নূরকে ফেরত দিচ্ছে ভারত
নারায়ণগঞ্জের
আলোচিত সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে
বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ভারতের একটি আদালত। শুক্রবার
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত বিচারিক হাকিমের আদালত এ
আদেশ দেন। বারাসাতের ভারপ্রাপ্ত জেলা দায়রা বিচারক সন্দীপ চক্রবর্তীর
আতদালত শুনানি শেষে রায়ে বলেন, ‘আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বন্দি
প্রত্যপর্ণ চুক্তি অনুযায়ী নূর হোসেনকে ফেরত দিতে হবে।’ ১৬ ডিসেম্বর গোটা
প্রক্রিয়াটি নিয়ে আদালতে রিপোর্ট দেয়ার আদেশও দেন আদালত। আদালতের ওই
নির্দেশের পর ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে নূর হোসনকে নারায়ণগঞ্জের সংশ্লিষ্ট
আদালতে হাজির করা হচ্ছে- এখন এটা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। এর আগে
বাংলাদেশের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়ায়
বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছিল ভারত সরকার।
নূর হোসেনকে ফিরিয়ে দেয়া বারাসাত আদালতের নির্দেশের খবর শুক্রবার বিকালে পেয়েছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেছে, ‘নূরকে হাতে পেলেই সাত খুনের মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেবে। মিলবে অনেক অজানা তথ্য। এদিকে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে- এমন খবরে পুরো নারায়ণগঞ্জে আলোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে নূর হোসেনের নিজ এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জে চলছে সাত খুন আর নূরের উত্থান-পতন নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনা। নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাত খুনের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শুক্রবার রাতে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েক দফা চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে আজই (শুক্রবার) ভারতের আদালতে তাকে ফিরিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছেন। এখনও ভারত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাবে। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
যুগান্তরের কলকাতা প্রতিনিধি কৃষ্ণকুমার দাস জানান, নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের মামলার আসামি নূর হোসেনকে শুক্রবার বারাসাত বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির করা হয়নি। তবে আদালতে হাজির করা না হলেও এদিন সরকারি আইনজীবীর আবেদনক্রমে নূর হোসেনের ওপর থেকে বিদেশী অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪ ধারার মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। তবে বিচারক সাত খুনের মামলার আসামি নূর হোসেনের ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহার করলেও জামিনে থাকা তার অন্য দুই সহযোগী খান সুমন ও ওয়াদুল জামাল শামিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ বহাল রয়েছে।
বিচারকের রায়ের পর সরকারি আইনজীবী বিকাশরঞ্জন দে জানান, ‘বাংলাদেশ সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের নির্দেশে শুধু নূর হোসেনের মামলা প্রত্যাহার করে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা হল।’ তবে এদিন রায়ের সময় বিএসএফ না পুলিশের মাধ্যমে নূর হোসেনকে ফেরত পাঠাতে হবে সে বিষয়টি বিচারক স্পষ্ট করেননি। তবে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদিও দ্রুত নূর হোসেনকে হাতে পেতে চাইছে। তবে শনিবার থেকেই পশ্চিমবঙ্গে ১০ দিনের পুজোর ছুটি শুরু হয়েছে। ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি কাজকর্ম বন্ধ। তাই কিভাবে নূর হোসনকে প্রত্যপর্ণ করা হবে তা নিয়ে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা চাইলে বিশেষ মামলা হিসেবে নূর হোসেনকে পুজোর ছুটির মধ্যেও হস্তান্তর করতে পারেন। তবে আদালতে নির্দেশনা অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যেই (১৫ ডিসেম্বর) নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ২০১৪ সালের ১৫ জুন গ্রেফতারের ১৪ দিন পর থেকেই দমদম জেলে বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রাজু আহমেদ জানান, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে- এমন সংবাদে পুরো নারায়ণগঞ্জেই চলছে আলোচনার ঝড়। বিশেষ করে নূরের নিজ এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জে চলছে সাত খুন আর নূরের উত্থান-পতন নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনা।
কে এই নূর হোসেন : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু এলাকার লোকের কাছে তিনি এখনও হোসেন চেয়ারম্যান নামে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। মূলত সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তার পরিচয় হয় হোসেন চেয়ারম্যান হিসেবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালে এলাকার স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি, রাস্তায় ইট বিছানোর নামে পরিষদের তহবিল তছরুপ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাঠানো অর্থ ও ত্রাণসামগ্রীর আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এজন্য অন্তত অর্ধশতবার তদন্ত হয়েছে। তদন্তে অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তাতে অবশ্য কিছুই হয়নি নূর হোসেনের।
