আমি না হয় পাখিই হব by আনিসুল হক

দুটো কবিতা সারাক্ষণ মাথার ভেতরে ঘোরে—একটা রবীন্দ্রনাথের—মা, যদি হও রাজি, বড় হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি। আরেকটা আল মাহমুদের। ‘আম্মা বলেন পড়রে সোনা/ আব্বা বলেন, মন দে;/ পাঠে আমার মন বসে না/ কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।’ এই কবিতার শেষ দুটো লাইন মাথার মধ্যে জলের মতো পাক খায়—‘তোমরা যখন শিখছো পড়া/ মানুষ হওয়ার জন্য,/ আমি না হয় পাখিই হবো,/ পাখির মতো বন্য।’ এই রকম করে কোনো কিশোর কি এখন ভাবতে পারে। নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু বলতে পারবে? না। পারবে না। বাবা-মা বলবেন, ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও। এমবিএ পড়ো, বিবিএ পড়ো। আচ্ছা সেসব পরে হবে, আগে ক্লাসে ফার্স্ট হও। সেকেন্ড কেন হয়েছ? এই জন্য তোমাকে টিউটর রেখে পড়াই? এক কোচিং সেন্টার থেকে নিয়ে আরেক কোচিং সেন্টারে দৌড়াই! তোমার কোচিং সেন্টারের সামনের ফুটপাতে দিবারাত্র বসে থাকি, কখনো-বা পত্রিকা বিছিয়ে! রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি! টাকা আনতে বাবার জিব বেরিয়ে যাচ্ছে! মা শরীরের হাড় কালি করছেন! নিজেদের কোনো সাধ-আহ্লাদ আছে! তুমি যা চাচ্ছো, তা-ই দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারপরেও রেজাল্ট ভালো হবে না কেন? কেন তুমি অঙ্কে ৯৮ পাবে। আর ২ গেল কোথায়? তাহলে দীপু পেল কীভাবে? রাইনা কীভাবে সব সাবজেক্টে জিপিএ ফাইভ পায়? যাও, ওদের পা ধোয়া পানি খাও! উফ্ফ। চাপ আর চাপ। শুধু কি পড়া। বাবা-মায়ের আরও কত শখ থাকে! গান শেখো, নাচ শেখো, সাঁতারের ক্লাসে যাও, ছবি আঁকার ক্লাসে! এই টিচার বেরিয়ে গেল তো ওই ওস্তাদ এলেন। বাচ্চা কেমন করে বলে,
আমার যেতে ইচ্ছে করে
নদীটির ওই পারে
যেথায় ধারে ধারে
বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো
বাঁধা সারে সারে।
কিংবা
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা,
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
সব সময় কি পড়তে ইচ্ছা করে? খেলার নিয়মই হলো, সবাই তো জয়লাভ করবে না। একটা যদি দৌড় প্রতিযোগিতা হয়, ১০০ জন অংশ নেয়, একজনই কেবল ফার্স্ট হবে। তিনজন পুরস্কার পাবে। ৯৭ জনই তো পাবে না। জিপিএ ফাইভও সবাই পাবে না। সবার সব বিষয় ভালো লাগবে না। কারও ভালো লাগে গণিত, কারও-বা সাহিত্য। কেউবা ভীষণ পড়াশোনা করে, কিন্তু স্কুলের বই না, বাইরের বই। ­আর স্কুলের পাঠ্যবইও এমন নীরস ভাষায়, এমন কঠিন গদ্যে লেখা, কেনই-বা পড়তে চাইবে বাচ্চারা!
আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমাকে ঘিরে ধরল, পড়ো তুমি এই বই। একটা কৃষিবিজ্ঞানের বই—উফ্ফ কী বলব, একেবারে রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনির উপযুক্ত বিদ্যা, এই বই জোর করে বাচ্চাদের গেলাতে হবে, এমনি না গিলতে পারলে এক গেলাস পানি দিয়ে চেষ্টা করা যায়! শুধু তত্ত্ব, মাটিভেদে বাংলাদেশকে কত ভাগে ভাগ করা যায়! কয়েক ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী লেখক! এখন বাচ্চাদের কাজ হবে সেসব মুখস্থ করা। শুধু সংজ্ঞা, শুধুই প্রকারভেদ। সংজ্ঞা দিয়ে যে কোনো কিছুকে চেনা যায় না, তা আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দুধ চেনার গল্প থেকেই জানি। দুধ কেমন? সাদা। সাদা কেমন? বকের মতো। বক কেমন? কাস্তের মতো। কাস্তে কেমন? এই যে কাস্তে। ওমা, দুধ এই রকম? তাহলে খাব না।
তবু কেউ কেউ ভালো করবে। কারও কারও মুখস্থ করার শক্তি বেশি থাকে। আর অল্পস্বল্প মুখস্থ তো আমাদের করতেই হয়। তিন চারে বারো হয়, এটাকে বলে নামতা, এটা আমরা মুখস্থই করেছি।
রবীন্দ্রনাথের ভোলানাথ অবশ্য অন্য রকম করেছিল:
ভোলানাথ লিখেছিল,
তিন-চারে নব্বই—
গণিতের মার্কায়
কাটা গেল সর্বই।
তিন চারে বারো হয়,
মাস্টার তারে কয়;
‘লিখেছিনু ঢের বেশি’
এই তার গর্বই।
এই রকম ভোলানাথেরাও তো থাকবে সমাজে। এবং তারা জীবনে যে খারাপই করবে, এমন কোনো কথা নেই। আপনি আপনার স্কুলের বন্ধুদের কথা ভাবুন। কেউ ক্লাসে ফার্স্ট হতো, কেউ ভালো করতে পারত না। আজকে তাকিয়ে দেখুন, কে কী করছে? যে ফার্স্ট হয়েছে, সেই কি সবচেয়ে ভালো করছে? যে ছেলেটা স্কুল পালাত, সেও কি ভালো করছে না?
আমি বলি, জীবন সবার জন্য সোনার মেডেল রেখে দিয়েছে। আইনস্টাইন বলেছিলেন, জীবন হলো একটা বাইসাইকেলের মতো, এটা সব সময় চালিয়ে যেতে হয়। আর কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘জীবন কী, এটা আমি মাত্র তিনটা শব্দে বলে দিতে পারব—জীবন চলেই যায়।’ আর জীবনটা চালিয়ে নিয়ে গেলে, শেষ পর্যন্ত সবাই সোনার মেডেলই পায়।
এই বাংলাদেশে প্রায় বেশির ভাগ পরিবারেরই তো উন্নতি হচ্ছে। আপনি আপনার পরিবারের দিকে দেখুন, আত্মীয়স্বজনের দিকে দেখুন, ৩০ বছর আগে কে কী করত, এখন কে কী করছে। তাহলেই বুঝবেন, প্রায় সব পরিবারেই উন্নতি হয়েছে। এটা আপনি চারদিকে তাকিয়ে দেখে বলতে পারবেন। আর অর্থনীতিবিদেরা বলতে পারবেন পরিসংখ্যান দিয়ে। ১০ কোটির বেশি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন, ৯০ শতাংশ মানুষ স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে, ৯৯ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়! গরিব দেশটা আজকে নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ। শুধু একটাই কিন্তু আছে। তার নাম মাদক। লাখ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত, তাদের পরিবারে লেগেই আছে নানা অশান্তি। মাদক থেকে দূরে থাকতে পারলে লেখাপড়াতেও ভালো করা যাবে, খেলাধুলাতেও ভালো করা যাবে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁদের পরিবারে বড়ই দুশ্চিন্তা ছিল, তাঁদের অভিভাবকদের চিঠিপত্র থেকে দেখা যায়—একটার পর একটা স্কুলে যাচ্ছেন, কোনোটাতেই মন বসাতে পারছেন না। তাঁকে মনে করা হতো প্রবলেম চাইল্ড। আইনস্টাইন কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। বিল গেটস হার্ভার্ডের পড়া শেষ করেননি। প্রচলিত আছে, বিল গেটস বলেছিলেন, আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটা সাবজেক্টে ফেল করেছিলাম, আমার একজন বন্ধু সব কটা সাবজেক্টে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছিল, আমার সেই বন্ধু এখন মাইক্রোসফটে ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করে। তবে বিল গেটস এও বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচুর স্বপ্ন দেখতাম। আর সেই সব স্বপ্ন আমি পেয়েছি বই থেকে।
