নিরপেক্ষ নির্বাচনের রূপরেখা by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
দেশ
ও জাতির এ সংকট মুহূর্তে নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকার ব্যবস্থার
প্রয়োজন যে ফুরিয়ে যায়নি, তা সবাই অনুভব করছেন। ইতিপূর্বে আমি একটি
সংবাদপত্রে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার রূপকল্প উপস্থাপন করে আসন্ন
সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করার ধারণাপত্র পেশ করেছিলাম। ড. আকবর আলি খান, ড.
শাহদীন মালিক, ব্যারিস্টার রফিক উল হক, টিআইবিসহ অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি ও
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনেক যৌক্তিক মডেল দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের
রাজনীতিকরা স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকার কারণে কোনো ফর্মুলাই শেষ পর্যন্ত
আলোর মুখ দেখেনি। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার মুখ খুলেছে। সরকারের
মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরাও ইদানীং রাজনৈতিক সংলাপ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য
নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। যদিও এখনও তাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে
কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না, তবুও মনে হচ্ছে তারা একটা যৌক্তিক
সমাধান চান। ১০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে
দলের শীর্ষ নেতারা বিরোধী দলের সঙ্গে সংসদের ভেতরে বা বাইরে যে কোনো
স্থানে আলোচনার কথা জানিয়েছেন। অর্থাৎ আগে শুধু সংসদে আলোচনা করতেই তারা
বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, কিন্তু এখন সংসদের বাইরেও আলোচনার প্রস্তাব
দিচ্ছেন। তবে শর্ত হল, সংবিধান ঠিক রাখতে হবে। সংবিধানের পবিত্রতা ক্ষুণœœ
না করে যে কোনো যৌক্তিক মডেল তারা মেনে নেবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে
বেদনাদায়ক হল, তারা এখনও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো মডেল উপস্থাপন করেননি।
ফলে জনগণ এখনও একতরফা নির্বাচনের বিপদাশংকাই দেখতে পাচ্ছে।
অপরদিকে বেশ গোছানো, পরিপাটি বিএনপি তাদের দাবি থেকে কেয়ারটেকার কথাটি উহ্য রেখে যুগান্তকারী ছাড় দিয়েছে বলে মনে করি। তবে পরিতাপের বিষয় হল, তারা এখনও পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ফর্মুলা পেশ করেননি। ৯ সেপ্টেম্বর বিএনপির সংসদীয় কমিটির সভার আলোচনাকে বেশ অপ্রস্তুতিমূলক ও বিশৃংখল বলে মনে হয়েছে। বিরোধী দলের চিফ হুইপ একটি ধারণাপত্র পাঠ শুরু করেন, অন্য নেতারা তার ব্যাপক সমালোচনা করেন। বেশ হট্টগোলের মধ্যে তিনটি ধারণাপত্র পাঠ করা হয় এবং বিএনপির দলীয় ফোরামে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো নির্ধারণ করা হবে বলে সভার প্রধান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবাইকে অবহিত করেন। বোঝা যায়, ভীষণ সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্যে বিএনপির দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এ সংগ্রাম চলছে, সেই কেয়ারটেকার ফর্র্মুলার বিষয়ে অনেক আগেই কি তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল না? আসলে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের চেয়েও সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ধারণাগত স্পষ্টতা, কর্মপরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা, একাডেমিক স্বচ্ছতা। বিশ্বায়নের এ যুগে আগের মতো মেঠো রাজনীতির উর্বর পরিবেশ আর নেই। যাই হোক, সব মিলিয়ে উভয় দলই যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কাঠামো প্রণয়নে তৎপর হয়েছে, এটাই আশার কথা। এখন আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা খতিয়ে দেখতে পারি।
ইতিপূর্বে সংবিধান সমুন্নত রেখে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ধারণা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন আইন বিশারদদের দ্বারা। যেগুলোর আলোকে আমরা মূল সরকার ব্যবস্থার কাঠামোগত বিন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। মূলত বাংলাদেশের মতো একটি আধা-ঘুমন্ত বা আধা-সচেতন দেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুষ্প্রাপ্যতাই স্বাভাবিক। এ কারণে ‘নিরপেক্ষ’ নয় বরং ‘পক্ষীয়’ ব্যক্তিদের নিয়ে অচিরেই একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন কমিটি’- ‘অনিক’ গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবেন। এ ছয়জনের সঙ্গে যুক্ত হবেন আরও চারজন সুশীলসমাজের অরাজনৈতিক প্রতিনিধি, যারা সমান সংখ্যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। দেশ ও জাতির অভিভাবক হিসেবে এ ‘অনিকের’ মুরব্বি সদস্য রাষ্ট্রপতিসহ মোট ১১ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনী কমিটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবে। এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকবেন তিনজন আওয়ামী লীগ, তিনজন বিএনপি, চারজন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও চারজন সুশীলসমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে মোট ১৪ জন সদস্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের জোটভুক্ত দলগুলো থেকে দু’জন করে মোট চারজন প্রতিনিধি পাঠাবে। একইভাবে দল দুটি সুশীলসমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দু’জন করে মোট চারজনকে মনোনীত করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অথবা একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৪ সদস্য আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে এ সরকারের প্রধানকে মনোনীত করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হবে বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিতর্কিত ইসির পুনর্গঠন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে মনোনিবেশ করা। সদ্য পদন্নোতিপ্রাপ্ত আমলাদের ব্যাপারে সৃষ্ট অসন্তোষ দূর করতেও নতুন নির্বাচনকালীন সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।
আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করতে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় ও সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এরই মধ্যে নবম সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে এবং সম্ভবত এটাই এ সংসদের শেষ অধিবেশন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলেও তারা গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলীয় সভায় সরকারকে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ ভেঙ্গে দিতে বলেছেন।
তিন-চারদিন আগে নরসিংদীর এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দলীয় সরকারের দাবিটি তুলে ধরেছেন। বিএনপি যেমন কেয়ারটেকারের দাবি থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে নির্দলীয় ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, আওয়ামী লীগও তেমনি সংবিধান অক্ষুণœ রেখে বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা পেশ করার সুযোগ নিতে পারে। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা এবং বাংলাদেশের শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকটা নিরাশ করেছে সরকার, তার অনমনীয় অবস্থানের কারণে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র ২-৩ বছর ধরেই এ বিষয়ে কথা বলে আসছে। সব শেষে কয়েকদিন আগে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। ড. ইউনূস ইস্যু, গার্মেন্ট কর্মীর নিরাপত্তা, দুর্নীতি, আইন-শৃংখলার অবনতিসহ নানা ইস্যুতে সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তার অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। ইইউ বারবার প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত ইইউ প্রতিনিধি সরকার, বিরোধী দল, স্পিকার, ইসিসহ সব স্পর্শকাতর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে স্পষ্ট করে বলেছেন, কেবল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই ইইউ’র কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তা না হলে কোনো একতরফা নির্বাচনে ইইউ তার পর্যবেক্ষক পাঠাবে না এবং নির্বাচনে কারিগরি সহায়তা দেবে না বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব সবার কাছে চিঠি পাঠিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সাধারণ পরিষদ চলাকালে পার্শ্বস্থানে সরকার ও বিরোধী দলের দু’জন করে মোট চারজনের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী বিতর্কের সমাধান করতে চেয়েছেন। কিন্তু বিএনপি রাজি থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নাকচে জাতিসংঘ মহাসচিবের সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হতে চলেছে। বিশ্বায়নের যুগে এ বৈশ্বিক গ্রামে বাংলাদেশ একা থাকতে পারে না। আমাদের মতো গ্রহীতা দেশে দাতাদের উপস্থিতি ও খবরদারি থাকবেই। দক্ষ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে সেই খবরদারি সর্বনিু পর্যায়ে রাখার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। সেজন্যও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য এ মুহূর্তে সময়ের দাবি। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশীদের সংশ্লিষ্টতাকে বহিঃহস্তক্ষেপ হিসেবে সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু সাহায্য নির্ভরতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। চারদিক থেকে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনেকটাই আÍবন্দি (স্ট্রাকচারাল ইন্টারলকিং)। এ আÍবন্দিত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ও জাতির সুখ-শান্তির জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সেই লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্যের সুদৃঢ় প্রাচীর, যেন ভবিষ্যতে কেউ তা ভাঙতে না পারে। নড়বড়ে জাতীয় চেতনা নিয়ে বিদেশী সংশ্লিষ্টতা পরিহার করার চিন্তা অবাস্তব।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অপরদিকে বেশ গোছানো, পরিপাটি বিএনপি তাদের দাবি থেকে কেয়ারটেকার কথাটি উহ্য রেখে যুগান্তকারী ছাড় দিয়েছে বলে মনে করি। তবে পরিতাপের বিষয় হল, তারা এখনও পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ফর্মুলা পেশ করেননি। ৯ সেপ্টেম্বর বিএনপির সংসদীয় কমিটির সভার আলোচনাকে বেশ অপ্রস্তুতিমূলক ও বিশৃংখল বলে মনে হয়েছে। বিরোধী দলের চিফ হুইপ একটি ধারণাপত্র পাঠ শুরু করেন, অন্য নেতারা তার ব্যাপক সমালোচনা করেন। বেশ হট্টগোলের মধ্যে তিনটি ধারণাপত্র পাঠ করা হয় এবং বিএনপির দলীয় ফোরামে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো নির্ধারণ করা হবে বলে সভার প্রধান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবাইকে অবহিত করেন। বোঝা যায়, ভীষণ সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্যে বিএনপির দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এ সংগ্রাম চলছে, সেই কেয়ারটেকার ফর্র্মুলার বিষয়ে অনেক আগেই কি তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল না? আসলে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের চেয়েও সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ধারণাগত স্পষ্টতা, কর্মপরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা, একাডেমিক স্বচ্ছতা। বিশ্বায়নের এ যুগে আগের মতো মেঠো রাজনীতির উর্বর পরিবেশ আর নেই। যাই হোক, সব মিলিয়ে উভয় দলই যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কাঠামো প্রণয়নে তৎপর হয়েছে, এটাই আশার কথা। এখন আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা খতিয়ে দেখতে পারি।
