অন্ধকার ছেড়ে আলোয় আসুন by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
গত
১৫ সেপ্টেম্বর বিকালে রংপুর জিলা স্কুল মাঠে এবং ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে
রাজশাহী শহরে মাদ্রাসা মাঠে ১৮ দলীয় জোট আয়োজিত স্মরণকালের বিশাল দুটি
জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। গত দেড়-দু’বছরে তিনি বিভিন্ন জেলায় অনেক জনসভায়
অংশগ্রহণ করেন। রংপুর ও রাজশাহীর জনসভার আলোকে আজকের কলামে দু’-চারটি কথা
পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করছি। জনসভায় সব বক্তার পক্ষ থেকে প্রধান আলোচ্য বিষয়
হিসেবে প্রাধান্য পায়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে
নির্বাচন অনুষ্ঠান। বক্তাদের মধ্যে অনেকেই বলেন, দেশে যদি তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের অধীনে নির্বাচন না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল
তাতে অংশগ্রহণ করবে না এবং সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একদলীয় নির্বাচন দেশ ও
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে দেশে অরাজক
পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হবে। সেটি কোনোভাবেই
কাম্য হতে পারে না। ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির নেতাকর্মীরা এবং
জোটের অন্যতম শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে
নিরলসভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন ও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের
মধ্যে কিছুসংখ্যক নেতা বিভিন্ন টকশোতে যান এবং জোটের অনুকূলে বিভিন্ন
বক্তব্য রাখেন। কিছু নেতা পত্রিকায় কলাম লেখেন। ঘটনাক্রমে আমি টকশোতেও যাই
এবং কলামও লিখি। প্রচুর সংখ্যক ১৮ দলীয় নেতা বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা
দেন এবং আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন।
এত চেষ্টার পরও সরকারের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল। ফলে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগও দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। এসব সভা-সমাবেশে বিরোধী দলের প্রতি কটূক্তি, কুৎসা রটনা ও হেয়প্রতিপন্নমূলক বক্তৃতাই প্রাধান্য পায়। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে সেসব জনসভায় আলোচনা হয় না বললেই চলে। ফলে জনগণ বিশাল এক উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। জানি না এর অবসান কবে হবে। বা আদৌ হবে কি-না। সবাই একটি কথা বারবার বলছেন, সেটি হচ্ছে- সরকারের সুমতির উদয় হওয়া প্রয়োজন। দেশের মানুষের প্রতি সরকারের মমত্ববোধ জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। কারণ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যে রকম একগুঁয়েমির পরিচয় দিচ্ছে এবং নেতিবাচক স্থির সিদ্ধান্তের প্রতি অটুট রয়েছে, এতে দেশের অমঙ্গল ছাড়া মঙ্গলের কোনো লক্ষণ নেই। ২১ আগস্ট থেকে শুরু করে যতগুলো টকশোতে আমি অংশগ্রহণ করেছি এবং যতগুলো কলাম লিখেছি, এর বেশিরভাগেই একটি যুক্তি উপস্থাপন করেছি। রংপুর ও রাজশাহীর ময়দানে জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় তিনিও ওই যুক্তিটি আরও দৃঢ়ভাবে, আরও সুন্দরভাবে নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। এই যুক্তিটি তিনি ৮ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর মাঠে উপস্থাপন করেননি। ব্যাখ্যাটি নিুরূপ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিদায়ের কিছুদিন আগে আলোচনায় চলে এসেছিল বিদায়-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের বিষয়টি। তৎকালীন বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার কথা ছিল সে সময়কার সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের। কিন্তু সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এতে বিরোধিতা করে। ওই বিরোধিতার কারণ ছিল, আওয়ামী লীগের মতে, ২০০৬ সাল থেকে পেছনের দিকে ২৫-৩০ বছর আগে বিচারপতি কেএম হাসান বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অর্থাৎ ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানের গায়ে আওয়ামী লীগের মতে বিএনপির গন্ধ ছিল। যদিও এই ২৫-৩০ বছরের মাঝখানে তিনি অ্যাডভোকেট হিসেবে প্র্যাকটিস করেছেন, হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন। এত কিছুর পরও আওয়ামী লীগের মতে, বিচারপতি কেএম হাসানের গায়ে বিএনপির গন্ধ থেকে গেছে। অতএব কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগ। একজন ব্যক্তির গায়ে যদি মিথ্যাভাবে ২৫ বছর আগের গন্ধ আরোপ করা যায় এবং সে কারণে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মানা না যায়, তাহলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করছেন, যিনি আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং নির্বাচনকালীনও দেশ শাসন করবেন বলে সদম্ভে ঘোষণা করছেন, যার গায়ে আপাদমস্তকই আওয়ামী লীগের গন্ধ রয়েছে- বিএনপি কেন তার অধীনে নির্বাচনে যাবে? এ প্রশ্নটি বেগম খালেদা জিয়া দেশবাসীর এবং বিশ্বের মানুষের বিবেকের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। এর উত্তর কী আসতে পারে, সেটি সহজেই অনুমেয়।
