মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের রায় বুধবার সাড়ে ১১টায়
জামায়াতে
ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায়
পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের শুনানি শেষ হয়েছে। কাল বুধবার রায় ঘোষণা করা
হবে। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেত্বত্বে আপিল
বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা
হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি
হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
মঙ্গলবার মুজাহিদের পক্ষে সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত রিভিউ শুনানি করেন তার প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। আধা ঘণ্টা বিরতির পর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর আদালত বুধবার রায়ের দিন ধার্য করেন।
শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন অভিযোগ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ছিল না। যখন তাকে কোর্টে আনা হয়েছে তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আমরা বলছি যেসব ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে সেসব ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওইসব ঘটনার সাথে মুজাহিদ সাহেব জড়িত ছিলেন না। বড় বড় পাকিস্তানী আর্মি অফিসারের সামনে তখন মুজাহিদের মতো অল্পবয়সী একজন ছেলের দাঁড়ানোর মতো সাহস বা ক্ষমতা ছিল না। তাদের কাছে যাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। আমার বয়স হয়েছে, আমরা দেখেছি তখন কি হয়েছে। তিনি বলেন, যে অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে ওই অভিযোগে তাকে কোন সাজা দেয়া যায় না।
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আসামীর বক্তব্যের বিষয়ে পত্রিকার রিপোর্ট আছে। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারে জার্মানির উদহারণ তুলে ধরে বলেন, এভিডেন্সেই বিচার হয়েছে। এরপর প্রধান বিচারপতি মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী জহির উদ্দিন জালালের সাক্ষের কিছু অংশ পাঠ করেন।
শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, মুজাহিদকে যে অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা সঠিক নয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে ৪২টি মামলা হয়েছে, তাতে কোথাও তার নাম আসেনি। তাছাড়া তদন্ত কর্মকর্তাও বলেছেন- রাজাকার, আলবদর বা আলশামসের সাথে মুজাহিদ জড়িত থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাননি।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামীর বিষয়ে ’৭১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বরের রিপোর্ট রয়েছে। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এখনো চলছে। এখনো বুদ্ধিজীবীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
আদালতে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পক্ষে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ছাড়াও অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট মো: শিশির মনির উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আদালতে শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতির কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রিভিউ তে বলেছি, যে অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেখানে যে সাক্ষ্য প্রমান আছে তার ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া বেআইনী হয়েছে। মাননীয় আদালত এটা আইনগতভাবে পুনর্বিবেচনা করবেন। আমরা বলেছি, অন্য আসামীর বিরুদ্ধে হত্যা, অগ্নি সংযোগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। কিন্তু মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রিভিউ’র শুনানিতে আমরা নতুন তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করে মুজাহিদের খালাস চেয়েছি। তিনি বলেন, অন্য আসামীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছিল কিন্তু মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুর্দিষ্ট অভিযোগ নেই। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে ৪২ টি মামলা হয়েছে। যেখানে মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি।
তিনি বলেন, জেনারেল নিয়াজীর সাক্ষাৎকার নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের সম্পাদিত বইয়ে বলা হয়েছে- আলবদর সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডে ছিল। সেখানে সাধারণ নাগরিকের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতো। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। কাল রিভিউ’র রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি এতে মুজাহিদ খালাস পাবেন।
অন্যদিকে অ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আমাদের প্রত্যাশা রিভিউ’র রায়েও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে। আপিল বিভাগ সঠিকভাবে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছেন। তার ক্ষেত্রে রিভিউ বিবেচনা করা যায় না। তিনি বলেন, আসামী পক্ষের রিভিউ’র যুক্তি ছিল মুজাহিদ কোনো লোককে হত্যা করেছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। আসামীপক্ষ মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আবেদন করেছেন তার আইনজীবী। এ বিষয়ে আমি বলেছি, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যা করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মুজাহিদের বক্তব্য বিবৃতি থেকে বা তার অনুসারী অপরাধ করলে এটাও তার উপর বর্তাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করলে আমরা হতাশ হব। আজ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন। অ্যাটর্নী জেনারেল আরো বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ নিতে হবে, এ আইনে এমনটি নেই।
এর আগে গত ২ নভেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।
গত ১৪ অক্টোবর আপিল বিভাগের সংশি¬ষ্ট শাখায় মুজাহিদের পক্ষে রিভিউ আবেদনটি দায়ের করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। ৩৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৩২টি গ্রাউন্ডে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা করে মুজাহিদকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি ও মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়।
রিভিউ আবেদনে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘দি ভ্যাঙ্কুইশড জেনারেলস’ বই নতুন দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে দাখিল করা হয়। এতে পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল এ, এ, কে, নিয়াজি স্বীকার করেছেন যে, আলবদর বাহিনী সরাসরি আর্মির কমান্ডে এবং কন্ট্রোলে পরিচালিত হতো। মুজাহিদ একজন ছাত্রনেতা হয়ে কিভাবে এই বাহিনীর কমান্ডার হলেন?