যেভাবে উত্থান : স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালের ঘটনা। সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন নূর হোসেন। পরে গাড়ি চালনা শিখে একটি গ্রুপে চাকরি করেছেন। ১৯৮৮ সালের দিকে শিমরাইলে আন্তঃজেলা ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রম চালু করেন দাইমুদ্দিন নামের এক ট্রাক ড্রাইভার। তার হাত ধরেই নূর হোসেন হেলপার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ইকবাল গ্রুপে। ১৯৮৯ সালের দিকে দাইমুদ্দিনকে বের করে দিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের দখল নেন নূর হোসেন। যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। কিন্তু ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে হয়ে যান বিএনপির নেতা। গঠন করেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নূর হোসেন চলে আসেন আওয়ামী লীগের বলয়ে।
১৭ বছরের বিরোধেই সাত খুন : গডফাদার নূর হোসেনের সঙ্গে নিহত (সাত খুনের একজন) প্যানেল মেয়র নজরুলের কোন্দল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে অনেক হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ। নজরুল ও হোসেনের কোন্দলের সূত্রপাত সেই ১৯৯৭ সালের সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে। দু’জনই ছিলেন ওই নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী। ওই নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হলে নূর হোসেন গ্রেফতার হয়ে ৭ দিন কারাভোগ করেন। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে ফের ভোট গ্রহণ হলে জয়ী হন নূর হোসেন। এরপর দু’জনই দু’জনকে মেরে ফেলতে কয়েক দফায় আক্রমণ চালিয়েছেন কিলার দিয়ে। ১৯৯৮ সালে নজরুলের কিলারের গুলিতে আহত হয়েছিলেন নূর হোসেন। ওই যাত্রায় বেঁচে গিয়ে ২০০০ সালে নূর হোসেনও স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে নজরুল ইসলামের ওপর হামলা চালায় হোসেনের ক্যাডার বাহিনী। ওই ঘটনায় মতিন নামে এক যুবক নিহত হন। গত ১৭ বছরে দু’জন দু’জনার এলাকায় প্রবেশ না করলেও ২০১২ সালে নজরুল ইসলামের আয়োজনে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে হাজির হয়েছিলেন নূর হোসেন। যদিও একই বছর নূর হোসেনের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ছিলেন না নজরুল ইসলাম। আর এই বিরোধের শেষ পরিণতি ছিল ৭ খুনের ঘটনা।
সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে হোসেন চিশতী সিপলু জানান, ভারতে কারাবন্দি সেভেন মার্ডার মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের আদালতের নির্দেশনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। পাশাপাশি তারা নূর হোসেনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন।
ওই ঘটনায় নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেছেন, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তার কণ্ঠেই আমরা শুনতে চাই, কারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নেপথ্যে কারা কাজ করেছে। কী কারণে সাতজনকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনাটি আড়াল করতে নূর হোসেনকে মেরেও ফেলা হতে পারে বলে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। ৩০ এপ্রিল বিকালে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার ১১ মাস পর গত ৮ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুটি মামলায় নূর হোসেন, তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। এদের মধ্যে ২২ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। আর ওই মামলায় নূর হোসেনসহ ১৩ জন পলাতক আছেন। তবে নূর হোসেন ও তার দুই সঙ্গী গত বছর ১৪ জুন কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে কৈখালী থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
নূর হোসেনকে ফিরিয়ে দেয়া বারাসাত আদালতের নির্দেশের খবর শুক্রবার বিকালে পেয়েছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেছে, ‘নূরকে হাতে পেলেই সাত খুনের মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেবে। মিলবে অনেক অজানা তথ্য। এদিকে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে- এমন খবরে পুরো নারায়ণগঞ্জে আলোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে নূর হোসেনের নিজ এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জে চলছে সাত খুন আর নূরের উত্থান-পতন নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনা। নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাত খুনের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শুক্রবার রাতে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েক দফা চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে আজই (শুক্রবার) ভারতের আদালতে তাকে ফিরিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছেন। এখনও ভারত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাবে। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
যুগান্তরের কলকাতা প্রতিনিধি কৃষ্ণকুমার দাস জানান, নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের মামলার আসামি নূর হোসেনকে শুক্রবার বারাসাত বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির করা হয়নি। তবে আদালতে হাজির করা না হলেও এদিন সরকারি আইনজীবীর আবেদনক্রমে নূর হোসেনের ওপর থেকে বিদেশী অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪ ধারার মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। তবে বিচারক সাত খুনের মামলার আসামি নূর হোসেনের ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহার করলেও জামিনে থাকা তার অন্য দুই সহযোগী খান সুমন ও ওয়াদুল জামাল শামিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ বহাল রয়েছে।