ইতিপূর্বে সংবিধান সমুন্নত রেখে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ধারণা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন আইন বিশারদদের দ্বারা। যেগুলোর আলোকে আমরা মূল সরকার ব্যবস্থার কাঠামোগত বিন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। মূলত বাংলাদেশের মতো একটি আধা-ঘুমন্ত বা আধা-সচেতন দেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুষ্প্রাপ্যতাই স্বাভাবিক। এ কারণে ‘নিরপেক্ষ’ নয় বরং ‘পক্ষীয়’ ব্যক্তিদের নিয়ে অচিরেই একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন কমিটি’- ‘অনিক’ গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবেন। এ ছয়জনের সঙ্গে যুক্ত হবেন আরও চারজন সুশীলসমাজের অরাজনৈতিক প্রতিনিধি, যারা সমান সংখ্যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। দেশ ও জাতির অভিভাবক হিসেবে এ ‘অনিকের’ মুরব্বি সদস্য রাষ্ট্রপতিসহ মোট ১১ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনী কমিটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবে। এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকবেন তিনজন আওয়ামী লীগ, তিনজন বিএনপি, চারজন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও চারজন সুশীলসমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে মোট ১৪ জন সদস্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের জোটভুক্ত দলগুলো থেকে দু’জন করে মোট চারজন প্রতিনিধি পাঠাবে। একইভাবে দল দুটি সুশীলসমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দু’জন করে মোট চারজনকে মনোনীত করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অথবা একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৪ সদস্য আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে এ সরকারের প্রধানকে মনোনীত করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হবে বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিতর্কিত ইসির পুনর্গঠন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে মনোনিবেশ করা। সদ্য পদন্নোতিপ্রাপ্ত আমলাদের ব্যাপারে সৃষ্ট অসন্তোষ দূর করতেও নতুন নির্বাচনকালীন সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।
আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করতে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় ও সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এরই মধ্যে নবম সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে এবং সম্ভবত এটাই এ সংসদের শেষ অধিবেশন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলেও তারা গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলীয় সভায় সরকারকে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ ভেঙ্গে দিতে বলেছেন।
তিন-চারদিন আগে নরসিংদীর এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দলীয় সরকারের দাবিটি তুলে ধরেছেন। বিএনপি যেমন কেয়ারটেকারের দাবি থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে নির্দলীয় ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, আওয়ামী লীগও তেমনি সংবিধান অক্ষুণœ রেখে বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা পেশ করার সুযোগ নিতে পারে। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা এবং বাংলাদেশের শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকটা নিরাশ করেছে সরকার, তার অনমনীয় অবস্থানের কারণে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র ২-৩ বছর ধরেই এ বিষয়ে কথা বলে আসছে। সব শেষে কয়েকদিন আগে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। ড. ইউনূস ইস্যু, গার্মেন্ট কর্মীর নিরাপত্তা, দুর্নীতি, আইন-শৃংখলার অবনতিসহ নানা ইস্যুতে সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তার অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। ইইউ বারবার প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত ইইউ প্রতিনিধি সরকার, বিরোধী দল, স্পিকার, ইসিসহ সব স্পর্শকাতর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে স্পষ্ট করে বলেছেন, কেবল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই ইইউ’র কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তা না হলে কোনো একতরফা নির্বাচনে ইইউ তার পর্যবেক্ষক পাঠাবে না এবং নির্বাচনে কারিগরি সহায়তা দেবে না বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব সবার কাছে চিঠি পাঠিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সাধারণ পরিষদ চলাকালে পার্শ্বস্থানে সরকার ও বিরোধী দলের দু’জন করে মোট চারজনের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী বিতর্কের সমাধান করতে চেয়েছেন। কিন্তু বিএনপি রাজি থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নাকচে জাতিসংঘ মহাসচিবের সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হতে চলেছে। বিশ্বায়নের যুগে এ বৈশ্বিক গ্রামে বাংলাদেশ একা থাকতে পারে না। আমাদের মতো গ্রহীতা দেশে দাতাদের উপস্থিতি ও খবরদারি থাকবেই। দক্ষ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে সেই খবরদারি সর্বনিু পর্যায়ে রাখার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। সেজন্যও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য এ মুহূর্তে সময়ের দাবি। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশীদের সংশ্লিষ্টতাকে বহিঃহস্তক্ষেপ হিসেবে সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু সাহায্য নির্ভরতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। চারদিক থেকে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনেকটাই আÍবন্দি (স্ট্রাকচারাল ইন্টারলকিং)। এ আÍবন্দিত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ও জাতির সুখ-শান্তির জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সেই লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্যের সুদৃঢ় প্রাচীর, যেন ভবিষ্যতে কেউ তা ভাঙতে না পারে। নড়বড়ে জাতীয় চেতনা নিয়ে বিদেশী সংশ্লিষ্টতা পরিহার করার চিন্তা অবাস্তব।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments