ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সাফল্য! by খলিলউল্লাহ্
চ্যালেঞ্জের মুখে নিকোলাস মাদুরো |
১৬
বছর পর ভেনেজুয়েলার জনপ্রিয় সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের
সমাজতান্ত্রিক দলের পরাজয় ঘটল ৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের
নির্বাচনে। ২০১৩ সালে চাভেজ মারা যাওয়ার পর নিকোলাস মাদুরো দলের দায়িত্ব
গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন থেকেই বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছিলেন
মাদুরো হয়তো সমাজতান্ত্রিক দলের জনপ্রিয়তা অটুট রেখে ভেনেজুয়েলার বিপ্লবী
নেতা সিমন বলিভারের আদর্শকে ধারণ করে চাভেজ যে বলিভারিয়ান বিপ্লব শুরু
করেছিলেন, তা এগিয়ে নিতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত মধ্য ডানপন্থী বিরোধী
দলের সংসদীয় নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে তা সত্য হতে শুরু করল। ১৬৭টি
আসনের মধ্যে বিরোধী দল ৯৯টি আসনে জয়ী হয়েছে। ২২টি আসনের ফল এখনো প্রকাশিত
হয়নি। সমাজতান্ত্রিক দলের পরাজয়ের পেছনে অর্থনৈতিক দুরবস্থাই প্রাথমিকভাবে
দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
প্রেসিডেন্টশাসিত সরকারব্যবস্থা হওয়ায় ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত মাদুরো নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারবেন। কিন্তু সদ্য বিজয়ী এমইউডি সংসদে মাদুরোর নীতি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া তারা নিজেরাও নতুন আইন পাস করে দেশে অনেক পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা ‘রাজনৈতিক বন্দীদের’ কারাগার থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে দীর্ঘ ১৬ বছরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থকেরা থাকায় সদ্য বিজয়ী দল পরিবর্তন কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
তেলের দাম পড়ে যাওয়াই ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ। তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েই সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল ভেনেজুয়েলা। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন ওপেককে তেলের দাম বাড়াতে ভেনেজুয়েলার অনুরোধের পরও ওপেক তা করেনি। কারণ হিসেবে ওপেক দেশগুলো শেল প্রকল্পের তেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বলে জানায়। প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে ওপেক দেশগুলো তেলের দাম কমানোর ফলে ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়, যা সরকারি ব্যবস্থাপনাকে আরও দুর্বল করে দেয়। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ভেনেজুয়েলাকে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বিশৃঙ্খল অর্থনীতির’ দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে মোটেও দেরি করেনি। লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির দেশ এখন ভেনেজুয়েলা। সঙ্গে রয়েছে মৌলিক ভোগ্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট। অবস্থা এমনই যে ক্রেতারা মৌলিক পণ্যের জন্য দীর্ঘ সারিতে কয়েক দিন অপেক্ষা করেও খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
কিন্তু নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে শুধু ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে দায়ী করা হলে এই দুরবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যে বড় ভূমিকা রয়েছে, তা অপ্রকাশিত থেকে যাবে। চাভেজ ও তাঁর উত্তরসূরি মাদুরো উভয়ই ভেনেজুয়েলাকে চাভেজের ভাষায় ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ আদর্শে রূপান্তর করতে অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সে লক্ষ্যে বিশাল তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ব্যয় করা হচ্ছিল সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে। তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুনর্বণ্টনমূলক কর্মসূচি চালু করার মাধ্যমে চাভেজ এমন এক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের দেখিয়ে দেওয়া নব্য উদারনীতিবাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মাদুরোও তা চলমান রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে দেশ চালাচ্ছিলেন। চাভেজের পর লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোতেও বামপন্থী বা মধ্য বামপন্থী দলগুলো ধীরে ধীরে ক্ষমতায় আসতে শুরু করে এবং বলিভারিয়ান মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে।
ভেনেজুয়েলা হলো লাতিন আমেরিকার আঞ্চলিকতাবাদ, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় ধারণা ও বলিভারিয়ান আদর্শের চালক। দেশটি ক্যারিবীয় ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ঠেকাতে ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ডমিনো তত্ত্ব অনুযায়ী, তেলসম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশটিতে সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে পারলে কিউবা, ইকুয়েডর ও বলিভিয়ার মতো দেশগুলো বিপন্ন হয়ে পড়বে, আর্জেন্টিনার নব্য ডানপন্থী সরকার আরও চাঙা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কলম্বিয়া, পেরু, প্যারাগুয়ে ও মধ্য আমেরিকার বাইরেও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে বিস্তৃত হওয়ার পথ সুগম হবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনে উঠেপড়ে লাগে।
