আজ আমরাও আক্রান্ত by হাসান ফেরদৌস
সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে প্যারিসে ফরাসি মুসলমানদের প্রতিবাদ |
প্যারিসের
ওপর নগ্ন ও কাপুরুষোচিত হামলার দায় স্বীকার করে বিভিন্ন সামাজিক
তথ্যমাধ্যমে তা প্রচার করেছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। তাদের দাবি ‘খিলাফতের
একদল বিশ্বস্ত সদস্য’ এই হামলা চালিয়েছে এবং ‘এই হামলায় কমপক্ষে ১০০
ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী (ক্রুসেডরস) নিহত ও আরও অনেকে আহত হয়েছে।’ তারা
আরও জানিয়েছে, এই হামলাই শেষ হামলা নয়। ‘ফ্রান্স ও তার সব সমর্থক এ কথা
জেনে রাখুক, তারা সবাই ইসলামিক স্টেটের আক্রমণ-তালিকার শীর্ষে রয়েছে। যত
দিন তারা এই ধর্মযুদ্ধ অব্যাহত রাখবে, মৃত্যুর গন্ধ তাদের ত্যাগ করবে না।’
আমরা জানি, গত শুক্রবার প্যারিসের ফুটবল স্টেডিয়ামে, কনসার্ট হলে, রেস্তোরাঁয় ও ক্যাফেতে যারা নিহত হলো, তারা কেউই কোনো ধর্মযুদ্ধের সৈনিক নয়। অতি সাধারণ মানুষ, সবান্ধব ও সপরিবারে শুধু একটি বিকেল উপভোগের জন্য তারা এসেছিল। মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, এমন ভাবনা কারও বিন্দুমাত্র ছিল না।
অন্যদিকে, যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, নিজেদের তারা ধর্মযুদ্ধের সৈনিক ভাবলেও এ কথায় কোনো ভুল নেই, তারা ধার্মিক নয়, তারা সৈনিকও নয়। নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যার বিধান ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মে নেই। আর বেসামরিক নিরস্ত্র নাগরিক হত্যা সৈনিকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। যারা কয়েক শ মানুষকে হতাহত করে নিজেরা নিহত হলো, তারা ও তাদের অভিভাবক সবার একটাই পরিচয়, তারা খুনে।
ঠিক কী অর্জিত হলো এই নির্বিকার খুনের ভেতর দিয়ে?
আইএস অবশ্যই দাবি করতে পারে, সুরক্ষিত ফ্রান্সের রাজধানী ভেদ করে সুপরিকল্পিত হামলা করার দক্ষতা তারা অর্জন করেছে। মানুষ খুনে তারা পারঙ্গম, এ কথা আমরা আগে থেকেই জানি। ক্যামেরার সামনে নিরীহ জিম্মিদের গলায় ছুরি বসিয়ে সেই দক্ষতার প্রমাণ তারা অনেক আগেই দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে তারা কী পেল? সারা বিশ্বের মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার। হ্যাঁ, সারা বিশ্বের এই সব মানুষের মধ্যে মুসলমানরাও আছে। নিরীহ মানুষের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, যতই তারা জিহাদের কথা বলুক, নিঃশর্ত ঘৃণার বাইরে তাদের প্রাপ্য আর কিছুই নেই।
যেহেতু তারা ইসলামের নামে এই রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে, এই অধর্মের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর প্রতিবাদ আসা উচিত মুসলমানদের কাছ থেকেই। মুসলমানদের ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার নামে দোহাই দিয়ে যারা এই নির্মম খেলায় লিপ্ত, তাকে ঠেকানোর—তাকে প্রত্যাখ্যান করার—প্রধান দায়িত্ব মুসলমানদের।
আইএসের এই নগ্ন আক্রমণের আশু প্রতিক্রিয়া পড়বে বিভিন্ন পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে অবস্থানরত অভিবাসী মুসলমান ও সেসব দেশে আশ্রয়প্রার্থী সিরীয়, ইরাকি ও আফগানি উদ্বাস্তুদের ওপর। আইএসের সামরিক সাফল্য ও সিরিয়ার অব্যাহত গৃহযুদ্ধের ফলে ইতিমধ্যে উদ্বাস্তু হয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রতিবেশী জর্ডান, তুরস্ক ও লেবানন তো রয়েছেই, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে ইউরোপে এসে হাজির হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এদের মধ্যে দেড় লাখ মানুষ ইতিমধ্যে