হাসিনা-মোদি বৈঠক: অগ্রগতি নেই তিস্তায় ফেনী নদীর পানি যাবে ত্রিপুরায়
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার ভারত সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে
আনুষ্ঠানিক বৈঠক এবং আগামীর সম্পর্কের ‘পথ নকশা’ সংক্রান্ত ৫৩ দফা যৌথ
বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে। দিল্লির বিদেশ মন্ত্রকের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে
প্রচারিত ওই জয়েন্ট স্টেটম্যান্টে তিস্তা, সীমান্ত হত্যাসহ দুই দেশের
সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব ইস্যু নিয়ে আলোচনার বিস্তারিত তুলে ধরা
হয়েছে। মোদি তার টুইটেও প্রায় সব বিষয়ে আলোচনার কথা জানিয়েছেন।
তিস্তা নদীর পানি বন্টন বিষয়ে ২০১১ সালে প্রায় চূড়ান্ত হওয়া কাঠামো চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত চুক্তিটি সইয়ের কথা বললে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার স্টেট হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে এটি নিষ্পত্তির ফের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে ওই বৈঠকে বাংলাদেশ আচমকা ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরার সাবরুম এলাকার জন্য পানি দেয়ার চুক্তি সই করেছে। বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে ঢাকার বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে বিবৃতিতে বরাবরের মত এনআরসি’কে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এনআরসি নিয়ে ঢাকায় বিস্তর উদ্বেগ-অস্বস্তি থাকলেও বৈঠকে প্রসঙ্গটি এসেছিল কি-না? তার কোন উল্লেখ ছিল না। বিবৃতিতে কাশ্মির প্রসঙ্গও অনুপস্থিত।
যদিও ঢাকার তরফে আগেই বলা হয়েছে- কাস্মির ইস্যুটি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বলে মনে করে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বরাতে শীর্ষ বৈঠকের নানা সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে যুক্ত বিবৃতিতে। বলা হয়েছে- দুই প্রধানমন্ত্রী উষ্ণ এবং খুবই আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা করেছেন। তারা ৩টি প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন ভিডিও কনফারেন্সে। ৭টি চুক্তি-সমঝোতা সাইয়ের আনুষ্ঠানিকতায়ও তারা উপস্থিত ছিলেন। দুই দেশের সম্পর্কে গভীরতা এবং বিস্তুৃতির বিদ্যমান অবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয়ে। বৈঠকে তারা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সমপর্কন্নোয়নে আর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে গঠনমূলক ও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সমপর্ক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দুই দেশের জন্যেই লাভজনক হবে এমন সুযোগগুলোকে শতভাগ কাজে লাগাতে উভয় নেতাই সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ন ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার ভিশনকে সমর্থন জানিয়েছেন মোদি। এর আগেও পূর্ন সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি। এদিকে বিবৃতিতে জানানো হয়, মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মোদি তা গ্রহণ করেছেন এবং দুই দেশের কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনায় সফরের দিনক্ষণ ঠিক করার তাগিদ দিয়েছেন।
তিস্তার চুক্তির জন্য বাংলাদেশ অপেক্ষায়, মোদি বললেন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সইয়ের চেষ্টা চলছে: বিবৃতি মতে, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ ২০১১ সালে প্রায় চূড়ান্ত হওয়া তিস্তার পানি বন্টন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের বাস্তবান বা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দেখতে চায়। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করে দ্রুত চুক্তিটি সম্পন্ন করতে কাজ করছে। বিবৃতিতে মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার নদীর পানি বন্টনে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিম চূড়ান্ত করতে আপডেট ডাটা শেয়ারিংয়ে জয়েন্ট রিভার কমিশনের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন দুই নেতা। একই সঙ্গে ফেনী নদী বিষয়েও তারা কাঠামো চুক্তির বিষয়ে একমত হন। ঢাকায় পানি সম্পদ সচিব পর্যায়ে বৈঠকে ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাবরুম এলাকার মানুষের খাবারের জন্য ভারত প্রত্যাহার করতে পারবে মর্মে যে সিদ্ধান্ত হয় তা-ও বিবৃতিতে তুলে ধরা হয় এবং এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করা হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় ভারতের আশ্বাস: এদিকে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আরও বড় পরিসরে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলা হয়- তারা (দুই নেতা) এ বিষয়ে একমত হন যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। উভয় নেতা আরও একমত হন যে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের নবভিটায় নিরাপদ, দ্রুত এবং টেকসই প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার জন্য মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়শী প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আরও ৫০টন মানবিক সাহায্য পাঠাবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। ওই ৫০ টনের মধ্যে রয়েছে- তাবু, রিলিফ এবং প্রাকৃতির দুযোগ থেকে উদ্ধার সরঞ্জমাদি। রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে ভারতের ২৫০ বাড়ি তৈরির কথা জানিয়ে সেখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনার কথাও জানানো হয় বিবৃতিতে।
আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। একইসঙ্গে এ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তার ভ্থমিকার ভ্থয়সী প্রশংসা করেছেন মোদি। এসময় উভয় দেশের জন্য সন্ত্রাসবাদকে সবথেকে বড় সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন দুই নেতা। সন্ত্রাসবাদ দমনে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। দুই পক্ষই সধারণ জনগণের চলাচল সহজীকরণে জোর দেন। বাংলাদেশি বৈধ ট্রাভেলারদের যাতাযাতে যে কোন পোর্ট ব্যবহারের যে প্রতিবন্ধকতা ছিল তা তুলে দেয়াসহ ভারতের তরফে ভিসাসহজীকরণের অঙ্গীকারে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে শেখ হাসিনা ধন্যবাদ জানান। এখন থেকে বাংলাদেশিরা বিদ্যমান সব পোট দিয়ে যেতে এবং ফিরতে পারবেন। যে পোর্ট দিয়ে যাকেন ওই পোর্ট দিয়ে ফেরার বাধ্যবাধকতা আর নেই। আলোচনায় দুই প্রধানমন্ত্রী কার্যকর বর্ডার ম্যানেজমেন্টের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা এটার নিশ্চিয়তা চেয়েছেন যে, বর্ডার হবে ক্রামই ফ্রি, উত্তেজনাহীন সর্বোপরি স্থিতিশীল। উভয় নেতাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বর্ডারের অবশিষ্ট এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের নির্র্দেশনা দেন। দুই নেতাই এ বিষয়ে একমত হন যে সীমান্তে একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুও অগ্রহণযোগ্য। এটা উদ্বেগজনক। তারা উভয়ে বর্ডার সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন মৃত্যুর ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে।
উইন-উইন বিজনেস পার্টনারশীপ: এলডিসি থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে বাংলাদেশের অপরিহার্য এবং প্রাথমিক শর্ত পূরণে সফলতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান মোদি। একই সঙ্গে দুই দেশ এ বিষয়ে একমত হয় যে দ্বিপক্ষীয় কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশীপ এগ্রিমেন্ট সই করতে একটি যৌথ সার্ভে সম্পাদনে। ভারতের অনুরোধে আখাউরা-আগরতলা বন্দর থেকে ভারতীয় পন্যের ওপর যে বাধানিষেধ ছিলো তা উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ভারতীয় কতৃপক্ষ পাটসহ বিভিন্ন পণ্যে ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি প্রত্যাহারের বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। তবে তারা তাদের বিদ্যমান এ সংক্রান্ত আইনের বিষয়টিও তুলে ধরেছে। তবে দুই নেতাই তাদের কর্মকর্তাদের বাণিজ্য সংক্রান্ত পদক্ষেপ এবং সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগী হতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ভারতীয় বাজারে কোটা ও শুল্কমুক্তভাবে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে সম্মত হওয়ায় ভারতের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে: প্রধানমন্ত্রী
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ উদ্বোধনীতে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন- বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রথাগত খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নানা অপ্রথাগত খাতেও সহযোগিতা সমপ্রসারিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে যোগ দিতে চার দিনের সফরে ভারতে অবস্থারত শেখ হাসিনা শনিবার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে এগারোটায় দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দেশটির প্রধানমন্ত্রর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের পর পারস্পরিক সহায়তা সংক্রান্ত ৭টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন হওয়া নতুন তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তারা।
সে সময় দুই নেতাই পারস্পরিক সহায়তার সম্পর্ক নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র বিভিন্ন প্রথাগত খাতে বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও অপ্রথাগত খাত যেমন ব্লু-ইকোনমি ও মেরিটাইম, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, মহাকাশ গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যান্ড উইথ রফতানি, সাইবার সিকিউরিটির মতো বিষয়ে উভয় দেশের সহযোগিতার হাত সমপ্রসারিত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, এসব বহুমুখী সহযোগিতার ফলে আমাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্ববাসীর সামনে সু-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মধ্যকার এই সম্পর্কের শুভ সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ ও সরকারের অপরিসীম অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত: মোদি
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে সারা বিশ্বের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শনিবার দিল্লিতে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর মোদি বলেন, এই আলোচনা দুই দেশের জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে। হায়দরাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর মোদি বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে মূল্য দেয়। সারা বিশ্বের মধ্যে দুই বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর মধ্যে সহযোগিতার অনন্য উদাহরণ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। আমাদের আজকের এই আলোচনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও জোরালো করবে। আমাদের বিশেষ এই বন্ধুত্বের লক্ষ্য হলো দুই দেশের জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতি।
তিস্তা নদীর পানি বন্টন বিষয়ে ২০১১ সালে প্রায় চূড়ান্ত হওয়া কাঠামো চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত চুক্তিটি সইয়ের কথা বললে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার স্টেট হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে এটি নিষ্পত্তির ফের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে ওই বৈঠকে বাংলাদেশ আচমকা ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরার সাবরুম এলাকার জন্য পানি দেয়ার চুক্তি সই করেছে। বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে ঢাকার বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে বিবৃতিতে বরাবরের মত এনআরসি’কে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এনআরসি নিয়ে ঢাকায় বিস্তর উদ্বেগ-অস্বস্তি থাকলেও বৈঠকে প্রসঙ্গটি এসেছিল কি-না? তার কোন উল্লেখ ছিল না। বিবৃতিতে কাশ্মির প্রসঙ্গও অনুপস্থিত।
যদিও ঢাকার তরফে আগেই বলা হয়েছে- কাস্মির ইস্যুটি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বলে মনে করে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বরাতে শীর্ষ বৈঠকের নানা সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে যুক্ত বিবৃতিতে। বলা হয়েছে- দুই প্রধানমন্ত্রী উষ্ণ এবং খুবই আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা করেছেন। তারা ৩টি প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন ভিডিও কনফারেন্সে। ৭টি চুক্তি-সমঝোতা সাইয়ের আনুষ্ঠানিকতায়ও তারা উপস্থিত ছিলেন। দুই দেশের সম্পর্কে গভীরতা এবং বিস্তুৃতির বিদ্যমান অবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয়ে। বৈঠকে তারা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সমপর্কন্নোয়নে আর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে গঠনমূলক ও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সমপর্ক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দুই দেশের জন্যেই লাভজনক হবে এমন সুযোগগুলোকে শতভাগ কাজে লাগাতে উভয় নেতাই সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ন ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার ভিশনকে সমর্থন জানিয়েছেন মোদি। এর আগেও পূর্ন সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি। এদিকে বিবৃতিতে জানানো হয়, মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মোদি তা গ্রহণ করেছেন এবং দুই দেশের কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনায় সফরের দিনক্ষণ ঠিক করার তাগিদ দিয়েছেন।
তিস্তার চুক্তির জন্য বাংলাদেশ অপেক্ষায়, মোদি বললেন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সইয়ের চেষ্টা চলছে: বিবৃতি মতে, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ ২০১১ সালে প্রায় চূড়ান্ত হওয়া তিস্তার পানি বন্টন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের বাস্তবান বা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দেখতে চায়। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করে দ্রুত চুক্তিটি সম্পন্ন করতে কাজ করছে। বিবৃতিতে মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার নদীর পানি বন্টনে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিম চূড়ান্ত করতে আপডেট ডাটা শেয়ারিংয়ে জয়েন্ট রিভার কমিশনের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন দুই নেতা। একই সঙ্গে ফেনী নদী বিষয়েও তারা কাঠামো চুক্তির বিষয়ে একমত হন। ঢাকায় পানি সম্পদ সচিব পর্যায়ে বৈঠকে ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাবরুম এলাকার মানুষের খাবারের জন্য ভারত প্রত্যাহার করতে পারবে মর্মে যে সিদ্ধান্ত হয় তা-ও বিবৃতিতে তুলে ধরা হয় এবং এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করা হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় ভারতের আশ্বাস: এদিকে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আরও বড় পরিসরে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলা হয়- তারা (দুই নেতা) এ বিষয়ে একমত হন যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। উভয় নেতা আরও একমত হন যে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের নবভিটায় নিরাপদ, দ্রুত এবং টেকসই প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার জন্য মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়শী প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আরও ৫০টন মানবিক সাহায্য পাঠাবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। ওই ৫০ টনের মধ্যে রয়েছে- তাবু, রিলিফ এবং প্রাকৃতির দুযোগ থেকে উদ্ধার সরঞ্জমাদি। রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে ভারতের ২৫০ বাড়ি তৈরির কথা জানিয়ে সেখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনার কথাও জানানো হয় বিবৃতিতে।
আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। একইসঙ্গে এ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তার ভ্থমিকার ভ্থয়সী প্রশংসা করেছেন মোদি। এসময় উভয় দেশের জন্য সন্ত্রাসবাদকে সবথেকে বড় সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন দুই নেতা। সন্ত্রাসবাদ দমনে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। দুই পক্ষই সধারণ জনগণের চলাচল সহজীকরণে জোর দেন। বাংলাদেশি বৈধ ট্রাভেলারদের যাতাযাতে যে কোন পোর্ট ব্যবহারের যে প্রতিবন্ধকতা ছিল তা তুলে দেয়াসহ ভারতের তরফে ভিসাসহজীকরণের অঙ্গীকারে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে শেখ হাসিনা ধন্যবাদ জানান। এখন থেকে বাংলাদেশিরা বিদ্যমান সব পোট দিয়ে যেতে এবং ফিরতে পারবেন। যে পোর্ট দিয়ে যাকেন ওই পোর্ট দিয়ে ফেরার বাধ্যবাধকতা আর নেই। আলোচনায় দুই প্রধানমন্ত্রী কার্যকর বর্ডার ম্যানেজমেন্টের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা এটার নিশ্চিয়তা চেয়েছেন যে, বর্ডার হবে ক্রামই ফ্রি, উত্তেজনাহীন সর্বোপরি স্থিতিশীল। উভয় নেতাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বর্ডারের অবশিষ্ট এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের নির্র্দেশনা দেন। দুই নেতাই এ বিষয়ে একমত হন যে সীমান্তে একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুও অগ্রহণযোগ্য। এটা উদ্বেগজনক। তারা উভয়ে বর্ডার সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন মৃত্যুর ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে।
উইন-উইন বিজনেস পার্টনারশীপ: এলডিসি থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে বাংলাদেশের অপরিহার্য এবং প্রাথমিক শর্ত পূরণে সফলতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান মোদি। একই সঙ্গে দুই দেশ এ বিষয়ে একমত হয় যে দ্বিপক্ষীয় কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশীপ এগ্রিমেন্ট সই করতে একটি যৌথ সার্ভে সম্পাদনে। ভারতের অনুরোধে আখাউরা-আগরতলা বন্দর থেকে ভারতীয় পন্যের ওপর যে বাধানিষেধ ছিলো তা উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ভারতীয় কতৃপক্ষ পাটসহ বিভিন্ন পণ্যে ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি প্রত্যাহারের বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। তবে তারা তাদের বিদ্যমান এ সংক্রান্ত আইনের বিষয়টিও তুলে ধরেছে। তবে দুই নেতাই তাদের কর্মকর্তাদের বাণিজ্য সংক্রান্ত পদক্ষেপ এবং সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগী হতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ভারতীয় বাজারে কোটা ও শুল্কমুক্তভাবে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে সম্মত হওয়ায় ভারতের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে: প্রধানমন্ত্রী
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ উদ্বোধনীতে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন- বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রথাগত খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নানা অপ্রথাগত খাতেও সহযোগিতা সমপ্রসারিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে যোগ দিতে চার দিনের সফরে ভারতে অবস্থারত শেখ হাসিনা শনিবার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে এগারোটায় দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দেশটির প্রধানমন্ত্রর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের পর পারস্পরিক সহায়তা সংক্রান্ত ৭টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন হওয়া নতুন তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তারা।
সে সময় দুই নেতাই পারস্পরিক সহায়তার সম্পর্ক নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র বিভিন্ন প্রথাগত খাতে বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও অপ্রথাগত খাত যেমন ব্লু-ইকোনমি ও মেরিটাইম, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, মহাকাশ গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যান্ড উইথ রফতানি, সাইবার সিকিউরিটির মতো বিষয়ে উভয় দেশের সহযোগিতার হাত সমপ্রসারিত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, এসব বহুমুখী সহযোগিতার ফলে আমাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্ববাসীর সামনে সু-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মধ্যকার এই সম্পর্কের শুভ সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ ও সরকারের অপরিসীম অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত: মোদি
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে সারা বিশ্বের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শনিবার দিল্লিতে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর মোদি বলেন, এই আলোচনা দুই দেশের জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে। হায়দরাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর মোদি বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে মূল্য দেয়। সারা বিশ্বের মধ্যে দুই বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর মধ্যে সহযোগিতার অনন্য উদাহরণ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। আমাদের আজকের এই আলোচনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও জোরালো করবে। আমাদের বিশেষ এই বন্ধুত্বের লক্ষ্য হলো দুই দেশের জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতি।
No comments