দুই মাস পরই শতবর্ষী হতেন by রফিক-উন-মুনীর চৌধুরী

র্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনেস এইরেসে চলতি বইমেলায় বিশেষ সম্মাননা জানানোর প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু সব থেমে গেল। চলে গেলেন এর্নেস্তো সাবাতো। গত ৩০ এপ্রিল শনিবার ভোরবেলা বুয়েনেস এইরেসের উপকণ্ঠের সান্তোস লুগারেস এলাকায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন সাবাতো। বয়স হয়েছিল, শরীর ভেঙে পড়েছিল, বহুদিন হয় আর লিখতে পারেননি, এ রকম অবস্থায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে গেলেন।
হিস্পানি বিশ্বে আধুনিক কালের আর্জেন্টিনার সাহিত্যের গুরু হলেন লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬), হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-১৯৮৪), আদোলফো বিওই কাসারেস (১৯১৪-১৯৯০) এবং এর্নেস্তো সাবাতো। বোর্হেস হলেন গুরুদের গুরু। বোর্হেস আর কোর্তাসারের খ্যাতি জগদ্ব্যাপী হলেও সাবাতোকে অতটা কেউ চেনে না, কিন্তু হিস্পানি বিশ্বে তাঁর খ্যাতি গেল শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই। বোর্হেস ও বিওই কাসারেসের পর তিনি হলেন একমাত্র আর্জেন্টিনার কথাশিল্পী, যিনি সের্বান্তেস পুরস্কারে (হিস্পানি সাহিত্যের নোবেল) ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যের দুর্ভাগ্য যে তাঁদের কেউই নোবেল পুরস্কার পাননি।
ইতালিয়ান বাবা ও আলবেনিয়ান মায়ের সন্তান সাবাতো হলেন বিংশ শতাব্দীর অনন্য সাধারণ আর্জেন্টিনার চিন্তক এবং লেখকদের একজন। বোর্হেস ও কোর্তাসারের খ্যাতি মূলত তাঁদের ছোটগল্পকে ঘিরে, আর সাবাতোর খ্যাতি মূলত ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে। মনে পড়ে, আমার গুরুতুল্য শিক্ষক হুয়ান আন্তেলিও মাসোলিবের স্প্যানিশ সম্মান কোর্সের প্রথম বর্ষে আমাদের এল তুনেল (দ্য টানেল, ১৯৪৮) পড়াতেন। কূটাভাসে ভরপুর স্বরভঙ্গির নৈরাশ্যবাদী, মনস্তাত্ত্বিক নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি পঠনের পর লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের শক্তিমত্তা সম্পর্কে উপলব্ধি ঘটেছিল তখন। নৈরাশ্যবাদ তাঁর পরবর্তী কালের সমস্ত রচনারই অন্যতম মুখ্য বৈশিষ্ট্য। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস সোব্রে এরোয়েস ই তুম্বাস (অন হিরোস অ্যান্ড টম্বস) প্রকাশের পর তাঁর খ্যাতি বহুগুণ বেড়ে যায়। তিনি হিস্পানি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক লেখকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। আর্জেন্টিনার সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত সাহিত্যকর্মের একটি এই উপন্যাস, যেটিতে গভীর অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে প্রতীকীভাবে উঠে এসেছে আর্জেন্টিনার অতীত ও বর্তমান ইতিহাস। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা কিশোর মার্তিন এবং অধঃপতিত একটি ঐতিহ্যবাহী আর্জেন্টিনার পরিবারের মেয়ে আলেহান্দ্রা বিদালের প্রণয়কাহিনিটি গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের আর্জেন্টিনার উত্তাল সামাজিক ও রাজনৈতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত। শুধু আর্জেন্টিনার নয়, বরং লাতিন আমেরিকা এবং মানবিক পরিস্থিতির একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা এই উপন্যাস। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রহেলিকায় দুরন্ত, বিয়োগান্তক ও বিক্ষুব্ধ ইতিহাসের এক আর্জেন্টিনার রূপক যেন এই উপন্যাস। এ দুটি উপন্যাস ছাড়াও তিনি আরেকটি উপন্যাস লিখেছেন, যার নাম আস্তাদোন এল এক্সতের্মিনাদোর (অ্যাঞ্জেল অব ডার্কনেস, ১৯৭৪)।
