সাদাসিধে কথা- এই লজ্জা কোথায় রাখি by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
কাক কাকের গোশত খায় না- কিন্তু এবারে মনে হয় একটু খেতেই হবে। আমি একটা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমি সাধারণত অন্য
বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করি
না। কিন্তু এবারে মনে হয় করতেই হবে।
আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আমার মতোন শিক্ষকরা সেই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে আটকে রেখেছেন। খবরে জেনেছি এই মুহূর্তে দয়া করে পনেরো দিনের জন্যে দম নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্ভবত আবার নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে।
আগেই বলে রাখি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তার শিক্ষকদের ভিতর কী সমস্যা সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছি না। শিক্ষকরা বলছেন তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তারপরেও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটকে রেখেছেন সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না। পত্রপত্রিকার লেখালেখি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
আমাদের দেশে লেখালেখির একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়েছে। সবারই একটা নিরপেক্ষতার ভান করতে হবে। তাই কেউ যদি গুরুতর অন্যায়ও করে সোজাসুজি স্পষ্ট করে কেউ লেখে না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে লেখে- যেন কেউ কিছু বলতে না পারে। আজকাল পত্রপত্রিকায় ইলেকট্রনিক ভার্সন রয়েছে। সেখানে কোনো লেখা ছাপা হলে তার লেজে পাঠক আবার ভুল বানান এবং অমার্জিত ভাষায় যা কিছু লিখতে পারে! সবাই ভয়ে ভয়ে লেখে, কার আর সত্যি কথা বলে গালমন্দ খেতে ভালো লাগে? আমি অবশ্যি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে দুর্বোধ্যভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি না- একেবারে সোজাসুজি বলছি, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে দিনের পর দিন আটকে রাখা খুব বড় একটা অন্যায় কাজ। কথাটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মানুষটি একজন ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে যদি একজন জুনিয়র লেকচারার কিংবা একজন অপরিচিত ছাত্রও হতো, তাকেও একটা ঘরের মাঝে আটকে রাখা গুরুতর একটি অন্যায়।
স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না। আমি আইনের মানুষ নই। কিন্তু আমার ধারণা দেশের আইনে এটা নিশ্চয়ই একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা এ কাজটি করছেন আমার এ লেখাটি তাদের চোখে পড়বে কিনা আমি জানি না। যদি পড়ে তাহলে তাদের প্রতি আমার একটা ছোট অনুরোধ। ঘরে তাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই কমবয়সী ছেলেমেয়ে আছে। পনেরো দিন পর তারা আবার যখন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলবেন, তখন তারা রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে নিচের এই বাক্যালাপগুলো করবেন!
তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বলবেন, ‘বাবা, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটা বিশাল কাজ করে এসেছি!’ ছেলেমেয়েরা তখন বলবে, ‘কী কাজ বাবা (কিংবা কী কাজ মা?)’ তখন তারা বলবেন, ‘আমাদের একজন ভাইস চ্যান্সেলর আছেন, তাকে আমরা দু’চোখে দেখতে পারিনা। তাই তাকে আমরা তার অফিসে আটকে রেখেছি। সেখান থেকে তাকে আমরা বের হতে দিই না।’
আমি ছোট বাচ্চাদের যেটুকু জানি তাতে আমার ধারণা তখন তারা চোখ বড় বড় করে বলবে, ‘বের হতে দাও না?’
‘হ্যাঁ, জেলখানায় যেরকম কেউ বের হতে পারে না, সেরকম। তাকে আমরা অফিস থেকে বের হতে দিই না। জেলখানার মতো আটকে রেখেছি।’
বাক্যালাপের এরকম পর্যায়ে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমাদের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেমেয়ে নেই? তারা কী বলে?’
‘তাদের আবার বলার কী আছে? একটা মেয়ে শুনেছি লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়েছে। তাকেও বিদায় জানাতে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে এয়ারপোর্টে যেতে দেইনি।’
বাচ্চাগুলো তখন নিশ্চয়ই শুকনো মুখে তাদের বাবা কিংবা মায়ের মুখের দিকে তাকাবে, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘সত্যি?’
শিক্ষকরা তখন বলবেন, ‘হ্যাঁ। উচিৎ শিক্ষা হচ্ছে। তোমরা যখন বড় হবে তখন তোমাদের যদি মানুষকে অপছন্দ হয় তাহলে তোমরাও তাকে এভাবে একটা ঘরে আটকে ফেলবে। বের হতে দেবে না!’
আমার ধারণা শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা আলোচনার এই পর্যায়ে এক ধরনের আহত এবং আতংকিত দৃষ্টিতে তাদের বাবা (কিংবা মা) এর দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আমার খুব জানার ইচ্ছে এবং আমি খুবই কৃতজ্ঞ হতাম যদি এই শিক্ষকদের কেউ আমাকে জানাতেন এই ধরনের একটা কথোপকথনের পর তাদের ছেলেমেয়েরা কী বলেছে।
২.
পৃথিবীর যেকোনো দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং গুণী মানুষ। সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী, সবচেয়ে বড় মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ এবং সম্ভবত জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। তাই সাধারণ মানুষ যখন দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন দেশের নাগরিককে জেলখানার মতো একটা ঘরে আটকে রাখছে তখন তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে যায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘আন্দোলন’।
মনে হয় আন্দোলন বলা হলেই পুরো বিষয়টাকে ন্যায়সঙ্গত, প্রগতিশীল, সত্যের জন্যে সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দেখা গেল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সংগ্রামী সকল নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্যে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কোনো একজন মানুষকে জোর করে একটা ঘরে আটকে রাখা হলে কাউকেই কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়তে হয় না বরং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাদের নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে যান। সোজা কথায় এতো বড় একটা অনৈতিক এবং বেআইনি বিষয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়।
এই দেশে বিষয়টা অবশ্য নতুন নয়। কাউকে জিম্মি করে কোনো একটা দাবি আদায় করে নেয়া এই দেশের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যারা ভদ্রতা করে এটা করে না তাদের মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমি নিজের কানে এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘এমনিতে কাজ হবে না, গিয়ে ঘেরাও কর, রাস্তাঘাটে কিছু ভাংচুর কর তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে।’
তাই দাবি আদায়ের জন্যে কাউকে জিম্মি করে ফেলা যে একটি বেআইনি কিংবা অত্যন্ত অমানবিক কাজ হতে পারে সেটা কেউ মনে পর্যন্ত করে না।
শুধু যে দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মহোদয় এই ধরনের বেআইনি কাজকে নিজের অজান্তেই গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন তা নয়, আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাও তাদের কাজকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। তারা দুই পক্ষকেই সমানভাবে নিজেদের বক্তব্য রাখতে দিচ্ছেন, পত্রিকার পাশাপাশি পৃষ্ঠায় তাদের বক্তব্য ছাপা হচ্ছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। সব কিছু যে বুঝতে পেরেছি সেটা দাবি করব না।
আমি বহুকাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি তাই একটা জিনিস জেনেছি, প্রকাশ্যে যে কথাগুলো বলা হয় সেগুলো সব সময় পুরো কথা নয়, আসল কথা নয়। প্রকাশ্য কথার পিছনে অপ্রকাশ্য কথা থাকে, গোপন এজেন্ডা থাকে অনেক সময় দেখা গেছে সেগুলোই মূল ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অপরাধের ব্যাপারে কোনটা সত্যিকার কথা সেটা জানি না। তবে অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে শাস্তি হবে কিন্তু আগেই নিজেরা শাস্তি দিয়ে একজনকে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে সেটি কোন দেশের বিচার?
পনেরো দিন পরে কী হবে আমরা জানি না। তবে একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা খুব ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি হল। কোনো একজন মানুষকে পছন্দ না হলে তাকে সরানোর জন্যে কয়েকজন (কিংবা অনেকজন) মানুষ একত্র হয়ে তাকে একটা ঘরে আটকে ফেলতে পারবেন- এর জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, দেশের আইন তাদের স্পর্শ করবে না। যেসব শিক্ষকরা অপছন্দের মানুষকে ঘরের ভেতর আটকে ফেলার কালচার চালু করলেন, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভাইস চ্যান্সলর হবেন। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব খুব কঠিন দায়িত্ব। নিশ্চিতভাবেই তখন তারা সবাইকে সমানভাবে খুশি করতে পারবেন না। তখন তাদেরকে যখন অন্য শিক্ষকেরা ঘরের মাঝে বন্দি করে ফেলবেন তখন তারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন কী না জানার ইচ্ছে করে।
৩.
