অতীত নিয়ে অসন্তোষ পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু করার তাগিদ- ইসির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক by সিরাজুস সালেকিন ও বেলায়েত হোসাইন
সাম্প্রতিক
সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। অতীতের মতো আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন যাতে
প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল নির্বাচনে
দায়িত্ব পালনকারী আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ
নির্দেশনা দেয়া হয়। বৈঠকে একটি বাহিনীর প্রধানের পক্ষ থেকে নির্বাচনের দিন
টেলিভিশনে ভোট কেন্দ্রের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপের
পরামর্শ আসলে নির্বাচন কমিশন তা নাকচ করে দেয়। একজন কমিশনার সাম্প্রতিক হয়ে
যাওয়া নির্বাচনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের
উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ জায়গা থেকে নির্বাচন পরিচালনা করছে।
তারপরও নির্বাচন ভালো হচ্ছে না কেন? পৌর নির্বাচন নিয়ে যাতে কোন প্রশ্ন না
উঠে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট
রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্বাচনের পরিবেশ এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে
নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেন। তাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন
কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, যেহেতু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
রয়েছে তাই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। নির্বাচনে আচরণবিধি
লঙ্ঘন ও অনিয়মের ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন
অপর এক নির্বাচন কমিশনার।
রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ র্যাব, আনসার, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন। ২৩৪ পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মাঠ পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ এসেছে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে। বৈঠক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
টাঙ্গাইল সদর পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেয়া হয়েছে। এতে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ সংখ্যাটা বাড়ানোর চিন্তা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেন তিনি। হাইকোর্টের আদেশে বিভিন্ন স্থানে বাতিল হওয়া প্রার্থীরা মনোনয়ন ফেরত পাওয়ায় ব্যালট পেপার নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। কুষ্টিয়ার রিটার্নিং অফিসার মুজিবর ফেরদৌস বলেন, হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় আমরা অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছি। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে অনেকে প্রার্থিতা ফেরত পেয়েছেন। এটা চলমান রয়েছে। নির্বাচনের দু-একদিন আগেও যদি কেউ প্রার্থিতা ফেরত পায়, তাহলে এ বিষয়ে একটা জটিলতা তৈরি হবে। ব্যালট পেপারেও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ব্যাপারে ইসির নির্দেশনা চান তিনি।
ভোটকেন্দ্র থেকে গণমাধ্যমের সরাসরি সম্প্রচার সম্পর্কে পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক বলেন, গত সিটি নির্বাচনে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। কারণ, যেখানে প্রিজাইডিং অফিসার বসে কাজ করে সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। এতে কাজের কিছু ক্ষতি হয়। আমার মনে হয় তাদের বাইরে থাকাই ভালো। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঠিক নির্দেশনা থাকলে এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হবে না। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের কাছে ২০১১ সালের মতোই পুলিশ চেয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালে ২৬৯টি পৌরসভায় দু’ভাগে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এবার ২৩৪টিতে একসঙ্গেই নির্বাচন হচ্ছে। এই অবস্থায় গতবারের মতো পুলিশ সদস্য দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৩ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৪ জন পুলিশ সদস্য দেয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব রাখেন তিনি। এসময় ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাধারণ ভোটকেন্দ্রে অতীতের ন্যায় ৫ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৬ জন পুলিশ সদস্য দেয়া দরকার। প্রয়োজনে টহল পুলিশের সংখ্যা কমানো যেতে পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটি বাস্তবে সব জায়গায় গড়ে উঠেনি। মিডিয়াতে বর্তমান সময়ে নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতিতে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে তা এক ধরনের প্রতিযোগিতা। অপর এক গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে দলীয় কোন্দল বাড়তে পারে। কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে। নির্বাচনের