সাবাতো মানুষের স্বাধীনতা ও সাম্যের জন্য লড়াই করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। উপন্যাস আর প্রবন্ধ ছাড়াও আর্জেন্টিনার ইতিহাসে তিনি আরেকটি কারণে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণের এই দেশ সামরিক স্বৈরশাসনে পিষ্ট হয়। সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই তৎকালীন স্বৈরশাসক জেনারেল হোর্হে বিদেলার নিমন্ত্রণে সাবাতো দুপুরের আহারেও যোগ দেন (সেদিন তাঁর সঙ্গে বোর্হেসও ছিলেন), যে ঘটনার জন্য পরবর্তীকালে তিনি অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে স্বৈরশাসনের পতনের পর প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাউল আলফোন্সিনের অনুরোধে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কমিশন কোনাদেপের দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসনামলে গুম হওয়া আট হাজার ৯৬০ জন নর-নারী-শিশু এবং ৩৪০টি অবৈধ নির্যাতনকেন্দ্র ও কারাগারের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা ছিল ওই কমিশনের কাজ। সাবাতোর নেতৃত্বাধীন ওই কমিশন তদন্ত রিপোর্টটি ১৯৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর লাখ লাখ আর্জেন্টিনার জনগণকে সাক্ষী রেখে প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেয়, যা আর্জেন্টিনার সমকালীন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তদন্ত রিপোর্টটির নাম ‘নুনকা মাস’ (আর কখনোই না), যা ‘সাবাতো রিপোর্ট’ নামেই সমধিক পরিচিত।
পেশাগত জীবনের শুরুতে পদার্থবিদ হিসেবে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চাকরি করা সাবাতো পরবর্তীকালে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হন এবং আর্জেন্টিনার কালজয়ী সাহিত্যগোষ্ঠী সুরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ও বোর্হেসের সঙ্গে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। বোর্হেসের সঙ্গে তাঁর সংলাপের একটি বই আছে: দিয়ালোগোস কোন হোর্হে লুইস বোর্হেস, ১৯৭৬।
সাবাতোর কাছে মানুষ এক রহস্যের নাম, যে রহস্য জানতে-বুঝতে তিনি নিরন্তর চালিয়ে গেছেন অনুসন্ধান। স্বস্তিহীন এই বিশ্ব ও মানুষের সংকটের জটিলতাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের জন্য রেখে গেলেন এক অমূল্য সাহিত্যকর্ম। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির বিদেহী আত্মার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
==========================
বিভাস বিস্মৃতির মেট্রো পরাশর  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(দশ)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(নয়)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(আট)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(সাত)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(ছয়)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(পাঁচ)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(চার)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(তিন)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(দুই)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(এক)  গল্প- পৃথিবীর দীর্ঘতম হাত  কালা পানির অনশন  লেখক না হলে গোয়েন্দা হতাম  অভিবাসী মানুষদের উপন্যাস  আগুনের পরশমণি  প্রেমাংশুর রক্ত চাই  গল্প- কোথায় তুমি  কবিতা বাতাসে অক্সিজেন ছড়ায়  সত্যজিৎ আমার গুরু ছিলেন  গল্প- দৌড়  বাংলা ঋতু-মাসের নামবিচার  যেভাবে মায়ের মন জয় করল বাবা  মানিক পীরের গান  গল্প- চুপি চুপি বাঁশি বাজে  গল্প- বিধুহীন  গল্প- অসমাপ্ত চুম্বনের ১৯ বছর পর...  গল্প- বসন্ত বিলাপ  খোয়াবের প্রতিলিপি  গল্প- জিঞ্জির ফেরা  দুর্লভ সময়ের হলফনামা  ইচ্ছা ছিল কবি হওয়ার  আমার গ্রন্থাগার  সোনার কমলার খোঁজে  রূপবান ঢাকার রক্তক্ষরণ  নারী জীবনের অচলায়তন  'ত্যাগের' মূল্যায়ন ও মুক্তকণ্ঠ তারুণ্য  মূল সংবিধান সংরক্ষণে সরকারের ইউটার্ন  তুরস্কে জেনারেলদের পদত্যাগ কেন?  ছোট দলগুলো ফুরফুরে মেজাজে!  কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষার বেহাল দশা  গল্প- লঞ্চের আপার ক্লাসে বাচ্চা হাতি  গুরুপল্লির আশ্রমে ভর্তি না হয়েই  মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই  মগ্নচৈতন্যের বর্ণময় অভিঘাত  গল্প- চিনেজোঁক  পুস্তক প্রকাশনা ও বাংলা একাডেমীর বইমেলা  শাহি মনজিলে সাহিত্য উৎসব by শাহীন আখতার  বাজে জসীমউদ্দীন  নান্দনিক চৈতন্য  গ্রামকে শহরে এনেছি  গল্প- জলঝড়  প্রাচ্যের ছহি খাবনামা  গল্প- এভাবেই ভুল হয়  গল্প- মাঠরঙ্গ


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ রফিক-উন-মুনীর চৌধুরী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.