বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ: আইএস বনাম জামায়াত-শিবির by মইনুল ইসলাম

বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গি আছে কি নেই, তা নিয়ে একটা বেফজুল বিতর্ক চলছে। যত দিন জামায়াত-শিবিরের কিলিং স্কোয়াড এ দেশে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে, তত দিন জঙ্গিবাদ বহাল তবিয়তেই থাকবে। এই সত্যটা মেনে নিলে এই বেফজুল বিতর্কটা যে অর্থহীন, তা বুঝতে অসুবিধা হবে না। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং জামায়াত-শিবিরের কথিত ‘গৃহযুদ্ধের’ ঘোষণা জাতি নিশ্চয়ই ভোলেনি। ২০১৫ সালের প্রথম ৯২ দিন আবারও বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের মানুষ পোড়ানোর তাণ্ডব আমাদের দেখতে হয়েছে।
তারপর গত ছয় মাস তাদের রহস্যজনক নীরবতা দেখে কেউ যদি ভেবে থাকেন যে জামায়াত-শিবির তাদের কৌশল পাল্টেছে, তবে মারাত্মক ভুল হবে। কারণ, তারা শক্তি সঞ্চয়ের জন্যই এই ছয় মাস তাদের কর্মকাণ্ড কিছুটা কমিয়ে দিয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি জোরদার করেছে। জামায়াত নেতাদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় দলটির প্রকাশ্য তৎপরতা কমে যায়। গত ছয় মাসে বিএনপির যাবতীয় নর্তন-কুর্দন-আন্দোলন-সংগ্রাম যে মাঠে মারা গেছে, তা এত দিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। অতএব, ক্ষমতাসীন জোটের সাময়িক জয় হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি তাণ্ডবের ওপর ভর করে মহাজোট সরকারকে উৎখাতের যে খোয়াব দেখেছিলেন, তা আপাতত ভেস্তে গেছে।
কিন্তু যখন আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বাস্তবায়নের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে, তখন জামায়াত-শিবিরের ‘গৃহযুদ্ধ’ও যে আবার পুরোদমে চাঙা হবে, তাতে সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর কাছে জামায়াত-শিবিরের এই আসন্ন তাণ্ডবের অশনিসংকেত ঠিকই পৌঁছে গেছে এবং ওই সংকেত পেয়েই অস্ট্রেলিয়া তাদের ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর নিরাপত্তার আশঙ্কায় স্থগিত করেছে। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকাও তাদের নারী ক্রিকেট দলের সফর বাতিল করেছে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফর চলাকালে একজন নিরীহ ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বিশ্বের প্রচারমাধ্যমগুলোতে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছে ঘাতক বাহিনী। আর আইএসের নামে ত্বরিতগতিতে ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র বলে মার্কা মেরে দিয়েছে তারা। এর কয়েক দিন যেতে না যেতেই রংপুরে নিহত হলেন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। এই দুজন নিরীহ, নির্বিরোধী এবং এ দেশের জনগণের উন্নয়ন প্রয়াসে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে হত্যা করা যে কত পৈশাচিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসলে এই দুটো হত্যাকাণ্ডের জন্য যতই আইএস জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হোক না কেন, এই হত্যাকাণ্ডগুলো জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব পুনরারম্ভের আলামতই তুলে ধরছে। আমার মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যতই এগিয়ে আসবে, ততই দলটির তাণ্ডব জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে দিতে চাইবে। প্রধানমন্ত্রীও বিদেশভ্রমণ থেকে ফিরে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে এ আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছেন।
বিগত ছয় মাস রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তুলনামূলক স্থিতি বিরাজ করছিল, তাতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতে পারেন। আমার আশঙ্কা, অচিরেই আবার পূর্ণোদ্যমে জামায়াত-শিবির মাঠে নামবে, দেশের সংঘাতমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আবার বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এই অবস্থাকে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহরিয়ার কবির গত বছর ‘টম অ্যান্ড জেরি শো’ অভিহিত করে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তারা খুনখারাবি শুরু করে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী মহোদয়। মাঝেমধ্যে মন্ত্রীরা জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে গরম-গরম কথা বললেও এদের যে নিষিদ্ধ করা হবে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ না করে একটা ঐতিহাসিক ভুল করছে ক্ষমতাসীন জোট। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে জামায়াত-শিবির আজও স্বীকার করেনি। পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলের পূর্বসূরি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররা যে গণহত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-ধর্মান্তরিতকরণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, তার জন্য এখনো তারা অনুশোচনা করেনি, জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাও করেনি। তাই এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার আছে বলে মনে করি না। এদের সঙ্গে ‘টম অ্যান্ড জেরি শো’ খেলাও মহাবিপদ ডেকে আনবে বলে মনে করি।