আশ্রয় পেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশসমূহে। প্যারিসের সন্ত্রাসী হামলার প্রথম ও প্রধান প্রতিক্রিয়া হবে নতুন কোনো সিরীয় উদ্বাস্তুর জন্য ইউরোপের দরজা বন্ধ হয়ে আসা। বস্তুত, সেই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পোল্যান্ড জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে সিরীয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সে তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাখ্যান করছে। জার্মানি, উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে যার ভূমিকা অত্যন্ত সাহসী, সেখান থেকে তীব্র সমালোচনা উঠেছে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের বিরুদ্ধে। ব্যাভারিয়ার প্রধানমন্ত্রী হরস্টসিহফার বলেছেন, জার্মানি যে ‘খোলা সীমান্ত’ নীতি গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এমনকি উদারনৈতিক সুইডেন থেকেও শোনা গেছে উদ্বাস্তুবিরোধী বক্তব্য।
ভয়াবহ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি আমাদের বিশ্ব। আমরা, যারা হাতির পদপিষ্ট উলুখাগড়া ভিন্ন কিছু নই, তাদের উচিত হবে একদিকে প্রবলতম ভাষায় ও ধিক্কারে আইএসকে প্রত্যাখ্যান। অন্যদিকে যেকোনো রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থা পরিষ্কার করা অনুমান করি, নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন এক জুজুর ভয় দেখিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একদিকে অভিবাসীবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠবে, অন্যদিকে অতি দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদী দলগুলো নতুন করে রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হওয়ার চেষ্টা চালাবে। ফ্রান্সের ফ্যাসিবাদী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান মারিল্য পেন অনেক দিন থেকেই অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক মূলধারায় জায়গা করে নিয়েছে। যুক্তরাজ্যে নাইজেল ফারাজের ইউকিপ পার্টিও দীর্ঘদিন থেকে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, এদের কাছে আইএসের হামলা বড়দিনের আগেই বড়দিনের উপহার হিসেবে হাজির হলো।
অন্য ভয়, অভ্যন্তরীণ চাপের ফলে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএস নিয়ন্ত্রণের নামে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, তাঁর দেশ এখন এক যুদ্ধের মুখোমুখি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর সেই ঘোষণার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। এই সংহতির প্রকাশ কীভাবে হবে আমরা জানি না। তা যদি গৃহযুদ্ধে ও বহিরাগত হামলায় ক্ষতবিক্ষত এই অঞ্চলে আরও বৃহত্তর, সর্বগ্রাসী এক যুদ্ধের সূচনা করে, তার চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন এমন লোকের অভাব নেই, যারা মনে করে, শুধু ড্রোন দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে হামলা চালিয়ে আইএসের মোকাবিলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পুরোদস্তুর সামরিক অভিযান। স্থলযুদ্ধের এই হুমকি একদম অলীক কল্পনা নয়। আমেরিকায় দীর্ঘদিন থেকেই একটি ফ্যাসিবাদী চক্র সচল, যাদের মধ্যে রয়েছে রিপাবলিকান পার্টির একটি প্রভাবশালী অংশ। তারা সম্ভব হলে এখনই আইএসের বিরুদ্ধে হামলার নামে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায়। ২০১৬ সালে যাঁরা রিপাবলিকান দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য প্রচারণায় নেমেছেন, তাঁদের অধিকাংশই প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তাঁর