শিক্ষার জঞ্জাল ঘোচাতেই নাভিশ্বাস by পিয়াস সরকার

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনিয়মই নিয়ম হয়ে ওঠা শিক্ষা খাতের জঞ্জাল সারাতে এখন গলদঘর্ম অবস্থা অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা প্রশাসনের। একের পর এক দাবি নিয়ে শিক্ষা খাতের কর্মীদের আন্দোলন থামাতে ব্যতিব্যস্ত কর্মকর্তারা। যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেয়ার পর সামনে নতুন দাবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো খাত নিয়ে মহাপরিকল্পনা বা সংস্কার পরিকল্পনা নেয়া ছাড়া এই সমস্যা উতরানো যাবে না। শিক্ষা খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রথম চিত্র দেখা গেছে সরকার পতনের পর প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক মব। দলীয় প্রশাসন ও দলীয় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ অনেকটা মবে পরিণত হয়েছিল। এই মব পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে গড়ে উঠেছে অনিয়মের আখড়া। সনদ বিক্রি, যত্রতত্র প্রতিষ্ঠান করে বাণিজ্য করার সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। আর এই সিন্ডিকেটেই ধস নামে শিক্ষা ব্যবস্থায়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান চ্যালেঞ্জ সামনে আসে পাঠ্য বইয়ের সংস্কার। দ্রুত সময়ে এই সংস্কার এবং পরিবর্তন করতে গিয়ে নানা বিপত্তিতে পড়ে প্রশাসন। সংস্কার করতে গিয়ে বছরের প্রায় দুই মাস পার হলেও এখনো অনেক শিক্ষার্থী হাতে বই পায়নি।

এ ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি ও অন্যান্য পদে নিয়োগের বিষয়ও চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিসি ও অন্যান্য পদে আনতে হয়েছে পরিবর্তন। এসব পদে নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পেতে নাভিশ্বাস অবস্থা তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুরোদমে আওয়ামী লীগের প্রশাসন তৈরি করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছুটা গতি আসা শুরু হলেও একের পর এক আন্দোলন সামনে আসছে। যা ছিল গত ছয় মাসের নিয়মিত চিত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন দশম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবিতে। তারা আন্দোলন করেছেন বেশ কয়েকদিন। সভা-সমাবেশ করার পাশাপাশি অবরোধ করেছিলেন সড়ক। কয়েক বছর ধরে এই আন্দোলন চললেও গুরুত্ব দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের চাকরিপ্রত্যাশীরা এখনো রয়েছেন সড়কে। যদিও এই সংকট তৈরি হয়েছে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি আদালতের রায়ে নিয়োগ বাতিলের প্রেক্ষিতে। এই নিয়োগপ্রত্যাশীরা কয়েকবার অবরুদ্ধ করেন শাহবাগ। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়।
স্বতন্ত্র এবতেদায়ী শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবি দীর্ঘদিনের। বেশ কয়েক বছর ধরেই তারা আন্দোলন করে আসছেন। সরকার কোণঠাসা করে রেখেছিল মাদ্রাসাগুলোকে। একাধিকবার করেছিলেন কর্মসূচি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এসবে গুরুত্ব দেয়নি, করেনি সমাধান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই শিক্ষকরা ফের আসেন সড়কে। তাদের উঠিয়ে দিতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এনিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি মেনে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলিপ্রথা চালুর জন্য আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষকরা। বছরের পর বছর ধরে চলা সেই আন্দোলনে শুধু আশ্বাসই দিয়ে গেছে তৎকালীন প্রশাসন। কিন্তু ইতিবাচক মনোভাব থাকায় এক মাসের মধ্যে এই বদলিপ্রথার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করেছেন জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকরা। তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শতভাগ উৎসব ভাতা, সরকারি চাকরিজীবীদের মতো বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। একইসঙ্গে আজ ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়াও এই সময়ে আন্দোলন হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)’র ঝুলে থাকা বিসিএস’সহ অন্যান্য পরীক্ষা দ্রুত নেয়ার দাবিতে। এ ছাড়াও নন-ক্যাডার নিয়ে অসন্তোষও দূর করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’তেও হয়েছে নানান আন্দোলন। শীর্ষ পদে এসেছে পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগীদের হটাতেও হয়েছে আন্দোলন। এ ছাড়াও বৃহদাকার ধারণ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ নিয়ে। অপরিকল্পিত, অপরিকপক্ব সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে অধিভুক্ত করা হয়েছিল সাত কলেজকে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল নিয়মিত ঘটনা। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেন। ঘোষণা দেন এই ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজ নিয়ে হবে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের প্রক্রিয়া ঠিককরণে প্রক্রিয়া নিয়েও মহাবিপাকে সরকার।

এসব নানান আন্দোলন নিয়ে ভয়েই আছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেন, ভয়ে থাকি কখন কোথায় কোন আন্দোলন শুরু হয়। আমরা এসেছি সংস্কারের জন্য। কিন্তু বিভিন্ন পক্ষের জমে থাকা ক্ষোভ, না পাওয়ার বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমরা সংস্কার নিয়ে ভাবার সময়টাও পাচ্ছি না। তিনি যুক্ত করেন, শিক্ষায় এত বিস্তর দুর্নীতি হয়েছে যেসব বিষয়ে সমাধানে আসাও দুরূহ।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, বিগত সরকারের নৈরাজ্য ছিল তারই প্রভাব এটা। শিক্ষা খাতের কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল বিগত সরকার। যার কারণে বর্তমান সরকারকে চাপ দিয়ে দাবি আদায়ের একটা চেষ্টা চলছে। সরকারের বল প্রয়োগের যে অনীহা আছে সেটার কারণেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই অযৌক্তিক দাবিগুলোর বিষয়ে কঠোর হওয়া উচিত। আগস্টের পর এইচএসসিতে অটোপাসটা মানবিক কারণে মেনে নিলো তখন সবার কাছে বার্তা চলে গেল তাদের কাছে আন্দোলন করলে দাবি মানানো যায়। এখন উচিত স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসা।

mzamin
শাহবাগে নিয়োগপ্রত্যাশী প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের অবস্থান ছবি: জীবন আহমেদ

No comments

Powered by Blogger.