কলম্বো লেবু by মনিরুজ্জামান

বিশ্ববাজারে খ্যাতি কুড়ানো নরসিংদীর কলম্বো জাতের সুগন্ধি
লেবু। আকারে কিছুটা বড়, পুরু বাকল ও ঘন সবুজ রং।
ছবিটি সম্প্রতি শিবপুর উপজেলার দত্তেরগাঁও ভিটিপাড়া
এলাকার এক বাগান থেকে তোলা l প্রথম আলো
কাপড় ও সবজির কল্যাণে যে নরসিংদীর খ্যাতি দেশজুড়ে, তা এখন কলম্বো লেবুর গুণেই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা এখানকার কলম্বো জাতের বিশেষ সুগন্ধযুক্ত লেবু রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কলম্বো জাতের এই লেবু যে শুধু ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানিই হচ্ছে তা নয়, সেখানে এটি ব্যাপক খ্যাতিও কুড়িয়েছে। লেবুটি বাণিজ্যিকভাবে শুধু এ জেলাতেই উৎপাদন হয়। আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে সারা বছর নরসিংদীতে প্রচুর লেবু চাষ হয়, কিন্তু কলম্বো জাতের লেবুটি ভিন্নরকম। এটি আকারে বড়, বেশি রসালো ও সুগন্ধিযুক্ত। এ ছাড়া এর বাকল পুরু ও ঘন সবুজ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নরসিংদী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ছয় উপজেলার মধ্যে শিবপুর, রায়পুরা, মনোহরদী ও বেলাবতে বাণিজ্যিকভাবে কলম্বো লেবুর চাষ হয়। এসব উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ১ চাজার ৮০০ লেবুর বাগান রয়েছে। প্রায় দেড় হাজার চাষি এর সঙ্গে জড়িত। অধিদপ্তরের সহযোগিতায় স্থানীয়ভাবে চাষিরা লেবু উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থা নিয়ে সিআইজি নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তাঁদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা লেবু কিনে দেশের বাইরে রপ্তানি করে থাকেন।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে দুই হাজার টন কলম্বো লেবু রপ্তানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডসহ ইউরোপের ১০টি দেশে ১ হাজার ৩০০ টন এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়ায় গেছে ৭০০ টন। এই লেবুর কেজি গড়ে ২০০ টাকার কিছু বেশি।
চাষিদের কথা: কথা হয় সিআইজির সভাপতি ও শিবপুরের দত্তেরগাঁও ভিটিপাড়া এলাকার চাষি খন্দকার মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে। জানালেন, ২০০৩ সালে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পাচ্ছিলেন না। তখন এলাকায় এক আত্মীয়ের পরামর্শে এক বিঘা জমিতে ২০ টাকা দরে ১০০ লেবুগাছ কিনে লাগান। ছয় মাস না যেতেই ঢাকা থেকে এক পাইকার এসে বাগান থেকে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ পোন (২০ হালিতে ১ পোন) লেবু কেনেন।
মাহবুব জানান, ওই সময়ই ১৫০ টাকা হালি হিসেবে দেড় লক্ষাধিক টাকার লেবু বিক্রি করেন। পরে তাঁকে দেখে অনেকেই এ লেবু চাষের দিকে ঝোঁকেন। এখন তাঁর সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির ওপর পাঁচটি বাগান রয়েছে। ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ করে ৬-৭ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে।
রায়পুরার লক্ষ্মীপুর গ্রামের চাষি বাবুল চৌধুরী বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর আগে প্রথমে এক বিঘা জমির ওপর লেবুর বাগান করি। সবজি চাষের তুলনায় পরিশ্রম কম করে লেবু চাষে অনেক লাভ। ওই বাগানের লেবু বিক্রির টাকায় প্রায় ১৩ বিঘা জমি কিনে লেবুর চাষ করছি। বাগানে বছরে মোট ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। লাভ হয় ১৫ লাখ টাকা।’
এই লেবুর গুণ ও সম্ভাবনা: নরসিংদী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মো. আবদুল কাফির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লেবুর রসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। এ ছাড়া অল্প পরিমাণে কোলেস্টেরল, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। কলম্বো জাতের এই সুগন্ধ লেবু শরীর বৃদ্ধি ও গঠনে বেশ কার্যকর। এ ছাড়া খনিজ লবণের চাহিদা মিটিয়ে ঠান্ডা-সর্দিতে বেশ উপকারী। পাশাপাশি এই লেবুর বাকল হজমশক্তিতে বেশ কাজ করে।
এই লেবুর সুগন্ধযুক্ত ছাল প্রক্রিয়াজাত করে উদ্বায়ী তেল তৈরি করা যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইতালি, স্পেন, সিসিলি, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পরিমাণে এই তেল বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন করা হয়। ওষুধে সুগন্ধি উপাদান হিসেবে এবং সুগন্ধি প্রসাধনী তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় এই তেল।
এর বাজার সম্পর্কে আশাবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অ্যান্ড ফ্রুটস এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মো. আরিফ উল্লাহ বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটি রপ্তানি করে ভবিষ্যতে আমরা আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারব।’

No comments

Powered by Blogger.