গ্রানাদায় আধাবেলা by ফারুক মঈনউদ্দীন
আলহামরার দেখতে গিয়ে সকালের খেপে টিকিট
মেলে না বলে গ্রানাদার ট্যুরিস্ট ম্যাপে ‘পালাসিও দে দার-আল-হোররা’ দেখে
ওটা দেখতে যাওয়া মনস্থ করি। ট্যাক্সিওয়ালাকে ম্যাপে জায়গাটা দেখিয়ে দিলে
বিনা বাক্যব্যয়ে দরজা খুলে দেয় আমাদের। আলহামরার আসসাবিকা পাহাড় থেকে নেমে
কিছুদূর পর আবার একটা পাহাড়ে চড়তে থাকে ট্যাক্সি। যত উঠতে থাকি তত সরু হয়ে
আসে রাস্তা, এখান দিয়ে যে গাড়ি চলে এবড়োথেবড়ো পাথুরে রাস্তার হাল দেখে সেটা
গলা কেটে ফেললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। একপর্যায়ে দুটো পাহাড়ের পাথুরে
দেয়ালের মাঝখানের সরু ফাঁক দিয়ে দুপাশের রিয়ার ভিউ মিরর গুটিয়ে অনেকটা
সার্কাসের রুদ্ধশ্বাস ভঙ্গিতে গাড়ি পার করে নিয়ে যায় ড্রাইভার। তারপর একসময়
একটা জনহীন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলে, এবার নামো। চারপাশের নির্জনতা দেখে
ঢোঁক গিলে বলি, পালাসিওটা কোথায়? লোকটা ভাড়ার ফেরত ভাংতি টাকা গুনে দিতে
দিতে ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের মতো সামনের দিকে অস্পষ্ট ইঙ্গিত করে বলে, ওই
হোথা। কিন্তু সামনের দিকে চোখে পড়ার মতো কোনো বাড়ির চিহ্ন দেখা যায় না।
দূরে আরেক পাহাড়ের মাথায় আলহামরা প্রাসাদের পূর্ণ অবয়ব দেখা যায়। তার পেছনে
সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার সফেদ শৃঙ্গ ভেসে আছে নীল আকাশের গায়ে। আমাদের
সামনে একটা বাগানমতো জায়গায় দুজন মালী কাজ করছিল, জানতাম লাভ নেই, তবুও
জানতে চাইলাম, পালাসিওটা কোথায়? ওরা দুর্বোধ্য ভাষায় যা বলল তার বাংলা
অর্থ এরকম হতে পারে, সায়েব আমরা মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, কী করে জানব
প্রাসাদের হদিস। এদিকে এমন কিছু আছে বলে তো মনে হয় না।
আমরা বিভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাই, কয়েকটা অতি সাধারণ ঘর-বাড়ি চোখে পড়ে, একটা উঁচু বাড়ির উন্নত মস্তক দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওটার দরজা কোথায়? হঠাৎ চোখে পড়ে পাশ দিয়ে একটা সরু পথ নেমে গেছে, সেই জনহীন পথে এগিয়ে যাই। অবিকল ঢাকার নারিন্দার ভূতের গলির মতো দুপাশে পলেস্তরা খসা প্রাচীন পাতলা ইটের দেয়ালের মাঝখান দিয়ে আরও এগিয়ে গেলে এক লোককে দেখা যায় মোটরসাইকেল স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করাচ্ছে, তার কাছে গিয়ে ম্যাপটা দেখিয়ে আল হোররা নামের ম্যানশনটির হদিস জানতে চাই। লোকটা বলে সামনে গেলেই পাওয়া যাবে, তবে আজ খোলা আছে কিনা কে জানে। রাস্তার ওপর বহু পুরনো একটা জরাজীর্ণ অর্ধচন্দ াকার ফটক, ওটা পেরিয়ে প্রায় ভুতুড়ে গলির একটা বাঁকের পর চোখে পড়ে সাদামাটা কাঠের একটা দরজা, ভেতর থেকে বন্ধ। বৈশিষ্ট্যহীন দরজাটির পাশে কলিংবেলের বোতামও আছে, ওটা টিপে টিপে আঙুল ব্যথা করে ফেলার পর ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই।
দরজার ওপর ছোট একটা বোর্ডে ‘পালাসিও দার আল হোররা’ লেখা না থাকলে কেউই বিশ্বাস করত না যে এটি কোনো দর্শনীয় বাড়ি। তার নিচে লেখা ‘প্রবেশের সময়সূচি মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার ১০টা থেকে ২টা।’ আমরা যখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল টেপাটেপি করছিলাম, সে সময় আরেক বিদেশী দর্শনার্থী উপস্থিত হয়, স্প্যানিশ ভাষা না জানার কারণে আমরা কেউই সপ্তাহে মাত্র দুদিনের বিষয়টা তখন বুঝতে পারিনি। প্রাসাদোপম এই বাড়িটি মুসলমান আমীরদের শাসনামলের শেষভাগে পঞ্চদশ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল। আরবি ‘দার-আল-হোররা’ অর্থ সৎ রমণীর বাড়ি (হাউস অব দ্য অনেস্ট লেডি)। ধারণা করা হয়, গ্রানাদার শেষ মুসলমান সম্রাট বোয়াবদিল বা আবু আবদুলার মায়ের জন্যই বাড়িটির এই নামকরণ। ১৪৯২ সালে খ্রিস্টান পুনর্বিজয়ের পর রানী ইসাবেলা এটিকে সান্টা ইসাবেলা লা রিয়েল কনভেন্ট নামে মঠে পরিণত করেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করেছে, সেই সরকারি অধিগ্রহণ এবং সংরক্ষণের নমুনা তো দেখতেই পেলাম, সপ্তাহে দুদিন মিলে মাত্র আট ঘণ্টা খোলা থাকে দর্শনার্থীদের জন্য।
হাতে আরও সময় থাকায় বহু কসরত করে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে চলে যাই আলকায়সারিয়া বা আরব মার্কেট। বিশাল এক পাঁচরাস্তার মোড়, পুয়ের্তা রিয়েল বা রয়াল গেট থেকে উত্তরের রাস্তা ধরে এগিয়ে কিছুদূর গেলেই ঘিঞ্জি এই বাজারটি মুসলমান আমলে ছিল রেশম বাজার। আন্দালুসিয়াতে খ্রিস্টান পুনর্বিজয়ের আগে থেকেই গ্রানাদার আলপুখারাস ছিল সমৃদ্ধ রেশম উৎপাদনকারী অঞ্চল। কায়ে সাকাতিন বা সাকাতিন স্ট্রিট থেকে হাতের বাঁয়ে ঢাকার ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের মতো পরপর কিছু সরু গলির জটাজালে জমজমাট বাজারটাই আলকায়সারিয়া। সাকাতিন শব্দের অর্থ কাপড়ের বাজার। আলকায়সারিয়ার রেশম বাজার থেকেই এই কাপড়ের বাজার কিংবা এই সাকাতিন থেকেই আলকায়সারিয়া। মুরীয় আমল থেকেই কাপড়ের পাশাপাশি গয়নার কারিগর, দর্জি, জুতোর সেলাইকারী, বোতাম-সুঁই-লেসফিতাওয়ালারা তাদের পসরা সাজাত এখানে।
