সিরিয়া- কার পক্ষে লড়ছেন ওবামা! by রবার্ট ফিস্ক
বারাক ওবামা যদি সিরিয়ার আসাদ সরকারের
ওপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, তাহলে আমেরিকার অবস্থান চলে
যাবে আল-কায়েদার পক্ষে।
এবং এটা ঘটবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো।
বেশ একটা জোট! আলেকজান্ডার ডুমার তিন মাস্কেটিয়ার যখন লড়তে যেত, তখন কি
তারা ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ বলে হাঁক ছাড়ত না?
পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সরকারেরা যদি বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
যায়, বা যখন যাবে, তাহলে তখন এটাই হওয়া উচিত নতুন রণহুংকার।
তারপর যে লোকেরা নাইন-ইলেভেনে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, তারাই এখন সেই জাতির পাশাপাশি লড়ে যাবে, আজ থেকে ঠিক ১২ বছর আগে যে জাতির নিরীহ-নিরপরাধ মানুষগুলোকে তারা হত্যা করেছে। ওবামা, ক্যামেরন, ওলাঁদসহ যুদ্ধবাজ নেতাদের এ এক বিরাট অর্জন বটে!
অবশ্য পেন্টাগন বা হোয়াইট হাউস এটা নিয়ে ঢাকঢোল পেটাবে না এবং আমার মনে হয় আল-কায়েদা তা করবে না, যদিও উভয় শক্তিই বাশারকে ধ্বংস করতে চায়। একই কথা বলা যায় আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন নুসরা ফ্রন্ট সম্পর্কেও। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কয়েকটি কৌতূহলোদ্দীপক সম্ভাবনা জেগে উঠেছে।
সম্ভবত আমেরিকানরা আল-কায়েদার কাছ থেকে গোয়েন্দা সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করবে। আসলে যুদ্ধের ময়দানে সশরীরে আছে তো আল-কায়েদাই, মাটির ওপর দিয়ে চলেফিরে বেড়াচ্ছে তারাই, যেটা আমেরিকানরা কখনো কখনো মোটেও করতে চায় না। আমেরিকানরা আল-কায়েদার কাছে গোয়েন্দা তথ্য চাইলে আল-কায়েদা কিছু লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য আমেরিকানদের দিতে পারে। অথচ আমেরিকা সাধারণভাবে বলে আসছে, আল-কায়েদার সদস্যরাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় দাগি আসামি, সিরিয়ানরা নয়।
অবশ্য কিছু বিষয় হবে অত্যন্ত পরিহাসময়। আমেরিকানরা ইয়েমেন ও পাকিস্তানে ড্রোন দিয়ে আল-কায়েদার সদস্যদের মেরে সাফ করে দিচ্ছে, একই সঙ্গে প্রচুর বেসামরিক মানুষও মারা পড়ছে। সেই আমেরিকাই সিরিয়ায় আল-কায়েদার শত্রুদের ওপর আঘাত হানার মধ্য দিয়ে আল-কায়েদার বিরাট সুবিধা করে দেবে। এই কাজে আমেরিকার সঙ্গে থাকবেন ক্যামেরন, ওলাঁদ প্রমুখ। আপনি আপনার শেষ কপর্দকটি বাজি রেখে বলতে পারেন, সিরিয়ায় আমেরিকানরা একমাত্র যাদের ওপর হামলা চালাবে না তারা হলো আল-কায়েদা বা নুসরা ফ্রন্টের লোকজন।
আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী তালিয়া বাজাবেন, আমেরিকানরা যা কিছুই করুক, যুক্তরাজ্য সবকিছুকেই বলবে চমৎকার এবং এবার আমেরিকার সঙ্গে থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জোট বাঁধবেন আল-কায়েদার সঙ্গে। আল-কায়েদা যে লন্ডনে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মেরেছিল, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতি থেকে সেটা ফসকে যাবে!
