আঞ্চলিক বৈষম্য ও সিলেট বিভাগ by সমীর রঞ্জন নাথ ও রাশেদা কে চৌধুরী
প্রাকৃতিক সম্পদ আর জনসাধারণের সাধারণ অর্থনৈতিক সামর্থ্যের নিরিখে সিলেট বিভাগ বেশ সমৃদ্ধিশালী। অথচ সামাজিক সাফল্যের নিরিখে এর অবস্থান তত ভালো নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের অনগ্রসরতার কারণ অনুসন্ধান এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে এডুকেশন ওয়াচ-এর সর্বশেষ গবেষণায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের এ প্রবন্ধ উপর্যুক্ত গবেষণার প্রধান কিছু ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে রচিত।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের শহরাঞ্চল ছাড়া পুরো জনপদেই শিশুদের বিদ্যালয়ে অভিগম্যতার হার জাতীয় পর্যায়ের গড় হারের তুলনায় কম। সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় এবং হাওর ও চা-বাগান এলাকায় এই হার জাতীয় পর্যায়ের গড় হারের অনেক নিচে। যেখানে সিলেট বিভাগের ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ গ্রামে শুধু কাঁচা রাস্তা রয়েছে। সেখানে হাওরাঞ্চলের ৫৪ শতাংশ গ্রামের অবস্থাই এ রকম। প্রধান শিক্ষকেরা জানালেন, শুকনো মৌসুমে যেখানে এক-পঞ্চমাংশ শিক্ষার্থীকে ‘খারাপ’ রাস্তাঘাট পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়, সেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক শিক্ষার্থীকে এই অবস্থায় পড়তে হয়। এ অবস্থা শিশুদের শিক্ষায় নিরুৎসাহিত করে।
সাধারণভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিশুদের তুলনায় সিলেট বিভাগের শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয় দেরিতে, আবার আগাম ঝরে পড়ার হারও বেশি। বয়সভিত্তিক নিট ভর্তি হারের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সিলেটের প্রতিটি বয়স গ্রুপের শিশুদের নিট ভর্তি হার এ-সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে কম। যেখানে বাংলাদেশের ছয় বছর বয়সী শিশুদের ৬৫ শতাংশ স্কুলে ভর্তি হয়, সেখানে সিলেট বিভাগের একই বয়সী শিশুদের মধ্যে এই হার মাত্র ৫২ শতাংশ। শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর বয়স সম্পর্কে অভিভাবকেরা অবহিত না থাকা এবং স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পরও ভর্তি করে না নেওয়া অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে। অবশ্য অভিভাবকদের একটি অংশ ভর্তি না করানোর কোনো কারণ বলতে পারেননি। শিশুর বয়স ১৫ বছর হতেই সমতল ভূমির অর্ধেক শিশু, হাওরাঞ্চলের ৬০ শতাংশ শিশু এবং চা-বাগান, পাহাড় ও বনভূমির ৭৩ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুতে পরিণত হয়। এ-সংক্রান্ত তুলনামূলক জাতীয় হার ৪০ শতাংশেরও নিচে। ঝরে পড়া শিশুদের একটি অংশের পরিবারগুলো পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করতে নিতান্তই অপারগ, আর অন্যরা অল্প বয়সেই আয়-উপার্জনের জন্য নানা ধরনের কাজে যোগ দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষণ-শিখনের দুর্বল মান, শেখানোর ক্ষেত্রে যত্নের অভাব শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
অভিভাবকেরা সার্বিকভাবে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন। এমনকি দরিদ্র পরিবারের মা-বাবাদের ক্ষেত্রেও শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু তাঁরা যখন শিশুর শিক্ষালাভকে তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়টি প্রাধান্য লাভ করে। এ কারণেই সিলেটের গ্রামীণ এলাকায় শিশুশ্রমের ব্যাপক প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। এই শিশুদের কেউ অর্থের বিনিময়ে আবার কেউ বা বিনা মূল্যে শ্রম দান করে। এর সঙ্গে যোগ হয় উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিদেশ যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে। এ বিষয়গুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা সামগ্রিকভাবে ‘অভিভাবকদের অসচেতনতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। এ ব্যাপারে তেমন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট বিভাগে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম নেই। কিন্তু এখানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। এটি অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কম বিনিয়োগের লক্ষণ। সিলেটের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকস্বল্পতা পাওয়া গেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা আর প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির দিক থেকে সিলেট বিভাগের শিক্ষকেরা অবশ্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষকদের মতোই। নারী শিক্ষকের অনুপাতে সিলেট বিভাগ এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক-চতুর্থাংশ শহর এলাকায় বসবাস করেন।
বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকা, কার্যদিবসে দেরিতে উপস্থিত হওয়া ও বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করার দিক থেকে সিলেট বিভাগের শিক্ষকেরা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষকদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। এসব এলাকার এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক জরিপের দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। নারী শিক্ষক ও হাওর এলাকার শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিতির হার বেশি পাওয়া গেছে।
