সিরিয়ার জটিল অংক by ফরহাদ মজহার
বারাক
ওবামা যা আশা করেছিলেন সেটা হয়নি। বিলাতের পার্লামেন্ট সিরিয়ায় সামরিক
হামলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেনি। ৩০ আগস্ট বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে তর্ক হয়েছে
পার্লামেন্টে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ব্রিটেন যুদ্ধে জড়াবে না।
ওবামার প্ল্যান এতে কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ কারণে
একা হয়ে যাবে সেটা ভাবার অবশ্য কোনো কারণ নাই। এরপরও সিরিয়ার হামলায় অনেক
দেশের সমর্থন পাওয়া যাবে। তবুও, মানতে হবে, ওবামার সামরিক বাসনা এতে কিছুটা
দমিত হতে পারে। সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর যুক্তি খাড়া করা
তার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার কোনো সুস্পষ্ট বা অকাট্য
প্রমাণ দিতে পারছে না কেউই। বরং উল্টা অভিযোগ উঠেছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত
এলাকায় ভয়াবহ ও বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করেছে বিদ্রোহীরাই। প্রশ্ন উঠেছে,
ওবামা কি যুদ্ধের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন চাইবেন? তার সম্ভাবনা খুবই কম।
কংগ্রেস এখন অধিবেশনে নাই। সেটা একটা কারণ। তবে গৌণ। মূল কারণ হচ্ছে, চাইতে
গেলে বিলাতের পার্লামেন্টের মতো সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত যুদ্ধের বিপক্ষেই
যাবে। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো হয়েছিল সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর ভিত্তি
করে। আন্তর্জাতিক বিধিবিধান ও নীতি-নৈতিকতা লংঘন করে। সে যুদ্ধ পাশ্চাত্য
সভ্যতার(?) ‘ঘোর কেলেংকারি’ হিসেবে এতই প্রতিষ্ঠিত যে সিরিয়ার বিরুদ্ধে
যুদ্ধের পক্ষে মত তৈরি করা তুলনামূলকভাবে কঠিন। ওবামাকে একটু থ মারতে
হচ্ছে। বৃহস্পতিবার-শুক্রবারের দিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আগাম হুঁশিয়ারি
শোনা যাচ্ছিল। সেখানে খানিক দম পড়েছে। রাশিয়া ও চীনের পাল্টা হুমকি এবং
মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন শক্তির যে সমীকরণ বর্তমান, সেসব বিচার করে অনেকে দাবি
করছেন, সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য হামলার অর্থ কার্যত তৃতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া। বিশ্ব পরিস্থিতি এতটাই গরম হয়ে আছে।
আসলে সিরিয়ার পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল। সবকিছু সাদাকালো নয়। বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যারা মাঠে লড়ছে, তাদের মধ্যে আল কায়দা আছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তারা লাভবান ও শক্তিশালী হয়েছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বেশ শ্লেষের সঙ্গেই বলেছেন, মার্কিনিরা যদি সিরিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে সেটা হল আল কায়দার পক্ষে সহায়তা। অর্থাৎ আল কায়দার হয়ে সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের যুদ্ধ হবে সেটা। যে মানুষগুলো ৯/১১-র সময় অগুনতি নিরীহ মার্কিন মেরে নিউইয়র্ক সাফা করে দিয়েছিল, তারা বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেই দেশের সহায়তা পেতে যাচ্ছে। এ এক পরাবাস্তব পরিস্থিতি। ওবামা, ক্যামেরন আর ওলাঁদের জন্য এ এক জব্বর কাজ হল বটে। রবার্ট ফিস্ক অভিজ্ঞ সাংবাদিক, তিনি সরলীকরণের জন্য কথাটা বলেননি, মার্কিন যুদ্ধবাজ নীতির বিরোধিতা করার জন্যই বোঝাতে চেয়েছেন, মার্কিনিরা একদিকে আল কায়দার বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কথা বলে, আর অন্যদিকে তাদের অপছন্দের বাশার আল আসাদকে শায়েস্তা করার জন্য আল কায়দাকেই সহায়তা করতে আপত্তি করে না।
তবে নিশ্চয়ই পরিস্থিতি এত সোজাসাপ্টা নয়। সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা শুরু করেছে, তার কারণে লাখ খানেকের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে। সে যে পক্ষেরই হোক না কেন। দেশটি ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের দিক থেকে দেখলে এটা বনে বাঘ জলে কুমিরের দশা। একদিকে একনায়কতান্ত্রিক শাসক বাশার আল আসাদের অত্যাচার ও দমনপীড়ন, আর অন্যদিকে পরদেশী হস্তক্ষেপ। বিদ্রোহীদের শক্তি পুরোটা তাদের নিজেদের নয়, বাইরের। জনগণের সমর্থন তাদের পেছনে আসলে ঠিক কতটা সেটাও অস্পষ্ট। কিন্তু দেশটি ইতিমধ্যেই যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। এমনকি এমন কোনো জায়গায় দাঁড়ানোর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না যেখানে সিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সব পক্ষের একটা সাধারণ স্বার্থ অন্বেষণ করা সম্ভব হয় এবং সেই স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়ে আত্মঘাতী যুদ্ধ থামানোর কিছু সূত্র পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষকে আরও অনেক রক্ত দিতে হবে। অথচ যে পক্ষই টিকে থাকুক বা জিতুক, তার ফল কী দাঁড়াবে সেটা খুবই অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে।