এফ আর খান বা ফজলুর রহমান খান (১৯২৯-১৯৮২)। তাঁকে বলা হয়, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন। শিকাগোতে তাঁর নির্মিত সুউচ্চ ভবন সিয়ার্স টাওয়ারের নিচে আছে এফ আর খান লেন, তাতে তাঁর আবক্ষ মূর্তির সঙ্গে খোদিত আছে তাঁর একটা বাণী—‘The technical man must not be lost in his own technology; he must be able to appreciate life, and life is art, drama, music, and most importantly, people.’(‘প্রযুক্তিবিদ যেন অবশ্যই নিজের প্রযুক্তির মধ্যে হারিয়ে না যান, তাঁকে অবশ্যই জীবন উপলব্ধি করার মতো সক্ষম হতে হবে, জীবন হচ্ছে শিল্প, নাটক ও সংগীত; আর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে মানুষ’) <https://en. wikipedia.org/wiki/Fazlur_Rahman_Khan>
ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই প্রখ্যাত প্রকৌশলী বলছেন, প্রযুক্তিবিদের আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাঁকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে, এবং জীবন হলো—শিল্পকলা, নাটক, সংগীত এবং সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ। আমরা এফ আর খানের একটা ছবি দেখি, তিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন ঘরের মধ্যে আড্ডার মধ্যমণি হয়ে। আর এ কারণেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকায় তিনি বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে জনমত সংগ্রহের কাজে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।
পরীক্ষায় ফল ভালো করলে ভালো। কিন্তু শুধু পরীক্ষার ফল ভালো করলেই সে বড় মানুষ হয় না। জীবন ও জীবিকায় ভালো করে না। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করলেই সে পরবর্তী পরীক্ষায় ভালো করবে, তার নিশ্চয়তা নেই, আবার পরীক্ষায় ভালো করলেই সে ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে, সে কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। তেমনি ছাত্রজীবনে খুব ভালো না করেও পরবর্তী জীবনে খুব ভালো করেছে, এই উদাহরণ ভূরি ভূরি।
কাজেই আমাদের অভিভাবকদের বলব, আপনার ছেলেমেয়েকে সঠিক মূল্যবোধটা দিন। আর তাকে খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া, বাকি সময় বই পড়া, সংস্কৃতিচর্চা করার সুযোগ দিন। আপনার অপূর্ণ স্বপ্ন তাকে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করবেন না। বাণিজ্যের নোবেল পুরস্কার বলে গণ্য অসলো বিজনেস ফর পিস পুরস্কারপ্রাপ্ত লতিফুর রহমান আমাদের একটা কথা বলেছিলেন, কোনো বাবা-মাই তার ছেলেমেয়েকে খারাপ হওয়ার উপদেশ দেয় না। ছোটবেলায় ঘুষখোরও তাঁর সন্তানকে বলবেন না, বড় হয়ে ঘুষ খাবি। ডাকাতও বলবেন না, ডাকাত হবি। সবাই বলবেন, সত্য কথা বলো, মানুষ হও। অতটুকুন মেনে চললেই হয়। সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা। তারপর যার যেটা ভালো লাগে, সেটা খুব মন দিয়ে আন্তরিকভাবে করা।
কিন্তু সব সময় সব দেশেই পরবর্তী প্রজন্মের মন-মানসিকতা চিন্তার জগৎ আলাদা হয়ে থাকে।
কবি কহলিল জিবরানের ভাষায়—
‘তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্র-কন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।’
কিন্তু আমরা অভিভাবকেরা এই কথাটা ভুলে যাই। আমরা চাপ দিতে থাকি। প্রত্যাশার চাপ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার জন্য আমি কত স্যাক্রিফাইস করছি, তার বিনিময়ে তুমি আমাকে দাও তোমার জীবনের সাফল্য। ডাক্তার হও। ইঞ্জিনিয়ার হও।
এটা ঠিক নয়। কেউ যদি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ভাবে—‘তোমরা যখন শিখছো পড়া মানুষ হওয়ার জন্য, আমি না হয় পাখিই হব, পাখির মতো বন্য।’—তাকে ভাবতে দিন। ওই হয়তো হবে লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো বড় শিল্পী, রাইট ভাইদের মতো বড় আবিষ্কারক। আইনস্টাইনই বলেছেন, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। আর সেসব কিছু যদি নাও হয়, সে একটা ভালো মানুষ হবে, হবে সুন্দর একটা মানুষ।
সুন্দর সুন্দর মানুষে ভরে যাক না আমাদের পৃথিবীটা!
এই স্বপ্ন নিয়েই আমরা কিশোর আলো নামের একটা পত্রিকা বের করি। আজ সেন্ট যোসেফ স্কুলে সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে তার দ্বিতীয় জন্মদিনের উৎসব—কিআনন্দ। সেখানে এলে দেখতে পাবেন, আমাদের সন্তানদের পৃথিবীটাও অনেক বড়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.