এলারি একারস্-এর কবিতা: ভাষান্তর by মঈনুস সুলতান
কবি,
শিশুসাহিত্যিক, শিল্পী ও নিসর্গবিদ এলারি একারস্-এর জন্ম ১৯৪৬ সালে। তিনি
হার্বার্ড ও সানফ্রানসিসকো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার
কাব্যগ্রন্থ দুটি। ২০১৫ সালে ‘প্র্যাকটিসিং দ্যা ট্রুথ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য
তিনি অটাম হাউস পোয়েট্রি প্রাইজ পান। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার ‘নকিং অন দি
আথর্’ কাব্যগ্রন্থ ওয়েসলিয়ান নিউ পোয়েট সিরিজের জন্য নির্বাচিত হয়। এছাড়াও
তিনি শিশুদের জন্য ‘সারাজ্ ওয়াটার ফল : অ্যা হিলিং স্টোরি আবাউট সেক্সুয়াল
এবিউস (২০০৯)’ শিরোনামে একটি উপন্যাসও রচনা করেছেন। কবি উত্তর
ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করেন।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাখি পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি নিসর্গ নিবিড় পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ফার বৃক্ষের বনানীতে পাখি পরিসংখ্যান
খুব ভালোভাবেই জানি—একর জুড়ে থাকা বনানীর কোথায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। যখন এক ফোঁটা বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ে হাকোলবেরির পাতা থেকে, কোথায় তা ঝরে পড়লো আমি তা অনুভব করি।ঘুরে ফিরে জানা হয়ে গেছে প্রতিটি পাখির নীড়ের নির্দিষ্ট অবস্থান। পরিচয় হয়েছে প্রতিটি আলাদা আলাদা কাকলীর গীতল ব্যঞ্জনার সঙ্গে, কোন বার্ডকল, কত প্রকারের কুজনে কথা বলছে কে কার সাথে, কোন খেচরটি শাসন করছে ছানাদের, ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে কোন পাখিটি। আমি সচেতন যে—কখন কমলাবউ পাখিটি ভুল করে ঢুকে পড়বে ভিন্ন এক খেচরের গণ্ডিতে, আর তাড়া খাবে তৎক্ষণাত।
আমার পরিবারে বাউন্ডারি বা নিজস্ব গণ্ডির বিষয়টি মানা হয় না তেমন। আমার জননী, যখন মদ্যপানে বেহেড, মাঝরাতে আমার কামরায় ডোর ঠেলে এসে হুড়মুড়িয়ে শুয়ে পড়েন আমার বিছানায়।
বসন্ত ঋতুর পুরোটা জুড়ে আমি বসবাস করেছি বনানীতে, আর তৈরি করেছি নানা রকমের গণ্ডিরেখা নির্ধারিত পরিসরের চার্ট। একটি চড়ুই যখন মাতে সংগীতময় কাকলিতে, সে হেলিয়ে দেয় তার ছোট্ট মাথাটি আর ফুলে ফেঁপে ওঠে তার গলার পালক। প্রতিক্রিয়ায় গান করে ওঠে আরেকটি চড়ুই, সে কাকলি দিয়ে তৈরি করে তার গণ্ডিবদ্ধ পরিসরের সীমান্তে দেয়াল। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে আমিও সে অনুযায়ী রেখা টানি চার্টের মানচিত্রে।
---হাঁস---
যখন আমি পত্রিকার সংবাদ পাঠে ক্লান্ত, একজন পুরুষ বাতাস ভরা পুতুল-মানবীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় মৃত্যুবরণ করছে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে; ফুলের মতো শোভন নামের একটি শহর ফলুজা, চলছে ওখানে খণ্ডযুদ্ধ; চাবুক ও হাতকড়ার সমবায়ে নতুন পদ্ধতিতে টর্চারের উদ্ভব...আমি পত্রিকাটি বন্ধ করে চলে আসি পুকুর পাড়ে। দেখি, হাঁসগুলো ডুবসাঁতারে মেতেছে, কখনো-বা কথা বলছে কোয়াক কোয়াক ধ্বনিতে। জলে ডোবা ম্যালার্ড হাঁসটির কমলালেবু রঙের দু-পা বাতাস কাটছে শূন্যে। তারা পাড়ের প্রান্ত ঘেঁষে আদার খুঁটছে, পুচ্ছ দুলিয়ে গিলে ফেলে ছুড়ে দেয়া রুটির টুকরা-টাকরা; জলজগুল্ম ঠোঁটে টেনে চলাচলে তৈরি হয় বাঁকানো বৃত্তাকার ট্রেইল; আর তাদের কণ্ঠনালীর সবুজ পালক রোদে ঝলকায়।
---মেফ্লাই---
মেফ্লাই নামের জলপতঙ্গটি কাদামাখা পানিতে যুঝে যাচ্ছে। আমি প্রকৃতির নিজস্ব বিষয়-আশয়ে জড়িয়ে না পড়ার জন্য নিজেকে সতর্ক করি, কিন্তু পতঙ্গটি যে ভাবে ডানা কাঁপিয়ে যুঝছে, আর দারুণভাবে ক্লান্ত হয়ে ভাসছে, তারপর ফের ডানা থেকে ঝরাতে চাচ্ছে কর্দমাক্ত জল—তা স্রেফ নির্লিপ্তভাবে দেখে যাওয়া বড় কঠিন। এবার মেফ্লাইটি ভেসে থাকার যুদ্ধে ক্লান্ত হতে হতে আমার দিকে আসতে চাচ্ছে। আমি একটি ডাল বাড়িয়ে দিলে সে তা আঁকড়ে ধরে। আমি নিজের আচরণে না হেসে পারি না। এ পতঙ্গটির সারা জীবনের মেয়াদ কেবলমাত্র এক দিনের। তো কাদাজল থেকে উদ্ধার করে আমি তার জীবনকে কতোটা দীর্ঘায়িত করতে পারলাম? সম্ভবত আমার সহায়তায় জলপোকাটি বেঁচে থাকবে আরো এক কিংবা দুই ঘণ্টা, তারপর অবধারিত মৃত্যুতে ঢলে পড়বে সে। কিন্তু যে ভাবে মেফ্লাইটি পরিষ্কার করছে তার পা, এবং রোদে মেলে শুকানোর চেষ্টা করছে তার ডানা, তা পর্যবেক্ষণ করে আমার মন ভরে ওঠে ভালো লাগার অনুভূতিতে।
---প্যাঁচা---
প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কটি ভেঙে যাওয়াতে ভারী বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলো আমার মন। তখন আমি বনানীর কুয়াশা কেটে হাঁটতে বেরোই । চাঁদ যেন ব্যান্ডেজ বাঁধার গজ কাপড়ে জড়ানো, গাছ বৃক্ষকেও দেখাচ্ছে আবছা। আমি শুয়ে পড়ি টিলার ঢালে। টারউইড গাছ থেকে নিসৃত গন্ধ এসে লাগছিলো নাকে, আর মাঝে মাঝে সমুদ্র থেকেও ভেসে আসছিলো নোনা গন্ধ। আমি করোটিতে ফারের মতো দেখতে ব্যারেট পরে ছিলাম, এবং হাত দুটো ভাঁজ করে রেখেছিলাম মাথার ওপর। ধারালো ও শীতল কিছু আমার আঙুল ছুঁয়ে উড়ে যায়। বুঝতে পারি—একটি প্যাঁচা, সম্ভবত নিশচর খেচরটি আমার ফার সদৃশ্য ব্যারেটটিকে ভেবেছে ছোট্ট কোন প্রাণী। সে ধারালো নখর দিয়ে ছোবল মেরে উড়ে যায় সামনে।
---অবশিষ্ট আছে যা---
