে চায় সবসময়। ভারতকেও তেমনভাবেই ভাবতে হবে। মমতা ব্যানার্জির দোহাই দিয়ে তিস্তা বাস্তবায়ন না করে, সীমান্ত বিল পাস না করে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এবং সীমান্তে ফেলানীর মতো নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা করে আর যা-ই দেখানো সম্ভব হোক না কেন, বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো, বড় ভাইয়ের ইমেজ দেখানো সম্ভব নয়। আর্থিকভাবে, ব্যবসা সম্প্রসারণে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের যেমন ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ যতই ছোট হোক, যেহেতু সে ভারতের প্রতিবেশী তাই তার বন্ধুত্বও ভারতের সমানভাবেই প্রয়োজন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের যে সমস্যা ভারতকে গ্রহণ করতে হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে তো ভারতের সেই সমস্যা গ্রহণ করতে হচ্ছে না! বাংলাদেশ-ভারত বিশাল সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্বের একটি স্থায়ী সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজনীয়তা ভারতের আছে। ফেলানী হত্যার বিচার প্রহসন এবং তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়গুলো ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে- এই সহজ বিষয়টি ভারত সরকার এবং জনগণকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
কংগ্রেস সরকার যা পারছে না, বিজেপি সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী আর তা আশা করতে পারে? সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান কংগ্রেস সরকারকে আরও মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি আর কৃষ্টিতে যথেষ্ট মিল রয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের মধ্যে। সীমান্ত এলাকায় সুসম্পর্কের এক ধরনের সুবাতাস বইছে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে। এমন দুটি দেশের কর্তৃপক্ষের সতর্ক অবস্থায় বিবেচনা করা প্রয়োজন দু’দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো। আর বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে বড় প্রতিবেশীকেই অধিক ছাড় দেয়ার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলামিস্ট
No comments