দেশবাসীকে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, জামায়াত-শিবির একটি ফ্যাসিবাদী সংগঠন। তারা ধর্মকে পুঁজি করে এ দেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের উন্মত্ত ও প্রাণঘাতী অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর টিভি ক্যামেরার সামনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের একাধিক নেতা দম্ভভরে এই ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। (এই হুমকির দায়ে ২০১৩ সালের ৯ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের নেতা রফিকুল ইসলাম খান ও সাংসদ হামিদুর রহমান আযাদকে তিন মাসের কারাদণ্ড ও তিন হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। সূত্র: প্রথম আলো, ১০ জুন, ২০১৩)।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একটি সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছেন: জামায়াত-শিবির আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী মৌলবাদী সংগঠনের বাংলাদেশি চ্যাপ্টার। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, ইন্দোনেশিয়ার জামাহ ইসলামিয়া, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী, আফগানিস্তানের তালেবান, সৌদি আরব ও আফগানিস্তান থেকে উত্থিত আল-কায়েদা, সাম্প্রতিক কালের ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেট’ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধরত ও ভিডিও ক্যামেরার সামনে মানুষের শিরশ্ছেদ বা মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো নারকীয় নিষ্ঠুরতার জন্মদাতা আইএস, আফ্রিকার আল-শাবাব ও বোকো হারাম—এগুলোর যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, সেটাই জামায়াত-শিবিরেরও অভিন্ন নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে জেএমবি, হুজি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), আনসারুল্লাহ, হিযবুত তাহ্রীর, হিযবুত তাওহীদ, আল-কায়েদা ইন্ডিয়ান কমান্ড, তালেবান দক্ষিণ এশিয়া কমান্ড ও এবারের আইএস—এ ধরনের হরেক কিসিমের নাম নিয়ে একেক সময় একেক জঙ্গিগোষ্ঠীর যে তাণ্ডব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, সেগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের আলাদা আলাদা অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা হলে মারাত্মক ভুল হবে।
এগুলো একই বৃক্ষের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বৈ তো নয়, কথায় বলে, ‘রসুনের কোয়া অনেকগুলো হলেও গোড়া একটাই’! প্রয়োজনমাফিক এসব ‘পকেট সংগঠনের’ জন্ম দিতেই থাকবে জামায়াত-শিবির ও তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরই যাবতীয় জঙ্গি সংগঠন ও জঙ্গিগোষ্ঠীর সূতিকাগার। অতএব যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে জামায়াত-শিবিরকে মডারেট মুসলিম রাজনৈতিক দলের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে এর পক্ষে ওকালতি করে, তখন আমাদের সাবধান হতে হবে। মনে রাখতে হবে, জামায়াতে ইসলামীর জন্মই হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে। আর আমেরিকার সিআইএ জামায়াত-শিবিরকে আশির দশকে আফগানিস্তানে সরাসরি ব্যবহার করেছে। তালেবানও সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানের আইএসআই। এমনকি আইএসকেও যুক্তরাষ্ট্রই সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েত এদের মদদদাতা।
এটা পরিষ্কার যে বিদেশি হত্যার মাধ্যমে দেশে আবারও ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরু করার পাঁয়তারা চলছে। প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটা বা হাতের কবজি কেটে নেওয়া, কাটা কবজি ছুরির আগায় গেঁথে বিজয় মিছিল করা, গলা কেটে মানুষ খুন করা, পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়া, ফ্লাইং কিক মারা, বোমা বানানো, গ্রেনেড ছুড়ে শত শত মানুষকে খুন-জখম করা, দেশের ৬৫টি স্থানে একই সঙ্গে বোমা ফাটানো, রেলের ফিশপ্লেট অপসারণ করে ট্রেন লাইনচ্যুত করা, ট্রেনের বগি পোড়ানো, হাজার হাজার গাছ নির্বিচারে ধ্বংস করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ব্রাশফায়ার করা কিংবা শিক্ষক বাসে বোমাবাজি করে শিক্ষকদের জখম করা, বাসে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারা—এসব বর্বরতার রেকর্ড জামায়াত–শিবির, বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা সৃষ্টি করেছে। এসব কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে জামায়াত–শিবির ক্যাডারদের পদোন্নতি মেলে, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হয়, সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। গ্রেপ্তার হলে পরিবারের দেখভাল করা হয়, বাজার পর্যন্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মামলা চালানোর পুরো খরচ বহন করা হয়। কোনো ক্যাডার নিহত হলে পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, আহত হলেও চিকিৎসার খরচ ও ভাতা দেওয়া হয়। মানে এটা পুরোদস্তুর একটা সিভিল বাহিনী।
আওয়ামী লীগ যদি এহেন একটি বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেয়, তাহলে তাদের কপালে দুঃখ আছে, জাতির কপালেও দুঃখ আছে। আমি আবারও বলছি, এই ঘাতক অপশক্তিকে এ দেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করার বিকল্প নেই।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.