রিভিউ আবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুদ্ধিজীবি হত্যার অভিযোগের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ দুইজন সাক্ষী হাজির করে। যথা রুস্তম আলী মোল্লা ও জহির উদ্দিন জালাল। ১৯৭১ সালে রুস্তম আলী মোল্লার বয়স ছিল ১৪ বছর এবং জহির উদ্দিন জালালের বয়স ছিল ১৩ বছর। রুস্তম আলী মোল্লা নিজেকে এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে দাবী করলেও তার সাক্ষ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান। আর জহিরউদ্দিন জালাল একজন শোনা সাক্ষী।
রুস্তম আলী মোল্লা জনাব মুজাহিদকে আর্মি অফিসারের সাথে ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনা করতে দেখেনি। সে দাবী করেছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৩/৪ মাস পর মুজাহিদকে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গেইটে দেখেছে। সে স্বীকার করেছে যে, জনাব মুজাহিদকে পূর্ব থেকে চিনতো না। গেইটে প্রহরারত ব্যক্তিরা বলাবলি করছিল যে, জনাব গোলাম আযম, নিজামী ও মুজাহিদ কলেজে এসেছেন এবং তখন সে মুজাহিদ সাহেবকে চিনতে পারে। রুস্তম আলী মোল্লার সাক্ষ্যে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সে পূর্ব থেকে এই তিনজনের কাউকেই চিনতো না। কেউ তাকে সুনির্দিষ্টভাবে মুজাহিদ সাহেবকে চিনিয়েও দেয়নি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, পূর্ব থেকে না চেনা স্বত্বেও কিভাবে সে নিজেই কলেজের গেইটে মুজাহিদ সাহেবকে চিহ্নিত করল? তর্কের খাতিরে রুস্তম আলী মোল্লার কথা সত্য বলে ধরে নিলেও এর দ্বারা কি আদৌ এটি প্রমাণিত হয় যে, তিনি আর্মি অফিসারের সাথে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করেছেন?
জহির উদ্দিন জালাল তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, নিজামী, মুজাহিদরা ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে আসতেন-এই খবরগুলো রুস্তম আলী মোল্লা কেরানীগঞ্জে তাকে জানিয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন রুস্তম আলী মোল্লা তদন্তকালে তার কাছে বলেনি যে, বিচ্ছু জালাল নামে কারো সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। সুতরাং জালালের দাবী অসত্য প্রমানিত।
রুস্তম আলী মোল্লার পিতা মোঃ রহম আলী মোল্লা ১৯৭১ সালে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের প্রহরী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি আজও জীবিত আছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় তাকে সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেনি। ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের তদানিন্তন অধ্যক্ষ মুহিবুল্লাহ খান মজলিস এবং তার ছেলে বর্তমান অধ্যক্ষ তারেক ইকবাল খান মজলিসকেও (যিনি ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন) সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি।
রিভিউতে অন্যাতম যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নিয়ে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ৪২ টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর একটিতেও জনাব মুজাহিদকে আসামী করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলাগুলোর নথি আদালতে উপস্থাপন করেনি। অথচ ৪২ বছর পর কিভাবে এই হত্যাকান্ডের সকল দায়-দায়িত্ব তার উপর চাপানো হয়েছে?
