বিপ্লবের জন্য পরিচয় লুকানোর নজির আছে by কাজী জেসিন
চে গুয়েভারের সেই কথা মনে রাখা দরকার। “বিপ্লব কোনো আপেল নয় যে, পেকে পড়ে যাবে। আপনাকে তা পতিত করতে হবে।” আর এই বিপ্লবের আপেল পতিত করার পেছনে বিগত পনেরো বছর যারা ত্যাগ করে গেছেন তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। প্রতিরোধ ছিল, প্রতিবাদ ছিল, বিপ্লবের মালা তৈরির জন্য প্রস্তুত ছিল পাটাতন। এই পাটাতন প্রস্তুতে বিগত বছরগুলোতে যারা প্রাণ দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
একজন সালমানের ডাকে ছাত্র-জনতা পথে নামেনি। কেউ একা এই গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক না। এই গণ-অভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে গেছে আবু সাঈদ, মুগ্ধ’র মতো শহীদেরা। তবে সালমানের ত্যাগকে খারিজ করা হবে অসততা।
ইতিহাসে বিপ্লব সফল করার জন্য পরিচয় লুকানোর নজির আছে। লেনিন একটি ছদ্মনাম। এই ছদ্মনামে তিনি এমনভাবেই পরিচিত হয়েছেন যে, তার নামের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গেছে এই ছদ্মনাম।
লেনিনের আসল নাম ছিল “ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ”। রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি গঠনের সময় লেনিন ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। সাইবেরিয়ার লেনা নদীর নামানুসারে তিনি নিজের নাম রাখেন লেনিন। ১৯০২ সালে, এই ছদ্মনাম ব্যবহার করে তিনি ‘কী করতে হবে’ শিরোনামে একটি বই রচনা করেন, যাতে বলা হয়-‘বিপ্লবের নেতৃত্ব এমন এক অনুশাসিত দলের হাতে থাকা উচিত, যাদের প্রধান কাজ হবে অধিকারের জন্য লড়াই করা’। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের নেতা, লেনিন জারের গোপন পুলিশ ‘ওখরানা’ থেকে বাঁচতে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। ১৯০৫ সালের ব্যর্থ বিপ্লবের পর, লেনিনকে রাশিয়া ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হয়। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেন। সেখানে থাকাকালীনও তিনি তার পরিচয় গোপন রাখতেন, যাতে রাশিয়ার গোপন পুলিশ তাকে আটক করতে না পারে। ১৯১৭ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সহায়তায় তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন।
১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের ঠিক আগে, যখন লেনিন পেত্রোগ্রাদে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) ছিলেন, তখন তাকে জারের পুলিশ এবং অস্থায়ী সরকারের পুলিশ থেকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। সে সময় তিনি ছদ্মবেশে থাকতেন, যেমন- দাড়ি কেটে, চেহারায় পরিবর্তন এনে এবং বিভিন্ন জায়গায় গোপনে থেকে তিনি কাজ চালাতেন। অক্টোবর বিপ্লবের সময় যখন বলশেভিক ক্ষমতা দখল করে, লেনিন তখন তার পরিচয় গোপন রেখেছিলেন এবং বিপ্লব সফল হওয়ার পরই প্রকাশ্যে আসেন।
বিপ্লবের জন্য ছদ্মনাম ব্যবহারের আরও উদাহরণ আছে। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ‘আইরিশ রিপাবলিকান’ নেতা হিসেবে পরিচিত “উলফে টোন” একটি ছদ্মনাম। তার আসল নাম ছিল থিওবাল্ড উলফে টোন (ঞযবড়নধষফ ডড়ষভব ঞড়হব)। তিনি বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮ শতকের আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। টোন মূলত আয়ারল্যান্ডকে বৃটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্ত করতে এবং আয়ারল্যান্ডের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন।
টোনের পরিচয় গোপনের অন্যতম বিখ্যাত ঘটনা ঘটে ১৭৯৬ সালে, যখন তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে একটি বিপ্লব সংগঠিত করার পরিকল্পনা করছিলেন। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ফরাসি সরকারের সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ফ্রান্সে গিয়েছিলেন এবং সেখানে ফরাসি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ফ্রান্সে থাকাকালীন নিজের আসল পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হন, কারণ বৃটিশরা তার বিরুদ্ধে ছিল এবং তাকে গ্রেপ্তারের হুমকি ছিল। তিনি তখন ‘জেমস স্মিথ’ নামে পরিচিতি নিয়েছিলেন।
১৭৯৮ সালে, আয়ারল্যান্ডে ফরাসি নৌবাহিনীর সহায়তায় একটি বিদ্রোহ সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে তিনি আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসেন। কিন্তু ফরাসি এবং আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহীদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, এবং টোনকে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করে। তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর তাকে ইংল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে, টোন গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। যদিও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মারা যাননি, তবে কিছুদিন পর তিনি এই আঘাতের ফলে মারা যান।
অ্যালান মুরের ভবিষ্যৎ ডিস্টোপিয়ান ইংল্যান্ডের উপর লেখা গ্রাফিক উপন্যাস “ভি ফর ভেনডেটা” এর কথা বলা যায়, যেখানে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। এই সরকারটি ‘নরসফায়ার’ নামে পরিচিত এবং তারা জনগণের সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। জনগণকে সেখানে ভয় এবং প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে শাসন করা হয়, এবং যারা সরকারের বিরোধিতা করে তাদের নির্যাতন করা হয় বা হত্যা করা হয়। গল্পের মূল চরিত্র ‘ভি’ একজন রহস্যময় মুখোশধারী ব্যক্তি, যিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করছেন। তিনি একটি ‘গাই ফক্স’ মাস্ক পরে থাকেন, যা ১৬০৫ সালের গায় ফক্সের বিদ্রোহের প্রতীক। ভি সরকারের বিভিন্ন অত্যাচার এবং অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভি-এর পরিকল্পনা হলো সরকারের কেন্দ্রীয় প্রতীক ‘পার্লামেন্ট ভবন’ উড়িয়ে দিয়ে জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালানো। ভি নিজেই একটি পরীক্ষাগারে সরকারের দ্বারা বন্দি হয়েছিলেন এবং সেখানে তার উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। সেই পরীক্ষার পর থেকে তিনি শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেন এবং ধীরে ধীরে প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
“ভি”-এর কাহিনীর পাশাপাশি, ‘ইভি হ্যামন্ড’ নামে একটি মেয়ের গল্পও দেখানো হয় এই উপন্যাসে যাকে “ভি” একসময় রক্ষা করেন। ইভি একটি সাধারণ মেয়ে, যার জীবন সরকার এবং সমাজের অত্যাচারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। “ভি” তাকে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা দেন এবং ধীরে ধীরে ইভি “ভি”-এর আদর্শকে গ্রহণ করেন এবং তার সহযোগী হয়ে ওঠেন। ইভি ভয় এবং আত্মসমর্পণ থেকে বেরিয়ে এসে সাহসের সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
গল্পের সবচেয়ে চমকপ্রদ মুহূর্তটি আসে যখন ভি তার সর্বশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, ৫ই নভেম্বর, গায় ফক্স ডে-তে, তিনি লন্ডনের পার্লামেন্ট ভবন উড়িয়ে দেবেন। এই দিনটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হবে, এবং ভি জনগণকে আহ্বান করেন যেন তারা তার সঙ্গে যোগ দেন এবং বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেন।
উপন্যাসের শেষে, ভি তার মিশন সম্পন্ন করতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন। তবে তার মৃত্যুর পরেও তার আইডিয়া এবং বিপ্লবী চেতনা বেঁচে থাকে। ইভি তার উত্তরসূরি হিসেবে পার্লামেন্ট উড়িয়ে দেয়ার কাজ সম্পন্ন করেন, যা এক প্রতীকী বিজয় হিসেবে ধরা হয়। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ গায় ফক্সের মুখোশ পরে রাজপথে নেমে আসে, যা বোঝায় যে জনগণ এখন আর ভয় পায় না এবং তারা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত।
ভি ফর ভেনডেটা-এর কাহিনী মূলত ব্যক্তিগত প্রতিশোধের সঙ্গে রাজনৈতিক বিপ্লবের মিশ্রণ, যেখানে ক্ষমতাহীন মানুষকে ক্ষমতা ফিরে পেতে উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং ফ্যাসিস্ট শাসনকে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
ভি বিশ্বাস করেন, ‘আইডিয়াস আর বুলেটপ্রুফ’ মতাদর্শ কখনো মরে না, এমনকি যদি ব্যক্তি মারা যায়।
বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থান কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। এই গণ-অভ্যুত্থান সম্পন্ন হয়েছে শুধু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে। এরপর এসেছে রাষ্ট্র সংস্কার, যা দ্বিতীয় স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ডাক। এই অভ্যুত্থান কোনো বিশেষ একটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল ছাত্রদলের ছাত্ররাও। কোনো দলের কর্মী হলেই তার ছাত্র পরিচয় মুছে যায় না। সুতরাং এই গণ-অভ্যুত্থানে পরিচয় গোপন করে “শাদিক কাইয়ুম” সালমান ছদ্মনাম নিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি লড়াইয়ে শামিল ছিলেন। যেমন লড়াইয়ে শামিল ছিলেন ছাত্রদলেরও অনেকে। রাষ্ট্র যখন ঘাতকের মতো বন্দুক তাক করে প্রতিবাদমুখী মানুষের দিকে তখন লড়াই চালিয়ে যেতে ভি-এর “গায় ফস্ক” মাস্কের প্রয়োজন পড়ে।
এই আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন শহীদেরা তাদের জীবন বিসর্জন দিয়ে। আর যারা জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে লড়াই করেছেন তাদের প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বলাবাহুল্য এই অভ্যুত্থানে কোনো বিশেষ কারও ডাকে সাড়া দিয়ে কেউ পথে নামেনি। সকল দল এবং মতের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল এই আন্দোলনে যাদের ডাকে জনতা পথে নামে। তাত্ত্বিকভাবে, এই কৌশলটি রাজনৈতিক প্রতিরোধের তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিপ্লবীরা যখন শাসকের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন পরিচয় লুকানোর মাধ্যমে তারা আড়ালে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যায়। আন্তোনিও গ্রামশি’র “হেজিমনি” তত্ত্ব অনুযায়ী, শাসক শ্রেণি তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু বিপ্লবীরা তাদের পরিচয় গোপন রেখে শাসকের এই ক্ষমতার কাঠামোকে ভেঙে দেয়। লেনিন, উলফে টোন, এবং ‘ভি ফর ভেনডেটা’-এর ভি চরিত্রটি দেখায় যে, হেজিমনির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে পরিচয় গোপন করাও একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে।
হাসিনার কালো গ্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার ডাকে কোনো মুনাফিকি ছিল না। কাফেলা এক ছিল বলেই সাধারণ মানুষ জীবনের ভয় না করে রাজপথে নেমেছিল। আর এই আন্দোলনের ডাক কেউ একা দেয়নি। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিপ্লব সম্পন্নের আগেই এইসব ভুল আমাদের পথচ্যুত করবে। লড়াই চলমান। লড়াই চলতে হবে যতদিন না বাংলাদেশ সত্যিকার গণতন্ত্রের গূঢ় অর্থ স্পর্শ করে। চে গুয়েভারের সেই কথা মনে রাখা দরকার।
“বিপ্লব কোনো আপেল নয় যে, পেকে পড়ে যাবে। আপনাকে তা পতিত করতে হবে।” আর এই বিপ্লবের আপেল পতিত করার পেছনে বিগত পনেরো বছর যারা ত্যাগ করে গেছেন তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। প্রতিরোধ ছিল, প্রতিবাদ ছিল, বিপ্লবের মালা তৈরির জন্য প্রস্তুত ছিল পাটাতন। এই পাটাতন প্রস্তুতে বিগত বছরগুলোতে যারা প্রাণ দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
No comments