একালের সরকারগুলোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি নেই, তাই বুঝি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন স্মরণ করতে পারছেন না যে আজ ওবামার সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি যেসব আবেগ-অনুভূতির কথা উচ্চারণ করছেন, আজ থেকে এক দশক আগে জর্জ বুশ আর টনি ব্লেয়ার সেই একই আবেগ-অনুভূতি প্রচার করেছেন। সেদিন তাঁদেরও একই ধরনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল ভীষণ আস্থার সঙ্গে; কিন্তু সেই নিশ্চয়তার পক্ষে সত্যিকারের কোনো প্রমাণ ছিল না, যে প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ শুরু করে দেওয়া চলে।
ইরাকে আমরা হামলা শুরু করেছিলাম নির্জলা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে। সেসব মিথ্যা কথা রটিয়েছিল একদল প্রতারক, ধোঁকাবাজ, জালিয়াত। আজকে একই ধরনের মিথ্যা রটিয়ে আবারও এক যুদ্ধ বাধাতে চলেছে ইউটিউব। তাই বলে এর মানে এটা নয় যে ইউটিউবে প্রচারিত বেসামরিক সিরীয় লোকজনের গ্যাসপ্রয়োগে মৃত্যুর ছবিগুলো বানোয়াট। অর্থটা এই যে এসব ছবির বিপরীত বাস্তবতা ফুটে ওঠে এমন যেকোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ চাপা দেওয়া হচ্ছে। যেমন, লেবাননের হিজবুল্লাহর যে যোদ্ধারা সিরিয়ার আসাদ সরকারের পক্ষে দামেস্কে যুদ্ধ করছেন, তাঁদের মধ্যকার তিনজনও দৃশ্যত একই গ্যাসের বিষক্রিয়ায় একই দিনে অসুস্থ হয়েছেন, সম্ভবত টানেলগুলোর ভেতরে। বলা হচ্ছে, তাঁরা এখন বৈরুতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সুতরাং এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠে আসে যে সিরিয়ার সরকারই যদি গ্যাস প্রয়োগ করে থাকে, তাহলে হিজবুল্লাহর সদস্যরা সেই গ্যাসে আক্রান্ত হন কী করে? অনিচ্ছাকৃত অপঘাতে?
আর যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতিশক্তির কথা বলি, আমাদের এসব ফুর্তিবাজ রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে কে আছেন, যিনি বলতে পারবেন আমেরিকানরা সর্বশেষ যেবার সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর চড়াও হয়েছিল, তখন কী ঘটেছিল? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তাঁদের কেউই সেটা স্মরণ করতে পারবেন না। ঠিক আছে, আমি বলে দিচ্ছি কী ঘটেছিল: ১৯৮৪ সালের ৪ ডিসেম্বর পূর্ব লেবাননের বেকা উপত্যকায় সিরিয়ার মিসাইল ব্যবস্থার ওপর বোমা মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমেরিকান বিমানবাহিনী। ঘটনাটি আমার বেশ মনে আছে, কারণ সে সময় এই লেবাননে ছিলাম। একটি আমেরিকান এ-৬ জঙ্গি বোমারু বিমানকে আঘাত করেছিল সিরিয়ার স্ত্রেলা মিসাইল (স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার তৈরি), ফলে সেটিকে জরুরি অবতরণ করতে হয়েছিল বেকা উপত্যকায়। বিমানটির পাইলট মার্ক ল্যাঞ্জ মারা যান, সহযোগী পাইলট রবার্ট গুডম্যানকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে গ্রেপ্তার করে দামেস্কের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর প্রায় এক মাস ধরে ‘সন্ত্রাসের অশুভ চক্রের অবসান’ নিয়ে বস্তাপচা সব কথাবার্তার মাঝে আমেরিকা থেকে জেস জ্যাকসনকে ছুটে যেতে হয়েছিল সিরিয়ায়, রবার্ট গুডম্যানকে ফিরিয়ে আনার জন্য। এ-৭ সিরিজের আরও একটি আমেরিকান বিমান সিরিয়ানদের গুলিতে বিধ্বস্ত হয়েছিল, তবে সেটির চালক ভূমধ্যসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলেন, লেবাননের এক মাছধরা নৌকার মাঝিরা তাঁকে সাগর থেকে টেনে তুলেছিল। তাঁর বিমানটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
আমরা শুনতে পাচ্ছি, সিরিয়ার ওপর আক্রমণটা হবে ঝটিকা আক্রমণ, সংক্ষিপ্ত, মাত্র দিন দুয়েকের। বারাক ওবামা এ রকমই ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু ইরানের কথা ভেবে দেখুন। হিজবুল্লাহর কথা ভেবে দেখুন। আমার তো সন্দেহ, ওবামা যদি এগিয়েই যান, সিরিয়ায় যদি হামলা চালানো হয়, তাহলে এবার আর থামবে না, চলতেই থাকবে।
যুক্তরাজ্যের দৈনিক দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক। দি ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা।
No comments