২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য জহির রায়হানকে আহবায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। প্রথিতযশা সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই কমিটির সদস্য ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়নি এবং তদন্তকালে তাঁদের কারো সাথে আলোচনাও করেনি। কেন রাষ্ট্রপক্ষ এই তদন্ত রিপোর্ট জাতির সামনে প্রকাশ করেনি? আন্দাজ ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে নিহত সকল বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার জন্য মুজাহিদকে দায়ী করা হয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এরপর ১ অক্টোবর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গত ১৬ জুন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আলী আহসান মুজাহিদের আপিল আবেদনের সংক্ষিপ্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ আলী আহসান মুজাহিদের রায় প্রদান করেন।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়।
মঙ্গলবার মুজাহিদের পক্ষে সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত রিভিউ শুনানি করেন তার প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। আধা ঘণ্টা বিরতির পর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর আদালত বুধবার রায়ের দিন ধার্য করেন।
শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন অভিযোগ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ছিল না। যখন তাকে কোর্টে আনা হয়েছে তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আমরা বলছি যেসব ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে সেসব ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওইসব ঘটনার সাথে মুজাহিদ সাহেব জড়িত ছিলেন না। বড় বড় পাকিস্তানী আর্মি অফিসারের সামনে তখন মুজাহিদের মতো অল্পবয়সী একজন ছেলের দাঁড়ানোর মতো সাহস বা ক্ষমতা ছিল না। তাদের কাছে যাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। আমার বয়স হয়েছে, আমরা দেখেছি তখন কি হয়েছে। তিনি বলেন, যে অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে ওই অভিযোগে তাকে কোন সাজা দেয়া যায় না।
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আসামীর বক্তব্যের বিষয়ে পত্রিকার রিপোর্ট আছে। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারে জার্মানির উদহারণ তুলে ধরে বলেন, এভিডেন্সেই বিচার হয়েছে। এরপর প্রধান বিচারপতি মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী জহির উদ্দিন জালালের সাক্ষের কিছু অংশ পাঠ করেন।
শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, মুজাহিদকে যে অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা সঠিক নয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে ৪২টি মামলা হয়েছে, তাতে কোথাও তার নাম আসেনি। তাছাড়া তদন্ত কর্মকর্তাও বলেছেন- রাজাকার, আলবদর বা আলশামসের সাথে মুজাহিদ জড়িত থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাননি।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামীর বিষয়ে ’৭১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বরের রিপোর্ট রয়েছে। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এখনো চলছে। এখনো বুদ্ধিজীবীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
আদালতে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পক্ষে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ছাড়াও অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট মো: শিশির মনির উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আদালতে শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতির কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রিভিউ তে বলেছি, যে অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেখানে যে সাক্ষ্য প্রমান আছে তার ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া বেআইনী হয়েছে। মাননীয় আদালত এটা আইনগতভাবে পুনর্বিবেচনা করবেন। আমরা বলেছি, অন্য আসামীর বিরুদ্ধে হত্যা, অগ্নি সংযোগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। কিন্তু মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রিভিউ’র শুনানিতে আমরা নতুন তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করে মুজাহিদের খালাস চেয়েছি। তিনি বলেন, অন্য আসামীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছিল কিন্তু মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুর্দিষ্ট অভিযোগ নেই। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে ৪২ টি মামলা হয়েছে। যেখানে মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি।
তিনি বলেন, জেনারেল নিয়াজীর সাক্ষাৎকার নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের সম্পাদিত বইয়ে বলা হয়েছে- আলবদর সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডে ছিল। সেখানে সাধারণ নাগরিকের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতো। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। কাল রিভিউ’র রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি এতে মুজাহিদ খালাস পাবেন।
অন্যদিকে অ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আমাদের প্রত্যাশা রিভিউ’র রায়েও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে। আপিল বিভাগ সঠিকভাবে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছেন। তার ক্ষেত্রে রিভিউ বিবেচনা করা যায় না। তিনি বলেন, আসামী পক্ষের রিভিউ’র যুক্তি ছিল মুজাহিদ কোনো লোককে হত্যা করেছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। আসামীপক্ষ মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আবেদন করেছেন তার আইনজীবী। এ বিষয়ে আমি বলেছি, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যা করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মুজাহিদের বক্তব্য বিবৃতি থেকে বা তার অনুসারী অপরাধ করলে এটাও তার উপর বর্তাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করলে আমরা হতাশ হব। আজ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন। অ্যাটর্নী জেনারেল আরো বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ নিতে হবে, এ আইনে এমনটি নেই।
এর আগে গত ২ নভেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।
গত ১৪ অক্টোবর আপিল বিভাগের সংশি¬ষ্ট শাখায় মুজাহিদের পক্ষে রিভিউ আবেদনটি দায়ের করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। ৩৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৩২টি গ্রাউন্ডে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা করে মুজাহিদকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি ও মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়।
রিভিউ আবেদনে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘দি ভ্যাঙ্কুইশড জেনারেলস’ বই নতুন দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে দাখিল করা হয়। এতে পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল এ, এ, কে, নিয়াজি স্বীকার করেছেন যে, আলবদর বাহিনী সরাসরি আর্মির কমান্ডে এবং কন্ট্রোলে পরিচালিত হতো। মুজাহিদ একজন ছাত্রনেতা হয়ে কিভাবে এই বাহিনীর কমান্ডার হলেন?