সুযোগে ফেরারি আসামিরা এলাকায় আসতে পারে। চলমান সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে একটা অভিযোগ এসেছে যে, কমিশনের বক্তব্যে বিভিন্নতা ছিলো। তারা অনেক কিছু স্পষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু এটা সঠিক নয়। আমাদের বক্তব্যে কোন বিভিন্নতা ছিল না। কোন বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে, আপনারা আমাদের ফোন করতে পারতেন। এসময় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা কোন খবর পাই না। পত্রিকা দেখে আমাদের জানতে হয়। পত্রিকা যা লিখছে- তা যেমন অতিরঞ্জিত, আবার কোন কিছু হচ্ছে না বলে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে চুপ রয়েছেন তাও ঠিক নয়। দুদিক থেকেই সঠিক খবর আসছে না। তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা দায়সারাভাবে কাজ করে যাবেন তা হবে না। এটা আপনাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কেউ যদি মনে করেন- কোনরকম নির্বাচনটা পার করে দিবো। তাহলে ভুল করবেন। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন না, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যে যে নির্বাচন হয়েছিল নির্বাচনে কমিশনের পক্ষ থেকে আমি সেই নির্বাচনে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছেন। তারা আমাকে বলেছেন, স্যার আমরা সারা দুনিয়ার নির্বাচন দেখি। আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন দেখলে খুব কষ্ট লাগে। হাফিজ আরও বলেন, সবারই প্রশ্ন নির্বাচন কেন ভালো হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন তো কারো পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে না। তারপরও কেন নির্বাচন ভালো হচ্ছে না? তাই আমি অনুরোধ করবো এ নির্বাচনে যেনো সেই রকম কোন কথা থেকে না যায়, যা মানুষ শুনতে চায় না।
এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন বলেন, হাফিজ সাহেব একটা কথা বলেছেন। নির্বাচন কেন ভালো হচ্ছে না। এটা আমরা এত তাড়াতাড়ি আশা করতে পারি না। তবে আমাদের বিশ্বাস দিন পাল্টাবে। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাচ্ছে। সিইসি বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি কোন কেন্দ্র আক্রান্ত হলে আমাদের কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়ে। নির্বাচন বন্ধ করে দিতে হয়। পরে আবার নির্বাচন করতে গিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। এটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত না। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বেশ কয়েক জায়গা থেকে সেনা মোতায়েনের দাবি এসেছে। কিন্তু এখানে সবার কথা শুনে আমরা নিশ্চিত হলাম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেনা মোতায়েনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। সিইসি বলেন, অনেক জায়গায় সন্ত্রাসী ও মাস্তানরা ধরা পড়ে। কিন্তু খবরের কাগজ সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে না। কারণ, নেগেটিভ খবর প্রকাশে তারা বেশি উৎসাহী। এটা তারা উপভোগ করে। কিন্তু আপনাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য এসেছে সবকিছু ঠিক আছে। এটা যেনো ঠিক থাকে। সেই দিকে তৎপর থাকতে হবে। কোনভাবেই যেনো দুষ্কৃতিকারীরা প্যারামিটারের ভেতরে না আসতে পারে। ভোটের আগের রাতে যেনো কেন্দ্র দখল না হয়, সেই দিকে সজাগ থাকতে হবে। আগে থেকে সব খবর রাখতে হবে।
বৈঠকে রাজশাহী ও রংপুরে জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। জনসমাবেশ টার্গেট হতে পারে। এই ধরনের কোন পরিস্থিতি যেনো না ঘটে সেদিকে আমরা সজাগ থাকবো। আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সুযোগে সর্বশক্তি দিয়ে এদের আয়ত্তে আনতে হবে। মিডিয়া প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, খবরের কাগজে অতি রঞ্জিত করে লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে সঠিক বিষয়টি তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে। প্রমাণ পেলে অ্যাকশন নিতে হবে। এখান থেকে অ্যাকশন না নিলে ইসি থেকে সেভাবে অ্যাকশন নেয়া সম্ভব হয় না।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা অ্যাকশন নেবেন এবং মিডিয়াকেও জানাবেন। তাহলে তারা সানন্দে সেটা কাভারেজ দেবে। এর আগে মিডিয়ার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমরা কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলাম। মিডিয়া থেকে আমাদের হেল্প নিতে হবে। তারা কেন্দ্রে প্রবেশ করবে। সাংবাদিকদেরকে সেই সুযোগ করে দিতে হবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে কেউ কেন্দ্রে অবস্থান করবে না।
বৈঠক শেষে সিইসি বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের মতো কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি কমিশনের অনুকূলে রয়েছে। মাঠেও পূর্ণ শৃঙ্খলা থাকবে। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে সীমিত আকারে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। এবার এমন কোন পরিকল্পনা নেই। বিজিবি, র্যাব বলেছে, তাদের পর্যাপ্ত ফোর্স আছে। সেগুলো মোতায়েন করবেন। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশের বিষয়ে তিনি বলেন, অতীতে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকলে এবার যাতে তা না হয়, সেজন্য নির্দেশনা দিয়েছি। সাংবাদিকদের পাস দেব। তারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন এবং রিপোর্ট করবেন। তবে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেন্দ্রে বেশিক্ষণ থাকবেন না। তাতে অন্যরা সুযোগ পাবে।
আগামী ৩০শে ডিসেম্বর ২৩৪ পৌরসভায় একযোগে ভোটগ্রহণ হবে। প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এটি। এতে ২০টি দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মেয়র পদে ৯২৩ প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে লড়াইয়ে রয়েছেন আরও ১১ হাজারের বেশি প্রার্থী। সাড়ে তিন হাজার ভোটকেন্দ্রের এসব পৌরসভায় ভোটার রয়েছে প্রায় ৭১ লাখ।
রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ র্যাব, আনসার, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন। ২৩৪ পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মাঠ পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ এসেছে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে। বৈঠক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
টাঙ্গাইল সদর পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেয়া হয়েছে। এতে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ সংখ্যাটা বাড়ানোর চিন্তা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেন তিনি। হাইকোর্টের আদেশে বিভিন্ন স্থানে বাতিল হওয়া প্রার্থীরা মনোনয়ন ফেরত পাওয়ায় ব্যালট পেপার নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। কুষ্টিয়ার রিটার্নিং অফিসার মুজিবর ফেরদৌস বলেন, হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় আমরা অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছি। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে অনেকে প্রার্থিতা ফেরত পেয়েছেন। এটা চলমান রয়েছে। নির্বাচনের দু-একদিন আগেও যদি কেউ প্রার্থিতা ফেরত পায়, তাহলে এ বিষয়ে একটা জটিলতা তৈরি হবে। ব্যালট পেপারেও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ব্যাপারে ইসির নির্দেশনা চান তিনি।
ভোটকেন্দ্র থেকে গণমাধ্যমের সরাসরি সম্প্রচার সম্পর্কে পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক বলেন, গত সিটি নির্বাচনে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। কারণ, যেখানে প্রিজাইডিং অফিসার বসে কাজ করে সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। এতে কাজের কিছু ক্ষতি হয়। আমার মনে হয় তাদের বাইরে থাকাই ভালো। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঠিক নির্দেশনা থাকলে এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হবে না। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের কাছে ২০১১ সালের মতোই পুলিশ চেয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালে ২৬৯টি পৌরসভায় দু’ভাগে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এবার ২৩৪টিতে একসঙ্গেই নির্বাচন হচ্ছে। এই অবস্থায় গতবারের মতো পুলিশ সদস্য দেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৩ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৪ জন পুলিশ সদস্য দেয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব রাখেন তিনি। এসময় ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাধারণ ভোটকেন্দ্রে অতীতের ন্যায় ৫ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৬ জন পুলিশ সদস্য দেয়া দরকার। প্রয়োজনে টহল পুলিশের সংখ্যা কমানো যেতে পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটি বাস্তবে সব জায়গায় গড়ে উঠেনি। মিডিয়াতে বর্তমান সময়ে নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতিতে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে তা এক ধরনের প্রতিযোগিতা। অপর এক গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে দলীয় কোন্দল বাড়তে পারে। কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে। নির্বাচনের সুযোগে ফেরারি আসামিরা এলাকায় আসতে পারে। চলমান সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে একটা অভিযোগ এসেছে যে, কমিশনের বক্তব্যে বিভিন্নতা ছিলো। তারা অনেক কিছু স্পষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু এটা সঠিক নয়। আমাদের বক্তব্যে কোন বিভিন্নতা ছিল না। কোন বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে, আপনারা আমাদের ফোন করতে পারতেন। এসময় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা কোন খবর পাই না। পত্রিকা দেখে আমাদের জানতে হয়। পত্রিকা যা লিখছে- তা যেমন অতিরঞ্জিত, আবার কোন কিছু হচ্ছে না বলে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে চুপ রয়েছেন তাও ঠিক নয়। দুদিক থেকেই সঠিক খবর আসছে না। তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা দায়সারাভাবে কাজ করে যাবেন তা হবে না। এটা আপনাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কেউ যদি মনে করেন- কোনরকম নির্বাচনটা পার করে দিবো। তাহলে ভুল করবেন। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন না, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যে যে নির্বাচন হয়েছিল নির্বাচনে কমিশনের পক্ষ থেকে আমি সেই নির্বাচনে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছেন। তারা আমাকে বলেছেন, স্যার আমরা সারা দুনিয়ার নির্বাচন দেখি। আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন দেখলে খুব কষ্ট লাগে। হাফিজ আরও বলেন, সবারই প্রশ্ন নির্বাচন কেন ভালো হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন তো কারো পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে না। তারপরও কেন নির্বাচন ভালো হচ্ছে না? তাই আমি অনুরোধ করবো এ নির্বাচনে যেনো সেই রকম কোন কথা থেকে না যায়, যা মানুষ শুনতে চায় না।
এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন বলেন, হাফিজ সাহেব একটা কথা বলেছেন। নির্বাচন কেন ভালো হচ্ছে না। এটা আমরা এত তাড়াতাড়ি আশা করতে পারি না। তবে আমাদের বিশ্বাস দিন পাল্টাবে। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাচ্ছে। সিইসি বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি কোন কেন্দ্র আক্রান্ত হলে আমাদের কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়ে। নির্বাচন বন্ধ করে দিতে হয়। পরে আবার নির্বাচন করতে গিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। এটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত না। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বেশ কয়েক জায়গা থেকে সেনা মোতায়েনের দাবি এসেছে। কিন্তু এখানে সবার কথা শুনে আমরা নিশ্চিত হলাম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেনা মোতায়েনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। সিইসি বলেন, অনেক জায়গায় সন্ত্রাসী ও মাস্তানরা ধরা পড়ে। কিন্তু খবরের কাগজ সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে না। কারণ, নেগেটিভ খবর প্রকাশে তারা বেশি উৎসাহী। এটা তারা উপভোগ করে। কিন্তু আপনাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য এসেছে সবকিছু ঠিক আছে। এটা যেনো ঠিক থাকে। সেই দিকে তৎপর থাকতে হবে। কোনভাবেই যেনো দুষ্কৃতিকারীরা প্যারামিটারের ভেতরে না আসতে পারে। ভোটের আগের রাতে যেনো কেন্দ্র দখল না হয়, সেই দিকে সজাগ থাকতে হবে। আগে থেকে সব খবর রাখতে হবে।
বৈঠকে রাজশাহী ও রংপুরে জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। জনসমাবেশ টার্গেট হতে পারে। এই ধরনের কোন পরিস্থিতি যেনো না ঘটে সেদিকে আমরা সজাগ থাকবো। আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সুযোগে সর্বশক্তি দিয়ে এদের আয়ত্তে আনতে হবে। মিডিয়া প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, খবরের কাগজে অতি রঞ্জিত করে লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে সঠিক বিষয়টি তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে। প্রমাণ পেলে অ্যাকশন নিতে হবে। এখান থেকে অ্যাকশন না নিলে ইসি থেকে সেভাবে অ্যাকশন নেয়া সম্ভব হয় না।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা অ্যাকশন নেবেন এবং মিডিয়াকেও জানাবেন। তাহলে তারা সানন্দে সেটা কাভারেজ দেবে। এর আগে মিডিয়ার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমরা কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলাম। মিডিয়া থেকে আমাদের হেল্প নিতে হবে। তারা কেন্দ্রে প্রবেশ করবে। সাংবাদিকদেরকে সেই সুযোগ করে দিতে হবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে কেউ কেন্দ্রে অবস্থান করবে না।
বৈঠক শেষে সিইসি বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের মতো কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি কমিশনের অনুকূলে রয়েছে। মাঠেও পূর্ণ শৃঙ্খলা থাকবে। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে সীমিত আকারে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। এবার এমন কোন পরিকল্পনা নেই। বিজিবি, র্যাব বলেছে, তাদের পর্যাপ্ত ফোর্স আছে। সেগুলো মোতায়েন করবেন। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশের বিষয়ে তিনি বলেন, অতীতে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকলে এবার যাতে তা না হয়, সেজন্য নির্দেশনা দিয়েছি। সাংবাদিকদের পাস দেব। তারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন এবং রিপোর্ট করবেন। তবে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেন্দ্রে বেশিক্ষণ থাকবেন না। তাতে অন্যরা সুযোগ পাবে।
আগামী ৩০শে ডিসেম্বর ২৩৪ পৌরসভায় একযোগে ভোটগ্রহণ হবে। প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এটি। এতে ২০টি দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মেয়র পদে ৯২৩ প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে লড়াইয়ে রয়েছেন আরও ১১ হাজারের বেশি প্রার্থী। সাড়ে তিন হাজার ভোটকেন্দ্রের এসব পৌরসভায় ভোটার রয়েছে প্রায় ৭১ লাখ।
No comments