চাভেজ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। চাভেজ তাঁর আগের রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। ২০১০ সালে অভ্যুত্থান উসকে দেওয়ার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে কারাকাস থেকে বহিষ্কার করা হলে দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক একদমই নিচে নেমে যায়। এক যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনী রাজনীতি, অন্তর্ঘাত ও সামরিক অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তবে সাম্প্রতিক কালে মাদুরো ক্ষমতায় আসার পর তারা আবারও রাজপথের সহিংসতা উসকে দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। ২০১৪ সালের শুরু থেকেই লিওপোলদো লোপেজের নেতৃত্বে সরকারি স্থাপনা ও কর্মীদের ওপর সহিংস হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেসব সহিংসতায় ৪৩ জন নিহত ও ৮৭০ জন আহত হয়। সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন এনজিও, রাজনৈতিক দল, নেতা, সাবেক ও বর্তমান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিপুল অর্থ দেয়। ২০১৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র আবারও এক সামরিক-বেসামরিক অভ্যুত্থানে ইন্ধন জোগায়, যা সফল হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে মৌলিক পণ্যের ব্যাপক মজুত ঘটিয়ে সংকট তৈরি করে। মুদ্রার কালোবাজারি ও চোরাকারবারির মাধ্যমে কলম্বিয়ায় ভোগ্যপণ্য পাচার করেও মৌলিক পণ্যের ভয়াবহ সংকট তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রাখে। এর ফলে মাদুরোর নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতি জনরোষ সৃষ্টি হলে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে দলটির পরাজয় নিশ্চিত হয়। মাদুরো বলেছেন, তাঁর দল হেরেছে বলেই যে ভেনেজুয়েলায় সমাজতান্ত্রিক ও বলিভারিয়ান আদর্শের পরাজয় ঘটেছে, তা নয়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই তাঁর দল হেরেছে, যার পেছনে মূল কারণ ছিল তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, জবাবদিহির অভাব ও রুগ্ণ অবকাঠামোর মতো সমস্যাও অর্থনীতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করায় সমাজতান্ত্রিক দলটির ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তনে হস্তক্ষেপের ইতিহাস পুরোনো। ভেনেজুয়েলার সংসদীয় নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দলের পরাজয় ও ডানপন্থী দলের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আবারও সে রকম পুনরাবৃত্তিই হলো।
খলিলউল্লাহ্: জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএসএস) ও সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
khalil.jibon@gmail.com
প্রেসিডেন্টশাসিত সরকারব্যবস্থা হওয়ায় ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত মাদুরো নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারবেন। কিন্তু সদ্য বিজয়ী এমইউডি সংসদে মাদুরোর নীতি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া তারা নিজেরাও নতুন আইন পাস করে দেশে অনেক পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা ‘রাজনৈতিক বন্দীদের’ কারাগার থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে দীর্ঘ ১৬ বছরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থকেরা থাকায় সদ্য বিজয়ী দল পরিবর্তন কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
তেলের দাম পড়ে যাওয়াই ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ। তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েই সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল ভেনেজুয়েলা। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন ওপেককে তেলের দাম বাড়াতে ভেনেজুয়েলার অনুরোধের পরও ওপেক তা করেনি। কারণ হিসেবে ওপেক দেশগুলো শেল প্রকল্পের তেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বলে জানায়। প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে ওপেক দেশগুলো তেলের দাম কমানোর ফলে ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়, যা সরকারি ব্যবস্থাপনাকে আরও দুর্বল করে দেয়। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ভেনেজুয়েলাকে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বিশৃঙ্খল অর্থনীতির’ দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে মোটেও দেরি করেনি। লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির দেশ এখন ভেনেজুয়েলা। সঙ্গে রয়েছে মৌলিক ভোগ্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট। অবস্থা এমনই যে ক্রেতারা মৌলিক পণ্যের জন্য দীর্ঘ সারিতে কয়েক দিন অপেক্ষা করেও খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