বিভিন্ন আলোচনা থেকে আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে যে, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি, অপশাসনে দেশ ছেয়ে গেছে। মানুষ সরকারের অপশাসনে এতটাই বিরক্ত যে, যদি এ মুহূর্তে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে নির্বাচন দেয়া হয়, তাহলে নৌকার পালে হাওয়া লাগার পরিবর্তে ভরাডুবির আশংকাই বেশি। এ বিষয়টি বর্তমান সরকারও ইতিমধ্যেই টের পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা যদি পরাজিত হয়, তাহলে তাদের দুর্নীতি, অপশাসন ও কুকর্মের জন্য দেশ তাদের ক্ষমা করবে না। বিচারের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতেই হবে। যে কারণে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের এ অন্তহীন অপচেষ্টা। তাদের মনে যদি সামান্যতম সৎ সাহস থাকত, তাহলে তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনকে ছেড়ে দিত। সেই সৎ সাহস তারা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। ১৯৭৪-৭৫ সালে তারা একবার চেষ্টা করেছিল একদলীয় শাসন কায়েম করতে; কিন্তু তারা সফল হয়নি। তারা টিকতে পারেনি। তারা এখন আবার চেষ্টা করছে, এদেশের সংগ্রামী জনগণই তাদের আবার ব্যর্থ করবে।
যাই হোক, জনসভাগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে জনমত সৃষ্টি। বিভিন্ন বক্তা তাদের বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণের মতামত গ্রহণের চেষ্টা করেন এবং জনগণকেও নিজেদের মতামত জানান। জনসভার বিভিন্ন পর্যায়ে বক্তারা জনগণের কাছ থেকে জানতে চান, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন, নাকি তা প্রতিহত করবেন? লাখ লাখ মানুষ সমস্বরে হাত উঁচিয়ে উচ্চকণ্ঠে জবাব দেন- না, আমরা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাব না। প্রয়োজন হলে আমরা রাজপথে আন্দোলনে নামব। তবুও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে দেব না। সরকারের যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। সেই সঙ্গে জনগণ ১৮ দলীয় জোটের প্রতি দৃঢ়ভাবে একাত্মতা পোষণ করেন। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত ১৮ দলীয় জোটের বিভিন্ন মহাসমাবেশে এ চিত্রই আমি দেখেছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনোভাবেই আপস না করে, তাহলে জনগণ সেটা মেনে নেবে না। সুতরাং দেশ এক কঠিন অরাজকতার মধ্যে পতিত হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে জনগণের সামনে একটাই প্রশ্ন- সেটি হচ্ছে আগামী ৪-৫ সপ্তাহের সময়টি কীভাবে অতিবাহিত হবে? কারণ সরকার বলেছে, ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে তারা যে কোনোভাবে তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেই। এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা মিডিয়াতে বিভিন্ন প্রকারে বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। তবে সব ধরনের বক্তব্যের মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়- সেটি হচ্ছে তারা নির্বাচন করবেন। অর্থাৎ সরকার তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগ্রহী। সরকার বলতে শুধু আওয়ামী লীগকেই বোঝানো হচ্ছে। কেননা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের যে মহাজোট, সেই মহাজোটে অনৈক্যের সুর বেজে উঠেছে। জোটের অনেক শরিক দলই বলছে, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে তারা সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও স্পষ্ট নয়। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি এক থেকে দেড় বছর ধরে বলে আসছে, তারা এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সাম্প্রতিককালে তাদের অবস্থান খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং এমন ধারণাও করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ একাই নির্বাচন অনুষ্ঠান করল এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অবস্থান নিল। এ ধারণাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ ১৯৮৬ সালে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তার পুনরাবৃত্তি হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। হুবহু পুনরাবৃত্তি না হলেও কাছাকাছি একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সাবধান করে দেন। আলোচনা বা বক্তৃতায় প্রকাশ পায় যে, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফোরাম বা বিএনএফ নামক একটি দল বা গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। জানা যায়, তারা নাকি তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে গমের শীষ চেয়েছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ। ধানের শীষ ও গমের শীষ যখন কাগজে ছাপা হয়, তখন দেখতে অনেকটা একরকম লাগে। ব্যালট পেপারে যখন ছাপানো হবে, তখন দেখতে একইরকম লাগবে। ভোটাররা বিভ্রান্ত হয়ে ধানের শীষ মনে করে গমের শীষে সিল মারবে। এরূপ একটি অর্বাচীন কল্পনা থেকেই বিএনএফ নামক দলকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। এ দলকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছুসংখ্যক আওয়ামী লীগপন্থী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং দলছুট রাজনীতিক পরিশ্রম করছেন বেশ কিছুদিন ধরে। তাদের সব ধরনের খরচ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী জোগান দিচ্ছে বলে বাজারে রটনা আছে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন দেয়ার জন্য দুই কদম আগায় তো এক কদম পেছায়- এরকম একটি অবস্থানে আছে বলে পত্রিকার রিপোর্ট মারফত জানা যায়। খালেদা জিয়া এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সাবধান করে বলেন, এটা কোনো মামাবাড়ির আবদার না!
বাংলাদেশের বয়স এখন ৪২-৪৩ বছর। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে পরিচিত নাম। এদেশে যেন শান্তি বজায় থাকে সে ব্যাপারে পৃথিবীর দেশগুলো এবং জাতিসংঘ দারুণভাবে আগ্রহী। খালেদা জিয়া বলেছেন, ১৮ দলীয় জোট প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না, প্রতিশোধের রাজনীতি করবে না, মারামারি-হানাহানির রাজনীতি করবে না। তিনি বলেছেন, মেধাবীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবেন, অনগ্রসর অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দেবেন, তথ্যপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেবেন। ধর্মীয় শিক্ষার ওপরে আক্রমণকে প্রতিহত করবেন। নারীর জন্য অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। এসব করতে হলে শান্তি প্রয়োজন। শান্তি আনতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন। তার জন্য সুষ্ঠু আইনের কাঠামো প্রয়োজন। তার জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। তার জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
লেখাটা দীর্ঘতর না করে একটি প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে শেষ করতে চাই। আওয়ামী লীগের জন্যই এ প্রস্তাব। দেশের জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান- এ কথাটি যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন, তাহলে একটি গণভোট দিন। আর যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে এই সংসদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সংবিধান সংশোধন করুন। আর যদি না করেন, তাহলে দেশে যে কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতির জন্য দায়িত্ব নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক : কলাম লেখক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
এত চেষ্টার পরও সরকারের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল। ফলে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগও দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। এসব সভা-সমাবেশে বিরোধী দলের প্রতি কটূক্তি, কুৎসা রটনা ও হেয়প্রতিপন্নমূলক বক্তৃতাই প্রাধান্য পায়। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে সেসব জনসভায় আলোচনা হয় না বললেই চলে। ফলে জনগণ বিশাল এক উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। জানি না এর অবসান কবে হবে। বা আদৌ হবে কি-না। সবাই একটি কথা বারবার বলছেন, সেটি হচ্ছে- সরকারের সুমতির উদয় হওয়া প্রয়োজন। দেশের মানুষের প্রতি সরকারের মমত্ববোধ জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। কারণ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যে রকম একগুঁয়েমির পরিচয় দিচ্ছে এবং নেতিবাচক স্থির সিদ্ধান্তের প্রতি অটুট রয়েছে, এতে দেশের অমঙ্গল ছাড়া মঙ্গলের কোনো লক্ষণ নেই। ২১ আগস্ট থেকে শুরু করে যতগুলো টকশোতে আমি অংশগ্রহণ করেছি এবং যতগুলো কলাম লিখেছি, এর বেশিরভাগেই একটি যুক্তি উপস্থাপন করেছি। রংপুর ও রাজশাহীর ময়দানে জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় তিনিও ওই যুক্তিটি আরও দৃঢ়ভাবে, আরও সুন্দরভাবে নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। এই যুক্তিটি তিনি ৮ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর মাঠে উপস্থাপন করেননি। ব্যাখ্যাটি নিুরূপ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিদায়ের কিছুদিন আগে আলোচনায় চলে এসেছিল বিদায়-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের বিষয়টি। তৎকালীন বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার কথা ছিল সে সময়কার সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের। কিন্তু সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এতে বিরোধিতা করে। ওই বিরোধিতার কারণ ছিল, আওয়ামী লীগের মতে, ২০০৬ সাল থেকে পেছনের দিকে ২৫-৩০ বছর আগে বিচারপতি কেএম হাসান বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অর্থাৎ ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানের গায়ে আওয়ামী লীগের মতে বিএনপির গন্ধ ছিল। যদিও এই ২৫-৩০ বছরের মাঝখানে তিনি অ্যাডভোকেট হিসেবে প্র্যাকটিস করেছেন, হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন। এত কিছুর পরও আওয়ামী লীগের মতে, বিচারপতি কেএম হাসানের গায়ে বিএনপির গন্ধ থেকে গেছে। অতএব কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগ। একজন ব্যক্তির গায়ে যদি মিথ্যাভাবে ২৫ বছর আগের গন্ধ আরোপ করা যায় এবং সে কারণে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মানা না যায়, তাহলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করছেন, যিনি আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং নির্বাচনকালীনও দেশ শাসন করবেন বলে সদম্ভে ঘোষণা করছেন, যার গায়ে আপাদমস্তকই আওয়ামী লীগের গন্ধ রয়েছে- বিএনপি কেন তার অধীনে নির্বাচনে যাবে? এ প্রশ্নটি বেগম খালেদা জিয়া দেশবাসীর এবং বিশ্বের মানুষের বিবেকের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। এর উত্তর কী আসতে পারে, সেটি সহজেই অনুমেয়।
বিভিন্ন আলোচনা থেকে আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে যে, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি, অপশাসনে দেশ ছেয়ে গেছে। মানুষ সরকারের অপশাসনে এতটাই বিরক্ত যে, যদি এ মুহূর্তে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে নির্বাচন দেয়া হয়, তাহলে নৌকার পালে হাওয়া লাগার পরিবর্তে ভরাডুবির আশংকাই বেশি। এ বিষয়টি বর্তমান সরকারও ইতিমধ্যেই টের পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা যদি পরাজিত হয়, তাহলে তাদের দুর্নীতি, অপশাসন ও কুকর্মের জন্য দেশ তাদের ক্ষমা করবে না। বিচারের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতেই হবে। যে কারণে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের এ অন্তহীন অপচেষ্টা। তাদের মনে যদি সামান্যতম সৎ সাহস থাকত, তাহলে তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনকে ছেড়ে দিত। সেই সৎ সাহস তারা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। ১৯৭৪-৭৫ সালে তারা একবার চেষ্টা করেছিল একদলীয় শাসন কায়েম করতে; কিন্তু তারা সফল হয়নি। তারা টিকতে পারেনি। তারা এখন আবার চেষ্টা করছে, এদেশের সংগ্রামী জনগণই তাদের আবার ব্যর্থ করবে।
যাই হোক, জনসভাগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে জনমত সৃষ্টি। বিভিন্ন বক্তা তাদের বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণের মতামত গ্রহণের চেষ্টা করেন এবং জনগণকেও নিজেদের মতামত জানান। জনসভার বিভিন্ন পর্যায়ে বক্তারা জনগণের কাছ থেকে জানতে চান, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন, নাকি তা প্রতিহত করবেন? লাখ লাখ মানুষ সমস্বরে হাত উঁচিয়ে উচ্চকণ্ঠে জবাব দেন- না, আমরা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাব না। প্রয়োজন হলে আমরা রাজপথে আন্দোলনে নামব। তবুও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে দেব না। সরকারের যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। সেই সঙ্গে জনগণ ১৮ দলীয় জোটের প্রতি দৃঢ়ভাবে একাত্মতা পোষণ করেন। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত ১৮ দলীয় জোটের বিভিন্ন মহাসমাবেশে এ চিত্রই আমি দেখেছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনোভাবেই আপস না করে, তাহলে জনগণ সেটা মেনে নেবে না। সুতরাং দেশ এক কঠিন অরাজকতার মধ্যে পতিত হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে জনগণের সামনে একটাই প্রশ্ন- সেটি হচ্ছে আগামী ৪-৫ সপ্তাহের সময়টি কীভাবে অতিবাহিত হবে? কারণ সরকার বলেছে, ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে তারা যে কোনোভাবে তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেই। এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা মিডিয়াতে বিভিন্ন প্রকারে বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। তবে সব ধরনের বক্তব্যের মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়- সেটি হচ্ছে তারা নির্বাচন করবেন। অর্থাৎ সরকার তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগ্রহী। সরকার বলতে শুধু আওয়ামী লীগকেই বোঝানো হচ্ছে। কেননা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের যে মহাজোট, সেই মহাজোটে অনৈক্যের সুর বেজে উঠেছে। জোটের অনেক শরিক দলই বলছে, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে তারা সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও স্পষ্ট নয়। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি এক থেকে দেড় বছর ধরে বলে আসছে, তারা এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সাম্প্রতিককালে তাদের অবস্থান খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং এমন ধারণাও করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ একাই নির্বাচন অনুষ্ঠান করল এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অবস্থান নিল। এ ধারণাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ ১৯৮৬ সালে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তার পুনরাবৃত্তি হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। হুবহু পুনরাবৃত্তি না হলেও কাছাকাছি একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সাবধান করে দেন। আলোচনা বা বক্তৃতায় প্রকাশ পায় যে, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফোরাম বা বিএনএফ নামক একটি দল বা গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। জানা যায়, তারা নাকি তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে গমের শীষ চেয়েছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ। ধানের শীষ ও গমের শীষ যখন কাগজে ছাপা হয়, তখন দেখতে অনেকটা একরকম লাগে। ব্যালট পেপারে যখন ছাপানো হবে, তখন দেখতে একইরকম লাগবে। ভোটাররা বিভ্রান্ত হয়ে ধানের শীষ মনে করে গমের শীষে সিল মারবে। এরূপ একটি অর্বাচীন কল্পনা থেকেই বিএনএফ নামক দলকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। এ দলকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছুসংখ্যক আওয়ামী লীগপন্থী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং দলছুট রাজনীতিক পরিশ্রম করছেন বেশ কিছুদিন ধরে। তাদের সব ধরনের খরচ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী জোগান দিচ্ছে বলে বাজারে রটনা আছে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন দেয়ার জন্য দুই কদম আগায় তো এক কদম পেছায়- এরকম একটি অবস্থানে আছে বলে পত্রিকার রিপোর্ট মারফত জানা যায়। খালেদা জিয়া এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সাবধান করে বলেন, এটা কোনো মামাবাড়ির আবদার না!
বাংলাদেশের বয়স এখন ৪২-৪৩ বছর। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে পরিচিত নাম। এদেশে যেন শান্তি বজায় থাকে সে ব্যাপারে পৃথিবীর দেশগুলো এবং জাতিসংঘ দারুণভাবে আগ্রহী। খালেদা জিয়া বলেছেন, ১৮ দলীয় জোট প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না, প্রতিশোধের রাজনীতি করবে না, মারামারি-হানাহানির রাজনীতি করবে না। তিনি বলেছেন, মেধাবীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবেন, অনগ্রসর অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দেবেন, তথ্যপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেবেন। ধর্মীয় শিক্ষার ওপরে আক্রমণকে প্রতিহত করবেন। নারীর জন্য অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। এসব করতে হলে শান্তি প্রয়োজন। শান্তি আনতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন। তার জন্য সুষ্ঠু আইনের কাঠামো প্রয়োজন। তার জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। তার জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
লেখাটা দীর্ঘতর না করে একটি প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে শেষ করতে চাই। আওয়ামী লীগের জন্যই এ প্রস্তাব। দেশের জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান- এ কথাটি যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন, তাহলে একটি গণভোট দিন। আর যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে এই সংসদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সংবিধান সংশোধন করুন। আর যদি না করেন, তাহলে দেশে যে কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতির জন্য দায়িত্ব নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক : কলাম লেখক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
No comments