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া করানোর জন্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন মনে হয় সেটা কারো মনে নেই। অনেকেরই ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিটি বুঝি তার নিজের সুখ সুবিধার জন্যে। নিজেদের ‘অধিকার’ আদায় করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়টি যদি পুরোপুরি চাপা পড়ে যায় তাতেও কেউ কিছু মনে করে না। ছাত্রছাত্রীদের কারণে, ধর্মঘট, মারামারি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ করে রেখেছেন সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। উদাহরণটি খুব ভালো নয়, সারা দেশে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর খুব বড় একটা গ্লানি নেমে এসেছে। এই গ্লানি থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় না।
৪.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে আজ থেকে ছয় বছর আগে ঠিক এই রকম সময়ে মিলিটারি সরকার গ্রেফতার করেছিল। তার লেখা বইয়ে আমি পড়েছি চোখ বেঁধে তাকে নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেয়া হতো। তাই আমরা জানি তার জেল খাটার অভিজ্ঞতা এবং মিলিটারি অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো রকমই আছে। আপাতত শিক্ষকদের চারদিনের রিমান্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন, পনেরো দিন পর যখন আবার শিক্ষকরা তাকে তাদের জেলখানা রিমান্ডে নিয়ে যাবেন আমি আশা করছি তিনি যেন ধৈর্য ধরে সেটা সহ্য করতে পারেন।
ছয় বছর আগে তাকে যখন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন আমি আর আমার স্ত্রী তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সাহস দিতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। পনেরো দিন পর যখন শিক্ষকরা আবার তাকে ঘরে আটকে ফেলবেন তখন হয়তো আমাদের আবার তার বাসায় গিয়ে স্ত্রী পুত্র কন্যাকে সাহস দেয়ার কথাÑ কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি তাদেরকে এবার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
লেখক, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আমার মতোন শিক্ষকরা সেই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে আটকে রেখেছেন। খবরে জেনেছি এই মুহূর্তে দয়া করে পনেরো দিনের জন্যে দম নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্ভবত আবার নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে।
আগেই বলে রাখি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তার শিক্ষকদের ভিতর কী সমস্যা সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছি না। শিক্ষকরা বলছেন তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তারপরেও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটকে রেখেছেন সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না। পত্রপত্রিকার লেখালেখি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
আমাদের দেশে লেখালেখির একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়েছে। সবারই একটা নিরপেক্ষতার ভান করতে হবে। তাই কেউ যদি গুরুতর অন্যায়ও করে সোজাসুজি স্পষ্ট করে কেউ লেখে না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে লেখে- যেন কেউ কিছু বলতে না পারে। আজকাল পত্রপত্রিকায় ইলেকট্রনিক ভার্সন রয়েছে। সেখানে কোনো লেখা ছাপা হলে তার লেজে পাঠক আবার ভুল বানান এবং অমার্জিত ভাষায় যা কিছু লিখতে পারে! সবাই ভয়ে ভয়ে লেখে, কার আর সত্যি কথা বলে গালমন্দ খেতে ভালো লাগে? আমি অবশ্যি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে দুর্বোধ্যভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি না- একেবারে সোজাসুজি বলছি, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে দিনের পর দিন আটকে রাখা খুব বড় একটা অন্যায় কাজ। কথাটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মানুষটি একজন ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে যদি একজন জুনিয়র লেকচারার কিংবা একজন অপরিচিত ছাত্রও হতো, তাকেও একটা ঘরের মাঝে আটকে রাখা গুরুতর একটি অন্যায়।
স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না। আমি আইনের মানুষ নই। কিন্তু আমার ধারণা দেশের আইনে এটা নিশ্চয়ই একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা এ কাজটি করছেন আমার এ লেখাটি তাদের চোখে পড়বে কিনা আমি জানি না। যদি পড়ে তাহলে তাদের প্রতি আমার একটা ছোট অনুরোধ। ঘরে তাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই কমবয়সী ছেলেমেয়ে আছে। পনেরো দিন পর তারা আবার যখন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলবেন, তখন তারা রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে নিচের এই বাক্যালাপগুলো করবেন!
তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বলবেন, ‘বাবা, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটা বিশাল কাজ করে এসেছি!’ ছেলেমেয়েরা তখন বলবে, ‘কী কাজ বাবা (কিংবা কী কাজ মা?)’ তখন তারা বলবেন, ‘আমাদের একজন ভাইস চ্যান্সেলর আছেন, তাকে আমরা দু’চোখে দেখতে পারিনা। তাই তাকে আমরা তার অফিসে আটকে রেখেছি। সেখান থেকে তাকে আমরা বের হতে দিই না।’
আমি ছোট বাচ্চাদের যেটুকু জানি তাতে আমার ধারণা তখন তারা চোখ বড় বড় করে বলবে, ‘বের হতে দাও না?’
‘হ্যাঁ, জেলখানায় যেরকম কেউ বের হতে পারে না, সেরকম। তাকে আমরা অফিস থেকে বের হতে দিই না। জেলখানার মতো আটকে রেখেছি।’
বাক্যালাপের এরকম পর্যায়ে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমাদের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেমেয়ে নেই? তারা কী বলে?’
‘তাদের আবার বলার কী আছে? একটা মেয়ে শুনেছি লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়েছে। তাকেও বিদায় জানাতে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে এয়ারপোর্টে যেতে দেইনি।’
বাচ্চাগুলো তখন নিশ্চয়ই শুকনো মুখে তাদের বাবা কিংবা মায়ের মুখের দিকে তাকাবে, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘সত্যি?’
শিক্ষকরা তখন বলবেন, ‘হ্যাঁ। উচিৎ শিক্ষা হচ্ছে। তোমরা যখন বড় হবে তখন তোমাদের যদি মানুষকে অপছন্দ হয় তাহলে তোমরাও তাকে এভাবে একটা ঘরে আটকে ফেলবে। বের হতে দেবে না!’
আমার ধারণা শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা আলোচনার এই পর্যায়ে এক ধরনের আহত এবং আতংকিত দৃষ্টিতে তাদের বাবা (কিংবা মা) এর দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আমার খুব জানার ইচ্ছে এবং আমি খুবই কৃতজ্ঞ হতাম যদি এই শিক্ষকদের কেউ আমাকে জানাতেন এই ধরনের একটা কথোপকথনের পর তাদের ছেলেমেয়েরা কী বলেছে।
২.
পৃথিবীর যেকোনো দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং গুণী মানুষ। সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী, সবচেয়ে বড় মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ এবং সম্ভবত জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। তাই সাধারণ মানুষ যখন দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন দেশের নাগরিককে জেলখানার মতো একটা ঘরে আটকে রাখছে তখন তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে যায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘আন্দোলন’।
মনে হয় আন্দোলন বলা হলেই পুরো বিষয়টাকে ন্যায়সঙ্গত, প্রগতিশীল, সত্যের জন্যে সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দেখা গেল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সংগ্রামী সকল নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্যে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কোনো একজন মানুষকে জোর করে একটা ঘরে আটকে রাখা হলে কাউকেই কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়তে হয় না বরং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাদের নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে যান। সোজা কথায় এতো বড় একটা অনৈতিক এবং বেআইনি বিষয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়।
এই দেশে বিষয়টা অবশ্য নতুন নয়। কাউকে জিম্মি করে কোনো একটা দাবি আদায় করে নেয়া এই দেশের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যারা ভদ্রতা করে এটা করে না তাদের মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমি নিজের কানে এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘এমনিতে কাজ হবে না, গিয়ে ঘেরাও কর, রাস্তাঘাটে কিছু ভাংচুর কর তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে।’
তাই দাবি আদায়ের জন্যে কাউকে জিম্মি করে ফেলা যে একটি বেআইনি কিংবা অত্যন্ত অমানবিক কাজ হতে পারে সেটা কেউ মনে পর্যন্ত করে না।