বিচারকের রায়ের পর সরকারি আইনজীবী বিকাশরঞ্জন দে জানান, ‘বাংলাদেশ সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের নির্দেশে শুধু নূর হোসেনের মামলা প্রত্যাহার করে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা হল।’ তবে এদিন রায়ের সময় বিএসএফ না পুলিশের মাধ্যমে নূর হোসেনকে ফেরত পাঠাতে হবে সে বিষয়টি বিচারক স্পষ্ট করেননি। তবে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদিও দ্রুত নূর হোসেনকে হাতে পেতে চাইছে। তবে শনিবার থেকেই পশ্চিমবঙ্গে ১০ দিনের পুজোর ছুটি শুরু হয়েছে। ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি কাজকর্ম বন্ধ। তাই কিভাবে নূর হোসনকে প্রত্যপর্ণ করা হবে তা নিয়ে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা চাইলে বিশেষ মামলা হিসেবে নূর হোসেনকে পুজোর ছুটির মধ্যেও হস্তান্তর করতে পারেন। তবে আদালতে নির্দেশনা অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যেই (১৫ ডিসেম্বর) নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ২০১৪ সালের ১৫ জুন গ্রেফতারের ১৪ দিন পর থেকেই দমদম জেলে বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রাজু আহমেদ জানান, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে- এমন সংবাদে পুরো নারায়ণগঞ্জেই চলছে আলোচনার ঝড়। বিশেষ করে নূরের নিজ এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জে চলছে সাত খুন আর নূরের উত্থান-পতন নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনা।
কে এই নূর হোসেন : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু এলাকার লোকের কাছে তিনি এখনও হোসেন চেয়ারম্যান নামে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। মূলত সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তার পরিচয় হয় হোসেন চেয়ারম্যান হিসেবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালে এলাকার স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি, রাস্তায় ইট বিছানোর নামে পরিষদের তহবিল তছরুপ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাঠানো অর্থ ও ত্রাণসামগ্রীর আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এজন্য অন্তত অর্ধশতবার তদন্ত হয়েছে। তদন্তে অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তাতে অবশ্য কিছুই হয়নি নূর হোসেনের।
যেভাবে উত্থান : স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালের ঘটনা। সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন নূর হোসেন। পরে গাড়ি চালনা শিখে একটি গ্রুপে চাকরি করেছেন। ১৯৮৮ সালের দিকে শিমরাইলে আন্তঃজেলা ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রম চালু করেন দাইমুদ্দিন নামের এক ট্রাক ড্রাইভার। তার হাত ধরেই নূর হোসেন হেলপার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ইকবাল গ্রুপে। ১৯৮৯ সালের দিকে দাইমুদ্দিনকে বের করে দিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের দখল নেন নূর হোসেন। যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। কিন্তু ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে হয়ে যান বিএনপির নেতা। গঠন করেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নূর হোসেন চলে আসেন আওয়ামী লীগের বলয়ে।
১৭ বছরের বিরোধেই সাত খুন : গডফাদার নূর হোসেনের সঙ্গে নিহত (সাত খুনের একজন) প্যানেল মেয়র নজরুলের কোন্দল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে অনেক হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ। নজরুল ও হোসেনের কোন্দলের সূত্রপাত সেই ১৯৯৭ সালের সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে। দু’জনই ছিলেন ওই নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী। ওই নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হলে নূর হোসেন গ্রেফতার হয়ে ৭ দিন কারাভোগ করেন। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে ফের ভোট গ্রহণ হলে জয়ী হন নূর হোসেন। এরপর দু’জনই দু’জনকে মেরে ফেলতে কয়েক দফায় আক্রমণ চালিয়েছেন কিলার দিয়ে। ১৯৯৮ সালে নজরুলের কিলারের গুলিতে আহত হয়েছিলেন নূর হোসেন। ওই যাত্রায় বেঁচে গিয়ে ২০০০ সালে নূর হোসেনও স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে নজরুল ইসলামের ওপর হামলা চালায় হোসেনের ক্যাডার বাহিনী। ওই ঘটনায় মতিন নামে এক যুবক নিহত হন। গত ১৭ বছরে দু’জন দু’জনার এলাকায় প্রবেশ না করলেও ২০১২ সালে নজরুল ইসলামের আয়োজনে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে হাজির হয়েছিলেন নূর হোসেন। যদিও একই বছর নূর হোসেনের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ছিলেন না নজরুল ইসলাম। আর এই বিরোধের শেষ পরিণতি ছিল ৭ খুনের ঘটনা।
সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে হোসেন চিশতী সিপলু জানান, ভারতে কারাবন্দি সেভেন মার্ডার মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের আদালতের নির্দেশনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। পাশাপাশি তারা নূর হোসেনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন।
ওই ঘটনায় নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেছেন, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তার কণ্ঠেই আমরা শুনতে চাই, কারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নেপথ্যে কারা কাজ করেছে। কী কারণে সাতজনকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনাটি আড়াল করতে নূর হোসেনকে মেরেও ফেলা হতে পারে বলে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। ৩০ এপ্রিল বিকালে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার ১১ মাস পর গত ৮ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুটি মামলায় নূর হোসেন, তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। এদের মধ্যে ২২ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। আর ওই মামলায় নূর হোসেনসহ ১৩ জন পলাতক আছেন। তবে নূর হোসেন ও তার দুই সঙ্গী গত বছর ১৪ জুন কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে কৈখালী থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
No comments