রিভিউ আবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুদ্ধিজীবি হত্যার অভিযোগের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ দুইজন সাক্ষী হাজির করে। যথা রুস্তম আলী মোল্লা ও জহির উদ্দিন জালাল। ১৯৭১ সালে রুস্তম আলী মোল্লার বয়স ছিল ১৪ বছর এবং জহির উদ্দিন জালালের বয়স ছিল ১৩ বছর। রুস্তম আলী মোল্লা নিজেকে এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে দাবী করলেও তার সাক্ষ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান। আর জহিরউদ্দিন জালাল একজন শোনা সাক্ষী।
রুস্তম আলী মোল্লা জনাব মুজাহিদকে আর্মি অফিসারের সাথে ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনা করতে দেখেনি। সে দাবী করেছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৩/৪ মাস পর মুজাহিদকে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গেইটে দেখেছে। সে স্বীকার করেছে যে, জনাব মুজাহিদকে পূর্ব থেকে চিনতো না। গেইটে প্রহরারত ব্যক্তিরা বলাবলি করছিল যে, জনাব গোলাম আযম, নিজামী ও মুজাহিদ কলেজে এসেছেন এবং তখন সে মুজাহিদ সাহেবকে চিনতে পারে। রুস্তম আলী মোল্লার সাক্ষ্যে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সে পূর্ব থেকে এই তিনজনের কাউকেই চিনতো না। কেউ তাকে সুনির্দিষ্টভাবে মুজাহিদ সাহেবকে চিনিয়েও দেয়নি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, পূর্ব থেকে না চেনা স্বত্বেও কিভাবে সে নিজেই কলেজের গেইটে মুজাহিদ সাহেবকে চিহ্নিত করল? তর্কের খাতিরে রুস্তম আলী মোল্লার কথা সত্য বলে ধরে নিলেও এর দ্বারা কি আদৌ এটি প্রমাণিত হয় যে, তিনি আর্মি অফিসারের সাথে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করেছেন?
জহির উদ্দিন জালাল তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, নিজামী, মুজাহিদরা ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে আসতেন-এই খবরগুলো রুস্তম আলী মোল্লা কেরানীগঞ্জে তাকে জানিয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন রুস্তম আলী মোল্লা তদন্তকালে তার কাছে বলেনি যে, বিচ্ছু জালাল নামে কারো সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। সুতরাং জালালের দাবী অসত্য প্রমানিত।
রুস্তম আলী মোল্লার পিতা মোঃ রহম আলী মোল্লা ১৯৭১ সালে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের প্রহরী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি আজও জীবিত আছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় তাকে সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেনি। ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের তদানিন্তন অধ্যক্ষ মুহিবুল্লাহ খান মজলিস এবং তার ছেলে বর্তমান অধ্যক্ষ তারেক ইকবাল খান মজলিসকেও (যিনি ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন) সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি।
রিভিউতে অন্যাতম যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নিয়ে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ৪২ টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর একটিতেও জনাব মুজাহিদকে আসামী করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলাগুলোর নথি আদালতে উপস্থাপন করেনি। অথচ ৪২ বছর পর কিভাবে এই হত্যাকান্ডের সকল দায়-দায়িত্ব তার উপর চাপানো হয়েছে?
২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য জহির রায়হানকে আহবায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। প্রথিতযশা সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই কমিটির সদস্য ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়নি এবং তদন্তকালে তাঁদের কারো সাথে আলোচনাও করেনি। কেন রাষ্ট্রপক্ষ এই তদন্ত রিপোর্ট জাতির সামনে প্রকাশ করেনি? আন্দাজ ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে নিহত সকল বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার জন্য মুজাহিদকে দায়ী করা হয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এরপর ১ অক্টোবর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গত ১৬ জুন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আলী আহসান মুজাহিদের আপিল আবেদনের সংক্ষিপ্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ আলী আহসান মুজাহিদের রায় প্রদান করেন।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়।
No comments