দুর্বল নেতৃত্বের জন্য সমালোচনা করেছেন এবং ‘আমেরিকাকে ফের বিশ্বের সেরা সামরিক শক্তি’ প্রমাণে জোর দাবি তুলেছেন। এই দলের অন্যতম প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি বোমা মেরে আইএসকে উড়িয়ে দেবেন এবং ইরাকের তেলসম্পদ নিজের দখলে আনবেন। যেসব সিরীয় উদ্বাস্তু আমেরিকায় আশ্রয় পেয়েছে, তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। প্রায় একই ভাষায়, একই রকম অসহিষ্ণুতা শোনা গেছে আরও দুই প্রার্থী, টেড ক্রুজ ও মার্কো রুবিওর গলায়। যে হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক তাদের কথা শোনার জন্য মিটিং-মিছিলে জড়ো হচ্ছে, অনুমান করি, তাদের অধিকাংশ এই যুদ্ধবাদী মনোভাব পোষণ করে।
বলাই বাহুল্য, প্যারিসের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ ও আমেরিকা যদি নতুন এক সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাতে সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে আইএসের। তাদের টিকে থাকার পক্ষে একমাত্র যুক্তি হচ্ছে, পশ্চিম ‘আমাদের’—অর্থাৎ মুসলমানদের—বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ‘তাদের’ সে আক্রমণ ঠেকাতেই ‘আমরা’ জিহাদে নেমেছি। বস্তুত, অনেকেই বিশ্বাস করেন, আইএসের উত্থানের প্রধান কারণই হলো ইরাকে আমেরিকার আগ্রাসী যুদ্ধ। এমনকি ডেমোক্রেটিক দলের অন্যতম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স গত শনিবার ডেমোক্রেটিক বিতর্কে কোনো রাখঢাক ছাড়াই সে কথা বলেছেন। এখন, সেই মধ্যপ্রাচ্যে যদি আরেক স্থলযুদ্ধ নতুন করে, আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আইএস তার জিহাদি প্রচারণার পক্ষে অত্যন্ত সবল নতুন রসদ পেয়ে যাবে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমপ্রধান দেশেও সম্ভবত তেমন কোনো যুদ্ধের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে উঠবে, যার অজুহাতে বিস্তৃত হবে আইএস বা এই জাতীয় মৌলবাদী আন্দোলন। যে যুদ্ধ এত দিন পর্যন্ত সীমিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে, তা অবশেষে আমাদের দরজায়ও এসে কড়া নাড়বে।
ভয়াবহ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি আমাদের বিশ্ব। আমরা, যারা হাতির পদপিষ্ট উলুখাগড়া ভিন্ন কিছু নই, তাদের উচিত হবে একদিকে প্রবলতম ভাষায় ও ধিক্কারে আইএসকে প্রত্যাখ্যান। অন্যদিকে যেকোনো রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থা পরিষ্কার করা। আমাদের হয়তো অস্ত্র নেই, কিন্তু আছে সংখ্যার শক্তি। সে শক্তি ব্যবহারের এখনই সময়।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
আমরা জানি, গত শুক্রবার প্যারিসের ফুটবল স্টেডিয়ামে, কনসার্ট হলে, রেস্তোরাঁয় ও ক্যাফেতে যারা নিহত হলো, তারা কেউই কোনো ধর্মযুদ্ধের সৈনিক নয়। অতি সাধারণ মানুষ, সবান্ধব ও সপরিবারে শুধু একটি বিকেল উপভোগের জন্য তারা এসেছিল। মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, এমন ভাবনা কারও বিন্দুমাত্র ছিল না।
অন্যদিকে, যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, নিজেদের তারা ধর্মযুদ্ধের সৈনিক ভাবলেও এ কথায় কোনো ভুল নেই, তারা ধার্মিক নয়, তারা সৈনিকও নয়। নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যার বিধান ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মে নেই। আর বেসামরিক নিরস্ত্র নাগরিক হত্যা সৈনিকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। যারা কয়েক শ মানুষকে হতাহত করে নিজেরা নিহত হলো, তারা ও তাদের অভিভাবক সবার একটাই পরিচয়, তারা খুনে।
ঠিক কী অর্জিত হলো এই নির্বিকার খুনের ভেতর দিয়ে?
আইএস অবশ্যই দাবি করতে পারে, সুরক্ষিত ফ্রান্সের রাজধানী ভেদ করে সুপরিকল্পিত হামলা করার দক্ষতা তারা অর্জন করেছে। মানুষ খুনে তারা পারঙ্গম, এ কথা আমরা আগে থেকেই জানি। ক্যামেরার সামনে নিরীহ জিম্মিদের গলায় ছুরি বসিয়ে সেই দক্ষতার প্রমাণ তারা অনেক আগেই দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে তারা কী পেল? সারা বিশ্বের মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার। হ্যাঁ, সারা বিশ্বের এই সব মানুষের মধ্যে মুসলমানরাও আছে। নিরীহ মানুষের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, যতই তারা জিহাদের কথা বলুক, নিঃশর্ত ঘৃণার বাইরে তাদের প্রাপ্য আর কিছুই নেই।
যেহেতু তারা ইসলামের নামে এই রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে, এই অধর্মের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর প্রতিবাদ আসা উচিত মুসলমানদের কাছ থেকেই। মুসলমানদের ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার নামে দোহাই দিয়ে যারা এই নির্মম খেলায় লিপ্ত, তাকে ঠেকানোর—তাকে প্রত্যাখ্যান করার—প্রধান দায়িত্ব মুসলমানদের।
আইএসের এই নগ্ন আক্রমণের আশু প্রতিক্রিয়া পড়বে বিভিন্ন পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে অবস্থানরত অভিবাসী মুসলমান ও সেসব দেশে আশ্রয়প্রার্থী সিরীয়, ইরাকি ও আফগানি উদ্বাস্তুদের ওপর। আইএসের সামরিক সাফল্য ও সিরিয়ার অব্যাহত গৃহযুদ্ধের ফলে ইতিমধ্যে উদ্বাস্তু হয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রতিবেশী জর্ডান, তুরস্ক ও লেবানন তো রয়েছেই, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে ইউরোপে এসে হাজির হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এদের মধ্যে দেড় লাখ মানুষ ইতিমধ্যে আশ্রয় পেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশসমূহে। প্যারিসের সন্ত্রাসী হামলার প্রথম ও প্রধান প্রতিক্রিয়া হবে নতুন কোনো সিরীয় উদ্বাস্তুর জন্য ইউরোপের দরজা বন্ধ হয়ে আসা। বস্তুত, সেই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পোল্যান্ড জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে সিরীয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সে তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাখ্যান করছে। জার্মানি, উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে যার ভূমিকা অত্যন্ত সাহসী, সেখান থেকে তীব্র সমালোচনা উঠেছে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের বিরুদ্ধে। ব্যাভারিয়ার প্রধানমন্ত্রী হরস্টসিহফার বলেছেন, জার্মানি যে ‘খোলা সীমান্ত’ নীতি গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এমনকি উদারনৈতিক সুইডেন থেকেও শোনা গেছে উদ্বাস্তুবিরোধী বক্তব্য।
ভয়াবহ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি আমাদের বিশ্ব। আমরা, যারা হাতির পদপিষ্ট উলুখাগড়া ভিন্ন কিছু নই, তাদের উচিত হবে একদিকে প্রবলতম ভাষায় ও ধিক্কারে আইএসকে প্রত্যাখ্যান। অন্যদিকে যেকোনো রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থা পরিষ্কার করা অনুমান করি, নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন এক জুজুর ভয় দেখিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একদিকে অভিবাসীবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠবে, অন্যদিকে অতি দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদী দলগুলো নতুন করে রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হওয়ার চেষ্টা চালাবে। ফ্রান্সের ফ্যাসিবাদী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান মারিল্য পেন অনেক দিন থেকেই অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক মূলধারায় জায়গা করে নিয়েছে। যুক্তরাজ্যে নাইজেল ফারাজের ইউকিপ পার্টিও দীর্ঘদিন থেকে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, এদের কাছে আইএসের হামলা বড়দিনের আগেই বড়দিনের উপহার হিসেবে হাজির হলো।