ইরান ও হিজবুল্লাহ প্রাণপণ বাশার আল আসাদের সরকার ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিস্তর হুমকি এর আগে আমরা শুনেছি। ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের কারণে যে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা আমরা দেখেছি সেটা এখন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্তিমিত হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে। ইরানিরা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে জবাবি প্রচারের চেয়ে নিঃশব্দ কূটনীতির পথই বেছে নিয়েছে। আহমেদিনেজাদ যেভাবে কথা বলে আর জোরে জবাব দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলতেন, নতুন প্রেসিডেন্ট ‘মধ্যপন্থী’ বলে সেই গরম কূটনীতির পথ ধরবেন না। সেটা নিশ্চিত। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় ইরানের শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে ইরান তার সমস্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এতে সন্দেহ নাই। আর সেদিক থেকে আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা ইরানের জন্য জরুরি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর সে অঞ্চলে ক্ষমতার সমীকরণ শিয়াদের পক্ষে চলে গিয়েছে, এ বাস্তবতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পাশ্চাত্য মিত্রেরা যেমন তাদের স্বার্থের অনুকূল হিসেবে দেখছে না, ঠিক তেমনি সুন্নি মুসলমানদের জন্যও এ একটা অসহনীয় পরিস্থিতি। বাশার আল আসাদ যদি টিকে যান, তার মানে সিরিয়ায় ইরানেরই বিজয় হল। বিদ্রোহীদের কবল থেকে বাশারের সৈন্যরা যখন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আবার দখল করে নিল, তাতে দূর থেকে মনে হচ্ছে বাশার এই যুদ্ধে টিকে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাশ্চাত্য মিত্রদের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কঠিন। ঠিক যেমন কঠিন সৌদি আরব, ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-রাজড়াদের জন্য। মাঠে আল কায়দার জন্যও সেটা মেনে নেয়া কঠিন। ফলে মার্কিনিরা আল কায়দার পক্ষেই বুঝি লড়তে যাচ্ছে- কথাটা সরল অর্থে বললেও পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জটিল ও ঘোলাটে।
সিরিয়ার যুদ্ধ বোঝার প্রাথমিক দিক হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান। একে একটা সুদূরপ্রসারী সামরিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত গণ্য করাই সঠিক। এই অর্থে যে, এই যুদ্ধ ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইসরাইলি সামরিক শক্তির অভিযান শুধু নয়। একই সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে অভিযান। রাশিয়া ও চীন সেভাবেই ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে একে দেখছে এবং সেই বিবেচনাতেই তাদের অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বের জ্বালানি সম্পদের পরিস্থিতির দিক থেকে দেখলে মধ্যপ্রাচ্য-মধ্য এশিয়ার তেলের মজুদের ওপর আধিপত্য ও দখলদারি বজায় রাখা এই যুদ্ধের আশু উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে যুক্ত তেলের পাইপলাইনগুলো রক্ষা করা এবং নিজেদের অধীনস্থ রাখার প্রতিযোগিতা ও লড়াই। এই দিকগুলো কমবেশি স্পষ্ট।
বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুধু দৃশ্যমান সামরিক রূপ নিয়ে জারি নেই, তার রাজনৈতিক প্রকাশও আছে। সেটা আমরা দেখি নতুনভাবে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পক্ষে সাজানোর লড়াই হিসেবে। সিরিয়ার যুদ্ধ এই সামগ্রিক সামরিক-রাজনৈতিক যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে আলাদা কিছু নয়। যারা সিরিয়ার যুদ্ধের খবর অনেক ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখেন, তারা দাবি করছেন সিরিয়ার ‘শাসক বদল’ (ৎবমরসব পযধহমব) করার কাজে ২০১১ সাল থেকে আল কায়দার সক্রিয়তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রণোদনা বা সমর্থন রয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে এখন সরাসরি সামরিক হামলার সিদ্ধান্ত নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে। আল কায়দা ছাড়াও বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় জনগণের ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভকে উসকে দিয়ে ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়ে উৎখাতের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। বাশার আল আসাদকে এখনও উৎখাত করা যায়নি। উপায়ন্তর না দেখে এখন বোমারু বিমানের হামলা এবং দরকার হলে সিরিয়ার মাটিতে বিদেশী সৈন্য পাঠানোর পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। বিদ্রোহীদের দিয়ে সরকার উৎখাতের কাজ হচ্ছে না এবং বিদ্রোহীরা পরাজিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে ইরানের বিজয়। এটা হতে দেয়া যায় না। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতেই হচ্ছে।
গত ১৫ বছরের হিসাব নিলে আরব বা মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের সামরিক অভিযান ঘটেছে নয়বার। সুদান, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মালি এবং ঘাতক ড্রোনের হামলা চলছে ইয়ামেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে। এই বাস্তবতা সব সময়ই চোখের সামনে হাজির রাখা দরকার।
মুশকিল হচ্ছে, এই যুদ্ধকে কিভাবে ‘ন্যায়সঙ্গত’ যুদ্ধ বলে হাজির করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? যেহেতু সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ঠিক সেই সময়ই গ্যাসে প্রায় ৩৫৫ জন নিরীহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। এখন সিরিয়ার ওপর মিসাইল আক্রমণের যে প্রস্তুতি চলছে সেখানেও সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ থাকার কথা বলা হচ্ছে। আসলে সিরিয়ার আদৌ রাসায়নিক অস্ত্র আছে কি-না এবং ২১ আগস্ট যে গ্যাসের হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছে সেই গ্যাস আসলে কী, তা তদন্তের জন্য জাতিসংঘের রাসায়নিক অস্ত্র পরিদর্শক দল কাজ করছে। তাদের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা ঘোষণা দিয়েছে যে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে- সে তথ্যের পক্ষে তাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ আছে। জাতিসংঘের তদন্ত কিন্তু শেষ হয়নি, জাতিসংঘের সেক্রেটারির কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়া অনেক পরের কথা। কিন্তু যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি নেয়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা জরুরি মনে করছে না।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ইরাকে হামলার সময় বলা হয়েছিল ইরাক গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুদ করে রেখেছে। গোয়েন্দাদের এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া মনে আছে নিশ্চয়ই যে, গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে বিল ক্লিনটন এক ওষুধের কারখানায় হামলা চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আল কায়দার বোমা হামলার প্রত্যুত্তর দিয়ে বীরত্ব দেখানো কর্তব্য মনে করেছিলেন। ওটা নাকি রাসায়নিক অস্ত্র বানানোর কারখানা ছিল। কিন্তু পরে পাহাড় কাঁপিয়ে পাহাড়ের গোড়ার গর্ত থেকে একটি ইঁদুর বের হয়ে এসেছিল : পর্বতের মূষিক প্রসব! আসলে ওটা রাসায়নিক অস্ত্র বানানোর কারখানা ছিল না, ছিল ওষুধের কারখানা। তবে দামেস্কের শহরতলীতে যে হামলায় বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে সেটা ভয়ঙ্কর। এটা ভয়াবহ অপরাধ। এভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা ও আহত করার বিহিত অবশ্যই হওয়া উচিত।
এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ার যুদ্ধে নীতিগত জায়গা থেকে বিবদমান দুই পক্ষের কোনো একটির পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতা করা একটি সাধারণ নীতি, কিন্তু সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাটিকে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শনাক্ত করা কঠিন। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল অংক সরল সমীকরণ নয়। কিন্তু কিছু দিক পরিষ্কার।
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য বাশার আল আসাদ দায়ী থাকুন বা না থাকুন, সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হামলা সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপন্ন করে তুলবে। একে ছুতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গ্রহণ করতে চাইছে। এটা প্রহসন যে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্কিন মিত্র হচ্ছে সৌদি আরব। সিরিয়ার জনগণের দুর্দশা ও দুর্ভোগকে আশ্রয় করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই ধোঁয়াশা পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ হচ্ছে সিরিয়ার জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো। আশা করা যায় যে, প্রায় অসাধ্য হলেও তারা তাদের সংকট নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম হবে। যুদ্ধ কী ভয়ানক প্রাণঘাতী হতে পারে সে অভিজ্ঞতা সবারই আছে।
সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা হয়, তখন তার সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে সারা দুনিয়ার মানুষকেই সচেতন হয়ে ওঠা দরকার। রাশিয়া ও চীনের অবস্থানের কারণে হামলার পরিণতি সেদিকে গড়াবে বলে অনেকে আন্দাজ করেন। আর, তার সঙ্গে যুক্ত মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার উত্তপ্ত পরিস্থিতি। বারাক ওবামা পরিষ্কারই বলেছেন, সিরিয়ার হামলার উদ্দেশ্য বাশার আল আসাদকে অপসারণ নয়। তাহলে সেটা কী? সেটা হচ্ছে বিদ্রোহীদের সহায়তা করা। এর ফলে সিরিয়ায় যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলতে থাকবে, এর নিরসন হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে দাঙ্গা ও হত্যার রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়ে ঘোলা পরিস্থিতিতে সুবিধা আদায় করাই মার্কিন নীতি। বড় কোনো যুদ্ধে জড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখন অসম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দুর্বল জায়গাটা তার পতনকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। আমাদের জীবদ্দশায় সেটা দেখে গেলে অবাক হবো না।
আসলে সিরিয়ার পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল। সবকিছু সাদাকালো নয়। বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যারা মাঠে লড়ছে, তাদের মধ্যে আল কায়দা আছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তারা লাভবান ও শক্তিশালী হয়েছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বেশ শ্লেষের সঙ্গেই বলেছেন, মার্কিনিরা যদি সিরিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে সেটা হল আল কায়দার পক্ষে সহায়তা। অর্থাৎ আল কায়দার হয়ে সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের যুদ্ধ হবে সেটা। যে মানুষগুলো ৯/১১-র সময় অগুনতি নিরীহ মার্কিন মেরে নিউইয়র্ক সাফা করে দিয়েছিল, তারা বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেই দেশের সহায়তা পেতে যাচ্ছে। এ এক পরাবাস্তব পরিস্থিতি। ওবামা, ক্যামেরন আর ওলাঁদের জন্য এ এক জব্বর কাজ হল বটে। রবার্ট ফিস্ক অভিজ্ঞ সাংবাদিক, তিনি সরলীকরণের জন্য কথাটা বলেননি, মার্কিন যুদ্ধবাজ নীতির বিরোধিতা করার জন্যই বোঝাতে চেয়েছেন, মার্কিনিরা একদিকে আল কায়দার বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কথা বলে, আর অন্যদিকে তাদের অপছন্দের বাশার আল আসাদকে শায়েস্তা করার জন্য আল কায়দাকেই সহায়তা করতে আপত্তি করে না।
তবে নিশ্চয়ই পরিস্থিতি এত সোজাসাপ্টা নয়। সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা শুরু করেছে, তার কারণে লাখ খানেকের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে। সে যে পক্ষেরই হোক না কেন। দেশটি ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের দিক থেকে দেখলে এটা বনে বাঘ জলে কুমিরের দশা। একদিকে একনায়কতান্ত্রিক শাসক বাশার আল আসাদের অত্যাচার ও দমনপীড়ন, আর অন্যদিকে পরদেশী হস্তক্ষেপ। বিদ্রোহীদের শক্তি পুরোটা তাদের নিজেদের নয়, বাইরের। জনগণের সমর্থন তাদের পেছনে আসলে ঠিক কতটা সেটাও অস্পষ্ট। কিন্তু দেশটি ইতিমধ্যেই যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। এমনকি এমন কোনো জায়গায় দাঁড়ানোর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না যেখানে সিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সব পক্ষের একটা সাধারণ স্বার্থ অন্বেষণ করা সম্ভব হয় এবং সেই স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়ে আত্মঘাতী যুদ্ধ থামানোর কিছু সূত্র পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষকে আরও অনেক রক্ত দিতে হবে। অথচ যে পক্ষই টিকে থাকুক বা জিতুক, তার ফল কী দাঁড়াবে সেটা খুবই অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে।
ইরান ও হিজবুল্লাহ প্রাণপণ বাশার আল আসাদের সরকার ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিস্তর হুমকি এর আগে আমরা শুনেছি। ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের কারণে যে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা আমরা দেখেছি সেটা এখন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্তিমিত হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে। ইরানিরা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে জবাবি প্রচারের চেয়ে নিঃশব্দ কূটনীতির পথই বেছে নিয়েছে। আহমেদিনেজাদ যেভাবে কথা বলে আর জোরে জবাব দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলতেন, নতুন প্রেসিডেন্ট ‘মধ্যপন্থী’ বলে সেই গরম কূটনীতির পথ ধরবেন না। সেটা নিশ্চিত। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় ইরানের শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে ইরান তার সমস্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এতে সন্দেহ নাই। আর সেদিক থেকে আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা ইরানের জন্য জরুরি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর সে অঞ্চলে ক্ষমতার সমীকরণ শিয়াদের পক্ষে চলে গিয়েছে, এ বাস্তবতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পাশ্চাত্য মিত্রেরা যেমন তাদের স্বার্থের অনুকূল হিসেবে দেখছে না, ঠিক তেমনি সুন্নি মুসলমানদের জন্যও এ একটা অসহনীয় পরিস্থিতি। বাশার আল আসাদ যদি টিকে যান, তার মানে সিরিয়ায় ইরানেরই বিজয় হল। বিদ্রোহীদের কবল থেকে বাশারের সৈন্যরা যখন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আবার দখল করে নিল, তাতে দূর থেকে মনে হচ্ছে বাশার এই যুদ্ধে টিকে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাশ্চাত্য মিত্রদের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কঠিন। ঠিক যেমন কঠিন সৌদি আরব, ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-রাজড়াদের জন্য। মাঠে আল কায়দার জন্যও সেটা মেনে নেয়া কঠিন। ফলে মার্কিনিরা আল কায়দার পক্ষেই বুঝি লড়তে যাচ্ছে- কথাটা সরল অর্থে বললেও পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জটিল ও ঘোলাটে।
সিরিয়ার যুদ্ধ বোঝার প্রাথমিক দিক হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান। একে একটা সুদূরপ্রসারী সামরিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত গণ্য করাই সঠিক। এই অর্থে যে, এই যুদ্ধ ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইসরাইলি সামরিক শক্তির অভিযান শুধু নয়। একই সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে অভিযান। রাশিয়া ও চীন সেভাবেই ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে একে দেখছে এবং সেই বিবেচনাতেই তাদের অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বের জ্বালানি সম্পদের পরিস্থিতির দিক থেকে দেখলে মধ্যপ্রাচ্য-মধ্য এশিয়ার তেলের মজুদের ওপর আধিপত্য ও দখলদারি বজায় রাখা এই যুদ্ধের আশু উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে যুক্ত তেলের পাইপলাইনগুলো রক্ষা করা এবং নিজেদের অধীনস্থ রাখার প্রতিযোগিতা ও লড়াই। এই দিকগুলো কমবেশি স্পষ্ট।
বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুধু দৃশ্যমান সামরিক রূপ নিয়ে জারি নেই, তার রাজনৈতিক প্রকাশও আছে। সেটা আমরা দেখি নতুনভাবে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পক্ষে সাজানোর লড়াই হিসেবে। সিরিয়ার যুদ্ধ এই সামগ্রিক সামরিক-রাজনৈতিক যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে আলাদা কিছু নয়। যারা সিরিয়ার যুদ্ধের খবর অনেক ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখেন, তারা দাবি করছেন সিরিয়ার ‘শাসক বদল’ (ৎবমরসব পযধহমব) করার কাজে ২০১১ সাল থেকে আল কায়দার সক্রিয়তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রণোদনা বা সমর্থন রয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে এখন সরাসরি সামরিক হামলার সিদ্ধান্ত নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে। আল কায়দা ছাড়াও বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় জনগণের ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভকে উসকে দিয়ে ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়ে উৎখাতের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। বাশার আল আসাদকে এখনও উৎখাত করা যায়নি। উপায়ন্তর না দেখে এখন বোমারু বিমানের হামলা এবং দরকার হলে সিরিয়ার মাটিতে বিদেশী সৈন্য পাঠানোর পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। বিদ্রোহীদের দিয়ে সরকার উৎখাতের কাজ হচ্ছে না এবং বিদ্রোহীরা পরাজিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে ইরানের বিজয়। এটা হতে দেয়া যায় না। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতেই হচ্ছে।
গত ১৫ বছরের হিসাব নিলে আরব বা মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের সামরিক অভিযান ঘটেছে নয়বার। সুদান, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মালি এবং ঘাতক ড্রোনের হামলা চলছে ইয়ামেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে। এই বাস্তবতা সব সময়ই চোখের সামনে হাজির রাখা দরকার।
মুশকিল হচ্ছে, এই যুদ্ধকে কিভাবে ‘ন্যায়সঙ্গত’ যুদ্ধ বলে হাজির করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? যেহেতু সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ঠিক সেই সময়ই গ্যাসে প্রায় ৩৫৫ জন নিরীহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। এখন সিরিয়ার ওপর মিসাইল আক্রমণের যে প্রস্তুতি চলছে সেখানেও সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ থাকার কথা বলা হচ্ছে। আসলে সিরিয়ার আদৌ রাসায়নিক অস্ত্র আছে কি-না এবং ২১ আগস্ট যে গ্যাসের হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছে সেই গ্যাস আসলে কী, তা তদন্তের জন্য জাতিসংঘের রাসায়নিক অস্ত্র পরিদর্শক দল কাজ করছে। তাদের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা ঘোষণা দিয়েছে যে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে- সে তথ্যের পক্ষে তাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ আছে। জাতিসংঘের তদন্ত কিন্তু শেষ হয়নি, জাতিসংঘের সেক্রেটারির কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়া অনেক পরের কথা। কিন্তু যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি নেয়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা জরুরি মনে করছে না।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ইরাকে হামলার সময় বলা হয়েছিল ইরাক গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুদ করে রেখেছে। গোয়েন্দাদের এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া মনে আছে নিশ্চয়ই যে, গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে বিল ক্লিনটন এক ওষুধের কারখানায় হামলা চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আল কায়দার বোমা হামলার প্রত্যুত্তর দিয়ে বীরত্ব দেখানো কর্তব্য মনে করেছিলেন। ওটা নাকি রাসায়নিক অস্ত্র বানানোর কারখানা ছিল। কিন্তু পরে পাহাড় কাঁপিয়ে পাহাড়ের গোড়ার গর্ত থেকে একটি ইঁদুর বের হয়ে এসেছিল : পর্বতের মূষিক প্রসব! আসলে ওটা রাসায়নিক অস্ত্র বানানোর কারখানা ছিল না, ছিল ওষুধের কারখানা। তবে দামেস্কের শহরতলীতে যে হামলায় বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে সেটা ভয়ঙ্কর। এটা ভয়াবহ অপরাধ। এভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা ও আহত করার বিহিত অবশ্যই হওয়া উচিত।
এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ার যুদ্ধে নীতিগত জায়গা থেকে বিবদমান দুই পক্ষের কোনো একটির পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতা করা একটি সাধারণ নীতি, কিন্তু সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাটিকে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শনাক্ত করা কঠিন। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল অংক সরল সমীকরণ নয়। কিন্তু কিছু দিক পরিষ্কার।
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য বাশার আল আসাদ দায়ী থাকুন বা না থাকুন, সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হামলা সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপন্ন করে তুলবে। একে ছুতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গ্রহণ করতে চাইছে। এটা প্রহসন যে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্কিন মিত্র হচ্ছে সৌদি আরব। সিরিয়ার জনগণের দুর্দশা ও দুর্ভোগকে আশ্রয় করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই ধোঁয়াশা পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ হচ্ছে সিরিয়ার জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো। আশা করা যায় যে, প্রায় অসাধ্য হলেও তারা তাদের সংকট নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম হবে। যুদ্ধ কী ভয়ানক প্রাণঘাতী হতে পারে সে অভিজ্ঞতা সবারই আছে।
সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা হয়, তখন তার সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে সারা দুনিয়ার মানুষকেই সচেতন হয়ে ওঠা দরকার। রাশিয়া ও চীনের অবস্থানের কারণে হামলার পরিণতি সেদিকে গড়াবে বলে অনেকে আন্দাজ করেন। আর, তার সঙ্গে যুক্ত মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার উত্তপ্ত পরিস্থিতি। বারাক ওবামা পরিষ্কারই বলেছেন, সিরিয়ার হামলার উদ্দেশ্য বাশার আল আসাদকে অপসারণ নয়। তাহলে সেটা কী? সেটা হচ্ছে বিদ্রোহীদের সহায়তা করা। এর ফলে সিরিয়ায় যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলতে থাকবে, এর নিরসন হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে দাঙ্গা ও হত্যার রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়ে ঘোলা পরিস্থিতিতে সুবিধা আদায় করাই মার্কিন নীতি। বড় কোনো যুদ্ধে জড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখন অসম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দুর্বল জায়গাটা তার পতনকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। আমাদের জীবদ্দশায় সেটা দেখে গেলে অবাক হবো না।
No comments