শুধু যে দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মহোদয় এই ধরনের বেআইনি কাজকে নিজের অজান্তেই গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন তা নয়, আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাও তাদের কাজকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। তারা দুই পক্ষকেই সমানভাবে নিজেদের বক্তব্য রাখতে দিচ্ছেন, পত্রিকার পাশাপাশি পৃষ্ঠায় তাদের বক্তব্য ছাপা হচ্ছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। সব কিছু যে বুঝতে পেরেছি সেটা দাবি করব না।
আমি বহুকাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি তাই একটা জিনিস জেনেছি, প্রকাশ্যে যে কথাগুলো বলা হয় সেগুলো সব সময় পুরো কথা নয়, আসল কথা নয়। প্রকাশ্য কথার পিছনে অপ্রকাশ্য কথা থাকে, গোপন এজেন্ডা থাকে অনেক সময় দেখা গেছে সেগুলোই মূল ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অপরাধের ব্যাপারে কোনটা সত্যিকার কথা সেটা জানি না। তবে অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে শাস্তি হবে কিন্তু আগেই নিজেরা শাস্তি দিয়ে একজনকে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে সেটি কোন দেশের বিচার?
পনেরো দিন পরে কী হবে আমরা জানি না। তবে একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা খুব ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি হল। কোনো একজন মানুষকে পছন্দ না হলে তাকে সরানোর জন্যে কয়েকজন (কিংবা অনেকজন) মানুষ একত্র হয়ে তাকে একটা ঘরে আটকে ফেলতে পারবেন- এর জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, দেশের আইন তাদের স্পর্শ করবে না। যেসব শিক্ষকরা অপছন্দের মানুষকে ঘরের ভেতর আটকে ফেলার কালচার চালু করলেন, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভাইস চ্যান্সলর হবেন। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব খুব কঠিন দায়িত্ব। নিশ্চিতভাবেই তখন তারা সবাইকে সমানভাবে খুশি করতে পারবেন না। তখন তাদেরকে যখন অন্য শিক্ষকেরা ঘরের মাঝে বন্দি করে ফেলবেন তখন তারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন কী না জানার ইচ্ছে করে।
৩.
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া করানোর জন্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন মনে হয় সেটা কারো মনে নেই। অনেকেরই ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিটি বুঝি তার নিজের সুখ সুবিধার জন্যে। নিজেদের ‘অধিকার’ আদায় করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়টি যদি পুরোপুরি চাপা পড়ে যায় তাতেও কেউ কিছু মনে করে না। ছাত্রছাত্রীদের কারণে, ধর্মঘট, মারামারি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ করে রেখেছেন সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। উদাহরণটি খুব ভালো নয়, সারা দেশে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর খুব বড় একটা গ্লানি নেমে এসেছে। এই গ্লানি থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় না।
৪.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে আজ থেকে ছয় বছর আগে ঠিক এই রকম সময়ে মিলিটারি সরকার গ্রেফতার করেছিল। তার লেখা বইয়ে আমি পড়েছি চোখ বেঁধে তাকে নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেয়া হতো। তাই আমরা জানি তার জেল খাটার অভিজ্ঞতা এবং মিলিটারি অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো রকমই আছে। আপাতত শিক্ষকদের চারদিনের রিমান্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন, পনেরো দিন পর যখন আবার শিক্ষকরা তাকে তাদের জেলখানা রিমান্ডে নিয়ে যাবেন আমি আশা করছি তিনি যেন ধৈর্য ধরে সেটা সহ্য করতে পারেন।
ছয় বছর আগে তাকে যখন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন আমি আর আমার স্ত্রী তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সাহস দিতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। পনেরো দিন পর যখন শিক্ষকরা আবার তাকে ঘরে আটকে ফেলবেন তখন হয়তো আমাদের আবার তার বাসায় গিয়ে স্ত্রী পুত্র কন্যাকে সাহস দেয়ার কথাÑ কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি তাদেরকে এবার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
লেখক, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments