প্রিয়া সাহা আমার নাম জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন: -ড. আবুল বারকাত
ড. আবুল বারকাত |
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড
ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের সময় প্রিয়া সাহা নামে একজন সংখ্যালঘু নেত্রী
যেভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ ও নিপীড়নের কথা তুলে ধরেছেন তার
পর থেকে অনেকগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে।
প্রিয়া
সাহা মি. ট্রাম্পকে বলেন, বাংলাদেশের ৩৭ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৭০ লাখ
হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান 'নিখোঁজ' হয়েছেন, সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার
হচ্ছেন - কিন্তু তারা বিচার পাচ্ছেন না।
প্রশ্ন উঠছে, 'নিখোঁজ' কথাটার মানে কী? তিন কোটি ৭০ লাখ লোক কি 'গুম' হয়ে গেছেন? এই সংখ্যাটাই বা কোত্থেকে এলো?
এই সংখ্যাগুলোর সাথে উঠে আসছে বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত গবেষক-অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের নাম।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন, গবেষণা করেছেন।
প্রিয়া
সাহা নিজেও আবুল বারকাতের গবেষণায় সংশ্লিষ্ট থাকার দাবি করেছেন,
জানিয়েছেন তার দেয়া তথ্যগুলোর সাথে আবুল বারকাতের গবেষণার ফলাফল মিলে
যায়। অন্য যারাই এ নিয়ে গত কিছুদিনে লেখালিখি করছেন, তারাও আবুল বারকাতের
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য উল্লেখ করছেন।
মি. বারকাতের নিজের কিছু
গবেষণার তথ্য সাম্প্রতিককালে আলোচিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩
এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু 'নিরুদ্দিষ্ট' হয়েছেন। ২০১৬
সালে তিনি বলেছিলেন, এমন হতে পারে যে ৫০ বছর পর বাংলাদেশে আর কোন হিন্দু
থাকবে না।
কিন্তু প্রিয়া সাহা তার '৩৭ মিলিয়ন' সংখ্যার সাথে ড. বারকাতের নাম জড়ানোর পর এই অর্থনীতিবিদ নিজেই এক প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছেন।
তিনি বলছেন, মিসেস সাহা তার নাম উল্লেখ করে কিছু তথ্য-উপাত্ত বিকৃতভাবে
ব্যবহার করেছেন, বিভ্রান্তিমূলক ও নীতিবিগর্হিত বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি
এসব বক্তব্য প্রত্যাহারেরও দাবি জানান প্রিয়া সাহার প্রতি।
'৩৭ মিলিয়ন' সংখ্যাটা আমি কোথাও বলিনি'
বাংলাদেশের
সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ, নিপীড়ন ইত্যাদি প্রসঙ্গে যেসব কথাবার্তা চলছে -
এগুলোর ব্যাপারে একজন গবেষকের দৃষ্টিতে প্রকৃত তথ্য-উপাত্তগুলো কি?
এ প্রশ্ন নিয়ে কথা হয় বিবিসি বাংলার দীর্ঘ সময় ধরে কথা হয় অধ্যাপক আবুল বারকাতের সাথে।
তিনি
বলেন, "প্রিয়া সাহা যে তথ্যটা দিয়েছেন তা হলো বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ
(তিনি বলেছেন ৩৭ মিলিয়ন) হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছেন, এবং এর
পর ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি আমার নাম উল্লেখ করে বলছেন, তার এই তথ্য 'আমার
গবেষণা-উদ্ভূত তথ্যের সাথে মিলে যায় বা একই' - এ কথাটা মিথ্যা।"
প্রশ্ন হলো, আবুল বারকাত তাহলে কী বলেছিলেন তার গবেষণায়?
