জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ by সাঈদ আহমেদ
একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আকাঙ্ক্ষা বহুদিন ধরে লালন করে আসছে দেশের মানুষ। সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের আগ্রহ সব সময় মেলে না। কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষেত্রে সেই মেলবন্ধনটা ছিল। এর ফলস্বরূপ এবং কিছুটা আন্তর্জাতিক চাপে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জারি করা হয় ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০০৭’। এরপর কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ দিতে লেগে যায় প্রায় এক বছর। ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং মুনিরা খান ও অধ্যাপক নীরুকুমার চাকমাকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়।
এর অল্প কিছুদিন পরই ক্ষমতায় আসে বর্তমানের নির্বাচিত সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে নতুন সরকার কীভাবে গ্রহণ করে তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। সংসদের প্রথম অধিবেশনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশকে অনুমোদন না দেওয়ায় কমিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এরপর ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিল ২০০৮’ নামে একটি আইন সংসদে উত্থাপন করা হয়। বিলটি আরও যাচাই-বাছাই করার জন্য আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। স্থায়ী কমিটি খসড়া এই বিলে অনেক সুপারিশ প্রদান করে এবং সংসদে উত্থাপনের এক দিন আগে নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ও করে। ৭ জুলাই ২০০৯ সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ সংসদে উত্থাপিত হয় ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯’। ৯ জুলাই ২০০৯ তা সংসদে পাস হয় এবং ১৪ জুলাই ২০০৯ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। নতুন আইনটিকে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ২০০৭ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজকর্মকে বৈধতা দেওয়া হয়।
২০০৭ সালের অধ্যাদেশ অনুমোদন না করে সরকারের নতুনভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ প্রণয়নের কারণ খানিকটা অনুমান করা যায়। বর্তমান সরকার হয়তো চায়নি, ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হোক যে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে। তা ছাড়া ২০০৭ সালের অধ্যাদেশে অনিবার্য কিছু সংশোধনী আনারও প্রয়োজন ছিল।
নতুন আইনে কমিশনের সদস্যদের সর্বোচ্চ বয়স ৭২ থেকে কমিয়ে যেহেতু ৭০ করা হয়, সেই বয়সসীমা অতিক্রম করায় কমিশনের সদস্য মুনিরা খান পদত্যাগ করেন ২০০৯-এর জুলাই মাসে এবং একই সময়ে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কমিশনের অপর সদস্য অধ্যাপক নীরুকুমার চাকমাও ফিরে যান তাঁর অধ্যাপনা পেশায়। সেই থেকে চেয়ারম্যান একাই ছিলেন কমিশনে। তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ ছিল কিছু বিবৃতি আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেওয়ার মধ্যে। এরপর প্রায় এক বছর কমিশন সদস্যহীন অবস্থায় থাকে। ২০০৯-এর ডিসেম্বরে বাছাই কমিটি একটি বৈঠক করে কমিশনের জন্য যোগ্য লোক খোঁজার দায়িত্ব দেয় আইন মন্ত্রণালয়কে।
এদিকে কমিশনের চেয়ারম্যানের অবসর নেওয়ার বয়স পূর্ণ হয় ২২ জুন ২০১০। তার মাত্র কয়েক দিন আগে ১৭ জুন ২০১০ বাছাই কমিটি পুনরায় বৈঠকে বসে এবং আমরা দেখি, ২২ জুন ২০১০ রাষ্ট্রপতি ড. মিজানুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে একজন সার্বক্ষণিক এবং পাঁচজন অবৈতনিক সদস্যের সমন্বয়ে কমিশন পুনর্গঠন করেন। অনেক দিন পরে হলেও কমিশন পুনর্গঠন করাটা অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এই নিয়োগ সম্পন্ন করা হলো, একটি কার্যকর ও শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠনের পথে তার প্রভাব কী হতে পারে, একটু আলোচনা করে দেখা যাক—
প্রথমত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া হচ্ছে—জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেবেন (ধারা-৭)। বাছাই কমিটি যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ না হওয়ায় (স্পিকার, আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদসচিব এবং সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় দুজন সাংসদ) নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের এমনিতেই উদ্বেগ ছিল। উপরন্তু, বাছাই কমিটির আইন মন্ত্রণালয়কে যোগ্য লোক খোঁজার দায়িত্ব দেওয়াটা শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ মানবাধিকার কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে খুব একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নয়। এরপর যখন দেখা গেল, নিয়োগের মাত্র এক দিন পর একজন সদস্যের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁকে সরিয়ে দিয়ে অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলো এবং তা জানানো হলে আইন মন্ত্রণালয় প্রেরিত বিজ্ঞপ্তি মারফত তখন নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সরকার তথা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেল। আমরা পরিষ্কারভাবে জানতে পারলাম না, নতুন যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো তাঁর নাম কি বাছাই কমিটির প্রস্তাবনায় ছিল? এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জনগণের কাছে স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।
আবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যেহেতু একটি ‘সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা’, এর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আইনেই উল্লেখ রয়েছে (ধারা-৮)। সেখানে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেসব কারণ ও যে পদ্ধতিতে অপসারিত হতে পারেন, সে রকম কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত চেয়ারম্যান বা কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাবে না। আরও বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান বা কোনো সদস্য যদি কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হন বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিজের দায়িত্ববহির্ভূত অন্য কোনো পদে নিয়োজিত হন (চেয়ারম্যান ও সার্বক্ষণিক সদস্যের ক্ষেত্রে), কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতস্থ ঘোষিত হন বা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন, তবে রাষ্ট্রপতি তাঁকে অপসারণ করতে পারবেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে খারাপ নজির স্থাপন করা হলো তা হচ্ছে, মন্ত্রণালয় প্রায় এক বছর ধরে যোগ্য লোক খোঁজার পরও এমন একজন ব্যক্তি নিয়োগ পেলেন, যাঁর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ রয়েছে। আর সেটাকে যে প্রক্রিয়ায় শোধরানো হলো তার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় খারাপ নজির স্থাপিত হলো। প্রথমত, নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সরকারের কর্তৃত্বের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে গেল এবং দ্বিতীয়ত, কমিশনের কোনো সদস্যকে অপসারণের আইনি-প্রক্রিয়াকেও ঠুনকো বিষয়ে পরিণত করা হলো। আমরা এর আগে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তার নিয়োগ নিয়েও এ ধরনের বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতে দেখেছি। শুরুতেই আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জন্য এটা একটা বাজে নজির স্থাপিত হলো এবং একই সঙ্গে কমিশনকে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতাও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে যেন আস্থার সংকট তৈরি না হয় সেদিকে সরকারের সতর্ক নজর রাখা উচিত।
সাঈদ আহমেদ: মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
এর অল্প কিছুদিন পরই ক্ষমতায় আসে বর্তমানের নির্বাচিত সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে নতুন সরকার কীভাবে গ্রহণ করে তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। সংসদের প্রথম অধিবেশনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশকে অনুমোদন না দেওয়ায় কমিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এরপর ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিল ২০০৮’ নামে একটি আইন সংসদে উত্থাপন করা হয়। বিলটি আরও যাচাই-বাছাই করার জন্য আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। স্থায়ী কমিটি খসড়া এই বিলে অনেক সুপারিশ প্রদান করে এবং সংসদে উত্থাপনের এক দিন আগে নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ও করে। ৭ জুলাই ২০০৯ সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ সংসদে উত্থাপিত হয় ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯’। ৯ জুলাই ২০০৯ তা সংসদে পাস হয় এবং ১৪ জুলাই ২০০৯ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। নতুন আইনটিকে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ২০০৭ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজকর্মকে বৈধতা দেওয়া হয়।
২০০৭ সালের অধ্যাদেশ অনুমোদন না করে সরকারের নতুনভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ প্রণয়নের কারণ খানিকটা অনুমান করা যায়। বর্তমান সরকার হয়তো চায়নি, ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হোক যে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে। তা ছাড়া ২০০৭ সালের অধ্যাদেশে অনিবার্য কিছু সংশোধনী আনারও প্রয়োজন ছিল।
নতুন আইনে কমিশনের সদস্যদের সর্বোচ্চ বয়স ৭২ থেকে কমিয়ে যেহেতু ৭০ করা হয়, সেই বয়সসীমা অতিক্রম করায় কমিশনের সদস্য মুনিরা খান পদত্যাগ করেন ২০০৯-এর জুলাই মাসে এবং একই সময়ে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কমিশনের অপর সদস্য অধ্যাপক নীরুকুমার চাকমাও ফিরে যান তাঁর অধ্যাপনা পেশায়। সেই থেকে চেয়ারম্যান একাই ছিলেন কমিশনে। তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ ছিল কিছু বিবৃতি আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেওয়ার মধ্যে। এরপর প্রায় এক বছর কমিশন সদস্যহীন অবস্থায় থাকে। ২০০৯-এর ডিসেম্বরে বাছাই কমিটি একটি বৈঠক করে কমিশনের জন্য যোগ্য লোক খোঁজার দায়িত্ব দেয় আইন মন্ত্রণালয়কে।
এদিকে কমিশনের চেয়ারম্যানের অবসর নেওয়ার বয়স পূর্ণ হয় ২২ জুন ২০১০। তার মাত্র কয়েক দিন আগে ১৭ জুন ২০১০ বাছাই কমিটি পুনরায় বৈঠকে বসে এবং আমরা দেখি, ২২ জুন ২০১০ রাষ্ট্রপতি ড. মিজানুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে একজন সার্বক্ষণিক এবং পাঁচজন অবৈতনিক সদস্যের সমন্বয়ে কমিশন পুনর্গঠন করেন। অনেক দিন পরে হলেও কমিশন পুনর্গঠন করাটা অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এই নিয়োগ সম্পন্ন করা হলো, একটি কার্যকর ও শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠনের পথে তার প্রভাব কী হতে পারে, একটু আলোচনা করে দেখা যাক—
প্রথমত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া হচ্ছে—জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেবেন (ধারা-৭)। বাছাই কমিটি যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ না হওয়ায় (স্পিকার, আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদসচিব এবং সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় দুজন সাংসদ) নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের এমনিতেই উদ্বেগ ছিল। উপরন্তু, বাছাই কমিটির আইন মন্ত্রণালয়কে যোগ্য লোক খোঁজার দায়িত্ব দেওয়াটা শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ মানবাধিকার কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে খুব একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নয়। এরপর যখন দেখা গেল, নিয়োগের মাত্র এক দিন পর একজন সদস্যের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁকে সরিয়ে দিয়ে অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলো এবং তা জানানো হলে আইন মন্ত্রণালয় প্রেরিত বিজ্ঞপ্তি মারফত তখন নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সরকার তথা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেল। আমরা পরিষ্কারভাবে জানতে পারলাম না, নতুন যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো তাঁর নাম কি বাছাই কমিটির প্রস্তাবনায় ছিল? এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জনগণের কাছে স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।
আবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যেহেতু একটি ‘সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা’, এর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আইনেই উল্লেখ রয়েছে (ধারা-৮)। সেখানে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেসব কারণ ও যে পদ্ধতিতে অপসারিত হতে পারেন, সে রকম কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত চেয়ারম্যান বা কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাবে না। আরও বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান বা কোনো সদস্য যদি কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হন বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিজের দায়িত্ববহির্ভূত অন্য কোনো পদে নিয়োজিত হন (চেয়ারম্যান ও সার্বক্ষণিক সদস্যের ক্ষেত্রে), কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতস্থ ঘোষিত হন বা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন, তবে রাষ্ট্রপতি তাঁকে অপসারণ করতে পারবেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে খারাপ নজির স্থাপন করা হলো তা হচ্ছে, মন্ত্রণালয় প্রায় এক বছর ধরে যোগ্য লোক খোঁজার পরও এমন একজন ব্যক্তি নিয়োগ পেলেন, যাঁর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ রয়েছে। আর সেটাকে যে প্রক্রিয়ায় শোধরানো হলো তার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় খারাপ নজির স্থাপিত হলো। প্রথমত, নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সরকারের কর্তৃত্বের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে গেল এবং দ্বিতীয়ত, কমিশনের কোনো সদস্যকে অপসারণের আইনি-প্রক্রিয়াকেও ঠুনকো বিষয়ে পরিণত করা হলো। আমরা এর আগে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তার নিয়োগ নিয়েও এ ধরনের বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতে দেখেছি। শুরুতেই আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জন্য এটা একটা বাজে নজির স্থাপিত হলো এবং একই সঙ্গে কমিশনকে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতাও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে যেন আস্থার সংকট তৈরি না হয় সেদিকে সরকারের সতর্ক নজর রাখা উচিত।
সাঈদ আহমেদ: মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
No comments