বাইরের সূর্যের আলো থেকে সরু গলির ছায়ায় ঢুকলেই চোখে পড়ে ছোট ছোট দোকানগুলো ট্যুরিস্ট-পছন্দ জিনিসপত্রে ঠাসা। কাপড়ের দোকানগুলোর দরজার বাইরে ঝোলানো উজ্জ্বল রঙের বান ডেকে যাওয়া পরিবেশ অনেকটা আমাদের গাউসিয়া মার্কেটের মতো। রেশম বাজার না হলেও এটির একটা বড় অংশে কাপড়ের পসরা সাজানো। এসব দোকানের বহুমুখী উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা দেখে জিপসি তরুণীর সাজ পোশাকের তুলনা মাথার ভেতর গেঁথে যায়। মেয়েদের সব ধরনের জামা-কাপড়, শাল, মাথায় বাঁধার হিজাব বা স্কার্ফ থেকে শুরু করে স্কার্ট, টপস, বিছানার চাদর এবং নাম না জানা আরও বহু ধরনের তৈরি পোশাক নিয়ে ভিনদেশী মহিলা ট্যুরিস্টরা কোমর বেঁধে দরকষাকষি করছে। ট্যুরিস্ট অফিসের মেয়েটি অবশ্য বলে দিয়েছিল যে, এই বাজার আদর্শ ট্যুরিস্ট বাজার, দরকষাকষি না করলে ঠকতে হবে। আমার মেয়েটিকে নিয়ে ওর মা দেখলাম পৃথুলা বিদেশিনীদের কনুইর তলা দিয়ে ঢুকে দিব্যি এটা ওটা ঘাঁটাঘাঁটি করছে, দোকানদারের সঙ্গে দরাদরি করছে সমানতালে। আমি ওদিকে না তাকিয়ে বাজারটির বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারের চেষ্টায় ওদের সঙ্গে নৈকট্য পরিহার করার কৌশল অবলম্বন করি। লক্ষ্য করলাম দোকানে সাজানো পণ্যসামগ্রীর মধ্যে মুরীয় প্রভাব যে রকম অপ্রচ্ছন্ন, নিচতলার দৃষ্টিকাড়া পণ্যসম্ভার থেকে চোখ তুলে ওপরের দিকে তাকালে শতাব্দী প্রাচীন ভবনগুলোর খিলানের ধনুকাকৃতি স্থাপত্যের কারুকাজ এবং নকশায়ও তার ছাপ স্পষ্ট।
কাপড়চোপড় বাদ দিলে বাজারটির ছোট-বড় বিভিন্ন মানের দোকানে থরে থরে সাজানো হস্তশিল্প, কাঠের কারুকাজ করা নানা সামগ্রী, পাথরের গহনা, গৃহসজ্জার উপকরণ, গালিচা, তৈজস এবং এখানকার বিখ্যাত ফাহালাউজার চিত্রিত চিনামাটির মৃৎশিল্পের অপূর্ব সুন্দর থালা পাত্র ইত্যাদি। মুরীয় যুগ থেকেই গ্রানাদার উপকণ্ঠের ফাহালাউজা ছিল উন্নত চিনামাটির তৈজস শিল্পের জন্য বিখ্যাত। খ্রিস্টান পুনর্বিজয়ের পর মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার প্রবল চাপ ও হুমকির মুখে ফাহালাউজার প্রধান কারখানাটির মালিক ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম গ্রহণ করেন ‘আলোনসো দে মোরালিস।’ ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হলেও নীলপ্রধান মুরীয় নকশার ঐতিহ্য এখনও সমুন্নত দেখা যায় সব ফাহালাউজা সামগ্রীতে। নীল বা ময়ুরকণ্ঠি রঙের সঙ্গে সবুজ এবং বেগুনির সমাহারে চিত্রিত হয় লতাপাতা ফুল পাখি এবং বিচিত্র চোখ ধাঁধানো জ্যামিতিক নকশা। হাফপ্যান্ট পরা বিশালবপু ট্যুরিস্টরা নানান ভঙ্গিতে সেসব উল্টেপাল্টে দেখে অবলীলায় কিনে নিচ্ছে।
আলকায়সারিয়ার দোকানগুলোয় ঘুরতে চাইলে পুরো দিনের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু লাঞ্চের জন্য সান মাতিয়াসে ঢুকে দুপুরের খাবারের জন্য যাই রেস্তোরাঁ-পট্টি কায়ে নাভাস, অর্থাৎ নাভাস স্ট্রিট। কায়ে নাভাস হচ্ছে গ্রানাদার এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ পাড়া। রাস্তাজুড়ে একের পর এক রেস্তোরাঁ, কোনটা ছেড়ে কোনটায় ঢুকব বাছাই করা