তিনি
তার ২০১৬ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশে কৃষি ভূমি জলা সংস্কারের রাজনৈতিক
অর্থনীতি' নামের বই থেকে উদ্ধৃতি দেন। বইটির একটি অনুচ্ছেদ হলো 'ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের ভূসম্পত্তিকেনন্দ্রিক প্রান্তিকতা: শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি
আইন।'
এখানে ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় আবুল বারকাত লিখেছেন: "আমার হিসেবে প্রায়
পাঁচ দশকে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু
ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন।"
তিনি বলছেন, "আমি কোথাও ৩
কোটি ৭০ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছেন একথা বলি নি। উপরন্তু
প্রিয়া সাহা কোথাও গবেষণার যে সময়কাল - ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ এই পঞ্চাশ বছর -
তার উল্লেখ করেন নি।
অধ্যাপক বারকাত আরো বলেন, "প্রিয়া সাহা এক
জায়গায় বলছেন যে তিনি সরাসরি আমার সাথে কাজ করেছেন, যে কারণে তিনি
বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবহিত। আমার সরাসরি উত্তর - প্রিয়া সাহা কখনো আমার
সহ-গবেষক বলেন, কো-অথর বলেন, গবেষণা সহযোগী বা সহকারী বলেন - কিছুই ছিলেন
না। "
"আমার নাম উল্লেখ করে প্রিয়া সাহা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছেন। এ জন্য আমি একটি প্রতিবাদপত্রও দিয়েছি" - বলেন ড. বারকাত।
প্রিয়া সাহা নিজে যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন
এই তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যাটি সম্পর্কে প্রিয়া সাহা নিজেই তার ইউটিউবে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে একটি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন।
তিনি
বলেন, "২০০১ সালের পরিসংখ্যানে সংখ্যালঘুদের উপর একটা চ্যাপ্টার রয়েছে।
সেনসাস (আদমশুমারি) অনুসারে দেশভাগের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিলো মোট জনসংখ্যার ২৯.৭ শতাংশ। এখন তা কমে ৯.৭ শতাংশ।
প্রিয়া
সাহা বলছেন, "সংখ্যালঘুদের শতকরা ভাগ যদি এখনো একই রকম থাকতো তাহলে
বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৩ কোটি ৭০ লাখের বেশি হতো - সেটাই আমি বলতে
চেয়েছি।"
কিন্তু পরিসংখ্যানের যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি - তাতে কি এরকম হিসেব যৌক্তিক হয়?
এ
প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, "না, একেবারেই না। প্রিয়া সাহা
একটা পাটীগণিত করেছেন। কিন্তু এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়।"
"আর
পরিসংখ্যান পরের কথা, আগে দেখতে হবে গবেষণার পদ্ধতি বা মেথডোলজি। যেমন ১৯৪১
সালে বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান জনসংখ্যার অনুপাত যা ছিল, এখনো প্রায় তাই আছে।
কিন্তু প্রিয়া সাহা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব এক জায়গায় করলেন কিভাবে?"
ডিজঅ্যাপিয়ার্ড মানে কি? নিখোঁজরা কোথায় গেলেন?
এর
পর আসছে প্রিয়া সাহার ব্যবহৃত 'ডিজএ্যাপিয়ার্ড' বা নিখোঁজ শব্দটির কথা।
তিনি বলছেন, ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বাংলাদেশের জনসংখ্যা থেকে
'নেই' হয়ে গেছে। নিখোঁজ মানুষগুলো কোথায় গেছে, তার সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর
দেননি তিনি।
আবুল বারকাত তার বইয়ে নিজেও লিখেছেন যে ১৯৬৪ সাল থেকে
২০১৩ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ
'নিরুদ্দিষ্ট' হয়েছেন।
অধ্যাপক বারকাত বলেন, "এটা হয়। এরকম শব্দ
নোবেল পুরস্কার পাওয়া অর্থনীতিবিদ তার অনেক আগের লেখায় 'মিসিং পপুলেশন'
বা 'নিরুদ্দিষ্ট জনসংখ্যা' কথাটি ব্যবহার করেছেন। নোয়াম চমস্কি এবং জর্জ
অরওয়েলও তাদের লেখায় সমার্থক শব্দ 'আন-পিপলিং' ব্যবহার করেছেন - যা
জোরজবরদস্তির কারণে বা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির কারণে ঘটতে পারে। সে অর্থে
এটা ব্যবহার করা যেতে পারে।"
"তবে প্রিয়া সাহা যদি সে অর্থে ব্যবহার
করতেন - তাহলে তিনি উল্লেখ করতেন শত্রু সম্পত্তি আইন বা অর্পিত সম্পত্তি
আইনের কথা। সেরকম কোন রেফারেন্স তিনি দেন নি।"
"তাহলে তিনি কি বলতে চাইছেন? বাংলাদেশের অবস্থা কি এরকম যে এখানে আমরা
হিন্দু কাউকে দেখলেই তেড়ে উঠি, মারি? আমার তো মনে হয় না জিনিসটা এরকম" -
বলেন ড. বারকাত।
অধ্যাপক বারকাত বলেন - "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
যে অভাব - এই সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী। প্রিয়া সাহা যার কাছে গিয়ে এ
অভিযোগ তুলেছেন - তার চাইতে সাম্প্রদায়িক লোক তো আর আছেন বলে আমার মনে
হয় না। এখানে তো অন্য কিছু আছে বলে মনে হয়, এটা হয়তো এত সিম্পল কিছু
না।"
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: বাংলাদেশের পরিস্থিতি আসলে কী?
আবুল
বারকাত বলছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের পেছনে শুধু শত্রু
সম্পত্তি আইনই (পরে অর্পিত সম্পত্তি আইন - যা শেখ হাসিনার সরকার ২০০১ সালে
বিলোপ করে ) একমাত্র নয়, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,
বাস্তব নিরাপত্তাহীনতা বা নিরাপত্তাহীনতার শংকা - এই সবগুলোই এর কারণ।
কিন্তু
সাধারণভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সত্যটা কি? আবুল বারকাত তার
গবেষণার আলোকে বলেছিলেন, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ হিন্দু দেশত্যাগ করছে। এ
হিসাবটা কিভাবে করা হয়েছিল?
জবাবে অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, গড়
হিসেবটা হচ্ছে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ৫০ বছরের সংখ্যার গড়,
কোন একদিনের গড় নয়।
আবুল বারকাতকে আরো প্রশ্ন করা হয়, তিনি
বছরকয়েক আগে বলেছিলেন যে ৫০ বছর পরে হয়তো বাংলাদেশে আর কোন হিন্দুই থাকবে
না। এখনও কি পরিস্থিতি তেমনই আছে?
এর জবাবে ড. বারকাত বলেন, "এটা
ছিল বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন বিলোপের আগের সময়টার কথা। সেই
পরিস্থিতির আলোকেই কথাটা বলা। এখন অর্পিত সম্পত্তি বিলোপ হয়েছে, অর্পিত
সম্পত্তি প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে, ট্রাইবুনাল করার কথা
বলা হচ্ছে।"
"তাই আমি মনে করি না যে (হিন্দু) শূন্য হয়ে যাবার ব্যাপারটা ঘটবে" - বলেন তিনি।
'দেশত্যাগের মাত্রা কমে গেছে'
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ কি এখনো চলছে? আবুল বারকাত বলছেন, তার মনে হয় সেটা অনেকখানি কমে গেছে।
"কারণ
যখন অর্পিত সম্পত্তি আইন বিলোপ হলো, তখন হিন্দুদের সম্পত্তি ভেস্টেড হযে
যাওয়া যে ইনটেনসিটিতে ছিল - তা হবার সম্ভাবনা আর থাকলো না।"
"আমি
একটা ভালো জিনিস দেখছি, শত্রু সম্পত্তি বিলোপ আইন হয়েছে - যা কঠিন কাজ
এবং কখনোই করা হয় নি। এখন ট্রাইবুনালে যাওয়া যায়। তবে আইন সবার জন্য
হলেও সুবিচার পাবার সংগতি সবার থাকে না। তা যদি হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে
সমস্যা আছে এবং সে সমস্যা দূর করতে হবে। আমি নৈরাশ্যবাদী নই।"
"তবে
অন্য কারণগুলো - যেমন বাস্তব নিরাপত্তাহীনতা বা নিরাপত্তাহীনতার শংকা, বা
নাসিরনগরের ঘটনার মতো ঘটনা, এগুলো যে একেবারেই নেই তা নয়। তবে তার মাত্রা
কমে গেছে, এক সময় আরো কমবে" - বলেন ড. বারকাত।
তিনি বলছেন,
"গবেষক হিসেবে আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের
ইনটেনসিটি বা তীব্রতা কমে গেছে। তবে এক পরিবার থেকে একজন আরেক দেশে চলে
গেলে তার সূত্রে অন্যরাও যায় - এটা হিন্দু বা মুসলমান সব পরিবারেই হতে
দেখা যায়। এটাও এক রকম মাইগ্রেশন, কিন্তু এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।"
"তবে ভীতির পরিবেশ যদি তৈরি হয় কোন কারণে - তাহলে, মনে রাখতে হবে মানুষ তো ভীতির মধ্যে থাকতে চায় না - বলেন অধ্যাপক আবুল বারকাত।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামনে অভিযোগ তুলছেন প্রিয়া সাহা, যে ভিডিওটি বাংলাদেশে ভাইরাল হয়েছে। |
No comments