কিন্তু নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে শুধু ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে দায়ী করা হলে এই দুরবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যে বড় ভূমিকা রয়েছে, তা অপ্রকাশিত থেকে যাবে। চাভেজ ও তাঁর উত্তরসূরি মাদুরো উভয়ই ভেনেজুয়েলাকে চাভেজের ভাষায় ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ আদর্শে রূপান্তর করতে অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সে লক্ষ্যে বিশাল তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ব্যয় করা হচ্ছিল সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে। তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুনর্বণ্টনমূলক কর্মসূচি চালু করার মাধ্যমে চাভেজ এমন এক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের দেখিয়ে দেওয়া নব্য উদারনীতিবাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মাদুরোও তা চলমান রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে দেশ চালাচ্ছিলেন। চাভেজের পর লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোতেও বামপন্থী বা মধ্য বামপন্থী দলগুলো ধীরে ধীরে ক্ষমতায় আসতে শুরু করে এবং বলিভারিয়ান মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে।
ভেনেজুয়েলা হলো লাতিন আমেরিকার আঞ্চলিকতাবাদ, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় ধারণা ও বলিভারিয়ান আদর্শের চালক। দেশটি ক্যারিবীয় ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ঠেকাতে ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ডমিনো তত্ত্ব অনুযায়ী, তেলসম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশটিতে সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে পারলে কিউবা, ইকুয়েডর ও বলিভিয়ার মতো দেশগুলো বিপন্ন হয়ে পড়বে, আর্জেন্টিনার নব্য ডানপন্থী সরকার আরও চাঙা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কলম্বিয়া, পেরু, প্যারাগুয়ে ও মধ্য আমেরিকার বাইরেও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে বিস্তৃত হওয়ার পথ সুগম হবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনে উঠেপড়ে লাগে।
চাভেজ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। চাভেজ তাঁর আগের রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। ২০১০ সালে অভ্যুত্থান উসকে দেওয়ার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে কারাকাস থেকে বহিষ্কার করা হলে দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক একদমই নিচে নেমে যায়। এক যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনী রাজনীতি, অন্তর্ঘাত ও সামরিক অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তবে সাম্প্রতিক কালে মাদুরো ক্ষমতায় আসার পর তারা আবারও রাজপথের সহিংসতা উসকে দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। ২০১৪ সালের শুরু থেকেই লিওপোলদো লোপেজের নেতৃত্বে সরকারি স্থাপনা ও কর্মীদের ওপর সহিংস হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেসব সহিংসতায় ৪৩ জন নিহত ও ৮৭০ জন আহত হয়। সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন এনজিও, রাজনৈতিক দল, নেতা, সাবেক ও বর্তমান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিপুল অর্থ দেয়। ২০১৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র আবারও এক সামরিক-বেসামরিক অভ্যুত্থানে ইন্ধন জোগায়, যা সফল হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে মৌলিক পণ্যের ব্যাপক মজুত ঘটিয়ে সংকট তৈরি করে। মুদ্রার কালোবাজারি ও চোরাকারবারির মাধ্যমে কলম্বিয়ায় ভোগ্যপণ্য পাচার করেও মৌলিক পণ্যের ভয়াবহ সংকট তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রাখে। এর ফলে মাদুরোর নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতি জনরোষ সৃষ্টি হলে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে দলটির পরাজয় নিশ্চিত হয়। মাদুরো বলেছেন, তাঁর দল হেরেছে বলেই যে ভেনেজুয়েলায় সমাজতান্ত্রিক ও বলিভারিয়ান আদর্শের পরাজয় ঘটেছে, তা নয়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই তাঁর দল হেরেছে, যার পেছনে মূল কারণ ছিল তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’।
তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, জবাবদিহির অভাব ও রুগ্ণ অবকাঠামোর মতো সমস্যাও অর্থনীতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করায় সমাজতান্ত্রিক দলটির ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তনে হস্তক্ষেপের ইতিহাস পুরোনো। ভেনেজুয়েলার সংসদীয় নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দলের পরাজয় ও ডানপন্থী দলের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আবারও সে রকম পুনরাবৃত্তিই হলো।
খলিলউল্লাহ্: জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএসএস) ও সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
khalil.jibon@gmail.com
No comments