মুশকিল হয়ে পড়ে। রাস্তায় অস্থায়ীভাবে টানানো রঙবেরঙের চাদোয়ার নিচে বিয়ারের মগ আর ‘তাপাস’ নিয়ে বসে থাকা আয়েশি লোকজন দেখে একটার সামনে খালি চেয়ার দেখে বসে পড়ি। দীর্ঘাঙ্গী বলশালী দেখতে সুশ্রী একটি মেয়ে এসে টেবিলে মেন্যুকার্ড রেখে বলে, বিয়ার? আমি বলি, অলসো তাপাস। মেয়েটি তার হাত দিয়ে স্বভাবজাত মেয়েলি ভঙ্গিতে এমন একটি মুদ্রা তৈরি করে যার অর্থ, কোনো ব্যাপার না, এটা বলে না দিলেও চলত।
এখানে বলে রাখা উচিত আন্দালুসিয়াতে ড্রিংকসের অর্ডার দিলে ‘তাপাস’ আপনিই আসবে ফ্রি। সাদামাটাভাবে বললে ‘তাপাস’ হচ্ছে অ্যাপেটাইজার, শব্দটা এসেছে স্প্যানিশ ক্রিয়াপদ ‘তাপার’ থেকে, অর্থ ঢাকা দেয়া। এটির একাধিক ইতিহাস আছে। একসময় তাপাস বলতে বোঝাত আন্দালুসিয়ার সরাইখানাগুলোতে চুমুক দেয়ার পর শেরীর গাস ঢেকে রাখার জন্য পাউরুটি অথবা মাংসের স্পাইস। কারণ শেরীর মিষ্টি গন্ধে বড় বড় ডুমো মাছি এসে হাজির হতো। সেই মাছির হাত থেকে শেরীর গাসকে ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহার হতো এই তাপার। সালামি অথবা চরিসো নামের নোনতা স্মোকড শূকরের মাংস দিয়ে এই তাপার তৈরি হতো যা খদ্দেরের পানের তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে দিত। এই কারণে মদ বিক্রি বাড়ানোর জন্য পানশালাগুলোতে শেরী কিংবা অন্য পানীয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের তাপার সার্ভ করা শুরু করে মালিকরা এবং সেটি একসময় রেওয়াজে পরিণত হয়।
অন্য এক ভাষ্যমতে রাজা দশম আলফনসো (১২২১-১২৮৪) অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজবৈদ্যরা তাকে সেরে ওঠার জন্য ওয়াইনের সঙ্গে অল্প অল্প করে কিছু খাবার খেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। রোগমুক্তির পর রাজা নাকি এই পথ্যের গুণে মুগ্ধ হয়ে ফরমান জারি করেছিলেন, সব পানশালায় ড্রিংকসের সঙ্গে যাতে বাধ্যতামূলক হালকা খাবার পরিবেশন করা হয়। গাসের ওপর পাউরুটি, অন্য খাবার কিংবা তার পেট রেখে দিলে মাছির উৎপাত থেকে যেমন রেহাই পাওয়া যেত, তেমনি খালি পেটে মদ গেলার কুফল থেকেও রক্ষা পেত পানবিলাসীরা। যেভাবেই হোক এই ‘তাপার’ পরবর্তী কালে ‘তাপাস’ হয়ে যায়। আন্দালুসিয়াতে ‘তাপাস বার’ কথাটা খুব চালু এবং গ্রানাদার সান মাতিয়াসের কায়ে নাভাস নামের গলিটি রেস্তোরাঁ এবং তাপাস বারের জন্য বিখ্যাত কয়েকটি ঠেকের একটি। আমরা যখন উঠি কায়ে নাভাসে তখনও টেবিলে টেবিলে হোয়াইট ওয়াইন, রেড ওয়াইন, বিয়ার আর টাপাসের মোচ্ছব চলছে। গলির এক পাশে বসে নিবিষ্ট মনে বেহালায় ছড় বোলাচ্ছে এক বাজনদার। তার কম্প্রমান ছড়সৃষ্ট সুর মাঝে মাঝে তলিয়ে যাচ্ছে পাশের টেবিল থেকে উছলে ওঠা অট্টহাস্যে।
ইমেইল: fmainuddin@hotmail.com
No comments