শেষ বার যেদিন আমি আমার দিদিমাকে টেলিফোন করেছিলাম, মনে হয়েছিলো কোনো কিছু নিয়ে তিনি ব্যস্ত আছেন, যেন কিছু একটা একাকি তিনি নিমগ্ন হয়ে শুনছেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রায় সব কিছুই আমি ভুলে গেছি, তবে শুধু একটি জিনিস এখনো মনে দাগ কেটে আছে...তার কফিনের উপর রাখা ফুলের তোড়ায় মৌমাছিগুলো মেতেছিলো পরাগায়ণে, তারা গর্ভকেশরগুলোতে হুল বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে ওড়াউড়ি করছিলো।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাখি পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি নিসর্গ নিবিড় পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ফার বৃক্ষের বনানীতে পাখি পরিসংখ্যান
খুব ভালোভাবেই জানি—একর জুড়ে থাকা বনানীর কোথায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। যখন এক ফোঁটা বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ে হাকোলবেরির পাতা থেকে, কোথায় তা ঝরে পড়লো আমি তা অনুভব করি।ঘুরে ফিরে জানা হয়ে গেছে প্রতিটি পাখির নীড়ের নির্দিষ্ট অবস্থান। পরিচয় হয়েছে প্রতিটি আলাদা আলাদা কাকলীর গীতল ব্যঞ্জনার সঙ্গে, কোন বার্ডকল, কত প্রকারের কুজনে কথা বলছে কে কার সাথে, কোন খেচরটি শাসন করছে ছানাদের, ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে কোন পাখিটি। আমি সচেতন যে—কখন কমলাবউ পাখিটি ভুল করে ঢুকে পড়বে ভিন্ন এক খেচরের গণ্ডিতে, আর তাড়া খাবে তৎক্ষণাত।
আমার পরিবারে বাউন্ডারি বা নিজস্ব গণ্ডির বিষয়টি মানা হয় না তেমন। আমার জননী, যখন মদ্যপানে বেহেড, মাঝরাতে আমার কামরায় ডোর ঠেলে এসে হুড়মুড়িয়ে শুয়ে পড়েন আমার বিছানায়।
বসন্ত ঋতুর পুরোটা জুড়ে আমি বসবাস করেছি বনানীতে, আর তৈরি করেছি নানা রকমের গণ্ডিরেখা নির্ধারিত পরিসরের চার্ট। একটি চড়ুই যখন মাতে সংগীতময় কাকলিতে, সে হেলিয়ে দেয় তার ছোট্ট মাথাটি আর ফুলে ফেঁপে ওঠে তার গলার পালক। প্রতিক্রিয়ায় গান করে ওঠে আরেকটি চড়ুই, সে কাকলি দিয়ে তৈরি করে তার গণ্ডিবদ্ধ পরিসরের সীমান্তে দেয়াল। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে আমিও সে অনুযায়ী রেখা টানি চার্টের মানচিত্রে।
---হাঁস---
যখন আমি পত্রিকার সংবাদ পাঠে ক্লান্ত, একজন পুরুষ বাতাস ভরা পুতুল-মানবীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় মৃত্যুবরণ করছে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে; ফুলের মতো শোভন নামের একটি শহর ফলুজা, চলছে ওখানে খণ্ডযুদ্ধ; চাবুক ও হাতকড়ার সমবায়ে নতুন পদ্ধতিতে টর্চারের উদ্ভব...আমি পত্রিকাটি বন্ধ করে চলে আসি পুকুর পাড়ে। দেখি, হাঁসগুলো ডুবসাঁতারে মেতেছে, কখনো-বা কথা বলছে কোয়াক কোয়াক ধ্বনিতে। জলে ডোবা ম্যালার্ড হাঁসটির কমলালেবু রঙের দু-পা বাতাস কাটছে শূন্যে। তারা পাড়ের প্রান্ত ঘেঁষে আদার খুঁটছে, পুচ্ছ দুলিয়ে গিলে ফেলে ছুড়ে দেয়া রুটির টুকরা-টাকরা; জলজগুল্ম ঠোঁটে টেনে চলাচলে তৈরি হয় বাঁকানো বৃত্তাকার ট্রেইল; আর তাদের কণ্ঠনালীর সবুজ পালক রোদে ঝলকায়।