অন্য ভয়, অভ্যন্তরীণ চাপের ফলে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএস নিয়ন্ত্রণের নামে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, তাঁর দেশ এখন এক যুদ্ধের মুখোমুখি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর সেই ঘোষণার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। এই সংহতির প্রকাশ কীভাবে হবে আমরা জানি না। তা যদি গৃহযুদ্ধে ও বহিরাগত হামলায় ক্ষতবিক্ষত এই অঞ্চলে আরও বৃহত্তর, সর্বগ্রাসী এক যুদ্ধের সূচনা করে, তার চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন এমন লোকের অভাব নেই, যারা মনে করে, শুধু ড্রোন দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে হামলা চালিয়ে আইএসের মোকাবিলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পুরোদস্তুর সামরিক অভিযান। স্থলযুদ্ধের এই হুমকি একদম অলীক কল্পনা নয়। আমেরিকায় দীর্ঘদিন থেকেই একটি ফ্যাসিবাদী চক্র সচল, যাদের মধ্যে রয়েছে রিপাবলিকান পার্টির একটি প্রভাবশালী অংশ। তারা সম্ভব হলে এখনই আইএসের বিরুদ্ধে হামলার নামে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায়। ২০১৬ সালে যাঁরা রিপাবলিকান দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য প্রচারণায় নেমেছেন, তাঁদের অধিকাংশই প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তাঁর দুর্বল নেতৃত্বের জন্য সমালোচনা করেছেন এবং ‘আমেরিকাকে ফের বিশ্বের সেরা সামরিক শক্তি’ প্রমাণে জোর দাবি তুলেছেন। এই দলের অন্যতম প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি বোমা মেরে আইএসকে উড়িয়ে দেবেন এবং ইরাকের তেলসম্পদ নিজের দখলে আনবেন। যেসব সিরীয় উদ্বাস্তু আমেরিকায় আশ্রয় পেয়েছে, তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। প্রায় একই ভাষায়, একই রকম অসহিষ্ণুতা শোনা গেছে আরও দুই প্রার্থী, টেড ক্রুজ ও মার্কো রুবিওর গলায়। যে হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক তাদের কথা শোনার জন্য মিটিং-মিছিলে জড়ো হচ্ছে, অনুমান করি, তাদের অধিকাংশ এই যুদ্ধবাদী মনোভাব পোষণ করে।
বলাই বাহুল্য, প্যারিসের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ ও আমেরিকা যদি নতুন এক সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাতে সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে আইএসের। তাদের টিকে থাকার পক্ষে একমাত্র যুক্তি হচ্ছে, পশ্চিম ‘আমাদের’—অর্থাৎ মুসলমানদের—বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ‘তাদের’ সে আক্রমণ ঠেকাতেই ‘আমরা’ জিহাদে নেমেছি। বস্তুত, অনেকেই বিশ্বাস করেন, আইএসের উত্থানের প্রধান কারণই হলো ইরাকে আমেরিকার আগ্রাসী যুদ্ধ। এমনকি ডেমোক্রেটিক দলের অন্যতম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স গত শনিবার ডেমোক্রেটিক বিতর্কে কোনো রাখঢাক ছাড়াই সে কথা বলেছেন। এখন, সেই মধ্যপ্রাচ্যে যদি আরেক স্থলযুদ্ধ নতুন করে, আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আইএস তার জিহাদি প্রচারণার পক্ষে অত্যন্ত সবল নতুন রসদ পেয়ে যাবে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমপ্রধান দেশেও সম্ভবত তেমন কোনো যুদ্ধের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে উঠবে, যার অজুহাতে বিস্তৃত হবে আইএস বা এই জাতীয় মৌলবাদী আন্দোলন। যে যুদ্ধ এত দিন পর্যন্ত সীমিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে, তা অবশেষে আমাদের দরজায়ও এসে কড়া নাড়বে।
ভয়াবহ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি আমাদের বিশ্ব। আমরা, যারা হাতির পদপিষ্ট উলুখাগড়া ভিন্ন কিছু নই, তাদের উচিত হবে একদিকে প্রবলতম ভাষায় ও ধিক্কারে আইএসকে প্রত্যাখ্যান। অন্যদিকে যেকোনো রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থা পরিষ্কার করা। আমাদের হয়তো অস্ত্র নেই, কিন্তু আছে সংখ্যার শক্তি। সে শক্তি ব্যবহারের এখনই সময়।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments