ভয়াবহ ঝুঁকিতে কাঁচপুর সেতু-জাইকার অর্থায়নে ৩২৫৩ কোটি টাকা খরচে কাঁচপুর, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে by পার্থ সারথি দাস

রাজধানীর সঙ্গে দেশের পূর্বাঞ্চলের ১৬ জেলার সংযোগকারী ও রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার কাঁচপুর সেতু ঝুঁকির মুখে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু সংস্কারে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। চলতি সপ্তাহে এ সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।


কিন্তু সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের অভাবে ৩৫ বছরের কাঁচপুর সেতুতে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছেই। সংস্কারের উদ্যোগ না নিলেও জাপান সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার ভরসায় কাঁচপুর সেতুর পাশে আরো একটি সেতু (দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু) নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতুও নির্মাণ করা হবে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) নিয়োগ করা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে দ্বিতীয় কাঁচপুরসহ তিনটি নতুন সেতুর নির্মাণ ব্যয়, সময় ও সেতুর ধরন (টাইপ) বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সভা করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রস্তাবিত দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১১ কোটি টাকা। আড়াই বছরে এটি নির্মাণ করা হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছায়েদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জাইকার অর্থায়নে তিনটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে। একটি সেতু হবে বিদ্যমান কাঁচপুর সেতুর পাশে। কাঁচপুর সেতু ঝুঁকিমুক্ত রাখতে আমরা সচেষ্ট আছি। নতুন তিনটি সেতুর ব্যয় ও ধরন চূড়ান্ত করা হয়েছে।'
কাঁচপুর সেতু ঝুঁকিপূর্ণ : শত বছরের স্থায়িত্বের লক্ষ্য নিয়ে নির্মিত ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার কাঁচপুর সেতু এখন বিধ্বস্তপ্রায়। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি রাজধানীর সঙ্গে দেশের পূর্বাঞ্চলের ১৬ জেলার সংযোগ স্থাপন করেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা গেছে, সংস্কারের অভাব, যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে সেতুটি ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া সেতুর পিলারের সঙ্গে মালবাহী নৌযানের ধাক্কা, সেতুর পিলারে শিকল বেঁধে মালবাহী জাহাজ থেকে মালামাল খালাস এবং সেতু এলাকায় অবৈধ দখলদারদের তৎপরতার কারণে সেতুটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সেতুর নিচে মেশিন বসিয়ে পাথর ভাঙার কারণে সেতুটি আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। সেতুটিতে এখন যানজটও প্রকট রূপ নিয়েছে। ১৪ বছর ধরে সেতু দেখভালেও নেই কোনো ব্যবস্থা।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জাইকা পরামর্শক দলের দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাঁচপুর সেতুর এক্সপানশন জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেতুর ফাউন্ডেশনে দৃশ্যমান ফাটলও রয়েছে। গত সোমবার দুপুরে সেতু এলাকায় গেলে যানজট চোখে পড়ে। ওই সময় যানজটে আটকে থাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের চালক মো. মুহিবুর রহমান বলেন, ব্রিজের অবস্থা ভালো না। সাবধানে, কম গতিতে গাড়ি চালাতে হয়।
সওজ নারায়ণগঞ্জ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, 'সেতুটি ঝুঁকিমুক্ত রাখতে আমরা সচেষ্ট আছি।'
সওজ সূত্রে জানা গেছে, জাপান সরকারের অর্থায়নে ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ৩৯৬ মিটার দীর্ঘ ও ১৫ মিটার প্রস্থ সেতুটি ২৪০ টন ওজন ধারণে সক্ষম। শুরুর দিকে দিনে গড়ে ১০০-১৫০টি যানবাহন চলাচল করত। সওজের সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, এখন সেতু দিয়ে কমপক্ষে ২২ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেতুতে তেমন যানজট দেখা যেত না। যানবাহনের চাপের কারণে কাঁচপুর সেতু এখন আতঙ্কের নাম। সেতু দিয়ে ধারণক্ষমতার চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে।
সওজ প্রকৌশলীদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন সেতুর ওপর দিয়ে পাঁচ থেকে ১০০ টন পর্যন্ত ওজনবাহী যান চলাচল করছে। ১০০ টন পর্যন্ত ওজন বহনকারী লং ট্রাকের সংখ্যা প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০টি। দিনের চেয়ে রাতের যানজটে সেতুটির ওপর চাপ পড়ে বেশি। রাতে যানজটে সেতুটির ওপর ২৫০-৩০০টি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলোর বেশির ভাগই মালবোঝাই ভারী ট্রাক। প্রতিটি গাড়ির মালসহ ওজন গড়ে ২০ টন করে হলেও সেতুটির ওপর ওজন পড়ে কমপক্ষে ছয় হাজার টন। এই ওজন সেতুর ওজন ধারণক্ষমতার তিন গুণ। পিলারের ওপর চাপ কমাতে যেসব এক্সপানশন জয়েন্ট রয়েছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না ঠিকমতো। নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দিলীপ কুমার দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বহুদিন ধরে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ। টাকা না থাকলে আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করব কিভাবে? আগের চেয়ে যানবাহন বহুগুণ বেড়েছে। আরো একটি সেতু হলে এই চাপ কমে যাবে। আরেক উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেতু এলাকা থেকে মাটি কেটে নেওয়া হয় এ অভিযোগ সঠিক নয়। যাতে মাটি কেউ কেটে নিতে না পারে তার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন ডিসেম্বরের মধ্যে : নতুন তিনটি সেতু নির্মাণের জন্য জাইকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কম্পানি লিমিটেড ও কাটাহিরা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার ইন্টারন্যাশনালকে। দুটো প্রতিষ্ঠান কাঁচপুর, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী এ তিনটি সেতুর সংস্কার ও বিদ্যমান সেতুগুলোর পাশাপাশি চার লেনের তিনটি নতুন সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা জরিপকাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দুটো প্রাথমিক সমীক্ষা শেষ করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্ভাব্যতা জরিপকাজের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। নতুন তিনটি সেতুর অবস্থান অনুমোদন করেছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু বিদ্যমান কাঁচপুর সেতুর ভাটিতে, দ্বিতীয় মেঘনা সেতু বিদ্যমান মেঘনা সেতুর উজানে ও দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু বিদ্যমান মেঘনা-গোমতী সেতুর উজানে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রাথমিক সমীক্ষায় প্রস্তাবিত তিনটি সেতু কী ধরনের (Type) হতে পারে সে বিষয়ে কারিগরি ও আর্থিক প্রতিবেদন এবং ভবিষ্যৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যয়সাশ্রয়ী প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
জাইকা নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কম্পানি লিমিটেড ও কাটাহিরা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার ইন্টারন্যাশনাল একটি বিশ্লেষণধর্মী সারণির মাধ্যমে তিনটি সেতুর চার ধরনের কাঠামোর প্রস্তাব করে। এর মধ্যে কন্টিনিউয়াস স্টিল ন্যারো বক্স গার্ডার ব্রিজ টাইপকে বাছাই করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ২৯ জুলাই এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে বুয়েট ও সওজের প্রকৌশলীরা মতামত দেন। এ ধরনের সেতুর আকার হবে বাক্সের মতো। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের সেতুর স্থায়িত্ব পর্যাপ্ত ও ভূমিকম্প প্রতিরোধকতা সুবিধাজনক। নির্মাণ পদ্ধতি ও মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি স্বাভাবিক।
অন্য তিনটি ধরনের ক্ষেত্রে প্রতিটির ৩০ বছরে একবার রংকরণ বা কার্বোনেশনের প্রয়োজন। কিন্তু এ ধরনের সেতুর প্রতি ৫০ বছরে একবার গার্ডারের উপরিভাগের পরিচর্যা প্রয়োজন হবে। এই ধরনে নির্মাণ করলে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মাণে সময় লাগবে তিন বছর। সেতুর বিয়ারিংসহ পিয়ার-সংখ্যা হবে ১১টি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরেছে প্রায় এক হাজার ৯৩ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণে সময় লাগবে তিন বছর। এটির বিয়ারিংসহ পিয়ার-সংখ্যা হবে ১৬। সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় এক হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা।

No comments

Powered by Blogger.