---মেফ্লাই---
মেফ্লাই নামের জলপতঙ্গটি কাদামাখা পানিতে যুঝে যাচ্ছে। আমি প্রকৃতির নিজস্ব বিষয়-আশয়ে জড়িয়ে না পড়ার জন্য নিজেকে সতর্ক করি, কিন্তু পতঙ্গটি যে ভাবে ডানা কাঁপিয়ে যুঝছে, আর দারুণভাবে ক্লান্ত হয়ে ভাসছে, তারপর ফের ডানা থেকে ঝরাতে চাচ্ছে কর্দমাক্ত জল—তা স্রেফ নির্লিপ্তভাবে দেখে যাওয়া বড় কঠিন। এবার মেফ্লাইটি ভেসে থাকার যুদ্ধে ক্লান্ত হতে হতে আমার দিকে আসতে চাচ্ছে। আমি একটি ডাল বাড়িয়ে দিলে সে তা আঁকড়ে ধরে। আমি নিজের আচরণে না হেসে পারি না। এ পতঙ্গটির সারা জীবনের মেয়াদ কেবলমাত্র এক দিনের। তো কাদাজল থেকে উদ্ধার করে আমি তার জীবনকে কতোটা দীর্ঘায়িত করতে পারলাম? সম্ভবত আমার সহায়তায় জলপোকাটি বেঁচে থাকবে আরো এক কিংবা দুই ঘণ্টা, তারপর অবধারিত মৃত্যুতে ঢলে পড়বে সে। কিন্তু যে ভাবে মেফ্লাইটি পরিষ্কার করছে তার পা, এবং রোদে মেলে শুকানোর চেষ্টা করছে তার ডানা, তা পর্যবেক্ষণ করে আমার মন ভরে ওঠে ভালো লাগার অনুভূতিতে।
---প্যাঁচা---
প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কটি ভেঙে যাওয়াতে ভারী বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলো আমার মন। তখন আমি বনানীর কুয়াশা কেটে হাঁটতে বেরোই । চাঁদ যেন ব্যান্ডেজ বাঁধার গজ কাপড়ে জড়ানো, গাছ বৃক্ষকেও দেখাচ্ছে আবছা। আমি শুয়ে পড়ি টিলার ঢালে। টারউইড গাছ থেকে নিসৃত গন্ধ এসে লাগছিলো নাকে, আর মাঝে মাঝে সমুদ্র থেকেও ভেসে আসছিলো নোনা গন্ধ। আমি করোটিতে ফারের মতো দেখতে ব্যারেট পরে ছিলাম, এবং হাত দুটো ভাঁজ করে রেখেছিলাম মাথার ওপর। ধারালো ও শীতল কিছু আমার আঙুল ছুঁয়ে উড়ে যায়। বুঝতে পারি—একটি প্যাঁচা, সম্ভবত নিশচর খেচরটি আমার ফার সদৃশ্য ব্যারেটটিকে ভেবেছে ছোট্ট কোন প্রাণী। সে ধারালো নখর দিয়ে ছোবল মেরে উড়ে যায় সামনে।
---অবশিষ্ট আছে যা---
শেষ বার যেদিন আমি আমার দিদিমাকে টেলিফোন করেছিলাম, মনে হয়েছিলো কোনো কিছু নিয়ে তিনি ব্যস্ত আছেন, যেন কিছু একটা একাকি তিনি নিমগ্ন হয়ে শুনছেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রায় সব কিছুই আমি ভুলে গেছি, তবে শুধু একটি জিনিস এখনো মনে দাগ কেটে আছে...তার কফিনের উপর রাখা ফুলের তোড়ায় মৌমাছিগুলো মেতেছিলো পরাগায়ণে, তারা গর্ভকেশরগুলোতে হুল বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে ওড়াউড়ি করছিলো।
এলারি একারস্ |
No comments