জরিপের দিন যেসব শিক্ষক বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অল্পসংখ্যকই সময়ানুবর্তিতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই সমস্যার ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে। এ কারণে একজন প্রাথমিক শিক্ষক দৈনিক গড়ে ৫৬ মিনিট আর একজন মাধ্যমিক শিক্ষক দৈনিক গড়ে ৪৮ মিনিট শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ সময়ের অপচয় করেছেন। সময় নষ্ট করার নিরিখে পুরুষ শিক্ষকেরা নারী শিক্ষকদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ সময়ের একটি বড় অংশই এ কারণে অপচয় হয়, যা শিক্ষার্থীদের শিখন, সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম এবং আচরণে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটি বিদ্যালয় শৃঙ্খলারও পরিপন্থী।
বিদ্যালয় পরিচালনার মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কর্মোদ্যোগ খুব কমই লক্ষ করা গেছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। আবার বেশ কটি মাত্র এক বা দুবার পরিদর্শন করা হয়েছে–যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উপজেলা রিসোর্স সেন্টার থেকে পরিদর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়া গেছে। বিদ্যালয় পরিদর্শন সাধারণভাবে খুবই সাদামাটাভাবে করা হয়ে থাকে। পরিদর্শনকালে যা আলোচনা হয়, সেগুলো সরাসরি শিক্ষার মানোন্নয়নের সমস্যা বা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তার অভাব একটি বড় কারণ হিসেবে বের হয়ে এসেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী করা যেতে পারে? জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সমতা বিধানের যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিকেন্দ্রীকৃত শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকে জোরালোভাবে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। চা-বাগানে শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় বাগান ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহণ বিবেচনায় নিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে হাওর এলাকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ওয়াটার বাস চালু করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রসারে যেসব ইতিবাচক কর্মসূচি রয়েছে (যেমন উপবৃত্তি ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি) সেগুলো সিলেটের কোনো কোনো অঞ্চলে বর্ধিত আকারে বিস্তৃত করা যেতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা এবং বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকসংখ্যা বাড়ানো দরকার। হাওর, চা-বাগান ও পাহাড়ের মতো দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়সমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বিদ্যালয় পর্যায়ে জবাবদিহি ও পরিদর্শনের মান বাড়ানো দরকার।
সবশেষে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অভিগম্যতার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের যে সমতা অর্জিত হয়েছে ও নারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যে অগ্রগতি লাভ করা গেছে, তা বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যথাযথ কৌশল নির্ধারণ ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের দিকে নজর দেওয়া দরকার।
সমীর রঞ্জন নাথ, গবেষণা সমন্বয়ক, ব্র্যাক।
nath.sr@brac.net
রাশেদা কে চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান।
rasheda@campebd.org
গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের শহরাঞ্চল ছাড়া পুরো জনপদেই শিশুদের বিদ্যালয়ে অভিগম্যতার হার জাতীয় পর্যায়ের গড় হারের তুলনায় কম। সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় এবং হাওর ও চা-বাগান এলাকায় এই হার জাতীয় পর্যায়ের গড় হারের অনেক নিচে। যেখানে সিলেট বিভাগের ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ গ্রামে শুধু কাঁচা রাস্তা রয়েছে। সেখানে হাওরাঞ্চলের ৫৪ শতাংশ গ্রামের অবস্থাই এ রকম। প্রধান শিক্ষকেরা জানালেন, শুকনো মৌসুমে যেখানে এক-পঞ্চমাংশ শিক্ষার্থীকে ‘খারাপ’ রাস্তাঘাট পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়, সেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক শিক্ষার্থীকে এই অবস্থায় পড়তে হয়। এ অবস্থা শিশুদের শিক্ষায় নিরুৎসাহিত করে।
সাধারণভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিশুদের তুলনায় সিলেট বিভাগের শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয় দেরিতে, আবার আগাম ঝরে পড়ার হারও বেশি। বয়সভিত্তিক নিট ভর্তি হারের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সিলেটের প্রতিটি বয়স গ্রুপের শিশুদের নিট ভর্তি হার এ-সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে কম। যেখানে বাংলাদেশের ছয় বছর বয়সী শিশুদের ৬৫ শতাংশ স্কুলে ভর্তি হয়, সেখানে সিলেট বিভাগের একই বয়সী শিশুদের মধ্যে এই হার মাত্র ৫২ শতাংশ। শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর বয়স সম্পর্কে অভিভাবকেরা অবহিত না থাকা এবং স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পরও ভর্তি করে না নেওয়া অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে। অবশ্য অভিভাবকদের একটি অংশ ভর্তি না করানোর কোনো কারণ বলতে পারেননি। শিশুর বয়স ১৫ বছর হতেই সমতল ভূমির অর্ধেক শিশু, হাওরাঞ্চলের ৬০ শতাংশ শিশু এবং চা-বাগান, পাহাড় ও বনভূমির ৭৩ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুতে পরিণত হয়। এ-সংক্রান্ত তুলনামূলক জাতীয় হার ৪০ শতাংশেরও নিচে। ঝরে পড়া শিশুদের একটি অংশের পরিবারগুলো পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করতে নিতান্তই অপারগ, আর অন্যরা অল্প বয়সেই আয়-উপার্জনের জন্য নানা ধরনের কাজে যোগ দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষণ-শিখনের দুর্বল মান, শেখানোর ক্ষেত্রে যত্নের অভাব শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
অভিভাবকেরা সার্বিকভাবে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন। এমনকি দরিদ্র পরিবারের মা-বাবাদের ক্ষেত্রেও শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু তাঁরা যখন শিশুর শিক্ষালাভকে তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়টি প্রাধান্য লাভ করে। এ কারণেই সিলেটের গ্রামীণ এলাকায় শিশুশ্রমের ব্যাপক প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। এই শিশুদের কেউ অর্থের বিনিময়ে আবার কেউ বা বিনা মূল্যে শ্রম দান করে। এর সঙ্গে যোগ হয় উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিদেশ যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে। এ বিষয়গুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা সামগ্রিকভাবে ‘অভিভাবকদের অসচেতনতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। এ ব্যাপারে তেমন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট বিভাগে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম নেই। কিন্তু এখানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। এটি অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কম বিনিয়োগের লক্ষণ। সিলেটের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকস্বল্পতা পাওয়া গেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা আর প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির দিক থেকে সিলেট বিভাগের শিক্ষকেরা অবশ্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষকদের মতোই। নারী শিক্ষকের অনুপাতে সিলেট বিভাগ এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক-চতুর্থাংশ শহর এলাকায় বসবাস করেন।
বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকা, কার্যদিবসে দেরিতে উপস্থিত হওয়া ও বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করার দিক থেকে সিলেট বিভাগের শিক্ষকেরা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষকদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। এসব এলাকার এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক জরিপের দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। নারী শিক্ষক ও হাওর এলাকার শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিতির হার বেশি পাওয়া গেছে।
জরিপের দিন যেসব শিক্ষক বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অল্পসংখ্যকই সময়ানুবর্তিতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই সমস্যার ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে। এ কারণে একজন প্রাথমিক শিক্ষক দৈনিক গড়ে ৫৬ মিনিট আর একজন মাধ্যমিক শিক্ষক দৈনিক গড়ে ৪৮ মিনিট শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ সময়ের অপচয় করেছেন। সময় নষ্ট করার নিরিখে পুরুষ শিক্ষকেরা নারী শিক্ষকদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ সময়ের একটি বড় অংশই এ কারণে অপচয় হয়, যা শিক্ষার্থীদের শিখন, সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম এবং আচরণে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটি বিদ্যালয় শৃঙ্খলারও পরিপন্থী।
বিদ্যালয় পরিচালনার মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কর্মোদ্যোগ খুব কমই লক্ষ করা গেছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। আবার বেশ কটি মাত্র এক বা দুবার পরিদর্শন করা হয়েছে–যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উপজেলা রিসোর্স সেন্টার থেকে পরিদর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়া গেছে। বিদ্যালয় পরিদর্শন সাধারণভাবে খুবই সাদামাটাভাবে করা হয়ে থাকে। পরিদর্শনকালে যা আলোচনা হয়, সেগুলো সরাসরি শিক্ষার মানোন্নয়নের সমস্যা বা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তার অভাব একটি বড় কারণ হিসেবে বের হয়ে এসেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী করা যেতে পারে? জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সমতা বিধানের যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিকেন্দ্রীকৃত শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকে জোরালোভাবে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। চা-বাগানে শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় বাগান ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহণ বিবেচনায় নিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে হাওর এলাকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ওয়াটার বাস চালু করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রসারে যেসব ইতিবাচক কর্মসূচি রয়েছে (যেমন উপবৃত্তি ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি) সেগুলো সিলেটের কোনো কোনো অঞ্চলে বর্ধিত আকারে বিস্তৃত করা যেতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা এবং বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকসংখ্যা বাড়ানো দরকার। হাওর, চা-বাগান ও পাহাড়ের মতো দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়সমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বিদ্যালয় পর্যায়ে জবাবদিহি ও পরিদর্শনের মান বাড়ানো দরকার।
সবশেষে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অভিগম্যতার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের যে সমতা অর্জিত হয়েছে ও নারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যে অগ্রগতি লাভ করা গেছে, তা বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যথাযথ কৌশল নির্ধারণ ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের দিকে নজর দেওয়া দরকার।
সমীর রঞ্জন নাথ, গবেষণা সমন্বয়ক, ব্র্যাক।
nath.sr@brac.net
রাশেদা কে চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান।
rasheda@campebd.org
No comments